সংলাপ ও সংঘাত পাশাপাশি চলে না সংলাপে আসতেই হবে by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
বাংলাদেশের
রাজনৈতিক চিত্রটা এখন কী? দেশ কি সংলাপের দিকে এগোচ্ছে, না সংঘাতের দিকে?
এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে যাওয়ার আগে বর্তমান পরিস্থিতি একটু বিবেচনা করা
যাক। শনিবার (২৬ অক্টোবর) বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী নিজে এবং
তার এডিসির মাধ্যমে বহুবার চেষ্টা করে বিরোধীদলীয় নেত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে
কথা বলতে পেরেছেন। জানা যায়, সাঁইত্রিশ মিনিট কথা হয়েছে। সংলাপ হয়েছে,
সংঘাত বন্ধ করা হয়নি। রাজশাহীতে রক্ত ঝরেছে। খালেদা জিয়াকে শেখ হাসিনা
টেলিফোন-আলাপে তিন দিনের হরতালের ডাক প্রত্যাহার করে আলোচনায় বসার আমন্ত্রণ
জানিয়েছেন। খালেদা জিয়া রাজি হননি। বলেছেন, তার জোটের আঠারো দল মিলে
হরতালের ডাক দিয়ে ফেলেছে, এখন আর কিছু করার নেই। ২৯ তারিখে সন্ধ্যায় হরতাল
শেষ হলে আলোচনায় বসা যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী তাকে গণভবনে দাওয়াত করেছেন।
বলেছেন, তিনি যাকে খুশি এবং যতজন তিনি চান সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারেন। তবে
আগে তাদের সংখ্যার কথা জানিয়ে দিতে হবে। যাতে সবার জন্য খাবারের আয়োজন করা
যায়।
এই আমন্ত্রণ খালেদা জিয়া গ্রহণ করেছেন, না ঝুলিয়ে রেখেছেন তা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। আমার ধারণা, খালেদা জিয়া আমন্ত্রণটি ঝুলিয়ে রেখেছেন। যুদ্ধরত দুই পক্ষ শান্তি আলোচনায় বসতে চাইলে আগে একটি যুদ্ধবিরতি ঘটায়। আলোচনা সফল না হলে আবার যুদ্ধ শুরু হয়। আমেরিকা-ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ও যতবার দুই পক্ষ শান্তি আলোচনায় বসেছে, যুদ্ধবিরতি ঘটানো হয়েছে। বিশ্বের সর্বত্রই শান্তি আলোচনার সময় এটা ঘটে।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তো যুদ্ধরত দুটি শত্র“পক্ষ নয়; একই দেশের দুটো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ রয়েছে। এই বিরোধ মেটানোর জন্য আপস আলোচনায় বসলে দু’পক্ষকেই তো আগে সংঘাত বর্জন করতে হবে, রাজপথের লড়াই স্থগিত করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সংঘাত বর্জন করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ মেটানোর জন্য তার বেতার ও টেলিভিশনে একটা প্রস্তাব দিয়েছেন। বিরোধীদলীয় নেত্রী এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে নিজে একটি পাল্টা প্রস্তাব দিয়েছেন।
অর্থাৎ আলোচনার একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। শেখ হাসিনার প্রস্তাব অথবা খালেদা জিয়ার পাল্টা প্রস্তাব কোনোটাই রাজনীতিতে শেষ কথা নয়। প্রস্তাব দেয়াই হয় এই প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংলাপ আলোচনা শুরু করার জন্য। খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনে এক ধরনের প্রস্তাব দিয়েছেন, আবার সংসদে গিয়ে সেই প্রস্তাব পাল্টেছেন। তথাপি এই প্রস্তাবকে ভিত্তি করেও আলাপ-আলোচনায় এগোনো যেত।
