গল্প- একটি সাধারণ সংবাদ by শাহনাজ মুন্নী
‘মাত্র কিছুক্ষণ আগে মারাত্মক রোমহর্ষক
একটা খুন হয়েছে শহরে।’ ‘আবার খুন? মানে আবার একটা অর্থহীন রক্তপাত, কারও
অনিচ্ছুক চলে যাওয়া কিংবা সময়ের আগেই কাউকে চলে যেতে বাধ্য করা।
তা
এবার কে খুন হলো? কোনো রাজনৈতিক কর্মী, সমাজসেবক, না নিরীহ পথচারী? নিউজ
করা যাবে তো? পাবলিকের তো আবার খুনখারাবি নিয়া আগ্রহের কমতি নাই। খোঁজ নিয়া
দেখছ প্রেমঘটিত খুন কি না? আগে বলো, ভিকটিম কে, নারী না পুরুষ?’
‘খুন হয়েছে একজন অল্প বয়সী নারী, যে দেখতে ছিল সুন্দরী, যার গায়ের রং শ্যামলা, কিন্তু চেহারা-ছবি অসাধারণ। কালো চুলে ঘেরা কী যে মায়াময় একটা মুখ ছিল নারীটির, তার বিষণ্ন ফ্যাকাশে মরা মুখটা দেখে এলাম। আহা, তার পাতলা নাকে একটা নীল পাথরের নাকফুল ঝিকমিক করছিল। যেন প্রাণহীন মুখটায় নাকফুলটি একবিন্দু প্রাণের আলো। সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার কী জানেন? নারীটি ছিল অন্তঃসত্ত্বা—ছয় মাসের গর্ভবতী।’
‘বলো কী! এ তো দেখছি নৃশংস জোড়া খুন—মা ও শিশু হত্যা। নিউজটাকে খুব ভালো ট্রিটমেন্ট দিতে হবে। তা, অন্তঃসত্ত্বা নারীটি বিবাহিতা তো; নাকি বিয়েটিয়ে হয়নি? বিয়ের আগেই পেটে বাচ্চা এসে গিয়েছিল, আর সে জন্যই কি তাকে খুন হতে হলো? শুনেছি, ভারতবর্ষে নাকি প্রেম-ভালোবাসা আর শারীরিক সম্পর্কের জের ধরে সবচেয়ে বেশি খুনখারাবি হয়। বাংলাদেশেও একই ট্রেন্ড। তা, কে খুন করল মেয়েটিকে? তার বিশ্বাসঘাতক প্রেমিক? যে পেটে বাচ্চা দিয়ে পিতৃত্বের দায় অস্বীকার করতে চায়? নাকি কুমারী মেয়ের গর্ভে সন্তান আসায় সামাজিক সম্মান হারানোর ভয়ে ভীত মা-বাবাই খুন করল আত্মজাকে? অনেক সময় হয় তো এ রকম—পরিবারের সম্মান রক্ষার জন্য অবাধ্য মেয়েদের “অনার কিলিং” করা। সত্যি বেশ রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি হে! মনে হচ্ছে, পাবলিক নিউজটা খাবে, আজকাল যা ঘটছে না চারদিকে...।’
‘আরে না না, মেয়েটি অবিবাহিত নয়, বিবাহিতই। ঘটনা অন্যখানে। মেয়েটির স্বামীর নাকি আরেকটি স্ত্রী ছিল। যে মেয়ে খুন হলো, সে ছিল লোকটির দ্বিতীয় স্ত্রী। তার প্রথম পক্ষের স্ত্রী নাকি খুবই দাপুটে মহিলা। সেই ঘরে লোকটির নাকি আবার বড় বড় দুটি সন্তানও আছে—একটা ছেলে, একটা মেয়ে। সেই বউ-বাচ্চা রেখে এই মেয়েটিকে বিয়ে করেছিল লোকটা।’
‘বুঝেছি, সহজ কেস! প্রথম পক্ষের স্ত্রী ভাড়াটে খুনি দিয়ে মেয়েটিকে খুন করিয়েছে। সতিনের প্রতি চিরন্তন ঈর্ষা। তার ওপর আবার বাচ্চা পেটে! সতিনের সন্তানকে স্বামীর সম্পদের ভাগ দিতে হবে বলেই এই খুনোখুনি। সব খুনের পেছনেই দেখবে কোনো না-কোনো মনস্তাত্ত্বিক বা অর্থনৈতিক কারণ থাকে, বুঝেছ? আচ্ছা, কীভাবে কী ঘটল, সব খুলে বলো তো—তাড়াহুড়ো করে সাদামাটা বিবরণ না, ডিটেইল বলবে। খুঁটিনাটি কিচ্ছু বাদ দেবে না। তা, ডেডবডিটা এখন কোথায়?’
