বাঙালির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিব by ড. এম আফজাল হোসেন
বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে সাফল্যমণ্ডিত ও গৌরবান্বিত অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা। ইতিহাসের এই গৌরবান্বিত অধ্যায়ের নেপথ্যে ছিল একটি প্রাণ, একটি শক্তি, একটি অভুত্থান, একটি আন্দোলন ও একটি বিপ্লব। বাঙালি জাতির এই স্বাধীনতা শক্তির নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
তিনি আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন। তাই সমকাল তাঁকে স্বীকৃতি দিয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির মর্যাদায়। শেখ মুজিব মানেই বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মানেই শেখ মুজিব। তিনি আমাদের চেতনা। তিনি সব বাঙালির অনুপ্রেরণা। যত দিন বাংলাদেশ নামে দেশ থাকবে, বাংলা ভাষা থাকবে, বাংলা সংস্কৃতি ও সভ্যতা থাকবে, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা বহমান থাকবে, তত দিন শেখ মুজিব নামটি সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে বাঙালি জাতির ইতিহাসের পাতায় পাতায়। তিনি চিরঞ্জীব, চির অম্লান হয়ে থাকবেন এ দেশের প্রতিটি মানুষের মণিকোঠায়। তাঁর স্মৃতি অক্ষয় ও অমর হয়ে থাকবে এ দেশের প্রতিটি ধূলিকণায়। তিনি আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আবহমান বাংলার প্রাণপ্রবাহ।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায়। এদিন জাতি হারিয়েছে তার প্রাণপুরুষকে আর দেশ হারিয়েছে তার স্থপতিকে এবং ইতিহাস হারিয়েছে তার রচনাকারীকে। সমগ্র জাতিকে অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্রান্তিলগ্নে স্বাধীনতার বিপক্ষের শত্রু এবং সেনাবাহিনীর কতিপয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বিশ্বাসঘাতকদের হাতে হাজার বছরের ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোররাতে নিজ বাসভবন ৩২ নম্বর ধানমণ্ডিতে সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন। ত্রিশ লাখ শহীদের স্বপ্ন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণের স্বপ্নের সোনার বাংলা ভূলুণ্ঠন করাই ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার পটভূমি। প্রসঙ্গত কারণে আহমদ ছফা লিখেছেন, 'একজন বা একাধিক ব্যক্তির শারীরিক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি রাজনৈতিক মিশনকে হত্যা করা যায় না। কারণ ব্যক্তির মৃত্যু ঘটতে পারে কিন্তু আদর্শের মৃত্যু নাই।' কোনো এক সাক্ষাৎকারে অন্নদাশঙ্কর রায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, 'বাঙালি বেইমান, তারা জাতির পিতাকে হত্যা করেছে- পিতৃহত্যাকারী।' তাই জাতির পিতার হত্যাকারীদের এবং স্বাধীনতার শত্রুদের বিচারের দাবিতে সমগ্র বাঙালি জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ। এ অধ্যায়ে বাঙালি জাতি আপসহীন। বঙ্গবন্ধুর ৩৭তম শাহাদাতবার্ষিকীতে তাঁর পরিবারের সব সদস্যের আত্মার মাগফিরাত ও সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল কামনা করছি।
পল্লীগ্রামের সুশীতল ছায়াময় পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন আমাদের স্বাধীনতার এই স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি ছিলেন কোমল হৃদয়ের অধিকারী, স্বাধীনচেতা ও সাহসী। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাজীবনেই কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে, যার মাধ্যমে প্রতিফলিত হয় তাঁর মহানুভবতা, পরোপকারিতা, দেশপ্রেম, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি মমত্ববোধ, ঔদার্য, অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া ইত্যাদি। স্কুলজীবনে তিনি একজন প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে গড়ে ওঠেন। স্কুলের গণ্ডি না পেরোতেই বঙ্গবন্ধুকে কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রথম কারাজীবন সম্পর্কে বলেছেন, 'আমার যেদিন প্রথম জেল হয়, সেদিন থেকেই আমার নাবালকত্ব ঘোচে বোধ হয়।'
