ভারতের ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট প্রথমবারের মতো বাংলাদেশি লেখকদের তিনটি বই প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে সেলিনা হোসেনের দুটি বই ‘আদান-প্রদানের পথ প্রসারিত হওয়া দরকার’ সাক্ষাৎকার : পারভেজ হোসেন
ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের তিনটি বই প্রকাশ করেছে।
এর
মধ্যে আপনার মতিজানের মেয়েরা ও অন্যান্য গল্প, রশীদ হায়দারের বৃহন্নলা ও
অন্যান্য গল্প ছাড়াও রয়েছে বাংলাদেশের গল্প নামে একটি সংকলন। সংকলনটি
আপনি সম্পাদনা করেছেন। ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে আপনার
যোগাযোগটি কীভাবে ঘটল?
সেলিনা হোসেন: ২০০৭ সালে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র আয়োজিত বইমেলার মাঠে প্রতিষ্ঠানটির পশ্চিম অঞ্চলের কর্মকর্তা (ওয়েস্টার্ন রিজিওনাল অফিসার) সুবীর দত্তের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে এবং নানা দেশের সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হয়। এ সময় তাঁকে আমাদের দেশের লেখকদের বই প্রকাশের ব্যাপারে প্রস্তাব দিয়েছিলাম। এরপর সুবীর দত্ত দেশে ফিরে ২০০৮-এর জানুয়ারিতে আমাকে একটি চিঠি লেখেন। সেখানে তিনি জানান, বিষয়টি ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়ার বাংলা সাহিত্য বিভাগের প্রধান ব্রতীন দে কে জানানো হয়েছে, তিনি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। এভাবেই যোগাযোগের সূত্রপাত। তবে বই প্রকাশের ক্ষেত্রে ব্রতীনের ভূমিকা ছিল আন্তরিক। নইলে প্রকাশ হতো কি না, জানি না।
পারভেজ: সেই যোগাযোগের পথ ধরে প্রকাশিত হলো বাংলাদেশের তিনটি বই। কিন্তু এই তিন বইয়ের মধ্যে বাংলাদেশের গল্প সংকলনে কীভাবে গল্প নির্বাচন করা হয়েছে?
সেলিনা: প্রথমে আমি ৩০টি গল্প পাঠিয়েছিলাম। পরে ওরা নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গল্পগুলো যখন পাঠাই, তখন ২০০৮ সাল। ২০১৩ সালে এসে ‘আদান-প্রদান’ সিরিজের আওতায় প্রকাশিত হলো বইটি। আমার এবং রশীদ হায়দারের বইও এ সিরিজ থেকে বেরিয়েছে। দীর্ঘ চার বছর এই বইগুলো নিয়ে কাজ চলেছে। হ্যাঁ, এ কথা ঠিক যে একেবারে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ হয়নি। কখনো কখনো আমরা যোগাযোগ-বিচ্ছিন্নও হয়ে পড়েছিলাম।
পারভেজ: বইগুলো প্রথমত বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। পরবর্তীকালে ভারতের অন্যান্য ভাষায়ও কি এগুলো অনূদিত হবে?
সেলিনা: এটা খুবই আনন্দের বিষয় যে বইগুলো প্রথমে বাংলায় প্রকাশিত হলেও অনুবাদের মাধ্যমে ভারতের বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশের পরিকল্পনা আছে ওদের। যতদূর জানি, প্রথম অনুবাদ হবে ইংরেজিতে। তারপর বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায়ও অনুবাদ হবে।
পারভেজ: বাংলাদেশের গল্প-এর ভূমিকায় আপনি লিখেছেন, ‘বাংলা ভাষার রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের নিজস্ব সাহিত্যিক ঘরানার একটা পরিচয় ফুটে উঠেছে এইসব গল্পে।’ সম্পাদক হিসেবে এই দাবির পেছনে আপনার যুক্তিগুলো কী?
সেলিনা: আমি সব সময় মনে করি, ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে একটি বড় সংযোজন ঘটিয়েছেন আমাদের এই ভূখণ্ডের লেখকেরা। আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বা আর্থসামাজিক পটভূমিতে নানা চড়াই-উতরাই—বিশেষত ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন ও মুক্তিযুদ্ধের মুখোমুখি হতে হয়েছে। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবে সাহিত্যে এর ছাপ পড়েছে। সেই ছাপ ধারণ করে বাংলাদেশের সাহিত্যও বৈচিত্র্যময় নতুন একটি পথ সৃষ্টি করেছে। এটি পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সাহিত্য থেকে আমাদের আলাদা করেছে। সামগ্রিক বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে এটি বৃহত্তর একটি সংযোজন। আমাদের নিজস্ব সাহিত্যিক ঘরানার আয়োজনটা ঘটেছে এখানেই।
পারভেজ: আপনি বলছেন ‘নিজস্ব সাহিত্যিক ঘরানা’র কথা। সে ক্ষেত্রে আপনার সম্পাদিত সংকলনে কি ওই ঘরানার পরিচয় পুরোমাত্রায় স্পষ্ট হয়েছে?