‘ডেডবডি তো মর্গে নিয়ে গেছে, লাশকাটা ঘরে হিম ঠান্ডায়। দেখে এলাম নিস্পন্দ মেয়েটি শুয়ে আছে একটা শক্ত কাঠের টেবিলে। মেয়েটির জরায়ুতে বড় হতে থাকা অর্ধশিশুটিও আছে ওর সঙ্গে, একইভাবে। হয়তো সেও মারা গেছে মায়ের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই, অথবা কয়েক সেকেন্ড পর। একদিন যে মা তাকে পৃথিবীতে এনেছিল, নিজের শরীরের ভেতরে যত্ন করে বাঁচিয়ে রেখেছিল, সেই মায়ের সঙ্গেই সে আবার চলে গেল অন্য কোনো প্রলম্বিত পৃথিবীতে। আমাদের এই পৃথিবীটা তার দেখাই হলো না। তার পরও খুব সম্ভবত মাতৃগর্ভেই সে জেনে গেল, মানুষের নির্মম নিষ্ঠুরতা...।’
‘হুম্, খুবই দুঃখজনক। মর্মান্তিক। খারাপ লাগছে আমারও। ভাবছি, স্পেশাল বক্সে নিউজটা দেওয়া যায় কি না। তা, মেয়েটাকে কীভাবে খুন করেছে, বলো তো? ছুরি মেরে? গুলি করে? নাকি গলা টিপে, শ্বাসরুদ্ধ করে? অস্ত্রটস্ত্র কিছু পাওয়া গেছে আশপাশে—ছুরি? পিস্তল? দা? বঁটি? আচ্ছা, নাম কী ছিল মেয়েটির?’
‘মেয়েটির নাম ছিল জান্নাত। হতভাগী জান্নাতের কপালে নিশ্চয়ই জাহান্নামের আঁচ এসে লেগেছিল। নইলে কি আর সে কোনো লোকের দ্বিতীয় স্ত্রী হয়? হয়তো বাপ-মা ছিল না তার, থাকলেও ছিল খুবই দরিদ্র। হয়তো তারা কোনো রকমে মেয়েটিকে পার করতে পেরেই বেঁচে গিয়েছিল, হয়তো তারা জানতই না জান্নাতের স্বামীর আরেকটি বউ আছে, হয়তো জেনে-শুনেই...কে জানে...।’
‘না, না, কথায় কথায় দারিদ্র্য টেনে এনো না, অনেক সময় অসচেতনভাবেও হয়ে যায় এ রকম। ক্রিমিনালগুলো নিজেদের অতীত পরিচয় লুকিয়ে রেখে মেয়ের মা-বাবাকে এমনভাবে ইমপ্রেস করে ফেলে যে না বুঝেই তারা নিজের আদরের কন্যাটিকে একটা দম-বন্ধ-করা বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দেয়। আবার অনেক সময় নারীরা নিজেরাও আবেগ আর উত্তেজনার বশে আগপিছ কিছু না জেনে, না ভেবে পা দেয় প্রেমঘটিত প্রতারণার ফাঁদে। এই মেয়েটিরও হয়তো তা-ই হয়েছে, কে জানে? আর মা-বাবাও যদি বিয়ে দিয়ে থাকে, তারা কি আর জেনে-শুনে দিয়েছে? তারা কি আর জানত যে জান্নাত নির্মমভাবে খুন হবে? কোনো মা-বাবা কি সজ্ঞানে চায় তার সন্তান খুন হোক? জান্নাতের মা-বাবাও হয়তো চেয়েছিল, আর দশটা মেয়ের মতোই নির্ঝঞ্ঝাটে সংসার করুক তাদের মেয়ে, সুখী হোক।’
‘হুম্, হতে পারে মা-বাবার মতোই জান্নাতও সম্ভবত একটি সুন্দর সংসারের স্বপ্নই দেখেছিল—স্বামী-সন্তানের স্নেহ-আদরে ভরপুর হাসি-কান্নামুখরিত একটি সংসার। বেশির ভাগ বাঙালি নারীর ভেতরে যে গোপন আকাঙ্ক্ষাটি ছোটবেলা থেকেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, তেমনি জান্নাতও হয়তো এমন আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্ত ছিল না। কিন্তু জানেন, প্রতিবেশীরা বলল, জান্নাতের স্বামীর ইচ্ছা ছিল অন্য রকম। সন্তান নেওয়ার ব্যাপারে তার নাকি