রাজনীতি- বীরদর্পে ভোঁ-দৌড় by শাহ্দীন মালিক

নিক রমনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন। আগামী নভেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে নিক রমনি আর ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী, বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মধ্যে।


আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মতো নিক রমনি অলিম্পিক উপলক্ষে লন্ডনে হাজির হয়েছেন। এটাও তাঁর নির্বাচনী প্রচারণার অংশ। লন্ডনে বসে পররাষ্ট্রনীতি, বৈদেশিক সম্পর্ক ইত্যাদি ব্যাপারে জ্ঞানগর্ভ কথাবার্তা বলবেন, মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দেবেন, আর এসব যুক্তরাষ্ট্রে প্রচারিত হবে। আমেরিকান ভোটাররা দেখবেন, তিনি বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ে কত পারদর্শী।
নিক রমনির দুর্ভাগ্য—লন্ডনে এসে প্রথম সংবাদ সম্মেলনেই বাজিমাত করার পরিবর্তে নিজেই ধরাশায়ী অলিম্পিকের উদ্বোধনের আগের দিন। সাংবাদিকেরা তাঁর কাছে লন্ডনের প্রস্তুতি সম্পর্কে মতামত জানতে চেয়েছিল। নিক রমনি বললেন, প্রস্তুতি সম্পর্কে তাঁর সন্দেহ হচ্ছে। নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত কোম্পানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকজন দিতে পারছে না। অন্যদিকে আবার লন্ডন ও অন্যান্য এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাঁদের দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য অলিম্পিকের সময়ই ধর্মঘটের হুমকি দিচ্ছেন। অর্থাৎ, রমনি সাহেবের মতে, অনেক কিছুই হযবরল হয়ে যেতে পারে। লন্ডনের প্রস্তুতি ভালো নয়।
এগুলো শুনছিলাম বিবিসি টেলিভিশনে। রমনির এই সংবাদ সম্মেলনের প্রতিক্রিয়া লন্ডনবাসীর মধ্যে কী হবে, তা বুঝতে বিশেষ জ্ঞান ও বিদ্যা-বুদ্ধির প্রয়োজন নেই। লন্ডনের মেয়র খেপে গিয়ে এক বক্তৃতায় রমনির কঠোর সমালোচনা করলেন। বিবিসি যা জানাল, তার মর্মার্থ হলো, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রমনির সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠক প্রায় বাতিল করে দিয়েছিলেন। পরে ভদ্রতার খাতিরে সাক্ষাৎ হয়েছিল।
ব্যাপারটা মনে করেন অনেকটা এ রকম—আমার দরজায় কলবেল বাজল। দরজা খুলে দেখলাম, বছর বিশেকের এক তরুণ। ধরে নিন, আমারও ওই বয়সী একটা ছেলে আছে, আর সাদা-পাকা চুলে-ভুঁড়িতে বুঝতে অসুবিধা নেই যে আমার বয়সও ষাটের কাছাকাছি। দরজা খুলতেই তরুণটা আমাকে বলল, ‘তোর ছেলেকে এখনই পাঠা। আমরা একসঙ্গে বেড়াতে যাব। এখনই ডাক দে।’
আমি কি তরুণটির কথা শুনে হন্তদন্ত হয়ে আমার ছেলেকে ডাকব, না অনেক কষ্টে তাকে থাপ্পড় মারার বাসনা নিবৃত করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করব?

