ভাষা আন্দোলন এবং সাঁওতালি ভাষার বর্ণমালা by মিথুশিলাক মুরমু
ভাষা আন্দোলনের মাসে অনুষ্ঠিতব্য একুশে বইমেলার উদ্বোধন প্রাক্কালে মাননীয়
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উচ্চারণ করেছেন, 'একুশে বাঙালি জনগণের প্রেরণার
একটি উৎস।
লিপি ও তার সরকারি স্বীকৃতির পর সাঁওতালরা মনে করলেন তাদের
ভাষা সমস্যার সমাধান হলো। কিন্তু সাঁওতালদের মধ্যে শতকরা প্রায় ৬৫ জন এবং
অন্য আদিবাসী গোষ্ঠীগুলো এ অলচিকি লিপিকে স্বীকৃতি না দেয়ায় এদের ভাষাগত বা
ব্যাকরণগত সমস্যা রয়েই গেছে' [আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতির প্রসঙ্গ নদীয়া
জেলা_ ড. শিবানী রায় (ম-ল), পৃষ্ঠা ২৪৪]। আমরা লক্ষ্য করেছি যে, বিগত
সেপ্টেম্বর ১৪-১৫. ১৯৯৫ সালে ভারতের কলকাতায় অনুষ্ঠিত ৩য় আন্তর্জাতিক
সাঁওতালি লিটামাতৃভাষায়
কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটি জাতির বীরত্বে ও ত্যাগের
কাহিনী।' বীরত্বের গাথা ভাষা আন্দোলনে আদিবাসী সাঁওতালদের অবদান যে ছিল না,
সেটি হলফ করে বলা যাবে না। ভাষা আন্দোলনের পরবর্তীকালে অনুষ্ঠিত পূর্ব
বাংলা প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট থেকে আদিবাসী সাঁওতাল রাজনৈতিক
ব্যক্তিত্ব শ্রী সাগরাম মাজহী (হাঁসদা) রাজশাহী-১৩ (৪৮) এবং শ্রীজীবন মুরমু
(সাঁওতাল) সিলেট-৯ (২৭২) থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ দুজন সাঁওতাল
ব্যক্তিত্ব সমকালীন রাজনীতিতে খুবই সচেতন এবং সক্রিয় ছিলেন। শ্রীজীবন মুরমু
ছিলেন বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে অবস্থিত 'বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়ন'-এর নেতা।
শ্রী মুরমু এবং স্থানীয় কংগ্রেস নেতা পূর্ণেদু কিশোর সেনগুপ্তের উদ্যোগে
১৯৪৮ সালে শ্রমিক ইউনিয়নটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অপরদিকে শ্রীসাগরাম মাজহী
ঐতিহাসিক নাচোল বিদ্রোহে রানী মা-খ্যাত ইলা মিত্রের সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
আদিবাসীদের অধিকারভিত্তিক আন্দোলনকে জাতীয় পর্যায়ে উন্নীত করেছিলেন। জাতীয়
নেতাদের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক ও সখ্য ছিল মধুর। একাধিক আদিবাসী
ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপে উঠে এসেছে, এ আদিবাসী সাঁওতাল নেতাদের জাতীয়
ইস্যুতে সম্পৃক্ততার সত্যতা এবং অবদান। তারা মনে করেন, আদিবাসীসহ বিভিন্ন
ভাষাভাষী রাজনীতিবিদদের (বীরেন্দ্র কিশোর ত্রিপুরা, কামিনী মোহন দেওয়ান)
জন্যই '৫২ ভাষা আন্দোলনের পরবর্তীকালে সব ভাষার সমান মর্যাদার প্রশ্নে দাবি
তুলেছিলেন সংস্কৃতি কর্মীরা। সেই সময়ের এক প্রবন্ধে লেখা হয়েছিল_ 'বহু
ভাষাভাষী জনগণের অর্থাৎ বহু জাতির মিলনক্ষেত্র পাকিস্তানের ভাষা সমস্যার
গণতন্ত্রসম্মত সমাধানের জন্য আমাদের আন্দোলনের মূলনীতি হবে ছোট-বড়
প্রত্যেকটি ভাষাকে সমান মর্যাদা ও সমান অধিকার দেয়া।' বিভিন্ন ভাষাভাষী
সাধারণ জনগণ যাতে রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ করতে পারে ও শিক্ষার পূর্ণ
সুযোগ পায় তার জন্য সংস্কৃতি কর্মীরা কতগুলো দাবি উত্থাপন করেন_ ক.
কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের সব আইন, ঘোষণা, দলিল প্রভৃতি বাংলা, উর্দু, সিন্ধি,
পাঞ্জাবি, পশুতু ও বেলুচি ভাষায় প্রকাশ করতে হবে। গুজরাটি ভাষাভাষী
জনসংখ্যা যথেষ্টসংখ্যক হলে সে ভাষাও প্রকাশ করতে হবে। মূলনীতি হবে,
পাকিস্তানের জনগণের প্রধান ভাষাতে কেন্দ্রীয় সরকারের সব দলিলাদি প্রকাশ
করতে হবে। খ. কেন্দ্রীয় আইনসভায় প্রত্যেক সভ্য নিজ নিজ মাতৃভাষায় নিজের
বক্তব্য বলতে পারবেন ও দোভাষীরা সেগুলো বিভিন্ন ভাষায় তরজমা করে দেবেন।
জাতিসংঘে ও বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ ব্যবস্থা সাফল্যের সঙ্গে
চলছে। গ. প্রত্যেক ভাষাভাষী জনগণের নিজ নিজ বাসভূমির (অর্থাৎ বিভিন্ন
প্রদেশের) রাষ্ট্রকার্য, আইন-আদালতের কার্য সে প্রদেশের ভাষায় চলবে।
বিভিন্ন প্রদেশে অবস্থিত অন্য ভাষাভাষী (যেমন-পূর্ববঙ্গে উর্দু ভাষীরা বা
পাঞ্জাবের বাঙালিরা) সেসব প্রদেশের আইন-আদালতে নিজ নিজ মাতৃভাষায় নিজ
বক্তব্য বলতে পারবেন। ঘ. বিভিন্ন উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে সেসব উপজাতির
ভাষায় আইন-আদালতের কাজ চলবে। ঙ. ছোট-বড় প্রত্যেক ভাষাভাষী জনসমষ্টি ও
বিভিন্ন প্রদেশের সংখ্যাল্পরাও নিজ নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ করার অধিকার
ভোগ করবে।' যুক্তফ্রন্ট কর্তৃক ঘোষিত ঐতিহাসিক ২১ দফাতেও মাতৃভাষা'র বিষয়টি
লক্ষণীয়। ২১ ফিগারটিকে চিরস্মরণীয় করার লক্ষ্যে নির্বাচনী কর্মসূচিকে একুশ
দফার কার্যসূচি হিসেবে ঘোষণা করে। ১ নম্বর ধারাতে ছিল_ 'বাংলাকে
পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হইবে' এবং ১০ ধারাতে সংযুক্তি ছিল_
'শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার করিয়া শিক্ষাকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে কার্যকর
করিয়া কেবল মাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হইবে এবং
সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোর বর্তমান ভেদাভেদ উঠাইয়া দিয়া একই
পর্যায়ভুক্ত করিয়া সব বিদ্যালয়কে সরকারি সাহায্যপুষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে
পরিণত করা হইবে এবং শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করা হইবে।'
পরবর্তীকালে ছাত্রদের ১১ দফায়ও মাতৃভাষার বিষয়টি স্থান পায়। মজলুম জননেতা
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও আকণ্ঠ
সমর্থন জানিয়েছিলেন। এ ১১ দফা পাকিস্তানের আবালবৃৃদ্ধবনিতা, ছাত্র-জনতা,
কৃষক-মজুর, মেহনতি শিক্ষক, ডাক্তার-কবিরাজ, রিকশাওয়ালা-ডোম-মেথর, মাঝি-কুলি
দেশের সব শ্রেণী, সব স্তরের মানুষ এক বাক্যে অন্তর দিয়ে ঐতিহাসিক ১১ দফাকে
সমর্থন করেছিল। দফার ১. ছ তে বলা হয়_ 'মাতৃভাষার মাধ্যমে সর্বস্তরে
শিক্ষার ব্যবস্থা করিতে হইবে।...' বঙ্গবন্ধু ২৮ অক্টোবর, ১৯৭০ সালে বেতার ও
