রাজিয়া শহীদের মৃত্যু ও প্রাসঙ্গিক কথা by জয়নাল আবেদীন
রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডখ্যাত রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, লেখক ও মুক্তিযোদ্ধা
কমরেড আবদুস শহীদের স্ত্রী রাজিয়া শহীদ গত ০১.০২.২০১৩ তারিখ বিকেলে ঢাকা
মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসারত অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন।
তিনি
হাতিরঝিল সংলগ্ন উলনের বাড়ির ছাদে নির্মাণ শ্রমিকদের কাজের তদারকি করা সময়
গত ২৪.০১.২০১৩ বৈদ্যুতিক তার থেকে সৃষ্ট অগি্নস্ফুলিঙ্গ থেকে অগি্নদগ্ধ
হয়ে হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হন। ৫-৬ দিন মৃত্যুর সাথে লড়ে শেষ
পর্যন্ত অজানার দেশে পাড়ি জমালেন। তার কন্যা তানিয়ার কাছে সারাশরীর অগি্নতে
দগ্ধ হওয়ার বিবরণ শুনে আমি ইচ্ছে করেই হাসপাতালে যাইনি। যদিও ০২.০২.১৩
তারিখ দুপুরে হাসপাতালে যাওয়ার কথা চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু তার আগেই
টেলিফোনে তার মৃত্যু সংবাদ পাই। তার এ মৃত্যু পরিচিতজনদের জন্য খুবই দুঃখ ও
বেদনার। টেলিফোনে আমাকে জানানো হয়েছিল বাদ যোহর উলন জামে মসজিদে নামাজে
জানাজা হবে। সময়মতো উলন মসজিদে গিয়ে জানাজার কোন আলামত না দেখে হাতিরঝিল
গিয়ে ভাড়া বাসা খুঁজে পাই। নিচে কাঠের বাক্সে রাজিয়া শহীদ চিরনিদ্রায়
শায়িত। ছোট কন্যা জয়া শহীদ আমাকে দোতলায় নিয়ে যায়। সেখানে বড় কন্যা তানিয়া
শুধু 'মা মা মা' বলে কান্না করছে আর বারবার মূর্ছা যাচ্ছে। এক ভদ্রমহিলা
তানিয়াকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। পরিস্থিতি এতই বেদনাদায়ক যে, তানিয়া, জয়া ও
পাভেলকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষাও আমার জানা ছিল না।
কমরেড আবদুস শহীদ ছাত্রাবস্থায় ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছিলেন। ১৯৪৩ সালের গ্র্যাজুয়েট আবদুস শহীদ ছিলেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের পার্শ্ববর্তী গ্রাম খলিশাকোঠার সন্তান। বিএ পাস করার সংবাদ জেনে বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী একে ফজলুল হক আবদুস শহীদকে ডেকে নিয়ে কলকাতা পোর্টে প্রথম শ্রেণীর চাকরিতে যোগদান করতে বলেছিলেন। কিন্তু পার্টির নির্দেশে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ না দিয়ে সাংবাদিকতা পেশায় যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশ ভাগ হলে বামপন্থিদের ওপর পাকিস্তান সরকারের দমননীতির ফলে কমরেড আবদুস শহীদ দীর্ঘ কয়েক বছর কারাভোগ করেন। ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহী জেলে খাপড়া ওয়ার্ডে গুলিবর্ষণের ফলে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হয়ে পঙ্গুত্ব নিয়ে অভাব-অনটনের সঙ্গে জীবন অতিবাহিত করেন। ১৯৫৮-৬০ সালে বিক্রমপুরের ষোলঘর এ কে এস কে উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতাকালীন সময়ে শীতকালে পার্টির এক সদস্য তার বাসায় বেড়াতে যান। আবদুস শহীদের বাসায় শীত নিবারণের জন্য তখন মাত্র একটি লেপ ও ২-৩টি কাঁথা ছিল। তিনি রাতে ঘুমানোর সময় কমরেডকে লেপ দিয়ে নিজেরা কাঁথা গায়ে ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নেন। এ সামান্য ঘটনা থেকে স্ত্রীর সঙ্গে মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি হয়। যা শেষ পর্যন্ত বিবাহবিচ্ছেদে রূপ নেয়।