বিএনপি তা করেনি। প্রস্তাব দিয়েই আলোচনায় বসার সুযোগ গ্রহণের আগেই আন্দোলনের হুমকি দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে সেই হুমকি কার্যকর করে। জামায়াত-শিবিরকে নামিয়ে দেয়া হয় মাঠে। তারা ভাংচুর শুরু করে এবং তাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রাণহানি এবং রক্তপাতও ঘটেছে। আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপির ঢাকায় ২৫ অক্টোবরের মহাসমাবেশ প্রথমে নিষিদ্ধ করেছিল। তাতে আমারও মনে হয়েছিল, গণতান্ত্রিক রীতি বিরোধী এই ব্যবস্থা গ্রহণ হাসিনা সরকারের জন্য ঠিক হয়নি। পরে মনে হয়েছে, ৫ মে ঢাকায় শাপলা চত্বরে হেফাজতিদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ঘটানোর প্রতিশ্র“তিতে বিশ্বাস স্থাপন করে তাদের সমাবেশ করার অনুমতি দিয়ে সরকার যে বিরাট ভুল করেছিল, সেই ভুল ২৫ অক্টোবরের বিএনপির সমাবেশের বেলায় তারা করতে চাননি।
২৫ অক্টোবরের সমাবেশে খালেদা জিয়া সরকারের বিরুদ্ধে তাদের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এই কর্মসূচি অনুযায়ী ২৭ অক্টোবর থেকে ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত হরতাল ঘোষিত হয়। কিন্তু ২৭ অক্টোবরের আগেই শুরু হয় ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানি অর্থাৎ বিএনপির ২৫ অক্টোবরের মহাসমাবেশ সম্পর্কে আওয়ামী লীগ সরকারের আশংকা যে একেবারেই অমূলক ছিল না, সমাবেশ-পরবর্তী সহিংস ঘটনা তা প্রমাণ করে। এই সমাবেশ উপলক্ষে সরকার জননিরাপত্তার ব্যবস্থামূলক কঠোর পুলিশি উপস্থিতির ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ৫ মে’র শাপলা চত্বরের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারত। আমাদের দেশের কপট গণতন্ত্র-প্রেমিকেরা যাই বলুক, গণতন্ত্রের ন্যূনতম নিয়ম-কানুন যারা মানে না, তাদের সঙ্গে গণতান্ত্রিক আচরণ করা খুবই বিপজ্জনক।
বিদেশী (ব্রিটিশ) শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলনেও মহাত্মা গান্ধী বলতেন, করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গ (ফড় ড়ৎ ফরব) অর্থাৎ হয় দাবি আদায় করব নয় মরব। বাংলাদেশে দেশী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমে বিএনপির নেতানেত্রীরা প্রথমেই বলেন, ‘হাত ভেঙে গুঁড়িয়ে দেব’, ‘আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য করব’, ‘হাসিনাকে তার পিতার পরিণতি বরণ করতে হবে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এমনকি ড. ইউনূসের মতো শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ীও এখন সরকারের হাত গুঁড়িয়ে দেয়ার হুংকার দিয়ে দেশে অশান্তি ছড়াচ্ছেন। এগুলো কি গণতান্ত্রিক রাজনীতির ভাষা? আর এই ভাষায় যারা কথা বলেন এবং সঙ্গে হিংসাত্মক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তাদের সঙ্গে গণতান্ত্রিক আচরণ করা গণতন্ত্র রক্ষার জন্যই বা কতটা নিশ্চয়তামূলক?
প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে খালেদা জিয়া কি সংলাপে যাবেন? এই ব্যাপারে তার আন্তরিকতা থাকলে তিনি ২৭ থেকে ২৯ তারিখ পর্যন্ত ঘোষিত হরতাল স্থগিত রাখতেন। হরতাল শুরু হওয়ার আগেই ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানি ঘটেছে। মূলত জামায়াত-শিবির মাঠে হিংস্রভাবে নেমেছে। এই অবস্থার মধ্যে খালেদা জিয়া গণভবনের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে যদি সংলাপে বসেনও তাতে সংলাপ সফল করার মতো অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা যাবে কি?