টেলিভিশন ভাষণে বলেছিলেন,'... জীবনের সব ক্ষেত্রে বাংলা ও উর্দু যাতে
ইংরেজির স্থান দখল করতে পারে_ সে ব্যাপারে অবিলম্বে কার্যকর করতে হবে।
আঞ্চলিক ভাষা বিকাশ ও উন্নয়নের ব্যাপারে উৎসাহ সৃষ্টি করতে হবে।' ১৯৭০ সালে
নির্বাচনে জয়লাভের পর ৬ দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে তা সর্বসাধারণের
জ্ঞাতার্থে ঘোষণা করা হয়। ঘোষণায় ভাষা ও সংস্কৃতি শীর্ষক শিরোনামে বলা হয়_
'পাকিস্তানের দুটি রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও উর্দু যাতে জীবনের সব ক্ষেত্রে
ইংরেজির স্থলাভিষিক্ত হতে পারে তার জন্য আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
পাকিস্তানের সব এলাকায় ভাষা এবং সাহিত্যের উন্নয়নকে উৎসাহিত করার জন্য
সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হবে।' বদরুদ্দীন উমর লিখেছিলেন, '১৯৪৮ সালের
ভাষা আন্দোলন যে সীমিত এলাকায় ঘটেছিল এবং ছাত্র-শিক্ষকসহ বুদ্ধিজীবীদের
একাংশের মধ্যে যেভাবে সীমাবদ্ধ ছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন সেভাবে
সীমাবদ্ধ থাকেনি। দ্বিতীয় পর্যায়ের ভাষা-আন্দোলন শুধু ভাষার প্রশ্নে
সীমাবদ্ধ না থেকে তা শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্তের এক ব্যাপক
গণপ্রতিরোধ আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়ে সমগ্র পূর্ব বাংলায় এক অভূতপূর্ব
আন্দোলন সৃষ্টি করেছিল।'
গত ৩ ফেব্রুয়ারি দৈনিক প্রথম আলো সাঁওতালি ভাষার বর্ণমালা কী হবে? শীর্ষক লেখাটি আমাকে আকর্ষিত করেছে। সত্যিই এ মুহূর্তে আদিবাসী সাঁওতালদের মধ্যে সাঁওতালি বর্ণমালা নিয়ে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। কেউ বলছেন, সাঁওতালি বর্ণমালা হবে বাংলা, কেউ বা রোমান। গবেষক পার্থ পাভেল লিখেছেন, 'রাজশাহীতে শুরু হয় সাঁওতালি ভাষার প্রথম বেসরকারি বিদ্যালয়'। প্রকৃতপক্ষে এটি হবে, সাঁওতালি ভাষার বাংলা বর্ণমালায় পরিচালিত প্রথম বেসরকারি বিদ্যালয়। আমারও সৌভাগ্য হয়েছিল উপস্থিত হওয়ার গোদাগাড়ী উপজেলার বর্ষাপাড়া সাঁওতালি বেসরকারি বিদ্যালয় উদ্বোধনে। বিদ্যালয়টির যাত্রা সাঁওতালি ভাষার বাংলা বর্ণমালার পাঠ্যপুস্তকে হলেও সেটি বেশিদিন স্থায়িত্ব লাভ করেনি। বেশ কয়েকবার পরিদর্শন এবং এলাকার গ্রামবাসীদের সঙ্গেও মতবিনিময় করে যেটি জেনেছি, সেটি হলো আদিবাসী সাঁওতালরা তাদের ছেলেমেদের সাঁওতালি ভাষার বাংলা বর্ণমালাতে পড়াশোনা করাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। ছেলেমেয়েরাও অস্বস্তিবোধ করে। অপর আরেকটি বিদ্যালয় একই উপজেলার সুন্দরপুর গ্রামে অবস্থিত। সেখানকার বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, শিক্ষকরা বাংলা বর্ণমালা অথবা রোমান বর্ণমালাতেও পড়াতে ইচ্ছুক। তাদের নিজস্ব কোন অভিরুচি নেই। চাকরির স্বার্থে তারা যে কোন বর্ণমালাতে পড়াতে পারেন।