২.
পদ্মা সেতু ও বিশ্বব্যাংক নিয়ে কথাবার্তা প্রচুর হয়েছে; হচ্ছেও কমবেশি কয়েক মাস ধরে। আগেও হয়েছে, তবে গত এক মাসে ভীষণভাবে হচ্ছে।
কিছুদিন আগে ভীষণভাবে সরকারপন্থী এক অর্থনীতিবিদ ফলাও করে বললেন, দেশি অর্থায়নে চার-চারটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। শুনে গর্বে বুক ভরে গেল। স্বপ্নীল চোখে চার-চারটা পদ্মা সেতু দেখতে দেখতে ঠিক করে ফেললাম, সেতু চারটি পাঁচ-সাত কিলোমিটার দূরে দূরে হলে হবে না, তাতে সেতুগুলো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে একসঙ্গে দেখা যাবে না। একটি সেতু থেকে অন্যটির মধ্যে দু-চার শ মিটারের বেশি ফারাক থাকবে না, যাতে নদীর পাশের উঁচু কোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে একসঙ্গে চার-চারটা সেতু দেখা যায়। দরকার হলে উভয় পাড়ে উঁচু করে মাটি দিয়ে ঢিবি বা ছোট টিলা করে চারটা সেতু যাতে একসঙ্গে দর্শনার্থীরা দেখতে পারে, এ ব্যবস্থা করতে হবে।
দেশীয় অর্থায়নে যেহেতু চারটা সেতু হবে, সেহেতু একটা সেতু থাকবে খাস দেশি যানবাহনের জন্য। প্রথম সেতু দিয়ে পার হবে শুধু রিকশা, ভ্যান, গরুর গাড়ি ও মহিষের গাড়ি। দ্বিতীয়টা থাকবে সিএনজি, নাসিমন, ভটভটি, দেশি ব্যাটারিচালিত যান ইত্যাদির জন্য। ভাবছি, ঘোড়ার গাড়ি প্রথম না দ্বিতীয়টা দিয়ে পার হবে।
আরেকটা একেবারেই নতুন জটিল প্রশ্ন হলো, সাচ্চা দেশপ্রেমিকদের জন্য আলাদা সেতু থাকবে, নাকি সাধারণ আমজনতার সঙ্গে একই সেতু তাঁরা ব্যবহার করবেন। দেশপ্রেমিকের নতুন সংজ্ঞায় তাঁদের সংখ্যা হু হু করে বাড়বে। যাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠবে, তাঁরা সবাই দেশপ্রেমিক খেতাব পাবেন। তাই দেশপ্রেমিকদের জন্য আস্ত একটা ‘বিরিজ’ লাগবে। আর গাড়ি, বাস, ট্রাক ইত্যাদির জন্য একটা। অবশ্য বলা বাহুল্য, বিশ্বব্যাংক, জাইকা, এডিবি ইত্যাদির নম্বর প্লেট লাগানো কোনো যানবাহনকে একটি সেতুতেও উঠতে দেওয়া হবে না।
অবশ্য প্রধানমন্ত্রী সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে বিশ্বব্যাংকের অডিট পর্যন্ত হয় কি না। বিশ্বব্যাংকের পদ্মা সেতু কাজের ব্যাপারে চীনা কোম্পানির প্রতি এত পিরিতের পেছনে ‘কমিশন খাওয়া’-জাতীয় কারণ আছে কি না, সেটা অনুসন্ধান করতে লন্ডনে বসে সাংবাদিকদের প্রতি তিনি আহ্বান জানিয়েছেন।
খোদ প্রধানমন্ত্রী যখন এসব কথা বলছেন, তখন শ্রদ্ধাভরে আমলে নিতে হবে। ফলে এখন আরও জটিল প্রশ্নের সম্মুখীন আমাদের হতে হবে। ‘কমিশন খাওয়া’ বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তারা যদি বিদেশি হন এবং তাঁরা যদি পদত্যাগ করেন, তাহলে তাঁরা ‘দেশপ্রেমিক’ খেতাব পাবেন না।
স্বীকৃত জাতীয় পদক, যেমন—স্বাধীনতা পদক বোধহয় বিদেশিদেরও দেওয়া যায়। তাই আমাদের ‘দেশপ্রেমিক’ খেতাব হিসেবে আলাদা একটা খেতাব চালু করতে হবে। বিদেশিরাও এই খেতাব পেতে পারেন। আর দেশপ্রেমিক খেতাবপ্রাপ্তদের জন্য একটা বিশেষ সুবিধা, অর্থাৎ একটা পদ্মা সেতুসহ অন্যান্য ব্যবস্থা, যেমন—টাকাভর্তি বস্তা গাড়িতে বা বাসায় পাওয়া গেলেও তা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে হবে।