বিএনপি নেত্রীর ঘনিষ্ঠ মহল থেকে জেনেছি, সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসার ব্যাপারে তার আগ্রহ আছে। প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে গণভবনে যাওয়ার ব্যাপারেও তার মধ্যে আগ্রহের কমতি নেই। কিন্তু মুশকিল হয়েছে তিনি এখন আর নিজের ইচ্ছা চালিত হতে পারছেন না। কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে তাকে সিঙ্গাপুরে যেতে হয়। সেখানে পুত্র তারেক রহমানের এবং অন্য বিদেশী মিত্রদের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
পুত্র তারেক রহমান বিদেশে বাস করেন এবং জামায়াতের গাঁটছড়াবন্দি। তার মতে, ‘জামায়াত এবং বিএনপি অভিন্ন পরিবার।’ আবার জামায়াতের পেছনে রয়েছে পাকিস্তানের কুখ্যাত সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। এই ত্রিভুজ বন্ধন থেকে খালেদা জিয়ার নিজেকে মুক্ত করতে পারা সহজ নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন একটা ভাঁওতামাত্র। আসল দাবি ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি বাতিল করা। জামায়াতের জনসমর্থন নেই। তাই বিএনপির জনসমর্থনের ওপর নির্ভর করে দলটিকে সামনে রেখে মাঠে নেমেছে। জনসমর্থন নেই; তাই ভাংচুর, সন্ত্রাস চালাচ্ছে।
কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা দিন দুই হয় বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি চাঞ্চল্যকর খবর ছেপেছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা জিইয়ে রাখা এবং আন্দোলনের নামে বর্তমান সন্ত্রাস সৃষ্টির পেছনে যে আইএসআই সক্রিয় এবং জামায়াত ও তারেক রহমানের মাধ্যমে বিএনপিকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তা বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাত দিয়ে পত্রিকাটি প্রকাশ করেছে।
এই খবরকে কেউ কেউ বলতে পারেন ভারতীয় পত্রিকার অপপ্রচার। যদি তাও হয় বাস্তবে কী দেখা যাচ্ছে? খালেদা জিয়ার প্রতিটি জনসমাবেশে এখন জামায়াত-শিবিরই অর্ধেকের বেশি মাঠ দখল করে থাকে। ছাত্রদলকে পিটিয়ে ছাত্রশিবির সভা ও সমাবেশের নিয়ন্ত্রণ দখল করে নেয়। হরতালের কর্মসূচি পালনেও জামায়াত ও শিবির ক্যাডারদেরই প্রাধান্য। বেগম জিয়া মুখে বলছেন, ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চান; কিন্তু কাজে প্রকাশ্যেই এই বিচারের ব্যাপারে বিতর্ক সৃষ্টি করছেন এবং যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি চাইছেন। ঢাকায় শুক্রবারের জনসভাতেও তিনি বলেছেন, ‘বিএনপি ক্ষমতায় গেলে সব রাজবন্দিকে মুক্তি দেবে।’ এই রাজবন্দি বলতে যে তিনি বন্দি এবং ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তিদানের কথা বলেছেন, তা একজন বালকের পক্ষেও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
শুক্রবার বেগম জিয়ার সভায় প্রথম বক্তাই ছিল ছাত্রশিবিরের এক নেতা। স্বয়ং বিএনপি-নেত্রী তার ভাষণে ছাত্রশিবিরের গ্রেফতারকৃত সভাপতির মুক্তি দাবি করে বলেছেন, এই শিবির-সভাপতি অত্যন্ত ভালো লোক। সরকার তাকে গ্রেফতার করে নির্যাতন চালাচ্ছে। বিএনপির এক প্রবীণ ও পুরনো নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার কাছে আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে বেগম জিয়া গণভবনে দাওয়াত খেতে গেলেও সংলাপ সফল হবে কিনা সে সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে। বিএনপি এখন আর আগের বিএনপি নেই। সম্পূর্ণভাবে জামায়াতের গ্রাসে চলে গেছে। দলনেত্রী সব ব্যাপারেই দলীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপ করেন। কিন্তু তাদের অধিকাংশের পরামর্শ শোনেন না। তিনি সিদ্ধান্ত নেন তারেক রহমান ও জামায়াতের সঙ্গে পরামর্শ করে। আজকাল তার বক্তৃতা-বিবৃতি শুনলে মনে হয়, তিনি গোলাম আযমের অনুপস্থিতিতে জামায়াতের অঘোষিত আমির।’
এই আক্ষেপ বিএনপির অনেক নেতাকর্মীর মনেই। কিন্তু তারা মুখ ফুটে তা বলার সাহস পান না। বেগম জিয়া যখন কোনো জনসভায় বক্তৃতা দেন তখন সভাস্থল জামায়াত ও শিবিরের লোক দ্বারা ভর্তি এবং চারদিকে শুধু জামায়াত ও শিবিরের ফেস্টুন, পোস্টার ও ব্যানার দেখে নিজেকে কোন দলের নেতা ভাবেন তা জানতে আমার খুব ইচ্ছা হয়। সরকারের এক নেতা বলেছেন, ‘তারা গণভবনে বেগম খালেদা জিয়া তথা বিএনপিকে শুধু আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। জামায়াতকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।’ অনেকের মতো আমারও প্রশ্ন, বিএনপির বর্তমানে যা অবস্থান, তাতে জামায়াতকে আলাদাভাবে আমন্ত্রণ জানানোর দরকার আছে কি?
