গ ল্প:- ছেলে আর মেয়ে by অ্যালিস মানরো অনুবাদ: শিবব্রত বর্মন
আমার বাবা শিয়ালখামারি। খোপরায় মেটে শিয়াল
পালেন তিনি। হেমন্তে বা শীতের শুরুতে যখন এদের লোম পুরু হয়ে যায়, তিনি
সেগুলোকে মেরে চামড়া ছাড়িয়ে হাডসনস বে কোম্পানি বা মন্ট্রিল ফার
ট্রেডার্সের কাছে বিক্রি করেন।
আমাদের বাসার দেয়ালে ঝোলে
এই কোম্পানিগুলোর ক্যালেন্ডার। ক্রিসমাসের আগে কয়েক সপ্তাহ বাবা রাতের
খাওয়া শেষে বাসার সেলারে কাজ করেন। সেলারের দেয়াল সাদা চুনকাম করা। টেবিলের
ওপর এক শ ওয়াটের বাল্ব জ্বলে। সিঁড়ির ওপরের ধাপে বসে আমি আর আমার ভাই
লেয়ার্ড বাবার কাজ করা দেখি। বাবা শিয়ালের চামড়া ছাড়িয়ে সেটা উল্টে দেন।
শেয়ালটাকে তখন ইঁদুরের মতো ছোট্ট লাগে। মৃতদেহগুলো একটা বস্তায় ভরে ময়লার
খালে পুঁতে ফেলা হয়। একবার আমাদের কিষান হেনরি বেইলি করল কি, এ রকম একটা
বস্তা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, ‘বড়দিনের উপহার!’ মা রেগে গিয়েছিলেন। মা
তো আসলে চামড়া ছাড়ানোর এই কাজটাকেই দেখতে পারতেন না। বলতেন, ‘এগুলো বাড়ির
বাইরে করলে হয় না! সারা বাড়ি গন্ধ হয়ে থাকে।’ আমার কাছে অবশ্য এটা এই
মৌসুমেরই গন্ধ বলে মনে হয়, কমলালেবু বা পাইন ফলের গন্ধের মতো।
আমাদের ওপরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ওপরে গিয়েও আমরা শিয়ালের গায়ের গন্ধ পাই, হেনরির হাসির আওয়াজ শুনি। নিচতলার উষ্ণ, নিরাপদ, উজ্জ্বল আলোয় ভেসে যাওয়া জগৎটা ওপরতলার ঠান্ডা বাতাসে মিশে থাকে। বাড়ির বাইরে গা-ছমছমে অন্ধকার দুনিয়া। তুষার পড়ে পড়ে স্তূপ হয়ে থাকে চারপাশে, শোঁ শোঁ বাতাস বয়।
অন্ধকারে আমরা বিছানায় শুয়ে থাকি, চোখ সিঁড়িঘরের একচিলতে আলোর দিকে। ক্রিসমাসের গান গুনগুন করে ঘুমিয়ে যায় লেয়ার্ড। আমি তখন নিজেকে নিজে গল্প বলতে শুরু করি। নিজেকে নিয়ে বানানো গল্প, আমি যখন বড় হয়ে গেছি, সেই সময়কার সব ঘটনা।
মরে যাওয়ার আগে শিয়ালগুলো আমার বাবার বানিয়ে দেওয়া জগতে বিচরণ করে। সেই জগৎটা উঁচু বেড়া দেওয়া—মধ্যযুগীয় শহরের মতো। একটা গেট আছে, রাতে সেটায় খিল আঁটা। ভেতরে বড় বড় খোপরা। তাতে মানুষ সমান উঁচু দরজা, তার ভেতরে তক্তা বেছানো, শিয়াল তাতে লাফালাফি, দৌড়াদৌড়ি করে। সবকিছু খুব পরিপাটি আর বুদ্ধি খাটিয়ে বানানো। বাবা ভীষণ সৃজনশীল, পৃথিবীতে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় উপন্যাস রবিনসন ক্রুশো।