বাংলাদেশে সাঁওতালি ভাষার 'বর্ণমালা' লড়াই অনেক দিনের। গত সেপ্টেম্বর ১-৪, ২০০৩ সালে অনুষ্ঠিত রাজশাহী কারিতাস হলরুমে 'সাঁওতালদের কৃষ্টি ও রীতিনীতি' শীর্ষক কর্মশালায় রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ২৪ জন মাজহী, পারগানা ও আদিবাসী ব্যক্তিত্বরা উপস্থিত ছিলেন। জরিপে সেদিন ২৩ জনই রোমান বর্ণমালার পক্ষে মতামত প্রদান করেছেন। আজ রোমান বর্ণমালার পক্ষে রাজশাহী, দিনাজপুরে সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন রচনা করা হচ্ছে। বাংলা বর্ণমালা পক্ষে সম্প্রতি রাজশাহীতে (১৯.১.২০১৩ সালে) আদিবাসী ছাত্র পরিষদ যে মানববন্ধন করেছে, সেখানে মাত্র পাঁচজন (জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন, তার ছেলে মানিক সরেন, তার মেয়ে শিল্পী সরেন এবং সুবাস চন্দ্র হেমরম, রবীন্দ্রনাথ হেমরম) আদিবাসী সাঁওতাল ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। এই উপস্থিতিও প্রমাণ করে সাঁওতালি ভাষার 'বাংলা বর্ণমালা' জনপ্রিয়তা।
২০০৩ সালে দৈনিক জনকণ্ঠে 'সাঁওতালি ভাষা' শীর্ষক সংবাদে বলা হয়, 'বর্ণমালা ছিল না, হয়েছে। একের পর এক বই বেরোচ্ছে সাঁওতালি ভাষায়। বাংলার সঙ্গে মিল আছে, অমিলও অনেক। সামনের বছর সাঁওতালিরা মাধ্যমিকে নিজেদের ভাষায় পরীক্ষা দেবে প্রথমবারের মতো। পশ্চিমবঙ্গে এক কোটি সাঁওতাল পরিবারে খুশির ঝলক। শততম সংবিধান সংশোধনী বিলটি লোকসভা-রাজ্যসভায় পাস হওয়ায় সাঁওতালি ভাষা অষ্টম তফসিলের অন্তর্ভুক্ত (জনকণ্ঠ ২৬.১২.২০০৩)। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং তার 'বাংলাদেশের বিপন্ন আদিবাসী' গ্রন্থে লিখেছেন, 'ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সাঁওতালি ভাষা হিসেবে পরীক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা মাধ্যমিক পরীক্ষা পর্যন্ত আছে এ রাজ্যে। কিন্তু পড়ানোর ব্যবস্থা নেই, ফলে এ সুযোগ অনেকখানি কাগজে-কলমেই থেকে যাচ্ছে।' ভারতের 'অলচিকি রেচার কনফারেন্সে_ প-িত রঘুনাথ মুরমুর উদ্ভাবিত 'অলচিকি বর্ণমালাকে বাতিল করা হয়।
গবেষক পাভেল পার্থ লিখেছেন, 'ব্রিটিশ উপনিবেশের অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে যে সাঁওতাল জনগণ ১৮৫৫ সালে সংগঠিত করেছেন দুনিয়া কাঁপানো বিদ্রোহ, ১৫৭ বছর পর সেই জনগণের পক্ষে নিজ মাতৃভাষাকে রোমন হরফে লেখা কি সম্ভব? ইতিহাস তো বলে, সাঁওতালরা প্রথমত অন্যায়-অত্যাচার, দুর্নীতিবাজ, সুদখোর এবং মহাজনদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল, এ গোষ্ঠীই সরকারের পক্ষে প্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল। ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সাঁওতালদের সরাসরি কথোপকথনের পরেই ব্রিটিশ সরকার সাঁওতালদের বিষয়ে সচেতন এবং উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। সত্যিকার অর্থে সাঁওতাল বিদ্রোহের পরবর্তীতে মিশনারিরা সাঁওতালদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও পুনর্বাসনে ভূমিকা নিয়েছেন, সেটি অবশ্যই প্রশংসনীয়। সামগ্রিক প্রচেষ্টাতেই গঠিত হয়েছিল নন রেগুলেটেড ডিস্ট্রিক্ট সাঁওতাল পরগনা। এটি নিশ্চিত যে, মিশনারিরাই প্রথম সাঁওতালি ভাষাকে লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। সাঁওতালি ভাষার ব্যাকরণ প্রণেতা স্কুফ্রুসেডও (ঝশৎবভংৎঁফ) প্রথমে বাংলা বর্ণমালার মাধ্যমে লেখার চেষ্টা চালিয়েছিলেন কিন্তু উচ্চারণ ভঙ্গির সমস্যার জন্যই রোমান বর্ণমালাকে বেছে নিয়েছিলেন। অতঃপরই রচিত হয়েছে_ সাঁওতালি ভাষা পাঠ্যপুস্তক, গ্রামার ডিক্সনারি, বাইবেল ডিক্সনারি, অসংখ্য গান, উপন্যাস, সাহিত্য। বাংলাদেশে রোমান বর্ণমালায় মিশনারি পরিচালিত অনেক বিদ্যালয়ে সাঁওতালি ভাষা পাঠ্যপুস্তক পড়ানো হচ্ছে। রোমান বর্ণমালায় নিয়মিত সাহিত্য চর্চা করা হচ্ছে 'তাবিথা নিউজ' এবং 'কয়জং'-এ। রোমান বর্ণমালাকে মিশনারিদের অর্থাৎ খ্রিস্টানদের অভিহিত করে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা আদিবাসী সাঁওতালদের পেছনের দিকে ধাবিত করার শামিল। '৫২ ভাষা আন্দোলনের প্রাক্কালেও দেখেছি, বাংলা ভাষার হরফ পরিবর্তন (আরবি/রোমান প্রভৃতি), ভাষার মুসলমানি চেহারা গঠন (শব্দ পরিবর্তন-আরবি ফারসি উর্দু শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে) এবং রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা হরণ (উদুর্কে রাষ্ট্র ভাষা করে জাতীয় জীবন থেকে বাংলা ও বাঙালির ভাষাকে নষ্ট করে) করার ষড়যন্ত্র পাকিস্তানপূর্ব ও পরবর্তীকালে বিভিন্নভাবে চলে আসছিল। রেনেসাঁ সোসাইটি (১৯৪০) মুসলমানি শব্দ অকাতরে বাংলাতে অনুপ্রবেশ ঘটানোর সুপারিশ করেছিল। ১৯৪৭ সালে আজাদী লাভের আগেই বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দানের প্রস্তাব ছিল। পূর্ব বাংলা সরকার এ প্রস্তাব লুফে নিয়ে রেনেসাঁবাদীদের দ্বারা সরকারি পত্রপত্রিকা, প্রচার মাধ্যমগুলোতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার শুরু করেছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারের বাঙালি শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান পূর্ব- পশ্চিমে রাজনৈতিক সংস্কৃতির ঐক্য সহজতর করার যুক্তিতে বাংলা হরফ পরিবর্তন করে আরবি হরফ প্রবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৫০ সাল নাগাদ আরবিতে বাংলা শিক্ষাদানের ২০টি বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্রে বিনামূল্যে আরবি হরফের বাংলা বই দেয়া হতো। পাকিস্তান সরকারের এসব উদ্দেশ্য হাসিলের একটি ছিল মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর নেতৃত্বে (সেক্রেটারি ছিলেন কবি গোলাম মোস্তফা) গঠিত বাংলা ভাষা সংস্কার কমিটি (১৯৪৯)। এ কমিটি বাংলা ভাষা, এর ব্যাকরণ ও বর্ণমালার গুরুতর সংস্কারের সুপারিশপূর্বক সহজ বাংলা প্রস্তাব করেছিলেন। জনগণের ব্যাপক প্রতিবাদ, প্রতিরোধ সংগ্রাম ও আন্দোলনের মুখে সব উদ্যোগ যদিও ব্যর্থ হয়েছিল, তবু এদের প্রয়াস থেমে ছিল না। নানাভাবে বাঙালিদের মনের ভাবনার, চিন্তার, আকাঙ্ক্ষার এবং শৃঙ্খলার পরিবর্তন ও বিকৃতি সাধনের উপায় অন্বেষণ করে চলেছিলেন।