২৭ থেকে ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত হরতালে কি ঘটবে তা ২৭ তারিখের ঢাকার অবস্থা দেখেই বোঝা যায়। ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ভয়ে অনেকেই গাড়ি বের করেননি বা দোকানপাট খোলেননি। কিন্তু আর সবকিছুই স্বাভাবিকভাবে চলছে। অর্থাৎ শিথিল হরতাল। যথারীতি জামায়াত-শিবির কিছু ভাংচুর করছে। যেসব জেলায় জামায়াত শক্তিশালী, সেসব জেলায় উপদ্রব বাড়তে পারে। রক্তপাতও হতে পারে। এর বেশি কিছু নয়। আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও কোনো কোনো নেতার বাড়িতে ককটেল ছোড়া হয়েছে। কিন্তু পটকা ফুটিয়ে যে ‘বিপ্লব’ করা যায় না, এই শিক্ষাটা বিএনপি-জামায়াত এখনও নেয়নি।
যত কিছুই হোক, বেগম জিয়াকে শেষ পর্যন্ত সংলাপে যেতে হবে বলে আমার ধারণা। গণভবনের আমন্ত্রণ আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণের আগেও তিনি শেখ হাসিনার টেলিফোন ধরার ব্যাপারে যেমন গড়িমসি করেছেন, তেমন গড়িমসি করবেন, নানা শর্ত জুড়বেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে আলাপ-আলোচনায় বসতে হবে। কারণ সংঘাতে গিয়ে যে কোনো লাভ নেই এবং গণআন্দোলন করার মতো শক্তি ও জনসমর্থন তার জোটের নেই, এটা দেশের পরিস্থিতিই তাকে বুঝিয়ে দেবে। অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই তাকে আলোচনায় আসতে হবে।
বিএনপি হয়তো এখনও আশা করে পাকিস্তানের আইএসআইয়ের সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়াও ভারত ও আমেরিকার চাপে হাসিনা সরকার হয়তো তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হবে। এ জন্য বাজারে তারা নানা গুজবও সৃষ্টি করেছিল। এই গুজবের পালে হাওয়া লাগিয়েছিল ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজিনা সাহেবের দিল্লিতে ছুটে যাওয়ার খবরটি। এখন তো ভারতের কাগজেই খবর বেরিয়েছে, দিল্লিতে মার্কিন দূতকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তাদের দেশে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়; বাংলাদেশেও তা হলে দিল্লির আপত্তি নেই। মজিনা সাহেব ভারতের সঙ্গে ঐকমত্য ঘোষণা করে তবে দিল্লি ছেড়েছেন। তাতে হাসিনা সরকারের মনোবল আরও বেড়েছে। শেখ হাসিনা নিজে খালেদা জিয়াকে সরাসরি গণভবনে আমন্ত্রণ জানাতে দ্বিধা করছেন না। দুর্বলতা কাটিয়ে উঠে সবল অবস্থানে পৌঁছতে পেরেছেন বলেই শেখ হাসিনা এটা করতে পারছেন।
আমি বর্তমান সরকারের ধৈর্য ও সহনশীলতার প্রশংসা করি। আন্দোলনের নামে বিরোধী দলের তাণ্ডবের মুখে তারা প্রশাসনিক শক্তি প্রয়োগ করছেন বটে, কিন্তু তা সীমিত। প্রয়োজনের বেশি শক্তি প্রয়োগ করছেন না। বাংলাদেশের পুলিশ মার খেয়ে এবং চরম উস্কানির মুখেও ধৈর্য ও সংযম দেখাতে পারে, এই সরকারের আমলে তার প্রমাণ পাওয়া গেল। দেখা যাক, তিন দিনের ‘পটকা-বিপ্লবের’ পর বিএনপি-জামায়াত পরবর্তী ধাপে কি করে? আরও কঠোর কর্মসূচি দিয়ে জনজীবনের বিরক্তিকর উপদ্রব তারা বাড়াতে পারবেন; কিন্তু ‘শিথিল হরতাল’ চাঙা করতে পারবেন না, সরকারকে নতিস্বীকার করানো দূরের কথা। ইতিমধ্যে ফাঁসির আদেশপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের দণ্ড কার্যকর হয়ে গেলে ৫ মের মতো হয়তো দেখা যাবে ময়দান ফাঁকা, কোথাও পাগড়ির দেখা মিলছে না।
