শ্রদ্ধাঞ্জলি- হুমায়ূনের ছোঁয়া by ফরিদ আহমেদ

বেলা দুইটায় শহীদ মিনারের বেদী থেকে হুমায়ূন আহমেদের কফিন তোলা হলো হিমগাড়িতে। জাতীয় ঈদগায় বেলা ২.৩০ মিনিটে জানাজার নামাজ। শহীদ মিনারে বাবার কফিন ধরে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে ছিল ছেলে নুহাশ। এখন কফিনের সঙ্গে গাড়িতে উঠে বসল।


খানিক পর আমি, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ভাইসহ ইকবাল ভাইয়ের মাইক্রোতে করে শহীদ মিনার থেকে ঈদগায়ে রওনা হলাম। হাইকোর্টের দক্ষিণ দিকের হাইকোর্ট মাজারে প্রবেশের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে আমাদের গাড়ি ঈদগা মাঠের পশ্চিম দিকে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে নেমে মাঠে ঢুকেই দেখতে পেলাম ঈদগা মাঠ এক জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। সবাই কাতার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছেন জানাজার জন্য। শোনা যাচ্ছে, মাইকে ইমাম সাহেব দোয়া পড়ছেন। মানুষের কাতার ঠেলে আমরা একেবারে মঞ্চের কাছে চলে এলাম। আমার সামনে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ও মাননীয় অর্থমন্ত্রী। এই দুই মন্ত্রীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে হাত দিয়ে তাঁদের সরিয়ে দক্ষিণ দিক দিয়ে আমি মঞ্চের ওপর উঠে এলাম। আমার পেছনে ইকবাল ভাই ও বাচ্চু ভাই।
মঞ্চে হুমায়ূন ভাইয়ের কফিন ধরে বসে আছে নুহাশ। জানাজার জন্য মাইক আনা ছিল। একজনের সহায়তায় মাইক স্ট্যান্ড মঞ্চে তুললাম। ইকবাল ভাইয়ের সামনে মাইক ধরে কিছু বলতে বললাম। অল্প কথায় সবার দোয়া চেয়ে ইকবাল ভাই নুহাশকে মাইকে ডাকলেন। নুহাশের ঠিক জানা নেই এ সময় কী বলতে হয়। আমার কাছ থেকে জেনে নিয়ে মাইকের সামনে শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বাবার জন্য সবার কাছে ক্ষমা চাইল এবং যদি বাবার কাছে কারও কোনো দেনা-পাওনা থাকে, তবে নুহাশ অথবা তার চাচা মুহম্মদ জাফর ইকবালের সঙ্গে যোগাযোগ করতে অনুরোধ জানাল। এই ঘোষণার পরপরই নুহাশকে নিয়ে আমি মঞ্চ থেকে নেমে মঞ্চের উত্তর-পূর্ব দিকে দাঁড়ালাম।
জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব জানাজার নামাজ পড়ালেন। নামাজ শেষে মোনাজাত করলেন। মোনাজাত শেষে আবারও আমি নুহাশকে নিয়ে মঞ্চে উঠে এলাম।
নির্দিষ্ট বাহিনী কফিন কাঁধে নেওয়ার জন্য হাত লাগিয়েছে। নুহাশ তাদের সঙ্গে হাত লাগিয়ে কাঁধে তুলে নিচ্ছে বাবার কফিন। নুহাশের পাশেই আমি কাঁধ লাগিয়েছি কফিনে। আমাদের ওপর যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে মানুষ। আমি একদিকে কফিনে কাঁধ লাগিয়েছি, আর এক হাত দিয়ে নুহাশকে আগলাবার চেষ্টা করছি। আমার ঘাড়ের ওপর দিয়ে একটি ছেলে হাত বাড়িয়েছে কফিনের দিকে। ঘাড় ফিরিয়ে চেয়ে দেখি, ছেলেটা আমার পরিচিত। সরে গিয়ে তুষারকে কফিনে কাঁধ লাগানোর সুযোগ করে দিয়ে আমি যতটুকু সম্ভব মানুষের চাপ থেকে নুহাশকে আগলাবার চেষ্টা করতে থাকলাম। কিন্তু এসব কিছুই খেয়াল করছে না নুহাশ, সে পরম মমতায় বাবার কফিন কাঁধে নিয়ে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। হিমগাড়িতে কফিন তোলা হলো।