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমি দোসররা যখন বাঙালির সামগ্রিক উন্নয়নের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে এবং যখন উপমহাদেশে ধর্মীয় জাতীয়তার জয়জয়কার, তখন বঙ্গবন্ধু সাহসের সঙ্গে ভৌগোলিক ও ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রতি সংগ্রামী হয়ে তিনি হয়েছেন সমাজবাদী। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলার নামকরণ করেন 'বাংলাদেশ' এবং তিনি বলেন, "একসময় এ দেশের বুক হতে মানচিত্রের পৃষ্ঠা হতে 'বাংলা' কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও চিরতরে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হইতেছে। জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি- আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র 'বাংলাদেশ'।" বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ঘোষণাকে পূর্ব বাংলার সংগ্রামী জনগণ বিপুলভাবে অভিনন্দিত করে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার জনগণের নিজের অধিকার আদায়, আন্দোলন ও সংগ্রামকে বেগবান করার লক্ষ্যে বিভিন্ন সভা ও সমাবেশে বিপ্লবী উক্তি করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই তিনি তাঁর পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, 'আমি একে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড করতে চাই।' বঙ্গবন্ধু সব সময় স্বপ্ন দেখতেন একটি শোষণহীন সমাজ গঠনের, যেখানে ধনী-গরিবের কোনো ব্যবধান থাকবে না। তাঁর এই আপসহীন সংগ্রাম আজ ও আগামী দিনের প্রজন্মের জন্য আদর্শ ও পাথেয় হয়ে থাকবে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকা শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্জন সেলের সামনে কবর খুঁড়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু মুক্তিপাগল অসীম সাহসী বীর বাঙালি নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেছেন, 'আমি বাঙালি, আমি মুসলমান, আমি মানুষ, মানুষ একবারই মরে, কয়েকবার মরে না, আমি কখনোই আত্মসর্মপণ করব না। যদি তোমরা আমাকে মেরে ফেল, মৃত্যুর পর আমার লাশটা আমার দেশে আমার মানুষদের কাছে পৌঁছে দিও।' পৃথিবীর ইতিহাসে এ রকম সফল রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি জাতির স্বাধীন সত্তা প্রতিষ্ঠা করতে সারা জীবন ত্যাগ-তিতিক্ষা করেছেন, জেল-জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করেছেন; এমনকি ফাঁসির দড়িও তাঁকে লক্ষ্য থেকে একচুলও নড়াতে পারেনি কোনো দিন। একমাত্র শেখ মুজিবই বলতে পারতেন, 'আমার লোক, আমার দেশ'। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে একমাত্র তিনিই এ কথাটি বলার যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পর গোটা বিশ্ববাসীর কাছে বঙ্গবন্ধু উদাত্ত আহ্বান করে বলেন, 'আমার একমাত্র প্রার্থনা, বিশ্ব আমার দেশের মানুষের সাহায্যে অগ্রসর হয়ে আসুক। আমার হতভাগ্য স্বদেশবাসীর পাশে এসে দাঁড়াক। দেশের কোটি কোটি ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে বিশ্ববাসী দাঁড়াবে- এটাই আমার একমাত্র কামনা।' জাতির জনক বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর শুরু হয় অরাজকতা, সামরিক শাসন জারি, হত্যা ও লুণ্ঠনের অপরাজনীতি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং তথ্য বিকৃতির খেলায় মেতে ওঠে পাকিস্তানি আলবদর, আলশামসদের এ দেশীয় দোসররা। শুধু তা-ই নয়, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রক্ষার্থে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করার মতো জঘন্য অপরাধ করে কিছু অকৃতজ্ঞ ও নির্লজ্জ পাকিস্তানি দোসর। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার আদর্শ, লক্ষ্য ও চেতনাকে ধ্বংস করে সমগ্র জাতিকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়। অবশেষে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুর সার্থক উত্তরসূরি জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারকাজ শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার হয়েছে। জাতি আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার ও ঐক্যবদ্ধ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের মানুষ ত্যাগ-তিতিক্ষা, আন্দোলন-সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ তথা মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার আদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। মুজিবকন্যা আপনি এগিয়ে চলুন। স্বাধীন বাংলার বিপ্লবী জনগণ আপনার পাশেই আছে। একদিন শেখ মুজিবকন্যা আরো এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবেন। জাতীয় শোকের মাসে আমরা এ আশাবাদ ব্যক্ত করি। জয় হোক এই ত্যাগী ও ডটার অব পিস মুজিবকন্যার।