শিয়ালগুলোর প্রতিটার আলাদা নাম আছে। টিনের পাতে প্রিন্ট করা সেই নাম ঝোলানো থাকে তাদের নিজ নিজ খোপরার দরজায়। বাবার রাখা নামগুলো হলো প্রিন্স, বব, ওয়ালি ও বেট্টি। আমার রাখা নাম স্টার, টার্ক, মরিন ও ডায়ানা। লেয়ার্ড নাম রেখেছে মড, এই নামে এক কিষানী কাজ করত আমাদের বাসায়, স্কুলের এক বন্ধুর নামে সে শিয়ালের নাম দিল হ্যারল্ড। আরেক শিয়ালের নাম মেক্সিকো। মেক্সিকো কেন? জবাব নেই।
নাম রাখলেই তো আর সেগুলো পোষা হয়ে যায় না। এ জন্য বাবা ছাড়া আর কেউ যায় না খোপরার কাছে। দুবার শিয়ালের কামড় খেয়েছেন তিনি, বিষক্রিয়া হয়েছিল। আমি এদের কাছে পানি বয়ে আনি। তখন খোপরার মধ্যে বেছানো তক্তায় সেগুলো ছোটাছুটি করে, মাঝেমধ্যে ডাক ছাড়ে। জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে।
পানি বয়ে আনা ছাড়াও বাবার ঘাসবিচালি কাটার কাজেও আমি হাত লাগাই। তিনি কাস্তে দিয়ে কাটেন, আমি সেগুলো স্তূপ করে রাখি। তিনি শিয়ালের খোপরার ছাদে ছড়িয়ে দেন ঘাসবিছালি। তাতে খোপরা ঠান্ডা থাকে।
একদিন সন্ধ্যার পর পর। আমি বাইরের গেটে খিল এঁটেছি। ভেতরে এগিয়ে দেখি রাতের আঁধারে গোলাঘরের সামনের উঁচু জায়গাটায় দাঁড়িয়ে বাবা আর মা। বাবা সবেমাত্র তাঁর কসাইঘর থেকে বেরিয়েছেন। কাপড়ে তখনো রক্ত লেগে, হাতের দু-এক জায়গায় মাংসের টুকরা।
মা গোলাঘরের সামনে নেমে এসেছেন, একটু অবাক করা ঘটনাই। খুব জরুরি না হলে তিনি সাধারণত উঠোনের বাইরে পা রাখেন না। তাঁর কাপড় তখনো বাসন মাজার পানিতে ভেজা। রুমালে চুল বাঁধা, তবে দু-একটা চুল এলোমেলো খসে পড়েছে। মা ভীষণ ব্যস্ত। ইদানীং আমাদের পেছনের বারান্দায় জমে গেছে শহর থেকে কেনা পিচ ফল, আঙুর আর আতার ঝুড়ি। বাড়ির আঙিনা থেকে উঠছে পেঁয়াজ, টমেটো আর শসা। এগুলো দিয়ে আচার, জেলি আর সস বানানো হবে। রান্নাঘরে সারাক্ষণই চুলায় আগুন জ্বলছে। দিন-রাত কাচের বয়ামের টুংটাং। দম ফেলার অবসর নেই।
শুনলাম মা বলছেন, ‘লেয়ার্ড আরেকটু বড় না হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরো, তারপর তো তোমার সত্যিকারের একটা কাজের হাত জুটবে।’
জবাবে বাবা কী বললেন, শুনতে পেলাম না। কিন্তু মায়ের এই কথার মানে কী? লেয়ার্ড তো অকর্মার ধাড়ি। এই যে এই মুহূর্তে কোথায় সে? দোলনায় দোল খাচ্ছে, না হয় নিজে নিজে চরকি-পাক দিচ্ছে, না হয় শুঁয়াপোকা ধরে বেড়াচ্ছে।
‘তখন আমিও মেয়েটাকে ঘরের কাজে লাগাতে পারব,’ শুনলাম মা বলছেন। ‘ঘাড় ঘুরিয়েছি কি তোমার মেয়ে ভোগাট্টা। ঘরে যে একটা মেয়ে আছে, বোঝার জো আছে!’