বিএনপির আরও সহযোগী শক্তি আছে। যেমন ড. কামাল হোসেন ও ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীদের তৃতীয় শিবির। তাদের প্রচেষ্টা এখন অনেকটা কুঁজোর চিৎ হয়ে শুয়ে চাঁদ দেখার স্বপ্নের মতো। সুশীল সমাজের মাথা ড. ইউনূস এখনও নভোচারী, দেশের কথা ভাবেন, কিন্তু দেশের মাটিতে পা রাখেন না। জঙ্গের ময়দানে সময় এলে এদের দেখা যাবে সে আশায় গুড়েবালি।
সংকট উত্তরণের একমাত্র পথ- সিরাতুল মুসতাকীম হল আঁচল থেকে সব পটকা, বোমা, বারুদ ঝেড়ে ফেলে দিয়ে আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ পন্থায় নির্বাচন-সংক্রান্ত সব মতভেদ যথাসম্ভব কমানো এবং একটা ঐকমত্যে পৌঁছানো। আমার বিশ্বাস, বিএনপি-নেত্রীকে সেই পথেই শেষ পর্যন্ত আগাতে হবে। আমি আশাবাদী।
এই আমন্ত্রণ খালেদা জিয়া গ্রহণ করেছেন, না ঝুলিয়ে রেখেছেন তা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। আমার ধারণা, খালেদা জিয়া আমন্ত্রণটি ঝুলিয়ে রেখেছেন। যুদ্ধরত দুই পক্ষ শান্তি আলোচনায় বসতে চাইলে আগে একটি যুদ্ধবিরতি ঘটায়। আলোচনা সফল না হলে আবার যুদ্ধ শুরু হয়। আমেরিকা-ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ও যতবার দুই পক্ষ শান্তি আলোচনায় বসেছে, যুদ্ধবিরতি ঘটানো হয়েছে। বিশ্বের সর্বত্রই শান্তি আলোচনার সময় এটা ঘটে।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তো যুদ্ধরত দুটি শত্র“পক্ষ নয়; একই দেশের দুটো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ রয়েছে। এই বিরোধ মেটানোর জন্য আপস আলোচনায় বসলে দু’পক্ষকেই তো আগে সংঘাত বর্জন করতে হবে, রাজপথের লড়াই স্থগিত করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সংঘাত বর্জন করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ মেটানোর জন্য তার বেতার ও টেলিভিশনে একটা প্রস্তাব দিয়েছেন। বিরোধীদলীয় নেত্রী এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে নিজে একটি পাল্টা প্রস্তাব দিয়েছেন।
অর্থাৎ আলোচনার একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। শেখ হাসিনার প্রস্তাব অথবা খালেদা জিয়ার পাল্টা প্রস্তাব কোনোটাই রাজনীতিতে শেষ কথা নয়। প্রস্তাব দেয়াই হয় এই প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংলাপ আলোচনা শুরু করার জন্য। খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনে এক ধরনের প্রস্তাব দিয়েছেন, আবার সংসদে গিয়ে সেই প্রস্তাব পাল্টেছেন। তথাপি এই প্রস্তাবকে ভিত্তি করেও আলাপ-আলোচনায় এগোনো যেত।
বিএনপি তা করেনি। প্রস্তাব দিয়েই আলোচনায় বসার সুযোগ গ্রহণের আগেই আন্দোলনের হুমকি দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে সেই হুমকি কার্যকর করে। জামায়াত-শিবিরকে নামিয়ে দেয়া হয় মাঠে। তারা ভাংচুর শুরু করে এবং তাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রাণহানি এবং রক্তপাতও ঘটেছে। আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপির ঢাকায় ২৫ অক্টোবরের মহাসমাবেশ প্রথমে নিষিদ্ধ করেছিল। তাতে আমারও মনে হয়েছিল, গণতান্ত্রিক রীতি বিরোধী এই ব্যবস্থা গ্রহণ হাসিনা সরকারের জন্য ঠিক হয়নি। পরে মনে হয়েছে, ৫ মে ঢাকায় শাপলা চত্বরে হেফাজতিদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ঘটানোর প্রতিশ্র“তিতে বিশ্বাস স্থাপন করে তাদের সমাবেশ করার অনুমতি দিয়ে সরকার যে বিরাট ভুল করেছিল, সেই ভুল ২৫ অক্টোবরের বিএনপির সমাবেশের বেলায় তারা করতে চাননি।
