শাহবাগের জাগরণ ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে স্যালুট তারুণ্য-স্যালুট by কাশেম হুমায়ূন
মিছিলে-শ্লেস্নাগানে গোটা বাংলাদেশ যেন মিলেছে শাহবাগে। সারাদেশে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে তথ্যপ্রযুক্তিপ্রেমী বস্নগার তরুণ যুবকরা।
প্রতিদিন
লাখো মানুষের ঢল সেখানে। শাহবাগে উত্তাল তারুণ্যের মহাসমাবেশের দাবি একটাই
: 'যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি'। কেউ কেউ একে 'দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের ডাক' বলেও
আখ্যা দিচ্ছেন। আবার কারও কারও মন্তব্য : এ জাগরণ '৫২-এর ভাষা আন্দোলন,
'৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান বা '৭১-এর স্বাধীনতা আন্দোলনের মতো। কিন্তু আমার
উপলব্ধি একটু ভিন্ন। উপরোক্ত আন্দোলন-সংগ্রামগুলোতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও
অভিভাবকত্ব ছিল। শাহবাগে তা নয়। এ জাগরণটিই বাংলাদেশের একমাত্র জাতীয়
গুরুত্ববহ ঘটনা যেটি ঘটেছে কোন রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা নির্দেশনা ছাড়া। কোন
রাজনৈতিক দলের আদর্শও প্রচার করে না তারা। এ জাগরণের তেজ ছড়িয়ে পড়েছে
সারাদেশের সবখানে। শুধু শাহবাগেই নয়, দেশের জেলা শহরগুলোর প্রায় সব শহীদ
মিনার এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো মুখরিত রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে। তাদের
প্রতিজ্ঞা : কাদের মোল্লাসহ সব রাজাকারের সর্বোচ্চ শাস্তির রায় না পাওয়া
পর্যন্ত দমবে না এ মহাজাগরণ। সারাদেশের জাগরণী মঞ্চে উচ্চারিত হচ্ছে
বাঙালির সেই রণধ্বনি 'জয় বাংলা'। যে রণধ্বনি দিয়ে একাত্তরে বাঙালি
মুক্তিযুদ্ধ করেছে, কাঁপন ধরিয়েছে পরাক্রমশালী পাকিস্তানি বাহিনীর দুর্গে।
অথচ '৭৫ পরবর্তী ধর্মাশ্রয়ী সামরিক রাজনীতি স্তব্ধ করেছে বাঙালির
রণধ্বনিকে। জয় বাংলার জয়গানে তারা প্রতিস্থাপন করেছে পাকিস্তানের আদলে
'বাংলাদেশ জিন্দাবাদ' ধ্বনি। এ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সেই রণধ্বনি ফিরিয়ে
দেয়ার পাশাপাশি জাতিকে ফিরিয়ে দিয়েছে তার পরিচয়ের ঠিকানা, 'জয় বাংলা, তোমার
আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা'সহ তেজোদীপ্ত শ্লোগানগুলো।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি নতুন নয়। এটি হঠাৎ আরোপ করা কোন ইস্যুও নয়। কিন্তু এ দাবিতে এমন গণজাগরণের আয়োজনটি অভূতপূর্ব ও অনন্য। রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে পাশ কাটিয়ে এ প্রজন্মের তারুণ্য সেই ম্যাজিকটি দেখিয়ে দিয়েছে। তবে ব্যাপক আয়োজনে যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবি যে করা যায়, তার পথদ্রষ্টা শহীদ জননী জাহানারা ইমাম- সেই সত্যও স্বীকার না করলে অপরাধী হতে হবে। তিনি সেই দাবি না তুললে হয়তো ইস্যুটি এ পর্যন্ত আসত না। ইতিহাসের নির্মমতা হচ্ছে সেই শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এ দেশের মাটিতে 'রাষ্ট্রদ্রোহ' মামলা মাথায় নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। আজ শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করছি সেই মহান মাকে। জাহানারা ইমাম তার অনাগত সন্তানদের ভেতর যুদ্ধাপরাধীদের নিশ্চিহ্ন করার যে বীজমন্ত্র রোপণ করে গিয়েছিলেন শাহবাগের তরুণরা তা-ই প্রমাণ দিচ্ছে।