মহাজোট সরকার যে ২০১৪ সাল থেকে ছয়টি আদিবাসী গোষ্ঠীর (চাকমা, গারো, ত্রিপুরা, মারমা, উরাঁও এবং সাঁওতাল) মাতৃভাষায় পড়াশোনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, সেটি অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে সরকারকে মাতৃভাষার বর্ণমালা নির্বাচনে সেই জনগোষ্ঠীর ৯০% লোকের মতামতকেই গ্রাহ্য, অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
গত ৩ ফেব্রুয়ারি দৈনিক প্রথম আলো সাঁওতালি ভাষার বর্ণমালা কী হবে? শীর্ষক লেখাটি আমাকে আকর্ষিত করেছে। সত্যিই এ মুহূর্তে আদিবাসী সাঁওতালদের মধ্যে সাঁওতালি বর্ণমালা নিয়ে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। কেউ বলছেন, সাঁওতালি বর্ণমালা হবে বাংলা, কেউ বা রোমান। গবেষক পার্থ পাভেল লিখেছেন, 'রাজশাহীতে শুরু হয় সাঁওতালি ভাষার প্রথম বেসরকারি বিদ্যালয়'। প্রকৃতপক্ষে এটি হবে, সাঁওতালি ভাষার বাংলা বর্ণমালায় পরিচালিত প্রথম বেসরকারি বিদ্যালয়। আমারও সৌভাগ্য হয়েছিল উপস্থিত হওয়ার গোদাগাড়ী উপজেলার বর্ষাপাড়া সাঁওতালি বেসরকারি বিদ্যালয় উদ্বোধনে। বিদ্যালয়টির যাত্রা সাঁওতালি ভাষার বাংলা বর্ণমালার পাঠ্যপুস্তকে হলেও সেটি বেশিদিন স্থায়িত্ব লাভ করেনি। বেশ কয়েকবার পরিদর্শন এবং এলাকার গ্রামবাসীদের সঙ্গেও মতবিনিময় করে যেটি জেনেছি, সেটি হলো আদিবাসী সাঁওতালরা তাদের ছেলেমেদের সাঁওতালি ভাষার বাংলা বর্ণমালাতে পড়াশোনা করাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। ছেলেমেয়েরাও অস্বস্তিবোধ করে। অপর আরেকটি বিদ্যালয় একই উপজেলার সুন্দরপুর গ্রামে অবস্থিত। সেখানকার বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, শিক্ষকরা বাংলা বর্ণমালা অথবা রোমান বর্ণমালাতেও পড়াতে ইচ্ছুক। তাদের নিজস্ব কোন অভিরুচি নেই। চাকরির স্বার্থে তারা যে কোন বর্ণমালাতে পড়াতে পারেন।
বাংলাদেশে সাঁওতালি ভাষার 'বর্ণমালা' লড়াই অনেক দিনের। গত সেপ্টেম্বর ১-৪, ২০০৩ সালে অনুষ্ঠিত রাজশাহী কারিতাস হলরুমে 'সাঁওতালদের কৃষ্টি ও রীতিনীতি' শীর্ষক কর্মশালায় রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ২৪ জন মাজহী, পারগানা ও আদিবাসী ব্যক্তিত্বরা উপস্থিত ছিলেন। জরিপে সেদিন ২৩ জনই রোমান বর্ণমালার পক্ষে মতামত প্রদান করেছেন। আজ রোমান বর্ণমালার পক্ষে রাজশাহী, দিনাজপুরে সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন রচনা করা হচ্ছে। বাংলা বর্ণমালা পক্ষে সম্প্রতি রাজশাহীতে (১৯.১.২০১৩ সালে) আদিবাসী ছাত্র পরিষদ যে মানববন্ধন করেছে, সেখানে মাত্র পাঁচজন (জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন, তার ছেলে মানিক সরেন, তার মেয়ে শিল্পী সরেন এবং সুবাস চন্দ্র হেমরম, রবীন্দ্রনাথ হেমরম) আদিবাসী সাঁওতাল ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। এই উপস্থিতিও প্রমাণ করে সাঁওতালি ভাষার 'বাংলা বর্ণমালা' জনপ্রিয়তা।