২৫ অক্টোবরের সমাবেশে খালেদা জিয়া সরকারের বিরুদ্ধে তাদের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এই কর্মসূচি অনুযায়ী ২৭ অক্টোবর থেকে ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত হরতাল ঘোষিত হয়। কিন্তু ২৭ অক্টোবরের আগেই শুরু হয় ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানি অর্থাৎ বিএনপির ২৫ অক্টোবরের মহাসমাবেশ সম্পর্কে আওয়ামী লীগ সরকারের আশংকা যে একেবারেই অমূলক ছিল না, সমাবেশ-পরবর্তী সহিংস ঘটনা তা প্রমাণ করে। এই সমাবেশ উপলক্ষে সরকার জননিরাপত্তার ব্যবস্থামূলক কঠোর পুলিশি উপস্থিতির ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ৫ মে’র শাপলা চত্বরের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারত। আমাদের দেশের কপট গণতন্ত্র-প্রেমিকেরা যাই বলুক, গণতন্ত্রের ন্যূনতম নিয়ম-কানুন যারা মানে না, তাদের সঙ্গে গণতান্ত্রিক আচরণ করা খুবই বিপজ্জনক।
বিদেশী (ব্রিটিশ) শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলনেও মহাত্মা গান্ধী বলতেন, করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গ (ফড় ড়ৎ ফরব) অর্থাৎ হয় দাবি আদায় করব নয় মরব। বাংলাদেশে দেশী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমে বিএনপির নেতানেত্রীরা প্রথমেই বলেন, ‘হাত ভেঙে গুঁড়িয়ে দেব’, ‘আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য করব’, ‘হাসিনাকে তার পিতার পরিণতি বরণ করতে হবে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এমনকি ড. ইউনূসের মতো শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ীও এখন সরকারের হাত গুঁড়িয়ে দেয়ার হুংকার দিয়ে দেশে অশান্তি ছড়াচ্ছেন। এগুলো কি গণতান্ত্রিক রাজনীতির ভাষা? আর এই ভাষায় যারা কথা বলেন এবং সঙ্গে হিংসাত্মক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তাদের সঙ্গে গণতান্ত্রিক আচরণ করা গণতন্ত্র রক্ষার জন্যই বা কতটা নিশ্চয়তামূলক?
প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে খালেদা জিয়া কি সংলাপে যাবেন? এই ব্যাপারে তার আন্তরিকতা থাকলে তিনি ২৭ থেকে ২৯ তারিখ পর্যন্ত ঘোষিত হরতাল স্থগিত রাখতেন। হরতাল শুরু হওয়ার আগেই ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানি ঘটেছে। মূলত জামায়াত-শিবির মাঠে হিংস্রভাবে নেমেছে। এই অবস্থার মধ্যে খালেদা জিয়া গণভবনের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে যদি সংলাপে বসেনও তাতে সংলাপ সফল করার মতো অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা যাবে কি?
বিএনপি নেত্রীর ঘনিষ্ঠ মহল থেকে জেনেছি, সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসার ব্যাপারে তার আগ্রহ আছে। প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে গণভবনে যাওয়ার ব্যাপারেও তার মধ্যে আগ্রহের কমতি নেই। কিন্তু মুশকিল হয়েছে তিনি এখন আর নিজের ইচ্ছা চালিত হতে পারছেন না। কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে তাকে সিঙ্গাপুরে যেতে হয়। সেখানে পুত্র তারেক রহমানের এবং অন্য বিদেশী মিত্রদের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
পুত্র তারেক রহমান বিদেশে বাস করেন এবং জামায়াতের গাঁটছড়াবন্দি। তার মতে, ‘জামায়াত এবং বিএনপি অভিন্ন পরিবার।’ আবার জামায়াতের পেছনে রয়েছে পাকিস্তানের কুখ্যাত সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। এই ত্রিভুজ বন্ধন থেকে খালেদা জিয়ার নিজেকে মুক্ত করতে পারা সহজ নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন একটা ভাঁওতামাত্র। আসল দাবি ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি বাতিল করা। জামায়াতের জনসমর্থন নেই। তাই বিএনপির জনসমর্থনের ওপর নির্ভর করে দলটিকে সামনে রেখে মাঠে নেমেছে। জনসমর্থন নেই; তাই ভাংচুর, সন্ত্রাস চালাচ্ছে।
কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা দিন দুই হয় বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি চাঞ্চল্যকর খবর ছেপেছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা জিইয়ে রাখা এবং আন্দোলনের নামে বর্তমান সন্ত্রাস সৃষ্টির পেছনে যে আইএসআই সক্রিয় এবং জামায়াত ও তারেক রহমানের মাধ্যমে বিএনপিকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তা বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাত দিয়ে পত্রিকাটি প্রকাশ করেছে।
এই খবরকে কেউ কেউ বলতে পারেন ভারতীয় পত্রিকার অপপ্রচার। যদি তাও হয় বাস্তবে কী দেখা যাচ্ছে? খালেদা জিয়ার প্রতিটি জনসমাবেশে এখন জামায়াত-শিবিরই অর্ধেকের বেশি মাঠ দখল করে থাকে। ছাত্রদলকে পিটিয়ে ছাত্রশিবির সভা ও সমাবেশের নিয়ন্ত্রণ দখল করে নেয়। হরতালের কর্মসূচি পালনেও জামায়াত ও শিবির ক্যাডারদেরই প্রাধান্য। বেগম জিয়া মুখে বলছেন, ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চান; কিন্তু কাজে প্রকাশ্যেই এই বিচারের ব্যাপারে বিতর্ক সৃষ্টি করছেন এবং যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি চাইছেন। ঢাকায় শুক্রবারের জনসভাতেও তিনি বলেছেন, ‘বিএনপি ক্ষমতায় গেলে সব রাজবন্দিকে মুক্তি দেবে।’ এই রাজবন্দি বলতে যে তিনি বন্দি এবং ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তিদানের কথা বলেছেন, তা একজন বালকের পক্ষেও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
শুক্রবার বেগম জিয়ার সভায় প্রথম বক্তাই ছিল ছাত্রশিবিরের এক নেতা। স্বয়ং বিএনপি-নেত্রী তার ভাষণে ছাত্রশিবিরের গ্রেফতারকৃত সভাপতির মুক্তি দাবি করে বলেছেন, এই শিবির-সভাপতি অত্যন্ত ভালো লোক। সরকার তাকে গ্রেফতার করে নির্যাতন চালাচ্ছে। বিএনপির এক প্রবীণ ও পুরনো নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার কাছে আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে বেগম জিয়া গণভবনে দাওয়াত খেতে গেলেও সংলাপ সফল হবে কিনা সে সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে। বিএনপি এখন আর আগের বিএনপি নেই। সম্পূর্ণভাবে জামায়াতের গ্রাসে চলে গেছে। দলনেত্রী সব ব্যাপারেই দলীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপ করেন। কিন্তু তাদের অধিকাংশের পরামর্শ শোনেন না। তিনি সিদ্ধান্ত নেন তারেক রহমান ও জামায়াতের সঙ্গে পরামর্শ করে। আজকাল তার বক্তৃতা-বিবৃতি শুনলে মনে হয়, তিনি গোলাম আযমের অনুপস্থিতিতে জামায়াতের অঘোষিত আমির।’
এই আক্ষেপ বিএনপির অনেক নেতাকর্মীর মনেই। কিন্তু তারা মুখ ফুটে তা বলার সাহস পান না। বেগম জিয়া যখন কোনো জনসভায় বক্তৃতা দেন তখন সভাস্থল জামায়াত ও শিবিরের লোক দ্বারা ভর্তি এবং চারদিকে শুধু জামায়াত ও শিবিরের ফেস্টুন, পোস্টার ও ব্যানার দেখে নিজেকে কোন দলের নেতা ভাবেন তা জানতে আমার খুব ইচ্ছা হয়। সরকারের এক নেতা বলেছেন, ‘তারা গণভবনে বেগম খালেদা জিয়া তথা বিএনপিকে শুধু আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। জামায়াতকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।’ অনেকের মতো আমারও প্রশ্ন, বিএনপির বর্তমানে যা অবস্থান, তাতে জামায়াতকে আলাদাভাবে আমন্ত্রণ জানানোর দরকার আছে কি?