শাহবাগের তরুণদের দেয়া বার্তা যারা কান পেতে শুনছেন না তারা বাস করছেন অবাস্তব দুনিয়ায়। তারুণ্যের এই দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ এ বাস্তবতাবিরোধীদের বিরুদ্ধেও গর্জে উঠবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য পার হচ্ছে একটি শিক্ষণীয় মুহূর্ত। তারা এর তাৎপর্য উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলে পরিণতি সুখকর হবে না। বিশেষ করে এ আন্দোলনের সূচনা ঘটিয়েছে তরুণ প্রজন্ম, যাদের কোন দলভিত্তিক রাজনৈতিক পরিচয় নেই। ঐক্যবদ্ধ এ তারুণ্যের ছটা শুধু ঢাকায় নয়; চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, বরিশালসহ দেশের প্রায় সব বড় শহরে ছড়িয়ে পড়েছে এক অভাবিত নতুন গণবিস্ফোরণ। বিশেষভাবে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে তাদের এ আন্দোলন একদিকে তেজস্বী, অন্যদিকে অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ এবং অহিংস। তারা তাদের দাবিগুলো তুলে ধরছে গানে, শ্লোগানে ও বক্তৃতায়। তাদের আবেগের প্রকাশ ঘটছে পোস্টারে, ব্যানারে ফেস্টুনে, রাজপথে অাঁকা নকশায়। সেখানে হাজার হাজার নারী-পুরুষ-শিশু সমবেত হচ্ছে। কিন্তু কেউ কাউকে ধাক্কা দেয় না। কোন মস্তানি-সন্ত্রাস নেই। নেই মঞ্চ বা মাইক দখলের লড়াই। কেউ খাবার আনলে কয়েকজন মিলে ভাগ করে খাচ্ছে। বসার জায়গা করে দিচ্ছে। এ যেন একাত্তরের কোন মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে সহযোদ্ধাদের সহাবস্থান। একাত্তরের দিনগুলোতে আমরা তো এটাই দেখেছি। রাজনৈতিক দলগুলোকে, সমাজের বিভিন্ন অংশের যারা নেতৃস্থানীয় রয়েছেন তাদের এ জাগরণ অবশ্যই আমলে নিতে হবে। যারা এ বাস্তবতা অগ্রাহ্য করবেন অবর্ণনীয় পরিণতি তাদের জন্য অবধারিত।
তরুণ সমাজের নাড়ির স্পন্দন উপলব্ধি করতে রাজনৈতিক দলগুলো ব্যর্থ হলে নির্ঘাত পস্তাতে হবে। এ ব্যর্থতার কঠিন মাশুল গুনতে হবে। সব রাজনৈতিক দলকে বুঝে নিতে হবে, যুদ্ধাপরাদের বিচারের বিষয়টি রাজনৈতিক লাভ-লোকসান হিসাব করার বিষয় নয়। এটি কোন রাজনীতির বা ভোটের পণ্য নয়। দুর্নীতি, ধাপ্পাবাজি-গোজামিলের রাস্তায় যারা রাজনীতিতে আসন গড়তে চান তাদের একটি বিপদ সংকেতই দেখাচ্ছে তরুণরা। দুর্নীতি-চাতুরিতে অভ্যস্তদের এখন সাবধান হওয়া ছাড়া কোন পথ খোলা নেই।
ক্ষমতাসীনদের উপলব্ধি করা জরুরি যুদ্ধাপরাধের বিচার তাদের অন্য নির্বাচনী অঙ্গীকারগুলোর মতো নয়। এটি কোন সাধারণ অঙ্গীকার নয়। বিচার প্রক্রিয়ার কোন পর্যায়ে কোন ক্ষেত্রে সামান্যতম দুর্বলতা, অদক্ষতার সুযোগ নেই এ উপলব্ধিতে এসে সরকারকে যে ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিতে হয়েছে সেটাও তারুণ্যেরই জয়। বিরোধীদল বিএনপির উপলব্ধি করা জরুরি যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি কেবলই আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ নয় এটি একটি জনদাবি। এ বাস্তবতা উপেক্ষা করার কোন সুযোগ নেই। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, জনতার আন্দোলন সফল হবে। আবার তার দলই যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে এক সঙ্গে চলছে। কান পেতে শুনুন এ ধরনের সাংঘর্ষিক ও চাতুরিপূর্ণ রাজনীতির বিরুদ্ধেও মেসেজ দিচ্ছে শাহবাগের তরুণরা।