আমি চুপচাপ গিয়ে গোলাঘরের কোনার একটা বস্তায় ঠেস দিয়ে বসলাম। মায়ের ওপর ভরসা করা যায় না। বাবার চেয়ে দরদ বেশি তাঁর, সেটা মানি। কিন্তু তাঁকে বোকা বানানো সোজা। আর আস্থা রাখা কঠিন।
মায়ের কথাকে বাবা যেন আবার পাত্তাটাত্তা না দেন। লেয়ার্ড করবে কাজ, তাহলেই হয়েছে। মায়ের বুঝ যে কত কম, এ থেকেই বোঝা যায়।
শিয়ালগুলোকে কী খাওয়ানো হয়, সেটাই বলতে ভুলে গেছি। বাবার জামা-কাপড়ে লেগে থাকা রক্ত দেখে মনে পড়ল। শিয়ালকে দেওয়া হয় ঘোড়ার মাংস। কৃষকেরা বেশির ভাগই এখনো ঘোড়া পোষেন। কোনোটা একেবারে বুড়ো থুড়থুড়ে হয়ে পড়লে, বা পা ভেঙে খোড়া হয়ে গেলে, উঠে দাঁড়াতে না পারলে, তখন বাবাকে খবর দেওয়া হয়। তিনি হেনরিকে সঙ্গে নিয়ে ট্রাক হাঁকিয়ে হাজির হন। সাধারণত বন্দুকের গুলি ছুড়ে ঘোড়াটাকে হত্যা করে সেখানেই মাংস কাটকুট করে নিয়ে আসেন তাঁরা। ঘোড়ার মালিককে পাঁচ থেকে বারো ডলার পর্যন্ত দেওয়া হয়। বাসায় আগে থেকেই মাংসের মজুত থাকলে তাঁরা ঘোড়াটাকে না মেরে জ্যান্ত বয়ে আনেন। কয়েক দিন আস্তাবলে রেখে দেওয়া হয় আবার মাংসের দরকার না পড়া পর্যন্ত। যুদ্ধের পর কৃষকেরা ট্রাক্টর কিনতে শুরু করেছেন। ঘোড়া খুব একটা কাজে লাগে না। শীতে কোনো অথর্ব ঘোড়া এলে আমরা বসন্ত পর্যন্ত সেটাকে রেখে দিই।
যে শীতে আমি এগারোয় পা দিয়েছি, সেবার আমাদের আস্তাবলে দুটো ঘোড়া এসে উপস্থিত। এদের আগের নাম তো আর জানি না, আমরা নাম দিয়ে দিলাম ম্যাক আর ফ্লোরা। ম্যাক বুড়ো কালো জোয়ালবাহী ঘোড়া। ফ্লোরা ঘোড়ী, গাড়িটানা। ম্যাক খুব ঢিমেতেতালা, তাকে জুত করা সোজা। কিন্তু ফ্লোরা অস্থির, কিছুটা হিংস্রও। তবে আমরা তার বীরপুরুষী পছন্দ করি। শনিবার দিনে আমরা আস্তাবলে ঢুকে পড়ি, আর যখনই পশুগন্ধি উষ্ণ আঁধারে দরজা খুলি, ফ্লোরা ঝট করে মাথা তোলে, চোখ ঘোরায়, তীব্র হ্রেষাধ্বনিতে ফেটে পড়ে।
বসন্ত এলে ঘোড়াগুলোকে গোলাঘরের সামনের আঙিনায় চরে বেড়াতে দেওয়া হলো। ম্যাক গোলাঘরের দেয়ালে ঠেস দিয়ে গা ঘষছে। কিন্তু ফ্লোরা এলোমেলো হেঁটে বেড়ায়, খুর দিয়ে বেড়ার গায়ে আঘাত করে। বরফ দ্রুত গলছে, বেরিয়ে পড়ছে শক্ত ধূসর মাটি। এক শনিবার আস্তাবলে ঢুকে দেখি, সবগুলো দরজা খোলা, আলো ঢুকছে। হেনরি সেখানে উপস্থিত।
‘তোমাদের বুড়ো বন্ধু ম্যাককে গুডবাই বলতে এসেছ?’ বলল হেনরি। ‘আসো, ওট খাওয়াও ওকে।’ লেয়ার্ডের মুঠোর মধ্যে কিছু ওট ঢেলে দিল হেনরি। লেয়ার্ড এগিয়ে গেল ম্যাককে খাওয়াতে। ম্যাকের দাঁত পড়ে গেছে। চিবাতে পারে না। হেনরি বলল, ‘বেচারা! ঘোড়ার দাঁত গেল, তো ধরে নাও ঘোড়াও গেল।’