২০০৩ সালে দৈনিক জনকণ্ঠে 'সাঁওতালি ভাষা' শীর্ষক সংবাদে বলা হয়, 'বর্ণমালা ছিল না, হয়েছে। একের পর এক বই বেরোচ্ছে সাঁওতালি ভাষায়। বাংলার সঙ্গে মিল আছে, অমিলও অনেক। সামনের বছর সাঁওতালিরা মাধ্যমিকে নিজেদের ভাষায় পরীক্ষা দেবে প্রথমবারের মতো। পশ্চিমবঙ্গে এক কোটি সাঁওতাল পরিবারে খুশির ঝলক। শততম সংবিধান সংশোধনী বিলটি লোকসভা-রাজ্যসভায় পাস হওয়ায় সাঁওতালি ভাষা অষ্টম তফসিলের অন্তর্ভুক্ত (জনকণ্ঠ ২৬.১২.২০০৩)। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং তার 'বাংলাদেশের বিপন্ন আদিবাসী' গ্রন্থে লিখেছেন, 'ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সাঁওতালি ভাষা হিসেবে পরীক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা মাধ্যমিক পরীক্ষা পর্যন্ত আছে এ রাজ্যে। কিন্তু পড়ানোর ব্যবস্থা নেই, ফলে এ সুযোগ অনেকখানি কাগজে-কলমেই থেকে যাচ্ছে।' ভারতের 'অলচিকি রেচার কনফারেন্সে_ প-িত রঘুনাথ মুরমুর উদ্ভাবিত 'অলচিকি বর্ণমালাকে বাতিল করা হয়।
গবেষক পাভেল পার্থ লিখেছেন, 'ব্রিটিশ উপনিবেশের অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে যে সাঁওতাল জনগণ ১৮৫৫ সালে সংগঠিত করেছেন দুনিয়া কাঁপানো বিদ্রোহ, ১৫৭ বছর পর সেই জনগণের পক্ষে নিজ মাতৃভাষাকে রোমন হরফে লেখা কি সম্ভব? ইতিহাস তো বলে, সাঁওতালরা প্রথমত অন্যায়-অত্যাচার, দুর্নীতিবাজ, সুদখোর এবং মহাজনদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল, এ গোষ্ঠীই সরকারের পক্ষে প্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল। ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সাঁওতালদের সরাসরি কথোপকথনের পরেই ব্রিটিশ সরকার সাঁওতালদের বিষয়ে সচেতন এবং উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। সত্যিকার অর্থে সাঁওতাল বিদ্রোহের পরবর্তীতে মিশনারিরা সাঁওতালদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও পুনর্বাসনে ভূমিকা নিয়েছেন, সেটি অবশ্যই প্রশংসনীয়। সামগ্রিক প্রচেষ্টাতেই গঠিত হয়েছিল নন রেগুলেটেড ডিস্ট্রিক্ট সাঁওতাল পরগনা। এটি নিশ্চিত যে, মিশনারিরাই প্রথম সাঁওতালি ভাষাকে লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। সাঁওতালি ভাষার ব্যাকরণ প্রণেতা স্কুফ্রুসেডও (ঝশৎবভংৎঁফ) প্রথমে বাংলা বর্ণমালার মাধ্যমে লেখার চেষ্টা চালিয়েছিলেন কিন্তু উচ্চারণ ভঙ্গির সমস্যার জন্যই রোমান বর্ণমালাকে বেছে নিয়েছিলেন। অতঃপরই রচিত হয়েছে_ সাঁওতালি ভাষা পাঠ্যপুস্তক, গ্রামার ডিক্সনারি, বাইবেল ডিক্সনারি, অসংখ্য গান, উপন্যাস, সাহিত্য। বাংলাদেশে রোমান বর্ণমালায় মিশনারি