২৭ থেকে ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত হরতালে কি ঘটবে তা ২৭ তারিখের ঢাকার অবস্থা দেখেই বোঝা যায়। ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ভয়ে অনেকেই গাড়ি বের করেননি বা দোকানপাট খোলেননি। কিন্তু আর সবকিছুই স্বাভাবিকভাবে চলছে। অর্থাৎ শিথিল হরতাল। যথারীতি জামায়াত-শিবির কিছু ভাংচুর করছে। যেসব জেলায় জামায়াত শক্তিশালী, সেসব জেলায় উপদ্রব বাড়তে পারে। রক্তপাতও হতে পারে। এর বেশি কিছু নয়। আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও কোনো কোনো নেতার বাড়িতে ককটেল ছোড়া হয়েছে। কিন্তু পটকা ফুটিয়ে যে ‘বিপ্লব’ করা যায় না, এই শিক্ষাটা বিএনপি-জামায়াত এখনও নেয়নি।
যত কিছুই হোক, বেগম জিয়াকে শেষ পর্যন্ত সংলাপে যেতে হবে বলে আমার ধারণা। গণভবনের আমন্ত্রণ আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণের আগেও তিনি শেখ হাসিনার টেলিফোন ধরার ব্যাপারে যেমন গড়িমসি করেছেন, তেমন গড়িমসি করবেন, নানা শর্ত জুড়বেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে আলাপ-আলোচনায় বসতে হবে। কারণ সংঘাতে গিয়ে যে কোনো লাভ নেই এবং গণআন্দোলন করার মতো শক্তি ও জনসমর্থন তার জোটের নেই, এটা দেশের পরিস্থিতিই তাকে বুঝিয়ে দেবে। অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই তাকে আলোচনায় আসতে হবে।
বিএনপি হয়তো এখনও আশা করে পাকিস্তানের আইএসআইয়ের সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়াও ভারত ও আমেরিকার চাপে হাসিনা সরকার হয়তো তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হবে। এ জন্য বাজারে তারা নানা গুজবও সৃষ্টি করেছিল। এই গুজবের পালে হাওয়া লাগিয়েছিল ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজিনা সাহেবের দিল্লিতে ছুটে যাওয়ার খবরটি। এখন তো ভারতের কাগজেই খবর বেরিয়েছে, দিল্লিতে মার্কিন দূতকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তাদের দেশে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়; বাংলাদেশেও তা হলে দিল্লির আপত্তি নেই। মজিনা সাহেব ভারতের সঙ্গে ঐকমত্য ঘোষণা করে তবে দিল্লি ছেড়েছেন। তাতে হাসিনা সরকারের মনোবল আরও বেড়েছে। শেখ হাসিনা নিজে খালেদা জিয়াকে সরাসরি গণভবনে আমন্ত্রণ জানাতে দ্বিধা করছেন না। দুর্বলতা কাটিয়ে উঠে সবল অবস্থানে পৌঁছতে পেরেছেন বলেই শেখ হাসিনা এটা করতে পারছেন।
আমি বর্তমান সরকারের ধৈর্য ও সহনশীলতার প্রশংসা করি। আন্দোলনের নামে বিরোধী দলের তাণ্ডবের মুখে তারা প্রশাসনিক শক্তি প্রয়োগ করছেন বটে, কিন্তু তা সীমিত। প্রয়োজনের বেশি শক্তি প্রয়োগ করছেন না। বাংলাদেশের পুলিশ মার খেয়ে এবং চরম উস্কানির মুখেও ধৈর্য ও সংযম দেখাতে পারে, এই সরকারের আমলে তার প্রমাণ পাওয়া গেল। দেখা যাক, তিন দিনের ‘পটকা-বিপ্লবের’ পর বিএনপি-জামায়াত পরবর্তী ধাপে কি করে? আরও কঠোর কর্মসূচি দিয়ে জনজীবনের বিরক্তিকর উপদ্রব তারা বাড়াতে পারবেন; কিন্তু ‘শিথিল হরতাল’ চাঙা করতে পারবেন না, সরকারকে নতিস্বীকার করানো দূরের কথা। ইতিমধ্যে ফাঁসির আদেশপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের দণ্ড কার্যকর হয়ে গেলে ৫ মের মতো হয়তো দেখা যাবে ময়দান ফাঁকা, কোথাও পাগড়ির দেখা মিলছে না।
বিএনপির আরও সহযোগী শক্তি আছে। যেমন ড. কামাল হোসেন ও ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীদের তৃতীয় শিবির। তাদের প্রচেষ্টা এখন অনেকটা কুঁজোর চিৎ হয়ে শুয়ে চাঁদ দেখার স্বপ্নের মতো। সুশীল সমাজের মাথা ড. ইউনূস এখনও নভোচারী, দেশের কথা ভাবেন, কিন্তু দেশের মাটিতে পা রাখেন না। জঙ্গের ময়দানে সময় এলে এদের দেখা যাবে সে আশায় গুড়েবালি।
সংকট উত্তরণের একমাত্র পথ- সিরাতুল মুসতাকীম হল আঁচল থেকে সব পটকা, বোমা, বারুদ ঝেড়ে ফেলে দিয়ে আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ পন্থায় নির্বাচন-সংক্রান্ত সব মতভেদ যথাসম্ভব কমানো এবং একটা ঐকমত্যে পৌঁছানো। আমার বিশ্বাস, বিএনপি-নেত্রীকে সেই পথেই শেষ পর্যন্ত আগাতে হবে। আমি আশাবাদী।
No comments