‘তোমরা কি আজই তাকে গুলি করবে?’ আমি জিজ্ঞেস করি।
হেনরি জবাব দেয় না। উঁচু খনখনে গলায় গান ধরে।
আমি কোনো ঘোড়াকে গুলি করা দেখিনি। কিন্তু জানি কোথায় ঘটনাটা ঘটে।
বাবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। কাঁধে বন্দুক।
‘তোমরা এখানে কী করছ?’ তিনি জিজ্ঞেস করেন।
‘কিছু না।’
‘যাও, বাসার ভেতরে গিয়ে খেলো।’
দুই সপ্তাহ পরে টের পেলাম, এবার ওরা ফ্লোরাকে গুলি করে মারবে। আগের রাতে বাবা-মায়ের আলাপ শুনেছি। মা জিজ্ঞেস করছিলেন, খড় বাড়ন্ত কি না। বাবা বললেন, ‘কাল থেকে তো থাকবে কেবল গরুটা। বাইরের ঘাসবিচালিই খাবে না হয়।’
পরদিন ঝকঝকে রোদ। আমরা উঠোনে ঘুরে বেড়াচ্ছি, শীতের ঝড়ে ঝরে পড়া গাছের ডাল কুড়াচ্ছি। কানে এল ফ্লোরার তীব্র হ্রেষাধ্বনি। তারপর বাবার গলার আওয়াজ, তারপর হেনরির চিৎকার। গোলাঘরের দিকে ছুটলাম, ব্যাপার কী দেখতে।
আস্তাবলের দরজা খোলা। হেনরি ফ্লোরাকে বাইরে আনামাত্র ফ্লোরা হাত থেকে ছুটে গেছে। এখন গোলাঘরের সামনের উঠোনময় ছুটে বেড়াচ্ছে, এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। আমরা বেড়ার ওপর উঠে বসলাম। ঘোড়ার ছোটাছুটি দেখতে মজা লাগছে। বাবা আর হেনরি পিছু ধাওয়া করছে, চেষ্টা করছে লাগামটা হাতের মুঠোয় কবজা করতে। তারা একটু একটু করে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছে ফ্লোরাকে। প্রায় পেরেই গিয়েছিল, শেষ মুহূর্তে দুজনার মাঝ-বরাবর ছুট লাগাল ঘোড়াটা, চোখে উদভ্রান্ত দৃষ্টি। হেনরি চিৎকার দিল, ‘আরে গেল, সে তো এবার মাঠে ঢুকে পড়েছে!’
তার মানে এবার ঘোড়াটা বাড়ির সামনের লম্বা এল-আকারের মাঠে এসে পড়েছে। মাঝামাঝি জায়গায় যদি চলে যেতে পারে, সেখানে বেড়ার গেট খোলা। এখনো বেরোতে পারেনি। দেখলাম, ঘোড়াটা উল্টোদিকে গেছে। এখন সে চোখের আড়ালে। নিশ্চয়ই দৌড়ে আবার এদিকে আসবে। গেটটা ভারী। আমি সেটাকে ঠেলে নিয়ে যেতে থাকলাম। মাঝামাঝি গেছি, দেখি ঘোড়াটা সোজা আমার দিকে দৌড়ে আসছে। শিকল লাগিয়ে দেওয়ার মতো সময় আছে মাত্র। লেয়ার্ড গর্ত বেয়ে চলে এসেছে আমাকে সাহায্য করতে।
গেটটা বন্ধ করে দেওয়ার বদলে আমি সেটা মেলে ধরলাম, যতটা পারা যায়। কোনো রকম সিদ্ধান্ত নিয়ে করিনি। এমনি এমনি হয়ে গেল। ফ্লোরা গতি কমাল না। আমার পাশ কেটে লাফিয়ে বেরিয়ে গেল। লেয়ার্ড আমার পাশে লাফাতে লাফাতে চেঁচাতে থাকল, ‘বন্ধ কর দিদি, গেটটা বন্ধ করে দে!’
