চারু শিল্প- বিশ্ব-পরিমণ্ডলে শিল্পাচার্য by আশীষ-উর-রহমান

বাংলাদেশের আধুনিক চারুশিল্প আন্দোলনের পথিকৃৎ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্ম শতবর্ষ উদ্যাপন উপলক্ষে চলছে বছরব্যাপী নানা কর্মসূচি।
এর মধ্যে বিশেষ একটি কাজ সম্পন্ন হলো শিল্পাচার্যের জীবন ও কর্ম নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রন্থ প্রকাশনা দিয়ে। ইতালির বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা স্কিরার সঙ্গে গ্রেট মাস্টার্স অব বাংলাদেশ: জয়নুল আবেদিন নামের এই গ্রন্থ প্রকাশ করেছে ঢাকার বেঙ্গল ফাউন্ডেশন।

৭ অক্টোবর রাজধানীর একটি হোটেলে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের মাধ্যমে বইটির আনুষ্ঠানিক মোড়ক উন্মোচনও হয়ে গেল। বলতে গেলে এক অর্থে এ বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের মধ্য দিয়েই শিল্পাচার্যের জন্ম শতবর্ষ উদ্যাপনের কর্মসূচির আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে।
স্কিরা ও বেঙ্গলের যৌথ প্রয়াসে বাংলাদেশের শিল্পগুরুদের জীবন ও কাজ নিয়ে আরও বেশ কিছু বই প্রকাশিত হবে। শিল্পাচার্যকে দিয়েই প্রথম প্রকাশনা শুরু হলো।
স্কিরা-বেঙ্গলের এই বই ছাপা, বাঁধাই সবই হয়েছে ইতালিতে। স্কিরা সারা বিশ্বে বইটি বিপণন করবে। সুতরাং প্রকাশনার দিক থেকে বইটি যে আন্তর্জাতিক মান লাভ করেছে, তা সহজেই অনুমেয়। এটি সম্পাদনা করেছেন রোসা মারিয়া ফালভো। তিনটি প্রবন্ধ, একটি সাক্ষাৎকার, জীবনপঞ্জি ও দশক অনুসারে তাঁর কাজের প্রকৃতি ও শিল্পাচার্যের বিভিন্ন সময়ের আলোকচিত্র নিয়ে ৩৩৬ পৃষ্ঠার এই বই।
‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন’ নামের প্রথম প্রবন্ধটি লিখেছেন শিল্পী আবুল মনসুর। তিনি শিল্পাচার্যের ছাত্র। আলোচনা শুরু করেছেন শিক্ষাগুরুর একটি কথা দিয়ে, যা তিনি শিক্ষার্থীদের বলতেন, ‘নৌকা আঁকতে হলে ঘরে বসে না এঁকে নদীর পাড়ে যেতে হবে। রক্তের মধ্যে যদি নৌকার দুলনিটাই অনুভব করতে না পারো, তবে যথার্থ নৌকা আঁকবে কেমন করে।’ এ প্রবন্ধে তিনি তুলে ধরেছেন জয়নুলের কাজের বৈশিষ্ট্য, তাঁর শিক্ষা ও তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপট—যেখান থেকে একজন মুসলমানের পক্ষে চারুকলা শিক্ষা গ্রহণ সহজ ছিল না।
‘পাইওনিয়ারিং মডার্ন আর্ট ইন বাংলাদেশ’ নামের দ্বিতীয় প্রবন্ধটি শিল্প-সমালোচক নজরুল ইসলামের। এখানে তিনি জোর দিয়েছেন বাংলাদেশের চারুকলা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নির্মাণে শিল্পাচার্যের ভূমিকার প্রতি। জয়নুল ও তাঁর নানা ধরনের কাজ সম্পর্কে জানা-অজানা তথ্যে সমৃদ্ধ এ প্রবন্ধটি।
গ্রেট মাস্টার্স অব বাংলাদেশ: জয়নুল আবেদিন-এর প্রচ্ছদ
আবুল হাসনাত তাঁর ‘ইমেজেস অব ফ্যামিন’ নামের প্রবন্ধে তুলে এনেছেন শিল্পাচার্যের সেই অবিস্মরণীয় কাজগুলোর কথা, যা তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে গেছে। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে স্রোতের মতো অনাহারি মানুষ আসছে কলকাতায়। পথে মরে পড়ে আছে ভুখানাঙ্গা শিশু, উচ্ছিষ্ট খাবার খুঁজছে ডাস্টবিনে কাকের সঙ্গে। শিল্পাচার্য এই বিপন্ন মানবতার এক মহাকাব্যিক দৃশ্যমালা তুলে ধরেছিলেন চায়না কলি ও মোটা তুলির টানে। কাগজও ছিল অল্প দামের, যা সাধারণত জিনিসপত্র মোড়ানোর জন্য ব্যবহূত হয়। এ প্রবন্ধে দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপট ও শিল্পাচার্যের কাজের ধারা বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে।
জয়নুলের রেখাচিত্রের পাশে সে সময়ের কিছু আলোকচিত্রও ব্যবহার করা হয়েছে। শেষে আছে তাঁর স্ত্রী বেগম জাহানারা আবেদিনের একটি সাক্ষাৎকার ও শিল্পাচার্যের জীবনপঞ্জি।
তিন প্রবন্ধের পর রয়েছে ১৯৩০, ১৯৪০, ১৯৫০, ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে আঁকা শিল্পাচার্যের ছবি। সব মিলিয়ে এ বইতে জয়নুল আবেদিনের ২৭০টি কাজের ছবি রয়েছে। ‘দুর্ভিক্ষের রেখাচিত্র’, ‘দুমকার জলং’, ‘সাঁওতাল দম্পতি’, ‘গুন টানা’, ‘আয়না ও নারী’, ‘বিদ্রোহী ষাঁড়’, ‘মনপুরার জলোচ্ছ্বাস ও নবান্ন স্ক্রল’, ‘মুক্তিযুদ্ধ’, ‘পাইন্যার মা’, ‘ক্রুদ্ধ কাক’—এসব বিখ্যাত ছবি তো আছেই। এ ছাড়া বইতে আছে আরও বহু কাজ, যা এখনও অনেকেরই দেখার বাইরে। তাঁর ‘দুর্ভিক্ষের রেখাচিত্র’-এর কথা সবার জানা; কিন্তু এই বিষয়ে তিনি কিছু ড্রাই পয়েন্ট ও লিনোকাটের ছাপাই ছবিও করেছিলেন। বইতে সেগুলোও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বিশেষত, দশকভিত্তিক ক্রমানুসারে ছবিগুলো আনুষঙ্গিক তথ্যসহ বিন্যস্ত করায় শিল্পাচার্যের কাজের বিষয়, বৈশিষ্ট্য, রীতি, আঙ্গিক—এসবের বিবর্তন সম্পর্কেও একটি ধারণা পাওয়া যাবে।
বইটি যে কারোই ব্যক্তিগত সংগ্রহকে সমৃদ্ধ করবে—কথাটি না বললেও চলে (বেঙ্গল গ্যালারিতে এটি বিক্রি হচ্ছে। দাম: বাংলাদেশি টাকায় ছয় হাজার টাকা)। তবে এর চেয়েও বড় কথা হলো, আমাদের দেশের বড় মাপের শিল্পীদের কাজ এই বইয়ের মাধ্যমে ছড়িয়ে গেল বিশ্বের বৃহৎ পরিমণ্ডলে।

No comments

Powered by Blogger.