রাজনৈতিক দল বা রাজনীতিকরা উপলব্ধি করুন বা নাই করুন তরুণ সমাজের এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যুক্তিযুদ্ধের চেতনার নবায়ন তথা নতুন উন্মেষ ঘটছে। আশা করা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের সুষ্ঠু বিচার হবে। উচিত শাস্তি হবে অপরাধীদের। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গ্লানিমুক্ত হতে আর বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে না।
নীরব শান্তিপ্রিয় বাঙালি প্রয়োজনে গর্জে উঠতে পারে তাও আরেকবার দেখা গেল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যখন যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লাকে ফাঁসির পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়েছেন, বাঙালি তখন বুঝে নিয়েছে গুরুপাপে এ লঘুদ- প্রকারান্তরে এক অন্যায়। তা মেনে নেয়া যায় না। এটা মেনে নেয়া মানে যুদ্ধাপরাধীদের আশকারা দেয়া, যুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্বজনদের অনুভূতিকে আঘাত দেয়া। মুক্তিযুদ্ধের শহীদ এবং বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে বেইমানি করা। মানুষ আইনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মারপ্যাঁচ বুঝতে চায়নি, তারা মোটা দাগে বুঝেছে হত্যা-ধর্ষণের শাস্তি একমাত্র মৃতুদ-ই।
জাতি লজ্জিত হয়েছে কাদের মোল্লার আস্ফালনে। এ হায়েনা 'ভি' চিহ্ন দেখিয়ে প্রকারান্তরে জাতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলিই দেখিয়েছে। তরুণ প্রজন্ম তা সহ্য করেনি। জ্বলে উঠেছে সঙ্গে সঙ্গে। এ জ্বালা-যন্ত্রণার আনুষ্ঠানিক ভ্যানু তারা করেছে শাহবাগকে। এ কারণে শাহবাগ এখন শুধু একটি স্থানের নাম নয়। এটি আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
আমরা যারা ১৯৭১ সাল দেখেছি, কঠিন যন্ত্রণা সহ্য করেছি এবং এখনও ক্ষত ও বেদনা বয়ে চলেছি, তাদের সঙ্গে এ প্রজন্মের বয়সের ব্যবধান অনেক। একাত্তর-পরবর্তী দুই বা তিনটি প্রজন্ম এখন বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে এ প্রজন্মও যে চেতনাগতভাবে একাত্তরের মন্ত্রে উজ্জীবিত তা প্রমাণ হলো শাহবাগে। এটা আমাদের জন্য অবশ্যই শুধু সংবাদ এবং আমরা যা শুরু করে শেষ করতে পারিনি, তরুণ-তরুণীদের সেটা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ_ এটা অবশ্যই ভরসার কথা।
বলার অপেক্ষা রাখে না এ প্রজন্ম একাত্তরের কথা শুনেছে, দেখেনি। বইয়ে পড়েছে, সিনেমায় দেখেছে। বাকিটা আপডেট হয়েছে ইন্টারনেটে। এক্ষেত্রে আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলব। ২০০৪ এবং এ বছরের জানুয়ারি মাসে অনেকের মতো আমিও যেন অপেক্ষা করছিলাম এমন একটি বিস্ফোরণের জন্য। বিলম্বে হলেও তা ঘটেছে তারুণ্যের উচ্ছলতায়। ঘরে ঘরে এর ডাক ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এমন স্বতঃস্ফূর্ততা কতদিন যে দেখেনি_ ঠিক মনে করতে পারছি না।
স্যালুট তারুণ্য_ তোমাদের স্যালুট।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি নতুন নয়। এটি হঠাৎ আরোপ করা কোন ইস্যুও নয়। কিন্তু এ দাবিতে এমন গণজাগরণের আয়োজনটি অভূতপূর্ব ও অনন্য। রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে পাশ কাটিয়ে এ প্রজন্মের তারুণ্য সেই ম্যাজিকটি দেখিয়ে দিয়েছে। তবে ব্যাপক আয়োজনে যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবি যে করা যায়, তার পথদ্রষ্টা শহীদ জননী জাহানারা ইমাম- সেই সত্যও স্বীকার না করলে অপরাধী হতে হবে। তিনি সেই দাবি