একটু পরে বাবা আর হেনরি এসে পৌঁছাল। তারা কেবল ঘোড়াটাকে ছুটে বেরিয়ে যেতে দেখেছে। আর কিছু দেখতে পায়নি।
কী হয়েছে জিজ্ঞেস করার সময় নেই তাদের হাতে। তারা দৌড়ে আবার গোলাঘরে গিয়ে বন্দুক আর ছুরি বের করল। সেগুলো তুলল ট্রাকে। ট্রাক ছুটল মাঠ পেরিয়ে। লেয়ার্ড চেঁচাল, ‘আমাকেও নাও। আমাকেও নাও।’
হেনরি ট্রাক থামাল। তাকে তুলে নিল ওরা।
ট্রাক বেরিয়ে গেলে আমি গেট বন্ধ করে দিলাম।
আমাদের ওপরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ওপরে গিয়েও আমরা শিয়ালের গায়ের গন্ধ পাই, হেনরির হাসির আওয়াজ শুনি। নিচতলার উষ্ণ, নিরাপদ, উজ্জ্বল আলোয় ভেসে যাওয়া জগৎটা ওপরতলার ঠান্ডা বাতাসে মিশে থাকে। বাড়ির বাইরে গা-ছমছমে অন্ধকার দুনিয়া। তুষার পড়ে পড়ে স্তূপ হয়ে থাকে চারপাশে, শোঁ শোঁ বাতাস বয়।
অন্ধকারে আমরা বিছানায় শুয়ে থাকি, চোখ সিঁড়িঘরের একচিলতে আলোর দিকে। ক্রিসমাসের গান গুনগুন করে ঘুমিয়ে যায় লেয়ার্ড। আমি তখন নিজেকে নিজে গল্প বলতে শুরু করি। নিজেকে নিয়ে বানানো গল্প, আমি যখন বড় হয়ে গেছি, সেই সময়কার সব ঘটনা।
মরে যাওয়ার আগে শিয়ালগুলো আমার বাবার বানিয়ে দেওয়া জগতে বিচরণ করে। সেই জগৎটা উঁচু বেড়া দেওয়া—মধ্যযুগীয় শহরের মতো। একটা গেট আছে, রাতে সেটায় খিল আঁটা। ভেতরে বড় বড় খোপরা। তাতে মানুষ সমান উঁচু দরজা, তার ভেতরে তক্তা বেছানো, শিয়াল তাতে লাফালাফি, দৌড়াদৌড়ি করে। সবকিছু খুব পরিপাটি আর বুদ্ধি খাটিয়ে বানানো। বাবা ভীষণ সৃজনশীল, পৃথিবীতে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় উপন্যাস রবিনসন ক্রুশো।
শিয়ালগুলোর প্রতিটার আলাদা নাম আছে। টিনের পাতে প্রিন্ট করা সেই নাম ঝোলানো থাকে তাদের নিজ নিজ খোপরার দরজায়। বাবার রাখা নামগুলো হলো প্রিন্স, বব, ওয়ালি ও বেট্টি। আমার রাখা নাম স্টার, টার্ক, মরিন ও ডায়ানা। লেয়ার্ড নাম রেখেছে মড, এই নামে এক কিষানী কাজ করত আমাদের বাসায়, স্কুলের এক বন্ধুর নামে সে শিয়ালের নাম দিল হ্যারল্ড। আরেক শিয়ালের নাম মেক্সিকো। মেক্সিকো কেন? জবাব নেই।