ঘোরতর আপত্তি ছিল, সে কখনোই চাইত না জান্নাতের পেটে বাচ্চা আসুক। জোর করে জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি খাওয়াত ওকে। চাপ দিত স্থায়ী কোনো পদ্ধতি নিতে। জান্নাত নিজেই গল্প করতে করতে, কথা প্রসঙ্গে এটা জানিয়েছিল প্রতিবেশীদের। কিন্তু সত্যি বলতে কি, জান্নাতের কোমল মন ছিল বাচ্চার জন্য উন্মুখ, সে প্রবলভাবে মা হতে চাইত। শিশুদের দেখলেই কেমন যেন উদাস হয়ে যেত সে। আশপাশের বাড়ির শিশুদের পাগল হয়ে কোলে নিত, আদর করত, চেপে ধরত বুকের সঙ্গে। হয়তো মাতৃত্বের অপ্রতিরোধ্য আকাঙ্ক্ষাতেই স্বামীর সতর্ক নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত সে নিজের সিদ্ধান্তেই গর্ভে সন্তান নিল।’
‘আচ্ছা, খোঁজ নিয়ে দেখেছ, জান্নাতের গর্ভের সন্তান তার স্বামীর ঔরসজাত কি না; নাকি অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল? হতে পারে পরকীয়া...খুব রসাল একটা নিউজ হবে কিন্তু...স্বামী যেহেতু সন্তান নিতে চায়ই না, তাই সে অনন্যোপায় হয়ে বিকল্প হিসেবে অন্য পুরুষের কাছ থেকে শুক্রাণু গ্রহণ করেছে। করতেই পারে, তাই না? স্ত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার দাম না দিয়ে স্বামীরা যদি শুধু নিজের মতামত তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চায়, তাহলে তো এমনটা ঘটা বিচিত্র নয়। আরে ভাই, যার সঙ্গে ঘর করো, সেই বউয়ের মনটা তো বুঝতে হবে, প্রয়োজনে তাকে বোঝাতে হবে। সেসব যদি না করো, আর তোমার স্ত্রী যদি অন্য লোকের কাছে যায়, গিয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণ করে, তাহলে স্ত্রীকে তো আর দোষ দেওয়া যায় না। আর সে কারণেই হয়তো সত্য ঘটনা জানতে পেরে তার স্বামী ক্ষিপ্ত হয়ে রাগে, ক্ষোভে কাণ্ডজ্ঞানশূন্য হয়ে, মানে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পেরে...কেই-বা সহ্য করতে পারে বলো স্ত্রীর দ্বিচারিতা? সব জেনে হয়তো স্বামীই তাকে খুন করে ফেলেছে। আচ্ছা এটা হত্যা, নাকি আত্মহত্যা, ভেবে দেখেছ? অন্য পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক করার জন্য অপরাধবোধের তাড়নায়, বিবেকের দংশনে জান্নাত নিজেই নিজেকে ধ্বংস করে দেয়নি তো...।’
‘না, আমি নিশ্চিত আত্মহত্যা নয়। এটা হত্যা। আর আত্মীয়স্বজনের ধারণা, জান্নাতকে হত্যা করেছে তার স্বামী।’
‘এই দেখো, সাসপেন্সটাই নষ্ট হয়ে গেল। আজকাল হরহামেশাই এ রকম ঘটনা ঘটছে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মাধুর্যগুলো নষ্ট হয়ে গেছে, বুঝেছ? অবিশ্বাস, সন্দেহ, প্রেমহীনতা—সব মিলিয়ে জন্ম নিচ্ছে তিক্ততা। তারপর একসময় চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে খুন। কী সাংঘাতিক! পূর্বাপর পরিণাম না ভেবে এমন একটা কাণ্ড করে ফেলা...উফ্।’