না তুললে হয়তো ইস্যুটি এ পর্যন্ত আসত না। ইতিহাসের নির্মমতা হচ্ছে সেই শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এ দেশের মাটিতে 'রাষ্ট্রদ্রোহ' মামলা মাথায় নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। আজ শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করছি সেই মহান মাকে। জাহানারা ইমাম তার অনাগত সন্তানদের ভেতর যুদ্ধাপরাধীদের নিশ্চিহ্ন করার যে বীজমন্ত্র রোপণ করে গিয়েছিলেন শাহবাগের তরুণরা তা-ই প্রমাণ দিচ্ছে।
শাহবাগের তরুণদের দেয়া বার্তা যারা কান পেতে শুনছেন না তারা বাস করছেন অবাস্তব দুনিয়ায়। তারুণ্যের এই দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ এ বাস্তবতাবিরোধীদের বিরুদ্ধেও গর্জে উঠবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য পার হচ্ছে একটি শিক্ষণীয় মুহূর্ত। তারা এর তাৎপর্য উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলে পরিণতি সুখকর হবে না। বিশেষ করে এ আন্দোলনের সূচনা ঘটিয়েছে তরুণ প্রজন্ম, যাদের কোন দলভিত্তিক রাজনৈতিক পরিচয় নেই। ঐক্যবদ্ধ এ তারুণ্যের ছটা শুধু ঢাকায় নয়; চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, বরিশালসহ দেশের প্রায় সব বড় শহরে ছড়িয়ে পড়েছে এক অভাবিত নতুন গণবিস্ফোরণ। বিশেষভাবে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে তাদের এ আন্দোলন একদিকে তেজস্বী, অন্যদিকে অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ এবং অহিংস। তারা তাদের দাবিগুলো তুলে ধরছে গানে, শ্লোগানে ও বক্তৃতায়। তাদের আবেগের প্রকাশ ঘটছে পোস্টারে, ব্যানারে ফেস্টুনে, রাজপথে অাঁকা নকশায়। সেখানে হাজার হাজার নারী-পুরুষ-শিশু সমবেত হচ্ছে। কিন্তু কেউ কাউকে ধাক্কা দেয় না। কোন মস্তানি-সন্ত্রাস নেই। নেই মঞ্চ বা মাইক দখলের লড়াই। কেউ খাবার আনলে কয়েকজন মিলে ভাগ করে খাচ্ছে। বসার জায়গা করে দিচ্ছে। এ যেন একাত্তরের কোন মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে সহযোদ্ধাদের সহাবস্থান। একাত্তরের দিনগুলোতে আমরা তো এটাই দেখেছি। রাজনৈতিক দলগুলোকে, সমাজের বিভিন্ন অংশের যারা নেতৃস্থানীয় রয়েছেন তাদের এ জাগরণ অবশ্যই আমলে নিতে হবে। যারা এ বাস্তবতা অগ্রাহ্য করবেন অবর্ণনীয় পরিণতি তাদের জন্য অবধারিত।
তরুণ সমাজের নাড়ির স্পন্দন উপলব্ধি করতে রাজনৈতিক দলগুলো ব্যর্থ হলে নির্ঘাত পস্তাতে হবে। এ ব্যর্থতার কঠিন মাশুল গুনতে হবে। সব রাজনৈতিক দলকে বুঝে নিতে হবে, যুদ্ধাপরাদের বিচারের বিষয়টি রাজনৈতিক লাভ-লোকসান হিসাব করার বিষয় নয়। এটি কোন রাজনীতির বা ভোটের পণ্য নয়। দুর্নীতি, ধাপ্পাবাজি-গোজামিলের রাস্তায় যারা রাজনীতিতে আসন গড়তে চান তাদের একটি বিপদ সংকেতই দেখাচ্ছে তরুণরা। দুর্নীতি-চাতুরিতে অভ্যস্তদের এখন সাবধান হওয়া ছাড়া কোন পথ খোলা নেই।
ক্ষমতাসীনদের উপলব্ধি করা জরুরি যুদ্ধাপরাধের বিচার তাদের অন্য নির্বাচনী অঙ্গীকারগুলোর মতো নয়। এটি কোন সাধারণ অঙ্গীকার নয়। বিচার প্রক্রিয়ার কোন পর্যায়ে কোন ক্ষেত্রে সামান্যতম দুর্বলতা, অদক্ষতার সুযোগ নেই এ উপলব্ধিতে এসে সরকারকে যে ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিতে হয়েছে সেটাও তারুণ্যেরই জয়। বিরোধীদল বিএনপির উপলব্ধি করা জরুরি যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি কেবলই আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ নয় এটি একটি জনদাবি। এ বাস্তবতা উপেক্ষা করার কোন সুযোগ নেই। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, জনতার আন্দোলন সফল হবে। আবার তার দলই যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে এক সঙ্গে চলছে। কান পেতে শুনুন এ ধরনের সাংঘর্ষিক ও চাতুরিপূর্ণ রাজনীতির বিরুদ্ধেও মেসেজ দিচ্ছে শাহবাগের তরুণরা।