নাম রাখলেই তো আর সেগুলো পোষা হয়ে যায় না। এ জন্য বাবা ছাড়া আর কেউ যায় না খোপরার কাছে। দুবার শিয়ালের কামড় খেয়েছেন তিনি, বিষক্রিয়া হয়েছিল। আমি এদের কাছে পানি বয়ে আনি। তখন খোপরার মধ্যে বেছানো তক্তায় সেগুলো ছোটাছুটি করে, মাঝেমধ্যে ডাক ছাড়ে। জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে।
পানি বয়ে আনা ছাড়াও বাবার ঘাসবিচালি কাটার কাজেও আমি হাত লাগাই। তিনি কাস্তে দিয়ে কাটেন, আমি সেগুলো স্তূপ করে রাখি। তিনি শিয়ালের খোপরার ছাদে ছড়িয়ে দেন ঘাসবিছালি। তাতে খোপরা ঠান্ডা থাকে।
একদিন সন্ধ্যার পর পর। আমি বাইরের গেটে খিল এঁটেছি। ভেতরে এগিয়ে দেখি রাতের আঁধারে গোলাঘরের সামনের উঁচু জায়গাটায় দাঁড়িয়ে বাবা আর মা। বাবা সবেমাত্র তাঁর কসাইঘর থেকে বেরিয়েছেন। কাপড়ে তখনো রক্ত লেগে, হাতের দু-এক জায়গায় মাংসের টুকরা।
মা গোলাঘরের সামনে নেমে এসেছেন, একটু অবাক করা ঘটনাই। খুব জরুরি না হলে তিনি সাধারণত উঠোনের বাইরে পা রাখেন না। তাঁর কাপড় তখনো বাসন মাজার পানিতে ভেজা। রুমালে চুল বাঁধা, তবে দু-একটা চুল এলোমেলো খসে পড়েছে। মা ভীষণ ব্যস্ত। ইদানীং আমাদের পেছনের বারান্দায় জমে গেছে শহর থেকে কেনা পিচ ফল, আঙুর আর আতার ঝুড়ি। বাড়ির আঙিনা থেকে উঠছে পেঁয়াজ, টমেটো আর শসা। এগুলো দিয়ে আচার, জেলি আর সস বানানো হবে। রান্নাঘরে সারাক্ষণই চুলায় আগুন জ্বলছে। দিন-রাত কাচের বয়ামের টুংটাং। দম ফেলার অবসর নেই।
শুনলাম মা বলছেন, ‘লেয়ার্ড আরেকটু বড় না হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরো, তারপর তো তোমার সত্যিকারের একটা কাজের হাত জুটবে।’
জবাবে বাবা কী বললেন, শুনতে পেলাম না। কিন্তু মায়ের এই কথার মানে কী? লেয়ার্ড তো অকর্মার ধাড়ি। এই যে এই মুহূর্তে কোথায় সে? দোলনায় দোল খাচ্ছে, না হয় নিজে নিজে চরকি-পাক দিচ্ছে, না হয় শুঁয়াপোকা ধরে বেড়াচ্ছে।
‘তখন আমিও মেয়েটাকে ঘরের কাজে লাগাতে পারব,’ শুনলাম মা বলছেন। ‘ঘাড় ঘুরিয়েছি কি তোমার মেয়ে ভোগাট্টা। ঘরে যে একটা মেয়ে আছে, বোঝার জো আছে!’
