জনগণের দাবি অপ্রতিরোধ্য by মাহমুদুল বাসার
শাহবাগের বিশাল মহাসমাবেশ থেকে বজ্রগর্জনে সেস্নাগান উঠেছে রাজাকারের ফাঁসি চাই। কাদের মোল্লাসহ সব যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি চাই।
সেস্নাগান
উঠেছে, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। জামায়াতের অবৈধ আয়ের সব
উৎস বন্ধ করার দাবি উঠেছে। নাম ধরে বলা হয়েছে, ইসলামী-ব্যাংক জাতীয়করণ
করতে হবে, দৈনিক 'আমার দেশ' সংগ্রাম বন্ধ করতে হবে, নয়াদিগন্ত টিভি চ্যানেল
বন্ধ করতে হবে। অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার শাহবাগ স্কয়ারে ১৯৭১ এর রণধ্বনি জয়
বাংলা সেস্নাগান উচ্চারিত হয়েছে।
৮-০২-১৩ তারিখ শাহবাগের মহাসমাবেশে যে শপথ বাণী পাঠ করা হয়েছে তার মর্মাবাণী উপলব্ধি করার সময় এসেছে। মুষ্টিবদ্ধ হাত। দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ : একাত্তরের সব রাজাকার, গণহত্যা আর ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি, মৃত্যুদ- নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত গণমানুষের নেতৃত্বে এ গণজাগরণ চলবে। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত গণমঞ্চ তৈরি করে আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে হবে। রাষ্ট্রদ্রোহী জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন অব্যাহত রাখব।
আরো উচ্চারিত হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের ব্যবসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বয়কট করাসহ তাদের সামাজিকভাবে বয়বট করব। এখানে গাওয়া হয়েছে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত আমাদের জাতীয় সংগীত। পাঠক নিশ্চয়ই জানেন, জামায়াত এই জাতীয় সংগীতের কোন মর্যাদা দেয় না, তারা জয় বাংলা সেস্নাগানের মর্যাদা দেয় না, তারা শহীদ মিনার মানে না, শহীদ মিনারে ফুল দেয়াকে তারা ধর্মবিরোধী কাজ বলে ফতোয়া দিয়ে থাকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে আজ পর্যন্ত ১৯৭১ সালের চেতনা মুছে ফেলার অনেক চেষ্টা হয়েছে। যে ভাষা আন্দোলনের রক্তে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার জন্ম হয়েছিল, যে চেতনার ভিত্তিতে ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে সেই 'বাঙালিত্ব' পুনরায় শাহবাগের স্কয়ারে লাখো কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে। হাজার বছরের বাঙালিত্বের ঐতিহ্যকে সেক্যুলার সিভিলবিরোধী শাসক গোষ্ঠী তছনছ করে দেয়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সে চেষ্টা সফল হবে না, আজ তা প্রমাণিত।
নারীরা এই আন্দোলনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। আজ অগি্নকন্যা লাকি আখতার বাঙালির হৃদয়ে চেতনার অগি্নমশাল জ্বালিয়েছেন। আরও নয়টি মেয়েকে 'অগি্নকন্যা' উপাধি দিয়েছে একটি জাতীয় পত্রিকা। তাদের শাণিত কণ্ঠের সেস্নাগান শাহবাগকে উত্তাল করে তুলেছে। এরা কি ক্ষুধার কথা তুলে গেছে? এরা কি ক্লান্তির কথা ভুলে গেছে? এরা কি একটু চোখের পাতা বন্ধ করে ঘুমানোর কথা ভুলে গেছে? ভুলে যাওয়ারই কথা : মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে নারীর স্বাধীনতা, নারীর মর্যাদা জড়িত। যেসব হায়েনা পশু-মুখ ব্যাদান করে ১৯৭২ এর সংবিধানে স্থানপ্রাপ্ত, চার মূলনীতির বিরোধিতা করেছে, তারাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এবং নারী অধিকারের বিরোধিতা করেছে। ১৯৭১ সালে বাঙালি নারীরা সবচেয়ে বড় মাপের ত্যাগ স্বীকার করেছে। সেই নারীর শত্রু হচ্ছে স্বাধীনতার শত্রু-জামায়াতিরা। তাই নারী আজ বিদ্রোহের অগি্নমশাল জ্বালিয়েছে।