আমি চলে এলাম শহীদ মিনারে। এখানে নোভা, শিলা আছে। এসে দেখি খালাম্মাকে (হুমায়ূন আহমেদের আম্মা) কেন্দ্র করে নিকটাত্মীয়রা বসে আছেন। ইকবাল ভাই শহীদ মিনারে এসে পরিবারের সঙ্গে মিলিত হওয়ার পর সবাই মিলে বিদায় জানালাম শহীদ মিনার চত্বরকে। ইকবাল ভাইয়ের মাইক্রোতে চড়ে বসলাম আমি, ইকবাল ভাই, ইয়াসমীন ভাবী, নোভা, শীলা, নোভার স্বামী আরশাদ, শীলার স্বামী অপু, অন্য দুটি গাড়িতে খালাম্মা, হুমায়ূন ভাইয়ের তিন বোন, বোনদের স্বামী, এক ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, তাঁদের সন্তানেরা এবং অন্যান্য নিকটাত্মীয়। আমরা এলাম বারডেম হাসপাতালের হিমঘরে। আমাদের সঙ্গে আছেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের বাচ্চু ভাই ও হাসান আরিফ ভাই। এর বাইরে আর কাউকে সেখানে থাকতে দেওয়া হলো না। হিমঘরের দুই স্টাফ ফ্রিজ থেকে টেনে বের করল একটি ট্রে। এই ট্রেতেই সাদা কফিনে জড়ানো অবস্থায় শুয়ে আছেন হুমায়ূন আহমেদ। ট্রে-টা রাখা হলো একটা ট্রলিতে। একটা মৃদু কান্নার রোল পড়ে গেল। ইকবাল ভাই খালাম্মাকে জড়িয়ে ধরে চোখ মুছতে মুছতে ট্রলির দিকে এগিয়ে এলেন। ট্রলির ডান দিকে দাঁড়িয়ে আছি আমি। বাঁ দিকে নোভা, শীলা, নুহাশ। শহীদ ভাই (হুমায়ূন আহমেদের মেজো বোনের স্বামী) কাফনের বাঁধন আলগা করলেন, মুখ থেকে সরিয়ে দিলেন কাফনের কাপড়। এই প্রথম আমরা সবাই দেখতে পেলাম আমাদের প্রিয় মানুষটির মুখ। খালাম্মা তাঁর প্রিয় ছেলের মুখ জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। আমি শিলাকে বললাম হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে তার বাবাকে। ওরা নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শিলা পেছনে দাঁড়িয়ে দুই হাত দিয়ে পরম মমতায় বাবার মাথা ধরে কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল।
কোনো এক মুহূর্তে আমার ডান হাত এগিয়ে গেল। আমার হাত স্পর্শ করল আমার প্রিয় মানুষের গাল, চিবুক। বেশ কয়েক সেকেন্ড হুমায়ূন ভাইয়ের মুখে হাত স্পর্শ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার সারা শরীর বেয়ে একটি বিদ্যুৎ চমক খেলে গেল, অনুভূতিহীন হয়ে গেল আমার সারা শরীর। কেউ একজন আমার হাত সরিয়ে লেখকের প্রিয় মুখটি ঢেকে দিলেন সাদা কাপড়ে। ট্রলি থেকে ট্রে-টা সরিয়ে নিয়ে আবারও প্রবেশ করিয়ে রাখা হলো হিমঘরে। বারডেমের হিমশীতল বিছানায় শুয়ে রইলেন এ দেশের মানুষের প্রিয় লেখক, প্রিয় মানুষ হুমায়ূন আহমেদ। আমার হাতে লেগে রইল তাঁর প্রিয় ছোঁয়া। এই স্পর্শ আমি অনুভব করতে থাকব সারা জীবন। দিনটি ২৩ জুলাই, ২০১২ সোমবার।
ফরিদ আহমেদ
প্রকাশক, সময় প্রকাশন

No comments

Powered by Blogger.