আমি চুপচাপ গিয়ে গোলাঘরের কোনার একটা বস্তায় ঠেস দিয়ে বসলাম। মায়ের ওপর ভরসা করা যায় না। বাবার চেয়ে দরদ বেশি তাঁর, সেটা মানি। কিন্তু তাঁকে বোকা বানানো সোজা। আর আস্থা রাখা কঠিন।
মায়ের কথাকে বাবা যেন আবার পাত্তাটাত্তা না দেন। লেয়ার্ড করবে কাজ, তাহলেই হয়েছে। মায়ের বুঝ যে কত কম, এ থেকেই বোঝা যায়।
শিয়ালগুলোকে কী খাওয়ানো হয়, সেটাই বলতে ভুলে গেছি। বাবার জামা-কাপড়ে লেগে থাকা রক্ত দেখে মনে পড়ল। শিয়ালকে দেওয়া হয় ঘোড়ার মাংস। কৃষকেরা বেশির ভাগই এখনো ঘোড়া পোষেন। কোনোটা একেবারে বুড়ো থুড়থুড়ে হয়ে পড়লে, বা পা ভেঙে খোড়া হয়ে গেলে, উঠে দাঁড়াতে না পারলে, তখন বাবাকে খবর দেওয়া হয়। তিনি হেনরিকে সঙ্গে নিয়ে ট্রাক হাঁকিয়ে হাজির হন। সাধারণত বন্দুকের গুলি ছুড়ে ঘোড়াটাকে হত্যা করে সেখানেই মাংস কাটকুট করে নিয়ে আসেন তাঁরা। ঘোড়ার মালিককে পাঁচ থেকে বারো ডলার পর্যন্ত দেওয়া হয়। বাসায় আগে থেকেই মাংসের মজুত থাকলে তাঁরা ঘোড়াটাকে না মেরে জ্যান্ত বয়ে আনেন। কয়েক দিন আস্তাবলে রেখে দেওয়া হয় আবার মাংসের দরকার না পড়া পর্যন্ত। যুদ্ধের পর কৃষকেরা ট্রাক্টর কিনতে শুরু করেছেন। ঘোড়া খুব একটা কাজে লাগে না। শীতে কোনো অথর্ব ঘোড়া এলে আমরা বসন্ত পর্যন্ত সেটাকে রেখে দিই।
যে শীতে আমি এগারোয় পা দিয়েছি, সেবার আমাদের আস্তাবলে দুটো ঘোড়া এসে উপস্থিত। এদের আগের নাম তো আর জানি না, আমরা নাম দিয়ে দিলাম ম্যাক আর ফ্লোরা। ম্যাক বুড়ো কালো জোয়ালবাহী ঘোড়া। ফ্লোরা ঘোড়ী, গাড়িটানা। ম্যাক খুব ঢিমেতেতালা, তাকে জুত করা সোজা। কিন্তু ফ্লোরা অস্থির, কিছুটা হিংস্রও। তবে আমরা তার বীরপুরুষী পছন্দ করি। শনিবার দিনে আমরা আস্তাবলে ঢুকে পড়ি, আর যখনই পশুগন্ধি উষ্ণ আঁধারে দরজা খুলি, ফ্লোরা ঝট করে মাথা তোলে, চোখ ঘোরায়, তীব্র হ্রেষাধ্বনিতে ফেটে পড়ে।
বসন্ত এলে ঘোড়াগুলোকে গোলাঘরের সামনের আঙিনায় চরে বেড়াতে দেওয়া হলো। ম্যাক গোলাঘরের দেয়ালে ঠেস দিয়ে গা ঘষছে। কিন্তু ফ্লোরা এলোমেলো হেঁটে বেড়ায়, খুর দিয়ে বেড়ার গায়ে আঘাত করে। বরফ দ্রুত গলছে, বেরিয়ে পড়ছে শক্ত ধূসর মাটি। এক শনিবার আস্তাবলে ঢুকে দেখি, সবগুলো দরজা খোলা, আলো ঢুকছে। হেনরি সেখানে উপস্থিত।
‘তোমাদের বুড়ো বন্ধু ম্যাককে গুডবাই বলতে এসেছ?’ বলল হেনরি। ‘আসো, ওট খাওয়াও ওকে।’ লেয়ার্ডের মুঠোর মধ্যে কিছু ওট ঢেলে দিল হেনরি। লেয়ার্ড এগিয়ে গেল ম্যাককে খাওয়াতে। ম্যাকের দাঁত পড়ে গেছে। চিবাতে পারে না। হেনরি বলল, ‘বেচারা! ঘোড়ার দাঁত গেল, তো ধরে নাও ঘোড়াও গেল।’
‘তোমরা কি আজই তাকে গুলি করবে?’ আমি জিজ্ঞেস করি।
হেনরি জবাব দেয় না। উঁচু খনখনে গলায় গান ধরে।