পরিচালিত অনেক বিদ্যালয়ে সাঁওতালি ভাষা পাঠ্যপুস্তক পড়ানো হচ্ছে। রোমান বর্ণমালায় নিয়মিত সাহিত্য চর্চা করা হচ্ছে 'তাবিথা নিউজ' এবং 'কয়জং'-এ। রোমান বর্ণমালাকে মিশনারিদের অর্থাৎ খ্রিস্টানদের অভিহিত করে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা আদিবাসী সাঁওতালদের পেছনের দিকে ধাবিত করার শামিল। '৫২ ভাষা আন্দোলনের প্রাক্কালেও দেখেছি, বাংলা ভাষার হরফ পরিবর্তন (আরবি/রোমান প্রভৃতি), ভাষার মুসলমানি চেহারা গঠন (শব্দ পরিবর্তন-আরবি ফারসি উর্দু শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে) এবং রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা হরণ (উদুর্কে রাষ্ট্র ভাষা করে জাতীয় জীবন থেকে বাংলা ও বাঙালির ভাষাকে নষ্ট করে) করার ষড়যন্ত্র পাকিস্তানপূর্ব ও পরবর্তীকালে বিভিন্নভাবে চলে আসছিল। রেনেসাঁ সোসাইটি (১৯৪০) মুসলমানি শব্দ অকাতরে বাংলাতে অনুপ্রবেশ ঘটানোর সুপারিশ করেছিল। ১৯৪৭ সালে আজাদী লাভের আগেই বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দানের প্রস্তাব ছিল। পূর্ব বাংলা সরকার এ প্রস্তাব লুফে নিয়ে রেনেসাঁবাদীদের দ্বারা সরকারি পত্রপত্রিকা, প্রচার মাধ্যমগুলোতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার শুরু করেছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারের বাঙালি শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান পূর্ব- পশ্চিমে রাজনৈতিক সংস্কৃতির ঐক্য সহজতর করার যুক্তিতে বাংলা হরফ পরিবর্তন করে আরবি হরফ প্রবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৫০ সাল নাগাদ আরবিতে বাংলা শিক্ষাদানের ২০টি বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্রে বিনামূল্যে আরবি হরফের বাংলা বই দেয়া হতো। পাকিস্তান সরকারের এসব উদ্দেশ্য হাসিলের একটি ছিল মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর নেতৃত্বে (সেক্রেটারি ছিলেন কবি গোলাম মোস্তফা) গঠিত বাংলা ভাষা সংস্কার কমিটি (১৯৪৯)। এ কমিটি বাংলা ভাষা, এর ব্যাকরণ ও বর্ণমালার গুরুতর সংস্কারের সুপারিশপূর্বক সহজ বাংলা প্রস্তাব করেছিলেন। জনগণের ব্যাপক প্রতিবাদ, প্রতিরোধ সংগ্রাম ও আন্দোলনের মুখে সব উদ্যোগ যদিও ব্যর্থ হয়েছিল, তবু এদের প্রয়াস থেমে ছিল না। নানাভাবে বাঙালিদের মনের ভাবনার, চিন্তার, আকাঙ্ক্ষার এবং শৃঙ্খলার পরিবর্তন ও বিকৃতি সাধনের উপায় অন্বেষণ করে চলেছিলেন।
মহাজোট সরকার যে ২০১৪ সাল থেকে ছয়টি আদিবাসী গোষ্ঠীর (চাকমা, গারো, ত্রিপুরা, মারমা, উরাঁও এবং সাঁওতাল) মাতৃভাষায় পড়াশোনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, সেটি অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে সরকারকে মাতৃভাষার বর্ণমালা নির্বাচনে সেই জনগোষ্ঠীর ৯০% লোকের মতামতকেই গ্রাহ্য, অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
No comments