সেলিনা: এটা বোধ হয় সূচি দেখলেই বোঝা যাবে। শওকত ওসমান থেকে এ সময়ের আহমাদ মোস্তফা কামাল পর্যন্ত সূচিবদ্ধ হয়েছেন এখানে। তবে একটা কথা না বললে ভুল-বোঝাবুঝির অবকাশ থাকতে পারে—সংকলনের জন্য বুক ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষকে আমি ৩০টি গল্প পাঠিয়েছিলাম। বই বের হওয়ার পর দেখি, এর মধ্য থেকে ২০টি গল্প ওরা স্থান দিয়েছে। কিন্তু কথা ছিল মোট ২১টি গল্প সংকলনভুক্ত হবে, হয়নি। আমি গল্প নির্বাচন করে দেওয়ার পর সেখান থেকে ওরা ওদের মতো করে গল্প নির্বাচন করেছে—এটা ঘটেছে ট্রাস্টের সম্পূর্ণ নিজস্ব সিদ্ধান্তে। ফলে আবদুল মান্নান সৈয়দসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন লেখক এখানে নেই। এ জন্য কিছুটা আফসোস বা দুঃখবোধ তো আমার নিজের আছেই। তার পরও চেয়েছি বইটি হোক। কারণ, বিভিন্ন ভাষার মানুষের কাছে আমাদের লেখকদের লেখা পৌঁছবে—এটা খুব বেশি কিছু না হলেও একেবারে কমও নয়।
পারভেজ: সামগ্রিকভাবে আমাদের বাংলাদেশের সাহিত্যের জন্য এ উদ্যোগ কতটা সুফল বয়ে আনবে বলে আপনার মনে হয়?
সেলিনা: আমি খুব আশাবাদী নই, আবার সে রকমভাবে হতাশও নই। অবশ্য এ বিষয়ে রশীদ হায়দারের ভিন্নমত থাকতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয়, দুটি গল্পগ্রন্থ, একটি সংকলন—একজন লেখকের দু-একটি গল্প—এভাবে তো আর বাংলাদেশের সামগ্রিক সাহিত্যের পরিচয় উঠে আসবে না। লেখককে চেনাও সম্ভব হবে না। বাংলাদেশের সাহিত্যে প্রতিনিধিত্বশীল গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজনের লেখা নিয়ে বেশ কয়েকটি বই এবং সংকলন প্রকাশিত হলে হয়তো বিষয়টি উঠে আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ শামসুল হক, রিজিয়া রহমান, রাবেয়া খাতুন, মাহমুদুল হকের মতো লেখকদের বই এবং এ দেশের নবীন-প্রবীণ লেখকদের লেখা নিয়ে আরও কয়েকটি সংকলন প্রকাশিত হলে তবেই আমরা প্রকৃত সুফল পাব বলে মনে হয়।
পারভেজ: ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টের এই উদ্যোগ অব্যাহত রাখার বিষয়ে আপনি কতটা জানেন?
সেলিনা: তারা হাসান আজিজুল হকের বইয়ের ব্যাপারে আগ্রহী, অচিরেই তাঁর বই প্রকাশ করবে—আমাকে এমনটি বলেছিল। তবে যতদূর জানি, এখন পর্যন্ত হাসান ভাইয়ের সঙ্গে এ ব্যাপারে তারা কোনো যোগাযোগ করেনি। এখানে আরেকটা বিষয়ও ভাবতে হবে, সেটি হচ্ছে আদান-প্রদান। তারা বাংলাদেশের লেখকদের বই প্রকাশে উদ্যোগী হয়েছে। এখন তারাও তো চাইতে পারে আমাদের দেশে বাংলা অনুবাদে ওদের মালয়ালাম বা তেলেগু ভাষার লেখকদের একটি গল্প সংকলন হোক। বিষয়টা আদান-প্রদানের, তাই আমরা যদি ওদেরকে প্রদান করার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা না রাখি, তাহলে একতরফাভাবে আমাদের বই কি ওরা বের করবে? বিষয়টি নিয়ে সরকারি পর্যায় থেকে শুরু করে আমাদের সবাইকে ভাবতে হবে। আসল কথা, আমাদের নিজেদের এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। এই যে আমাদের তিনটি বই দিল্লি থেকে প্রকাশিত হলো, আরও আটটি ভাষায় এটি অনূদিত হবে। এখন আমাদেরও উচিত ওদের ভাষার সাহিত্য নিয়ে কাজ করা। আদান-প্রদানের পথটি আরও প্রসারিত হওয়া দরকার।
পারভেজ: মতিজানের মেয়েরা ও অন্যান্য গল্প বইয়ের গল্প নির্বাচনে আপনি কোন কোন বিষয় প্রাধান্য দিয়েছেন?
সেলিনা: নানা রকম, নানা মাত্রার গল্প আমি লিখেছি। এর মধ্যে আমার পছন্দের বেশ কিছু গল্প কম্পোজ করে ডাকে পাঠিয়েছিলাম। সেখান থেকে তারা ২১টি গল্প নির্বাচন করেছে। বইয়ের পাণ্ডুলিপি করার সময় আমি নিজের বিভিন্ন সুর ও স্বরের গল্পকে প্রথমত একত্র করেছি। এরপর বাছাই করেছি। এ ক্ষেত্রে আমার প্রাধান্য ছিল গল্পের বিষয়-বৈচিত্র্যের দিকে।
No comments