শাহবাগে ছুটে গেছেন সব প্রগতিশীল মানুষ যারা বিবেকের চর্চা করেন, শান্তির সপক্ষে শুভবুদ্ধির চর্চা করেন, মুক্তবুদ্ধির চর্চা করেন, যারা ১৯৭২ এর সংবিধানের চেতনায় এবং অঙ্গীকারে বিশ্বাস করেন। ছুটে গেছেন জনপ্রিয় লেখক ড. জাফর ইকবাল, ড. মো. আনোয়ার হোসেন, ড. আরেফিন সিদ্দিকী। ছুটে গেছেন সংগ্রামী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা, সেক্টর কমান্ডাররা। আন্দোলনের মশালধারি তরুণদের লক্ষ্য করে ড. জাফর ইকবাল বলেন, 'আমার জীবনে এত আনন্দের দিন আর কখনো আসেনি। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে আজকের ২০১৩ সাল একাত্তর সালে রূপান্তরিত হয়েছে। আজকের দিনে শুধু আমি আনন্দিত নই, শহীদজননী জাহানারা ইমামও ওপর থেকে এই সমাবেশ দেখছেন আর হাসছেন। পৃথিবীতে তোমাদের মতো মানুষ আর হয় না। আর কেউ তোমাদের পরাজিত করতে পারবে না। তরুণ সমাজকে নিয়ে এতদিন আমার যে ধারণা ছিল তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দাও।
ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত ওই সমাবেশে একটা মূল্যবান কথা বলেছেন, 'আমাদের প্রতিদিন যুদ্ধ করতে হচ্ছে। এখনও একদল মানুষ আছে যারা বলে, যুদ্ধাপরাধের বিচার যেন নিরপেক্ষ হয়। আমার প্রশ্ন, একাত্তরে কি নিরপেক্ষভাবে যুদ্ধাপরাধীরা মানুষ হত্যা করেছে?'
সমাবেশ থেকে এবং বিক্ষোভের মূল মঞ্চ থেকে জামায়াত-শিবিরের মিছিল-সমাবেশ প্রতিহত করার ঘোষণা আসে। সমাবেশের একটি অন্যতম তাৎপর্য ও হচ্ছে প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক উপাদানের ব্যবহার। ব্যঙ্গচিত্র অাঁকা হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের, একাত্তরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত গানগুলো বাজানো হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধ ও মৌলবাদবিরোধী কবিতা আবৃত্তি করা হচ্ছে। একটি নাটক পর্যন্ত মঞ্চস্থ হয়। আমাদের এক কালোত্তীর্ণ কথা শিল্পী সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ 'লাল সালু' উপন্যাসে দেখিয়েছেন যে, মৌলবাদী, ধর্মান্ধরা সংস্কৃতির শত্রু, তাই তারা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বিষাক্ত ফতোয়া দিয়ে থাকে।
মনে নেই ১৯৭১ এ কামরুল হাসানের অাঁকা ইয়াহিয়া খানের সেই ছবির কথা? 'এই জানোয়ারাদের হত্যা করতে হবে।' বিশ্ববেহায়া স্বৈরাচারের যে ছবি এঁকেছিলেন তিনি তার প্রতিক্রিয়ায় নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান ঘটেছিল।
শাহবাগের সমাবেশের সেস্নাগানগুলো লক্ষ্য করুন : যে মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙালি সেই 'জয় বাংলা' সেস্নাগানে আজ মুখরিত রাজপথ। লক্ষ্য প্রাণের উচ্চারিত এই ধ্বনি প্রতি ধ্বনিত হচ্ছে আকাশে বাতাসে। পাশাপাশি, 'বীর বাঙালির হাতিয়ার- গর্জে ওঠো আরেকবার। জামায়াত মারার হাতিয়ার-শিবির মারার হাতিয়ার গর্জে ওঠো আরেকবার। দালালদের আস্তানা ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও। সামপ্রদায়িকতার আস্তানা ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও/জ্বালো-জ্বালো আগুন জ্বালো/ আয়রে আয় ডাক দিয়েছে মায়, অস্তিত্বের সংগ্রামে আজ জোট বাঁধো সবাই/ পাকিস্তানের প্রেতাত্মা পাকিস্তানেই ফিরে যা/ লাখো শহীদ ডাক পাঠালো সারা বাংলায় খবর দে, সারা বাংলা ঘেরাও করে জামায়াত-শিবির কবর দে।