রাজনৈতিক দল বা রাজনীতিকরা উপলব্ধি করুন বা নাই করুন তরুণ সমাজের এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যুক্তিযুদ্ধের চেতনার নবায়ন তথা নতুন উন্মেষ ঘটছে। আশা করা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের সুষ্ঠু বিচার হবে। উচিত শাস্তি হবে অপরাধীদের। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গ্লানিমুক্ত হতে আর বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে না।
নীরব শান্তিপ্রিয় বাঙালি প্রয়োজনে গর্জে উঠতে পারে তাও আরেকবার দেখা গেল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যখন যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লাকে ফাঁসির পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়েছেন, বাঙালি তখন বুঝে নিয়েছে গুরুপাপে এ লঘুদ- প্রকারান্তরে এক অন্যায়। তা মেনে নেয়া যায় না। এটা মেনে নেয়া মানে যুদ্ধাপরাধীদের আশকারা দেয়া, যুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্বজনদের অনুভূতিকে আঘাত দেয়া। মুক্তিযুদ্ধের শহীদ এবং বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে বেইমানি করা। মানুষ আইনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মারপ্যাঁচ বুঝতে চায়নি, তারা মোটা দাগে বুঝেছে হত্যা-ধর্ষণের শাস্তি একমাত্র মৃতুদ-ই।
জাতি লজ্জিত হয়েছে কাদের মোল্লার আস্ফালনে। এ হায়েনা 'ভি' চিহ্ন দেখিয়ে প্রকারান্তরে জাতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলিই দেখিয়েছে। তরুণ প্রজন্ম তা সহ্য করেনি। জ্বলে উঠেছে সঙ্গে সঙ্গে। এ জ্বালা-যন্ত্রণার আনুষ্ঠানিক ভ্যানু তারা করেছে শাহবাগকে। এ কারণে শাহবাগ এখন শুধু একটি স্থানের নাম নয়। এটি আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
আমরা যারা ১৯৭১ সাল দেখেছি, কঠিন যন্ত্রণা সহ্য করেছি এবং এখনও ক্ষত ও বেদনা বয়ে চলেছি, তাদের সঙ্গে এ প্রজন্মের বয়সের ব্যবধান অনেক। একাত্তর-পরবর্তী দুই বা তিনটি প্রজন্ম এখন বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে এ প্রজন্মও যে চেতনাগতভাবে একাত্তরের মন্ত্রে উজ্জীবিত তা প্রমাণ হলো শাহবাগে। এটা আমাদের জন্য অবশ্যই শুধু সংবাদ এবং আমরা যা শুরু করে শেষ করতে পারিনি, তরুণ-তরুণীদের সেটা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ_ এটা অবশ্যই ভরসার কথা।
বলার অপেক্ষা রাখে না এ প্রজন্ম একাত্তরের কথা শুনেছে, দেখেনি। বইয়ে পড়েছে, সিনেমায় দেখেছে। বাকিটা আপডেট হয়েছে ইন্টারনেটে। এক্ষেত্রে আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলব। ২০০৪ এবং এ বছরের জানুয়ারি মাসে অনেকের মতো আমিও যেন অপেক্ষা করছিলাম এমন একটি বিস্ফোরণের জন্য। বিলম্বে হলেও তা ঘটেছে তারুণ্যের উচ্ছলতায়। ঘরে ঘরে এর ডাক ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এমন স্বতঃস্ফূর্ততা কতদিন যে দেখেনি_ ঠিক মনে করতে পারছি না।
স্যালুট তারুণ্য_ তোমাদের স্যালুট।
No comments