‘আত্মীয়স্বজন অভিযোগ করেছে, নির্যাতন করেই তার স্বামী জান্নাতকে মেরে ফেলেছে। অবশ্য জান্নাতের বড় বোনের ননদ বলছে, মৃত্যুর আগের দিন সন্ধ্যাবেলা সন্তানসম্ভবা জান্নাত নাকি হঠাৎ করেই পা পিছলে বাথরুমে পড়ে গিয়েছিল।’
‘হুম্, বাথরুম নিশ্চয়ই সাবান পড়ে পিচ্ছিল হয়েছিল, অথবা শ্যাওলা জমেছিল, অথবা হতে পারে মেয়েটির অসতর্কতা। এ রকম ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে, মানে গর্ভবতী মায়েদের তো একটু সতর্ক হয়ে চলাফেরা করতেই হয়। এ সময় যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে সেটা তো মা-বাচ্চা দুজনের জীবনের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ। তো, এটাকে খুন বলছ কেন তুমি? এ তো স্রেফ দুর্ঘটনা।’
‘হয়তো তা-ই। কে জানে? কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, বাথরুমে পড়ে যাওয়ার পরপরই রক্তক্ষরণ শুরু হয় তার। কিন্তু সেই অবস্থাতেও জান্নাতের স্বামী তাকে ডাক্তারের কাছে নেয়নি। উপরন্তু বকাঝকা করেছে। রাগ দেখিয়েছে। সারা রাত প্রচুর রক্ত গেছে জান্নাতের। বিছানার চাদর লাল রক্তে ভেসে গেছে। এত রক্ত যাওয়ায় একসময় প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়ে জান্নাত। সকালবেলা ওকে যখন আধমরা অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন সব শেষ। ডাক্তাররা বলছে, হয়তো হাসপাতালে আনার আগেই বা আনার পথেই কোনো একসময় মারা গেছে সে।’
‘নাহ্। এবার তো স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে স্বামীটাই ক্রিমিনাল। জান্নাতের এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য তার স্বামীই দায়ী। এটি অবশ্যই খুন—ঠান্ডা মাথায় মানুষ হত্যা। আচ্ছা, এই ঘটনায় কোনো মামলা হয়েছে? পুলিশ কী করছে?’
‘পুলিশ বলেছে, মেয়েটিকে নির্যাতন করে খুন করার অভিযোগ তারা শুনেছেন। তবে মৃত জান্নাতের সুরতহাল রিপোর্টে শরীরে আঘাত ও নির্যাতনের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। এ কারণে খুনের কেস নিতে চাইছে না তারা।’
‘বলো কী! পুলিশের মুখ আবার টাকাপয়সা দিয়ে বন্ধ করা হয়নি তো? জান্নাতের স্বামী কি খুব প্রভাবশালী কেউ? পলিটিশিয়ান? টাকাওয়ালা পার্টি? টাকা না থাকলে দুই-দুইটা বউ পালে কীভাবে? শুনেছি বড়লোকেরা নাকি এমন সব ঘটনা টাকার মাধ্যমে বেমালুম ধামাচাপা দিয়ে দেয়। এখানেও নিশ্চয়ই তা-ই হয়েছে। করে কী জান্নাতের স্বামী? ব্যবসায়ী? রাজনীতি করে? নাকি সরকারি কর্মকর্তা? দাও ব্যাটাকে ফাঁসিয়ে। এমনভাবে ঘটনাটা লেখো, যাতে ওর কঠিন সাজা হয়। তা কী করে জান্নাতের স্বামী? খোঁজ নিয়েছ? পালিয়ে যায়নি তো?’
‘না, পালায় নাই। আছে। আসলে জান্নাতের স্বামী একজন রিকশাচালক।’
‘কী বললা? এ্যাঁ? রিকশাওয়ালা?’
‘হ্যাঁ, দয়াগঞ্জ এলাকায় পাঁচ-ছয় বছর ধরে রিকশা চালায় সে।’
‘অ! রিকশাওয়ালারও দুই বউ?’