শাহবাগের গণসমাবেশে সেই সেস্নাগানটি ফিরে এসেছে, 'তুই রাজাকার'। কাদের মোল্লা তুই রাজাকার।' গোলাম-মুজাহিদ-নিজামী-সাঈদী-সাকা-আলীম তুই রাজাকার। শাহবাগের জনতার গভীর আত্ম প্রত্যয়, 'আমরা করবো জয়।' জনতার আন্দোলন ব্যর্থ হয় না, রাজাকার- আলবদর-যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি হবেই_ এ প্রত্যয় জনতার। সমাবেশে সেক্টর কমান্ডার কে এম শফিউল্লাহ বলেন, পাকিস্তানিদের সহযোগী হয়ে আমাদের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করেছে, মা-বোনদের ধর্ষণ করেছে তারা হলো এই রাজাকার। কিছুদিন আগে হুমকি দিয়েছে গৃহযুদ্ধ বাধাবে। তাদের শুধু ক্ষমা নয়, নাকে খত দিয়ে পাকিস্তানে চলে যেতে হবে। সুলেখক আনিসুল হক বলেন, বড়দের কথা না শুনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছেন, স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। আইন সংশোধনের কথা উঠেছে। আপনারা মাঠ ছাড়বেন না। ফাঁসি হবেই।
ইসলামী ব্যাংককে জাতীয়করণের মাধ্যমে জামায়াত-শিবিরের হাত থেকে রক্ষা করার দাবি উঠেছে সমাবেশ থেকে। একই সঙ্গে দিগন্ত টিভিকে সমাবেশ স্থল থেকে চলে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে জনগণকে দিগন্ত, টিভি না দেখার অনুরোধ জানানো হয়। ইসলামী ব্যাংকে নতুন একাউন্ট না খোলা এবং পুরাতন একাউন্ট থেকে আমানত তুলে নেয়ার আহ্বান জানানো হয়। এছাড়া জামায়াত পরিচালিত সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান বর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন শাহবাগের সংগ্রামী জনতা।
এই একবিংশ শতাব্দীতে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটল বাংলাদেশে। বায়ান্ন যে মূল্যবোধ জন্ম দিয়েছিল, ১৯৭১ সালে যে মূল্যবোধ জন্ম হয়েছিল এবং যে রক্তাক্ত মূল্যবোধ বঙ্গবন্ধুর খুনিরা গুঁড়িয়ে দিয়েছিল, তার পুনরুত্থান ঘটেছে শাহবাগে। জেগে উঠেছে সিভিল মানুষেরা, জেগে উঠেছে ১৯৭১ এর স্বাধীনতার মূল্যবোধ।
৩৮ বছর চেষ্টা চলছে ৭১ এর চেতনা মুছে ফেলার, তা আর সম্ভব নয় ঘোষণা দিল অগি্নগর্ভ শাহবাগ। লাখো কণ্ঠের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা, 'রাজাকারের ফাঁসি চাই, জামায়াত-শিবিরের রাজানীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।' জনতার দাবি উপেক্ষা করার শক্তি কারো নেই, কেই যেন তা না ভাবেন। অতএব সাধু সাবধান।
[লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও গবেষক]
৮-০২-১৩ তারিখ শাহবাগের মহাসমাবেশে যে শপথ বাণী পাঠ করা হয়েছে তার মর্মাবাণী উপলব্ধি করার সময় এসেছে। মুষ্টিবদ্ধ হাত। দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ : একাত্তরের সব রাজাকার, গণহত্যা আর ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি, মৃত্যুদ- নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত গণমানুষের নেতৃত্বে এ গণজাগরণ চলবে। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত গণমঞ্চ তৈরি করে আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে হবে। রাষ্ট্রদ্রোহী জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন অব্যাহত রাখব।