আমি কোনো ঘোড়াকে গুলি করা দেখিনি। কিন্তু জানি কোথায় ঘটনাটা ঘটে।
বাবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। কাঁধে বন্দুক।
‘তোমরা এখানে কী করছ?’ তিনি জিজ্ঞেস করেন।
‘কিছু না।’
‘যাও, বাসার ভেতরে গিয়ে খেলো।’
দুই সপ্তাহ পরে টের পেলাম, এবার ওরা ফ্লোরাকে গুলি করে মারবে। আগের রাতে বাবা-মায়ের আলাপ শুনেছি। মা জিজ্ঞেস করছিলেন, খড় বাড়ন্ত কি না। বাবা বললেন, ‘কাল থেকে তো থাকবে কেবল গরুটা। বাইরের ঘাসবিচালিই খাবে না হয়।’
পরদিন ঝকঝকে রোদ। আমরা উঠোনে ঘুরে বেড়াচ্ছি, শীতের ঝড়ে ঝরে পড়া গাছের ডাল কুড়াচ্ছি। কানে এল ফ্লোরার তীব্র হ্রেষাধ্বনি। তারপর বাবার গলার আওয়াজ, তারপর হেনরির চিৎকার। গোলাঘরের দিকে ছুটলাম, ব্যাপার কী দেখতে।
আস্তাবলের দরজা খোলা। হেনরি ফ্লোরাকে বাইরে আনামাত্র ফ্লোরা হাত থেকে ছুটে গেছে। এখন গোলাঘরের সামনের উঠোনময় ছুটে বেড়াচ্ছে, এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। আমরা বেড়ার ওপর উঠে বসলাম। ঘোড়ার ছোটাছুটি দেখতে মজা লাগছে। বাবা আর হেনরি পিছু ধাওয়া করছে, চেষ্টা করছে লাগামটা হাতের মুঠোয় কবজা করতে। তারা একটু একটু করে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছে ফ্লোরাকে। প্রায় পেরেই গিয়েছিল, শেষ মুহূর্তে দুজনার মাঝ-বরাবর ছুট লাগাল ঘোড়াটা, চোখে উদভ্রান্ত দৃষ্টি। হেনরি চিৎকার দিল, ‘আরে গেল, সে তো এবার মাঠে ঢুকে পড়েছে!’
তার মানে এবার ঘোড়াটা বাড়ির সামনের লম্বা এল-আকারের মাঠে এসে পড়েছে। মাঝামাঝি জায়গায় যদি চলে যেতে পারে, সেখানে বেড়ার গেট খোলা। এখনো বেরোতে পারেনি। দেখলাম, ঘোড়াটা উল্টোদিকে গেছে। এখন সে চোখের আড়ালে। নিশ্চয়ই দৌড়ে আবার এদিকে আসবে। গেটটা ভারী। আমি সেটাকে ঠেলে নিয়ে যেতে থাকলাম। মাঝামাঝি গেছি, দেখি ঘোড়াটা সোজা আমার দিকে দৌড়ে আসছে। শিকল লাগিয়ে দেওয়ার মতো সময় আছে মাত্র। লেয়ার্ড গর্ত বেয়ে চলে এসেছে আমাকে সাহায্য করতে।
গেটটা বন্ধ করে দেওয়ার বদলে আমি সেটা মেলে ধরলাম, যতটা পারা যায়। কোনো রকম সিদ্ধান্ত নিয়ে করিনি। এমনি এমনি হয়ে গেল। ফ্লোরা গতি কমাল না। আমার পাশ কেটে লাফিয়ে বেরিয়ে গেল। লেয়ার্ড আমার পাশে লাফাতে লাফাতে চেঁচাতে থাকল, ‘বন্ধ কর দিদি, গেটটা বন্ধ করে দে!’
একটু পরে বাবা আর হেনরি এসে পৌঁছাল। তারা কেবল ঘোড়াটাকে ছুটে বেরিয়ে যেতে দেখেছে। আর কিছু দেখতে পায়নি।
কী হয়েছে জিজ্ঞেস করার সময় নেই তাদের হাতে। তারা দৌড়ে আবার গোলাঘরে গিয়ে বন্দুক আর ছুরি বের করল। সেগুলো তুলল ট্রাকে। ট্রাক ছুটল মাঠ পেরিয়ে। লেয়ার্ড চেঁচাল, ‘আমাকেও নাও। আমাকেও নাও।’
হেনরি ট্রাক থামাল। তাকে তুলে নিল ওরা।
ট্রাক বেরিয়ে গেলে আমি গেট বন্ধ করে দিলাম।
(সংক্ষেপিত)
No comments