‘হ্যাঁ, এই ঘটনায় জান্নাতের স্বামী আলম মিয়াকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।’
‘ও, আচ্ছা। যাক, অনেক সময় নষ্ট করলা আমার। এক কাজ করো, আমাদের ভেতরের পাতার জন্য চার-পাঁচ লাইনের একটা ছোট্ট নিউজ লিখে দাও। অত ডিটেইল লেখার দরকার নাই, সংক্ষিপ্ত। আমি যাই, আমার আরও অনেক কাজ পড়ে আছে।’
‘খুন হয়েছে একজন অল্প বয়সী নারী, যে দেখতে ছিল সুন্দরী, যার গায়ের রং শ্যামলা, কিন্তু চেহারা-ছবি অসাধারণ। কালো চুলে ঘেরা কী যে মায়াময় একটা মুখ ছিল নারীটির, তার বিষণ্ন ফ্যাকাশে মরা মুখটা দেখে এলাম। আহা, তার পাতলা নাকে একটা নীল পাথরের নাকফুল ঝিকমিক করছিল। যেন প্রাণহীন মুখটায় নাকফুলটি একবিন্দু প্রাণের আলো। সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার কী জানেন? নারীটি ছিল অন্তঃসত্ত্বা—ছয় মাসের গর্ভবতী।’
‘বলো কী! এ তো দেখছি নৃশংস জোড়া খুন—মা ও শিশু হত্যা। নিউজটাকে খুব ভালো ট্রিটমেন্ট দিতে হবে। তা, অন্তঃসত্ত্বা নারীটি বিবাহিতা তো; নাকি বিয়েটিয়ে হয়নি? বিয়ের আগেই পেটে বাচ্চা এসে গিয়েছিল, আর সে জন্যই কি তাকে খুন হতে হলো? শুনেছি, ভারতবর্ষে নাকি প্রেম-ভালোবাসা আর শারীরিক সম্পর্কের জের ধরে সবচেয়ে বেশি খুনখারাবি হয়। বাংলাদেশেও একই ট্রেন্ড। তা, কে খুন করল মেয়েটিকে? তার বিশ্বাসঘাতক প্রেমিক? যে পেটে বাচ্চা দিয়ে পিতৃত্বের দায় অস্বীকার করতে চায়? নাকি কুমারী মেয়ের গর্ভে সন্তান আসায় সামাজিক সম্মান হারানোর ভয়ে ভীত মা-বাবাই খুন করল আত্মজাকে? অনেক সময় হয় তো এ রকম—পরিবারের সম্মান রক্ষার জন্য অবাধ্য মেয়েদের “অনার কিলিং” করা। সত্যি বেশ রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি হে! মনে হচ্ছে, পাবলিক নিউজটা খাবে, আজকাল যা ঘটছে না চারদিকে...।’
‘আরে না না, মেয়েটি অবিবাহিত নয়, বিবাহিতই। ঘটনা অন্যখানে। মেয়েটির স্বামীর নাকি আরেকটি স্ত্রী ছিল। যে মেয়ে খুন হলো, সে ছিল লোকটির দ্বিতীয় স্ত্রী। তার প্রথম পক্ষের স্ত্রী নাকি খুবই দাপুটে মহিলা। সেই ঘরে লোকটির নাকি আবার বড় বড় দুটি সন্তানও আছে—একটা ছেলে, একটা মেয়ে। সেই বউ-বাচ্চা রেখে এই মেয়েটিকে বিয়ে করেছিল লোকটা।’
‘বুঝেছি, সহজ কেস! প্রথম পক্ষের স্ত্রী ভাড়াটে খুনি দিয়ে মেয়েটিকে খুন করিয়েছে। সতিনের প্রতি চিরন্তন ঈর্ষা। তার ওপর আবার বাচ্চা পেটে! সতিনের সন্তানকে স্বামীর সম্পদের ভাগ দিতে হবে বলেই এই খুনোখুনি। সব খুনের পেছনেই দেখবে কোনো না-কোনো মনস্তাত্ত্বিক বা অর্থনৈতিক কারণ থাকে, বুঝেছ? আচ্ছা, কীভাবে কী ঘটল, সব খুলে বলো তো—তাড়াহুড়ো করে সাদামাটা বিবরণ না, ডিটেইল বলবে। খুঁটিনাটি কিচ্ছু বাদ দেবে না। তা, ডেডবডিটা এখন কোথায়?’