রাজিয়া শহীদ ছিলেন আবদুস শহীদের দ্বিতীয় স্ত্রী। তিনি ছিলেন আবদুস শহীদের শেষ জীবনের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। আবদুস শহীদ শেষ জীবনে কোন পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। নিজেকে 'ব্যক্তি কমিউনিস্ট' পরিচয় দিতেন। সংবাদপত্রে লেখালেখির প্রাপ্ত সম্মানী ও নিজের লেখা বই বিক্রির টাকা দিয়েই সংসার চালাতেন। রাজিয়া শহীদ স্বামীর মৃত্যুর পর বহু কষ্ট ও সংগ্রামের মধ্যে দু'কন্যা ও এক পুত্রসন্তান নিয়ে সংসারের হাল ধরেন। সারাজীবনের সঞ্চয় ও গ্রামের ভিটা-জমি বিক্রি করে উলনে গড়েছিলেন তিনতলা একটি দালান। যা হাতিরঝিল প্রকল্পে চলে যায়। বাড়িটির দক্ষিণের সামান্য অংশ আন্দোলন-সংগ্রাম করে তিনি রক্ষা করেছিলেন। বাড়ির এ ছোট অংশেই কন্যা-পুত্রসহ বসবাসের আশা নিয়ে নির্মাণ শ্রমিকদের কাজের তদারকি করতে গিয়ে ছাদের উপর দিয়ে নেয়া বৈদ্যুতিক তার থেকে অগি্নস্ফুলিঙ্গ এসে তার গায়ে পড়ে শরীর ঝলসে দেয় চোখের পলকে। ৫-৬ দিন মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেন।
তার বাড়ির উপর থেকে বৈদ্যুতিক তার স্থানান্তর করার জন্য তিনি ১২.১১.১২ তারিখে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বরাবর লিখিত আবেদনে বলেছিলেন, 'তার সরিয়ে না নিলে যে কোন মুহুর্তে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।' ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লি. যদি তার আবেদন বিবেচনায় এনে কার্যকর ব্যবস্থা নিতেন তা হলে রাজিয়া শহীদের অকাল মৃত্যু হতো না।
বাড়ি রক্ষার জন্য তিনি একপর্যায়ে অনশন করেন। সরকারের পক্ষ থেকে স্থানীয় সংসদ সদস্য অনশন ভঙ্গ করিয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বাড়িটি রক্ষা করার। কিন্তু সে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়নি। যদি এ পরিবারটিকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে একটি ফ্ল্যাটে পুনর্বাসিত করা হতো বা বাড়ির বেঁচে যাওয়া অংশের উপর থেকে বৈদ্যুতিক তার সরিয়ে নেয়া হতো তাহলে রাজিয়া শহীদকে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করতে হতো না। আশা করি তার দুই কন্যা ও এক পুত্রের বসবাসের জন্য সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
[লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও ব্যাংকার]
কমরেড আবদুস শহীদ ছাত্রাবস্থায় ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছিলেন। ১৯৪৩ সালের গ্র্যাজুয়েট আবদুস শহীদ ছিলেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের পার্শ্ববর্তী গ্রাম খলিশাকোঠার সন্তান। বিএ পাস করার সংবাদ জেনে বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী একে ফজলুল হক আবদুস শহীদকে ডেকে নিয়ে কলকাতা পোর্টে প্রথম শ্রেণীর চাকরিতে যোগদান করতে বলেছিলেন। কিন্তু পার্টির নির্দেশে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ না দিয়ে সাংবাদিকতা পেশায় যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশ ভাগ হলে বামপন্থিদের ওপর পাকিস্তান সরকারের দমননীতির ফলে কমরেড আবদুস শহীদ দীর্ঘ কয়েক বছর কারাভোগ করেন। ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহী জেলে খাপড়া ওয়ার্ডে গুলিবর্ষণের ফলে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হয়ে পঙ্গুত্ব নিয়ে অভাব-অনটনের সঙ্গে জীবন অতিবাহিত করেন। ১৯৫৮-৬০ সালে বিক্রমপুরের ষোলঘর এ কে এস কে উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতাকালীন সময়ে শীতকালে পার্টির এক সদস্য তার বাসায় বেড়াতে যান। আবদুস শহীদের বাসায় শীত নিবারণের জন্য তখন মাত্র একটি লেপ ও ২-৩টি কাঁথা ছিল। তিনি রাতে ঘুমানোর সময় কমরেডকে লেপ দিয়ে নিজেরা কাঁথা গায়ে ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নেন। এ সামান্য ঘটনা থেকে স্ত্রীর সঙ্গে মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি হয়। যা শেষ পর্যন্ত বিবাহবিচ্ছেদে রূপ নেয়।
রাজিয়া শহীদ ছিলেন আবদুস শহীদের দ্বিতীয় স্ত্রী। তিনি ছিলেন আবদুস শহীদের শেষ জীবনের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। আবদুস শহীদ শেষ জীবনে কোন পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। নিজেকে 'ব্যক্তি কমিউনিস্ট' পরিচয় দিতেন। সংবাদপত্রে লেখালেখির প্রাপ্ত সম্মানী ও নিজের লেখা বই বিক্রির টাকা দিয়েই সংসার চালাতেন। রাজিয়া শহীদ স্বামীর মৃত্যুর পর বহু কষ্ট ও সংগ্রামের মধ্যে দু'কন্যা ও এক পুত্রসন্তান নিয়ে সংসারের হাল ধরেন। সারাজীবনের সঞ্চয় ও গ্রামের ভিটা-জমি বিক্রি করে উলনে গড়েছিলেন তিনতলা একটি দালান। যা হাতিরঝিল প্রকল্পে চলে যায়। বাড়িটির দক্ষিণের সামান্য অংশ আন্দোলন-সংগ্রাম করে তিনি রক্ষা করেছিলেন। বাড়ির এ ছোট অংশেই কন্যা-পুত্রসহ বসবাসের আশা নিয়ে নির্মাণ শ্রমিকদের কাজের তদারকি করতে গিয়ে ছাদের উপর দিয়ে নেয়া বৈদ্যুতিক তার থেকে অগি্নস্ফুলিঙ্গ এসে তার গায়ে পড়ে শরীর ঝলসে দেয় চোখের পলকে। ৫-৬ দিন মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেন।
তার বাড়ির উপর থেকে বৈদ্যুতিক তার স্থানান্তর করার জন্য তিনি ১২.১১.১২ তারিখে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বরাবর লিখিত আবেদনে বলেছিলেন, 'তার সরিয়ে না নিলে যে কোন মুহুর্তে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।' ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লি. যদি তার আবেদন বিবেচনায় এনে কার্যকর ব্যবস্থা নিতেন তা হলে রাজিয়া শহীদের অকাল মৃত্যু হতো না।
বাড়ি রক্ষার জন্য তিনি একপর্যায়ে অনশন করেন। সরকারের পক্ষ থেকে স্থানীয় সংসদ সদস্য অনশন ভঙ্গ করিয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বাড়িটি রক্ষা করার। কিন্তু সে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়নি। যদি এ পরিবারটিকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে একটি ফ্ল্যাটে পুনর্বাসিত করা হতো বা বাড়ির বেঁচে যাওয়া অংশের উপর থেকে বৈদ্যুতিক তার সরিয়ে নেয়া হতো তাহলে রাজিয়া শহীদকে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করতে হতো না। আশা করি তার দুই কন্যা ও এক পুত্রের বসবাসের জন্য সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
[লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও ব্যাংকার]
No comments