আরো উচ্চারিত হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের ব্যবসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বয়কট করাসহ তাদের সামাজিকভাবে বয়বট করব। এখানে গাওয়া হয়েছে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত আমাদের জাতীয় সংগীত। পাঠক নিশ্চয়ই জানেন, জামায়াত এই জাতীয় সংগীতের কোন মর্যাদা দেয় না, তারা জয় বাংলা সেস্নাগানের মর্যাদা দেয় না, তারা শহীদ মিনার মানে না, শহীদ মিনারে ফুল দেয়াকে তারা ধর্মবিরোধী কাজ বলে ফতোয়া দিয়ে থাকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে আজ পর্যন্ত ১৯৭১ সালের চেতনা মুছে ফেলার অনেক চেষ্টা হয়েছে। যে ভাষা আন্দোলনের রক্তে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার জন্ম হয়েছিল, যে চেতনার ভিত্তিতে ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে সেই 'বাঙালিত্ব' পুনরায় শাহবাগের স্কয়ারে লাখো কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে। হাজার বছরের বাঙালিত্বের ঐতিহ্যকে সেক্যুলার সিভিলবিরোধী শাসক গোষ্ঠী তছনছ করে দেয়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সে চেষ্টা সফল হবে না, আজ তা প্রমাণিত।
নারীরা এই আন্দোলনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। আজ অগি্নকন্যা লাকি আখতার বাঙালির হৃদয়ে চেতনার অগি্নমশাল জ্বালিয়েছেন। আরও নয়টি মেয়েকে 'অগি্নকন্যা' উপাধি দিয়েছে একটি জাতীয় পত্রিকা। তাদের শাণিত কণ্ঠের সেস্নাগান শাহবাগকে উত্তাল করে তুলেছে। এরা কি ক্ষুধার কথা তুলে গেছে? এরা কি ক্লান্তির কথা ভুলে গেছে? এরা কি একটু চোখের পাতা বন্ধ করে ঘুমানোর কথা ভুলে গেছে? ভুলে যাওয়ারই কথা : মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে নারীর স্বাধীনতা, নারীর মর্যাদা জড়িত। যেসব হায়েনা পশু-মুখ ব্যাদান করে ১৯৭২ এর সংবিধানে স্থানপ্রাপ্ত, চার মূলনীতির বিরোধিতা করেছে, তারাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এবং নারী অধিকারের বিরোধিতা করেছে। ১৯৭১ সালে বাঙালি নারীরা সবচেয়ে বড় মাপের ত্যাগ স্বীকার করেছে। সেই নারীর শত্রু হচ্ছে স্বাধীনতার শত্রু-জামায়াতিরা। তাই নারী আজ বিদ্রোহের অগি্নমশাল জ্বালিয়েছে।
শাহবাগে ছুটে গেছেন সব প্রগতিশীল মানুষ যারা বিবেকের চর্চা করেন, শান্তির সপক্ষে শুভবুদ্ধির চর্চা করেন, মুক্তবুদ্ধির চর্চা করেন, যারা ১৯৭২ এর সংবিধানের চেতনায় এবং অঙ্গীকারে বিশ্বাস করেন। ছুটে গেছেন জনপ্রিয় লেখক ড. জাফর ইকবাল, ড. মো. আনোয়ার হোসেন, ড. আরেফিন সিদ্দিকী। ছুটে গেছেন সংগ্রামী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা, সেক্টর কমান্ডাররা। আন্দোলনের মশালধারি তরুণদের লক্ষ্য করে ড. জাফর ইকবাল বলেন, 'আমার জীবনে এত আনন্দের দিন আর কখনো আসেনি। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে আজকের ২০১৩ সাল একাত্তর সালে রূপান্তরিত হয়েছে। আজকের দিনে শুধু আমি আনন্দিত নই, শহীদজননী জাহানারা ইমামও ওপর থেকে এই সমাবেশ দেখছেন আর হাসছেন। পৃথিবীতে তোমাদের মতো মানুষ আর হয় না। আর কেউ তোমাদের পরাজিত করতে পারবে না। তরুণ সমাজকে নিয়ে এতদিন আমার যে ধারণা ছিল তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দাও।
ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত ওই সমাবেশে একটা মূল্যবান কথা বলেছেন, 'আমাদের প্রতিদিন যুদ্ধ করতে হচ্ছে। এখনও একদল মানুষ আছে যারা বলে, যুদ্ধাপরাধের বিচার যেন নিরপেক্ষ হয়। আমার প্রশ্ন, একাত্তরে কি নিরপেক্ষভাবে যুদ্ধাপরাধীরা মানুষ হত্যা করেছে?'