‘ডেডবডি তো মর্গে নিয়ে গেছে, লাশকাটা ঘরে হিম ঠান্ডায়। দেখে এলাম নিস্পন্দ মেয়েটি শুয়ে আছে একটা শক্ত কাঠের টেবিলে। মেয়েটির জরায়ুতে বড় হতে থাকা অর্ধশিশুটিও আছে ওর সঙ্গে, একইভাবে। হয়তো সেও মারা গেছে মায়ের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই, অথবা কয়েক সেকেন্ড পর। একদিন যে মা তাকে পৃথিবীতে এনেছিল, নিজের শরীরের ভেতরে যত্ন করে বাঁচিয়ে রেখেছিল, সেই মায়ের সঙ্গেই সে আবার চলে গেল অন্য কোনো প্রলম্বিত পৃথিবীতে। আমাদের এই পৃথিবীটা তার দেখাই হলো না। তার পরও খুব সম্ভবত মাতৃগর্ভেই সে জেনে গেল, মানুষের নির্মম নিষ্ঠুরতা...।’
‘হুম্, খুবই দুঃখজনক। মর্মান্তিক। খারাপ লাগছে আমারও। ভাবছি, স্পেশাল বক্সে নিউজটা দেওয়া যায় কি না। তা, মেয়েটাকে কীভাবে খুন করেছে, বলো তো? ছুরি মেরে? গুলি করে? নাকি গলা টিপে, শ্বাসরুদ্ধ করে? অস্ত্রটস্ত্র কিছু পাওয়া গেছে আশপাশে—ছুরি? পিস্তল? দা? বঁটি? আচ্ছা, নাম কী ছিল মেয়েটির?’
‘মেয়েটির নাম ছিল জান্নাত। হতভাগী জান্নাতের কপালে নিশ্চয়ই জাহান্নামের আঁচ এসে লেগেছিল। নইলে কি আর সে কোনো লোকের দ্বিতীয় স্ত্রী হয়? হয়তো বাপ-মা ছিল না তার, থাকলেও ছিল খুবই দরিদ্র। হয়তো তারা কোনো রকমে মেয়েটিকে পার করতে পেরেই বেঁচে গিয়েছিল, হয়তো তারা জানতই না জান্নাতের স্বামীর আরেকটি বউ আছে, হয়তো জেনে-শুনেই...কে জানে...।’
‘না, না, কথায় কথায় দারিদ্র্য টেনে এনো না, অনেক সময় অসচেতনভাবেও হয়ে যায় এ রকম। ক্রিমিনালগুলো নিজেদের অতীত পরিচয় লুকিয়ে রেখে মেয়ের মা-বাবাকে এমনভাবে ইমপ্রেস করে ফেলে যে না বুঝেই তারা নিজের আদরের কন্যাটিকে একটা দম-বন্ধ-করা বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দেয়। আবার অনেক সময় নারীরা নিজেরাও আবেগ আর উত্তেজনার বশে আগপিছ কিছু না জেনে, না ভেবে পা দেয় প্রেমঘটিত প্রতারণার ফাঁদে। এই মেয়েটিরও হয়তো তা-ই হয়েছে, কে জানে? আর মা-বাবাও যদি বিয়ে দিয়ে থাকে, তারা কি আর জেনে-শুনে দিয়েছে? তারা কি আর জানত যে জান্নাত নির্মমভাবে খুন হবে? কোনো মা-বাবা কি সজ্ঞানে চায় তার সন্তান খুন হোক? জান্নাতের মা-বাবাও হয়তো চেয়েছিল, আর দশটা মেয়ের মতোই নির্ঝঞ্ঝাটে সংসার করুক তাদের মেয়ে, সুখী হোক।’
‘হুম্, হতে পারে মা-বাবার মতোই জান্নাতও সম্ভবত একটি সুন্দর সংসারের স্বপ্নই দেখেছিল—স্বামী-সন্তানের স্নেহ-আদরে ভরপুর হাসি-কান্নামুখরিত একটি সংসার। বেশির ভাগ বাঙালি নারীর ভেতরে যে গোপন আকাঙ্ক্ষাটি ছোটবেলা থেকেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, তেমনি জান্নাতও হয়তো এমন আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্ত ছিল না। কিন্তু জানেন, প্রতিবেশীরা বলল, জান্নাতের স্বামীর ইচ্ছা ছিল অন্য রকম। সন্তান নেওয়ার ব্যাপারে তার নাকি ঘোরতর আপত্তি ছিল, সে কখনোই চাইত না জান্নাতের পেটে বাচ্চা আসুক। জোর করে জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি খাওয়াত ওকে। চাপ দিত স্থায়ী কোনো পদ্ধতি নিতে। জান্নাত নিজেই গল্প করতে করতে, কথা প্রসঙ্গে এটা জানিয়েছিল প্রতিবেশীদের। কিন্তু সত্যি বলতে কি, জান্নাতের কোমল মন ছিল বাচ্চার জন্য উন্মুখ, সে প্রবলভাবে মা হতে চাইত। শিশুদের দেখলেই কেমন যেন উদাস হয়ে যেত সে। আশপাশের বাড়ির শিশুদের পাগল হয়ে কোলে নিত, আদর করত, চেপে ধরত বুকের সঙ্গে। হয়তো মাতৃত্বের অপ্রতিরোধ্য আকাঙ্ক্ষাতেই স্বামীর সতর্ক নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত সে নিজের সিদ্ধান্তেই গর্ভে সন্তান নিল।’
‘আচ্ছা, খোঁজ নিয়ে দেখেছ, জান্নাতের গর্ভের সন্তান তার স্বামীর ঔরসজাত কি না; নাকি অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল? হতে পারে পরকীয়া...খুব রসাল একটা নিউজ হবে কিন্তু...স্বামী যেহেতু সন্তান নিতে চায়ই না, তাই সে অনন্যোপায় হয়ে বিকল্প হিসেবে অন্য পুরুষের কাছ থেকে শুক্রাণু গ্রহণ করেছে। করতেই পারে, তাই না? স্ত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার দাম না দিয়ে স্বামীরা যদি শুধু নিজের মতামত তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চায়, তাহলে তো এমনটা ঘটা বিচিত্র নয়। আরে ভাই, যার সঙ্গে ঘর করো, সেই বউয়ের মনটা তো বুঝতে হবে, প্রয়োজনে তাকে বোঝাতে হবে। সেসব যদি না করো, আর তোমার স্ত্রী যদি অন্য লোকের কাছে যায়, গিয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণ করে, তাহলে স্ত্রীকে তো আর দোষ দেওয়া যায় না। আর সে কারণেই হয়তো সত্য ঘটনা জানতে পেরে তার স্বামী ক্ষিপ্ত হয়ে রাগে, ক্ষোভে কাণ্ডজ্ঞানশূন্য হয়ে, মানে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পেরে...কেই-বা সহ্য করতে পারে বলো স্ত্রীর দ্বিচারিতা? সব জেনে হয়তো স্বামীই তাকে খুন করে ফেলেছে। আচ্ছা এটা হত্যা, নাকি আত্মহত্যা, ভেবে দেখেছ? অন্য পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক করার জন্য অপরাধবোধের তাড়নায়, বিবেকের দংশনে জান্নাত নিজেই নিজেকে ধ্বংস করে দেয়নি তো...।’
‘না, আমি নিশ্চিত আত্মহত্যা নয়। এটা হত্যা। আর আত্মীয়স্বজনের ধারণা, জান্নাতকে হত্যা করেছে তার স্বামী।’
‘এই দেখো, সাসপেন্সটাই নষ্ট হয়ে গেল। আজকাল হরহামেশাই এ রকম ঘটনা ঘটছে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মাধুর্যগুলো নষ্ট হয়ে গেছে, বুঝেছ? অবিশ্বাস, সন্দেহ, প্রেমহীনতা—সব মিলিয়ে জন্ম নিচ্ছে তিক্ততা। তারপর একসময় চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে খুন। কী সাংঘাতিক! পূর্বাপর পরিণাম না ভেবে এমন একটা কাণ্ড করে ফেলা...উফ্।’
‘আত্মীয়স্বজন অভিযোগ করেছে, নির্যাতন করেই তার স্বামী জান্নাতকে মেরে ফেলেছে। অবশ্য জান্নাতের বড় বোনের ননদ বলছে, মৃত্যুর আগের দিন সন্ধ্যাবেলা সন্তানসম্ভবা জান্নাত নাকি হঠাৎ করেই পা পিছলে বাথরুমে পড়ে গিয়েছিল।’