৩.
একটা আজগুবি যুক্তি আজকাল পত্রপত্রিকায় প্রায়ই আসছে। ‘বিশ্ব ব্যাংক দুর্নীতি তো প্রমাণ করতে পারেনি।’
আরে বাবা, দুর্নীতির সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগাড় করতে হলে দুদক বা পুলিশের ক্ষমতা তো বিশ্বব্যাংককে দিতে হবে! পাঠক, মনে করেন, আপনি জানলেন যে আমি দুর্নীতি করে আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে লাখ লাখ টাকা জমা করেছি। আপনি যদি আমার দুর্নীতি প্রমাণ করার জন্য আমাকে আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের হিসাব দিতে বলেন বা ব্যাংকের ম্যানেজারের কাছে আমার অ্যাকাউন্টের স্টেটমেন্ট চান, তাহলে দুজনই আপনাকে বুড়ো আঙুলে দেখাব।
আপনি আমার দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারবেন না। আমার সম্পত্তি বা ব্যাংকের হিসাব চাইতে এবং দিতে বাধ্য করার ক্ষমতা কেবল দুদকের। এখন দুদক যদি বলে, আমি ধোয়া তুলসীপাতা, আর প্রধানমন্ত্রী যদি আমাকে দেশপ্রেমিকের খেতাব দেন, তাহলে বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিল করা ছাড়া কি গত্যন্তর থাকে?
গত এক মাসে সরকারের বিভিন্নজনের বক্তৃতা-বিবৃতিতে এটা স্পষ্ট যে প্রথমত, সরকার পদ্মা সেতুর ব্যাপারে কাজ করেছে ডেইলি বেসিসে। আজকে এক সিদ্ধান্ত, তো আগামীকাল অন্যটি। দ্বিতীয়ত, খোদ প্রধানমন্ত্রী যা বলছেন, তাঁর মন্ত্রীরা পরক্ষণেই বলছেন অন্য কথা। তৃতীয়ত, প্রায় সব কথাই বহুলাংশে বাস্তবতা বিবর্জিত। আবেগ-আক্রোশ-বিদ্যাবুদ্ধিহীনতা তাড়িত।
দুই-একজনের বুদ্ধিহীনতা আর একগুঁয়েমির জন্য পুরো দেশ ও জাতিকে যে কত চড়া মূল্য দিতে হয়, তার অন্তত গন্ডা খানেক উদাহরণ আমরা দেখেছি গত কয়েক মাসের মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাপ্রবাহে। তিউনিশিয়া আর মিসরের সরকারপ্রধান গোয়ার্তুমি একটু কম করেছিল। গাদ্দাফি করেছিলেন অনেক বেশি। সিরিয়ায় আসাদের গোয়ার্তুমিটা গাদ্দাফিকে ছাড়িয়ে যাবে কিনা এবং কত হাজার নিরীহ লোককে প্রাণ দিতে হবে, সেটাই এখন প্রশ্ন। অন্য উত্তর ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আসাদের পতন হবেই। আগস্ট-সেপ্টেম্বর না অক্টোবরে—সেটা এখন সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না।
ক্ষমতায় যে যত বেশি দিন থাকে, তাদের গোয়ার্তুমি তত বাড়ে, বাড়ে জনগণের দুঃখ-দুর্দশা।
পদ্মা সেতু দেশি অর্থায়নে হবে না। সম্ভব নয়; বিশেষত যখন সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো দেশপ্রেমিকদের সরকার এত বেশি মূল্যায়ন করে।
নিক রমনির মতো লন্ডনে অলিম্পিক দেখতে এসে আয়োজকদের সমালোচনা করে লন্ডনবাসী ও যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে যে আদর-আতিথেয়তা পেয়েছেন অর্থাৎ রাগ আর হাসির পাত্র হয়েছেন, ঠিক সেভাবে বিশ্বব্যাংককে খামখেয়ালি আর দুর্নীতিগ্রস্ত বলে তাদের কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা আশা করা যায়, কিন্তু পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ।
দেশপ্রেমিক সাবেক মন্ত্রী নাকি পদত্যাগের পর লাপাত্তা হয়ে গেছেন। বীরদর্পে দিয়েছেন বোধহয় ভোঁ-দৌড়।
শ্রদ্ধাভাজন সৈয়দ আবুল মকসুদের ‘সাইলেন্স ইজ গোল্ড’ উপদেশটা (‘দেশপ্রেমিকে পদোন্নতি’ শিরোনামে ২৮ জুলাইয়ের প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায়) সরকারের কেউই গ্রহণ করবেন বলে মনে হয় না। আমি তো নস্যি।
দেশটা ভালো চলুক, পদ্মাসেতু হোক—এটা সবাই আমরা চাই । এ-জাতীয় ইস্যুতে বিরোধী দলের প্রথম সারির নেতা, বিশেষজ্ঞসহ সবাইকে নিয়ে বসুন। আলাপ-আলোচনা করে সবাইকে নিয়ে ঠান্ডা মাথায় যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিন।
অন্যকে যত বেশি গালমন্দ করবেন, নিজের, দলের আর দেশের তত বেশি ক্ষতি হবে।
ড. শাহ্দীন মালিক: অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট।

No comments

Powered by Blogger.