সমাবেশ থেকে এবং বিক্ষোভের মূল মঞ্চ থেকে জামায়াত-শিবিরের মিছিল-সমাবেশ প্রতিহত করার ঘোষণা আসে। সমাবেশের একটি অন্যতম তাৎপর্য ও হচ্ছে প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক উপাদানের ব্যবহার। ব্যঙ্গচিত্র অাঁকা হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের, একাত্তরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত গানগুলো বাজানো হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধ ও মৌলবাদবিরোধী কবিতা আবৃত্তি করা হচ্ছে। একটি নাটক পর্যন্ত মঞ্চস্থ হয়। আমাদের এক কালোত্তীর্ণ কথা শিল্পী সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ 'লাল সালু' উপন্যাসে দেখিয়েছেন যে, মৌলবাদী, ধর্মান্ধরা সংস্কৃতির শত্রু, তাই তারা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বিষাক্ত ফতোয়া দিয়ে থাকে।
মনে নেই ১৯৭১ এ কামরুল হাসানের অাঁকা ইয়াহিয়া খানের সেই ছবির কথা? 'এই জানোয়ারাদের হত্যা করতে হবে।' বিশ্ববেহায়া স্বৈরাচারের যে ছবি এঁকেছিলেন তিনি তার প্রতিক্রিয়ায় নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান ঘটেছিল।
শাহবাগের সমাবেশের সেস্নাগানগুলো লক্ষ্য করুন : যে মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙালি সেই 'জয় বাংলা' সেস্নাগানে আজ মুখরিত রাজপথ। লক্ষ্য প্রাণের উচ্চারিত এই ধ্বনি প্রতি ধ্বনিত হচ্ছে আকাশে বাতাসে। পাশাপাশি, 'বীর বাঙালির হাতিয়ার- গর্জে ওঠো আরেকবার। জামায়াত মারার হাতিয়ার-শিবির মারার হাতিয়ার গর্জে ওঠো আরেকবার। দালালদের আস্তানা ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও। সামপ্রদায়িকতার আস্তানা ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও/জ্বালো-জ্বালো আগুন জ্বালো/ আয়রে আয় ডাক দিয়েছে মায়, অস্তিত্বের সংগ্রামে আজ জোট বাঁধো সবাই/ পাকিস্তানের প্রেতাত্মা পাকিস্তানেই ফিরে যা/ লাখো শহীদ ডাক পাঠালো সারা বাংলায় খবর দে, সারা বাংলা ঘেরাও করে জামায়াত-শিবির কবর দে।
শাহবাগের গণসমাবেশে সেই সেস্নাগানটি ফিরে এসেছে, 'তুই রাজাকার'। কাদের মোল্লা তুই রাজাকার।' গোলাম-মুজাহিদ-নিজামী-সাঈদী-সাকা-আলীম তুই রাজাকার। শাহবাগের জনতার গভীর আত্ম প্রত্যয়, 'আমরা করবো জয়।' জনতার আন্দোলন ব্যর্থ হয় না, রাজাকার- আলবদর-যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি হবেই_ এ প্রত্যয় জনতার। সমাবেশে সেক্টর কমান্ডার কে এম শফিউল্লাহ বলেন, পাকিস্তানিদের সহযোগী হয়ে আমাদের বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করেছে, মা-বোনদের ধর্ষণ করেছে তারা হলো এই রাজাকার। কিছুদিন আগে হুমকি দিয়েছে গৃহযুদ্ধ বাধাবে। তাদের শুধু ক্ষমা নয়, নাকে খত দিয়ে পাকিস্তানে চলে যেতে হবে। সুলেখক আনিসুল হক বলেন, বড়দের কথা না শুনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছেন, স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। আইন সংশোধনের কথা উঠেছে। আপনারা মাঠ ছাড়বেন না। ফাঁসি হবেই।
ইসলামী ব্যাংককে জাতীয়করণের মাধ্যমে জামায়াত-শিবিরের হাত থেকে রক্ষা করার দাবি উঠেছে সমাবেশ থেকে। একই সঙ্গে দিগন্ত টিভিকে সমাবেশ স্থল থেকে চলে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে জনগণকে দিগন্ত, টিভি না দেখার অনুরোধ জানানো হয়। ইসলামী ব্যাংকে নতুন একাউন্ট না খোলা এবং পুরাতন একাউন্ট থেকে আমানত তুলে নেয়ার আহ্বান জানানো হয়। এছাড়া জামায়াত পরিচালিত সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান বর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন শাহবাগের সংগ্রামী জনতা।
এই একবিংশ শতাব্দীতে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটল বাংলাদেশে। বায়ান্ন যে মূল্যবোধ জন্ম দিয়েছিল, ১৯৭১ সালে যে মূল্যবোধ জন্ম হয়েছিল এবং যে রক্তাক্ত মূল্যবোধ বঙ্গবন্ধুর খুনিরা গুঁড়িয়ে দিয়েছিল, তার পুনরুত্থান ঘটেছে শাহবাগে। জেগে উঠেছে সিভিল মানুষেরা, জেগে উঠেছে ১৯৭১ এর স্বাধীনতার মূল্যবোধ।
৩৮ বছর চেষ্টা চলছে ৭১ এর চেতনা মুছে ফেলার, তা আর সম্ভব নয় ঘোষণা দিল অগি্নগর্ভ শাহবাগ। লাখো কণ্ঠের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা, 'রাজাকারের ফাঁসি চাই, জামায়াত-শিবিরের রাজানীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।' জনতার দাবি উপেক্ষা করার শক্তি কারো নেই, কেই যেন তা না ভাবেন। অতএব সাধু সাবধান।
[লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও গবেষক]
No comments