‘হুম্, বাথরুম নিশ্চয়ই সাবান পড়ে পিচ্ছিল হয়েছিল, অথবা শ্যাওলা জমেছিল, অথবা হতে পারে মেয়েটির অসতর্কতা। এ রকম ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে, মানে গর্ভবতী মায়েদের তো একটু সতর্ক হয়ে চলাফেরা করতেই হয়। এ সময় যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে সেটা তো মা-বাচ্চা দুজনের জীবনের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ। তো, এটাকে খুন বলছ কেন তুমি? এ তো স্রেফ দুর্ঘটনা।’
‘হয়তো তা-ই। কে জানে? কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, বাথরুমে পড়ে যাওয়ার পরপরই রক্তক্ষরণ শুরু হয় তার। কিন্তু সেই অবস্থাতেও জান্নাতের স্বামী তাকে ডাক্তারের কাছে নেয়নি। উপরন্তু বকাঝকা করেছে। রাগ দেখিয়েছে। সারা রাত প্রচুর রক্ত গেছে জান্নাতের। বিছানার চাদর লাল রক্তে ভেসে গেছে। এত রক্ত যাওয়ায় একসময় প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়ে জান্নাত। সকালবেলা ওকে যখন আধমরা অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন সব শেষ। ডাক্তাররা বলছে, হয়তো হাসপাতালে আনার আগেই বা আনার পথেই কোনো একসময় মারা গেছে সে।’
‘নাহ্। এবার তো স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে স্বামীটাই ক্রিমিনাল। জান্নাতের এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য তার স্বামীই দায়ী। এটি অবশ্যই খুন—ঠান্ডা মাথায় মানুষ হত্যা। আচ্ছা, এই ঘটনায় কোনো মামলা হয়েছে? পুলিশ কী করছে?’
‘পুলিশ বলেছে, মেয়েটিকে নির্যাতন করে খুন করার অভিযোগ তারা শুনেছেন। তবে মৃত জান্নাতের সুরতহাল রিপোর্টে শরীরে আঘাত ও নির্যাতনের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। এ কারণে খুনের কেস নিতে চাইছে না তারা।’
‘বলো কী! পুলিশের মুখ আবার টাকাপয়সা দিয়ে বন্ধ করা হয়নি তো? জান্নাতের স্বামী কি খুব প্রভাবশালী কেউ? পলিটিশিয়ান? টাকাওয়ালা পার্টি? টাকা না থাকলে দুই-দুইটা বউ পালে কীভাবে? শুনেছি বড়লোকেরা নাকি এমন সব ঘটনা টাকার মাধ্যমে বেমালুম ধামাচাপা দিয়ে দেয়। এখানেও নিশ্চয়ই তা-ই হয়েছে। করে কী জান্নাতের স্বামী? ব্যবসায়ী? রাজনীতি করে? নাকি সরকারি কর্মকর্তা? দাও ব্যাটাকে ফাঁসিয়ে। এমনভাবে ঘটনাটা লেখো, যাতে ওর কঠিন সাজা হয়। তা কী করে জান্নাতের স্বামী? খোঁজ নিয়েছ? পালিয়ে যায়নি তো?’
‘না, পালায় নাই। আছে। আসলে জান্নাতের স্বামী একজন রিকশাচালক।’
‘কী বললা? এ্যাঁ? রিকশাওয়ালা?’
‘হ্যাঁ, দয়াগঞ্জ এলাকায় পাঁচ-ছয় বছর ধরে রিকশা চালায় সে।’
‘অ! রিকশাওয়ালারও দুই বউ?’
‘হ্যাঁ, এই ঘটনায় জান্নাতের স্বামী আলম মিয়াকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।’
‘ও, আচ্ছা। যাক, অনেক সময় নষ্ট করলা আমার। এক কাজ করো, আমাদের ভেতরের পাতার জন্য চার-পাঁচ লাইনের একটা ছোট্ট নিউজ লিখে দাও। অত ডিটেইল লেখার দরকার নাই, সংক্ষিপ্ত। আমি যাই, আমার আরও অনেক কাজ পড়ে আছে।’
No comments