লেখক : উপাচার্য, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও
প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায়। এদিন জাতি হারিয়েছে তার প্রাণপুরুষকে আর দেশ হারিয়েছে তার স্থপতিকে এবং ইতিহাস হারিয়েছে তার রচনাকারীকে। সমগ্র জাতিকে অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্রান্তিলগ্নে স্বাধীনতার বিপক্ষের শত্রু এবং সেনাবাহিনীর কতিপয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বিশ্বাসঘাতকদের হাতে হাজার বছরের ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোররাতে নিজ বাসভবন ৩২ নম্বর ধানমণ্ডিতে সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন। ত্রিশ লাখ শহীদের স্বপ্ন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণের স্বপ্নের সোনার বাংলা ভূলুণ্ঠন করাই ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার পটভূমি। প্রসঙ্গত কারণে আহমদ ছফা লিখেছেন, 'একজন বা একাধিক ব্যক্তির শারীরিক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি রাজনৈতিক মিশনকে হত্যা করা যায় না। কারণ ব্যক্তির মৃত্যু ঘটতে পারে কিন্তু আদর্শের মৃত্যু নাই।' কোনো এক সাক্ষাৎকারে অন্নদাশঙ্কর রায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, 'বাঙালি বেইমান, তারা জাতির পিতাকে হত্যা করেছে- পিতৃহত্যাকারী।' তাই জাতির পিতার হত্যাকারীদের এবং স্বাধীনতার শত্রুদের বিচারের দাবিতে সমগ্র বাঙালি জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ। এ অধ্যায়ে বাঙালি জাতি আপসহীন। বঙ্গবন্ধুর ৩৭তম শাহাদাতবার্ষিকীতে তাঁর পরিবারের সব সদস্যের আত্মার মাগফিরাত ও সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল কামনা করছি।
পল্লীগ্রামের সুশীতল ছায়াময় পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন আমাদের স্বাধীনতার এই স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি ছিলেন কোমল হৃদয়ের অধিকারী, স্বাধীনচেতা ও সাহসী। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাজীবনেই কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে, যার মাধ্যমে প্রতিফলিত হয় তাঁর মহানুভবতা, পরোপকারিতা, দেশপ্রেম, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি মমত্ববোধ, ঔদার্য, অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া ইত্যাদি। স্কুলজীবনে তিনি একজন প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে গড়ে ওঠেন। স্কুলের গণ্ডি না পেরোতেই বঙ্গবন্ধুকে কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রথম কারাজীবন সম্পর্কে বলেছেন, 'আমার যেদিন প্রথম জেল হয়, সেদিন থেকেই আমার নাবালকত্ব ঘোচে বোধ হয়।'
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমি দোসররা যখন বাঙালির সামগ্রিক উন্নয়নের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে এবং যখন উপমহাদেশে ধর্মীয় জাতীয়তার জয়জয়কার, তখন বঙ্গবন্ধু সাহসের সঙ্গে ভৌগোলিক ও ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রতি সংগ্রামী হয়ে তিনি হয়েছেন সমাজবাদী। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলার নামকরণ করেন 'বাংলাদেশ' এবং তিনি বলেন, "একসময় এ দেশের বুক হতে মানচিত্রের পৃষ্ঠা হতে 'বাংলা' কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও চিরতরে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হইতেছে। জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি- আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র 'বাংলাদেশ'।" বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ঘোষণাকে পূর্ব বাংলার সংগ্রামী জনগণ বিপুলভাবে অভিনন্দিত করে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার জনগণের নিজের অধিকার আদায়, আন্দোলন ও সংগ্রামকে বেগবান করার লক্ষ্যে বিভিন্ন সভা ও সমাবেশে বিপ্লবী উক্তি করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই তিনি তাঁর পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, 'আমি একে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড করতে চাই।' বঙ্গবন্ধু সব সময় স্বপ্ন দেখতেন একটি শোষণহীন সমাজ গঠনের, যেখানে ধনী-গরিবের কোনো ব্যবধান থাকবে না। তাঁর এই আপসহীন সংগ্রাম আজ ও আগামী দিনের প্রজন্মের জন্য আদর্শ ও পাথেয় হয়ে থাকবে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকা শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্জন সেলের সামনে কবর খুঁড়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু মুক্তিপাগল অসীম সাহসী বীর বাঙালি নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেছেন, 'আমি বাঙালি, আমি মুসলমান, আমি মানুষ, মানুষ একবারই মরে, কয়েকবার মরে না, আমি কখনোই আত্মসর্মপণ করব না। যদি তোমরা আমাকে মেরে ফেল, মৃত্যুর পর আমার লাশটা আমার দেশে আমার মানুষদের কাছে পৌঁছে দিও।' পৃথিবীর ইতিহাসে এ রকম সফল রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি জাতির স্বাধীন সত্তা প্রতিষ্ঠা করতে সারা জীবন ত্যাগ-তিতিক্ষা করেছেন, জেল-জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করেছেন; এমনকি ফাঁসির দড়িও তাঁকে লক্ষ্য থেকে একচুলও নড়াতে পারেনি কোনো দিন। একমাত্র শেখ মুজিবই বলতে পারতেন, 'আমার লোক, আমার দেশ'। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে একমাত্র তিনিই এ কথাটি বলার যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পর গোটা বিশ্ববাসীর কাছে বঙ্গবন্ধু উদাত্ত আহ্বান করে বলেন, 'আমার একমাত্র প্রার্থনা, বিশ্ব আমার দেশের মানুষের সাহায্যে অগ্রসর হয়ে আসুক। আমার হতভাগ্য স্বদেশবাসীর পাশে এসে দাঁড়াক। দেশের কোটি কোটি ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে বিশ্ববাসী দাঁড়াবে- এটাই আমার একমাত্র কামনা।' জাতির জনক বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর শুরু হয় অরাজকতা, সামরিক শাসন জারি, হত্যা ও লুণ্ঠনের অপরাজনীতি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং তথ্য বিকৃতির খেলায় মেতে ওঠে পাকিস্তানি আলবদর, আলশামসদের এ দেশীয় দোসররা। শুধু তা-ই নয়, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রক্ষার্থে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করার মতো জঘন্য অপরাধ করে কিছু অকৃতজ্ঞ ও নির্লজ্জ পাকিস্তানি দোসর। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার আদর্শ, লক্ষ্য ও চেতনাকে ধ্বংস করে সমগ্র জাতিকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়। অবশেষে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুর সার্থক উত্তরসূরি জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারকাজ শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার হয়েছে। জাতি আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার ও ঐক্যবদ্ধ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের মানুষ ত্যাগ-তিতিক্ষা, আন্দোলন-সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ তথা মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার আদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। মুজিবকন্যা আপনি এগিয়ে চলুন। স্বাধীন বাংলার বিপ্লবী জনগণ আপনার পাশেই আছে। একদিন শেখ মুজিবকন্যা আরো এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবেন। জাতীয় শোকের মাসে আমরা এ আশাবাদ ব্যক্ত করি। জয় হোক এই ত্যাগী ও ডটার অব পিস মুজিবকন্যার।
লেখক : উপাচার্য, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও
প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর।
No comments