বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শন by ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম শামীম
রাজনীতির বাইরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষা ও শিক্ষাসম্পর্কিত বিষয়ে সবচেয়ে বেশি মনোযোগী ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশে স্বাধীনতা-উত্তর তাঁর সরকারের আমলেই এ বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।
১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই তাঁর নেতৃত্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। এ কমিশন গঠনের উদ্দেশ্য ছিল 'বর্তমান শিক্ষার নানাবিধ অভাব ও ত্রুটি-বিচ্যুতি দূরীকরণ, শিক্ষার মাধ্যমে সুষ্ঠু জাতি গঠনের নির্দেশ দান এবং দেশকে আধুনিক জ্ঞান ও কর্মশক্তিতে বলীয়ান করে তোলা।' অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় দেশের বাস্তব প্রয়োজন মেটানো সম্ভব নয়। এ কারণে পুরনো কাঠামোকে ভেঙে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। ঔপনিবেশিক শিক্ষা ও শিক্ষাপদ্ধতির সঙ্গে তিনি পরিচিত ছিলেন। শৈশবে সেই শিক্ষা তাঁকেও গ্রহণ করতে হয়েছিল। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, 'আমার ছোট দাদা খান সাহেব শেখ আবদুর রশিদ একটা এম. ই. স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। আমাদের অঞ্চলের মধ্যে সেকালে এই একটা মাত্র ইংরেজি স্কুল ছিল। পরে এটা হাই স্কুল হয়, সেটি আজও আছে। আমি তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত এই স্কুলে লেখাপড়া করে আমার আব্বার কাছে চলে যাই।' গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলেও বঙ্গবন্ধুর অনেকগুলো বছর কেটেছে এবং এ স্কুলের ছাত্রাবস্থায় তাঁর রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে পরিচয় এই স্কুলের সংবর্ধনা থেকেই।
বঙ্গবন্ধু প্রচলিত শিক্ষায় কেরানি তৈরির মনমানসিকতার পরিবর্তে আধুনিক যুগোপযোগী শিক্ষার দিকে আকৃষ্ট ছিলেন। দেশের তরুণ সমাজকে কার্যকর ও অর্থপূর্ণ শিক্ষায় প্রকৃত শিক্ষিত করে তোলার ওপর তিনি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি চেয়েছিলেন জাতিকে এমন এক বাস্তবমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে, যা কেবল তাদের উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের দিকেই নিয়ে যাবে না, বরং দেশের পুনর্গঠনের কাজে আত্মনিয়োগে উৎসাহ জোগাবে। শিক্ষা দর্শনের মূল তত্ত্বকথাও একই। আমরা জানি, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতালব্ধ যে মত বা পথ সামগ্রিকভাবে শিক্ষাপ্রক্রিয়ার গতি-প্রকৃতি নির্ণয়ে, অর্থ অনুধাবনে লক্ষ্যপদ্ধতি পাঠক্রম শিক্ষার্থীর প্রয়োজন নির্ধারণে সাহায্য করে তাকে শিক্ষা দর্শন বলে। বিখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল মনে করেন, শিক্ষা দ্বারা আমরা কেমন মানুষ প্রস্তুত করতে চাই সে সম্পর্কে একটা ধারণা থাকা প্রয়োজন এবং এটাই হবে শিক্ষা দর্শনের মূল লক্ষ্য। শিক্ষা দর্শনের তত্ত্বের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাতত্ত্বের একটা আদর্শিক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সংগত কারণে খুদা কমিশনের কাছে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশা ছিল, 'দেশের নতুন শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে গঠন করতে হবে, যাতে মানবিক মূল্যবোধের উৎকর্ষ সাধিত হয় এবং সেই সঙ্গে উৎপাদনের সর্বক্ষেত্রে নতুন গতিধারা যেন সংযোজিত হয়। দেশের দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে নয়া কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তার প্রতি কমিশন বিশেষভাবে লক্ষ রাখবে।' শিক্ষা দর্শনের আরো একটি দিক হলো শিক্ষার মাধ্যম। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দিতে গিয়ে মাতৃভাষা শিক্ষার মাধ্যম হওয়া উচিত বলে অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। পাকিস্তান শাসনামলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদার দাবিতে নিজেই বাংলা ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এ কারণে দেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাকে পূর্ণ মর্যাদাদানের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু স্থির করেন, বাংলাই হবে রাষ্ট্রভাষা এবং সরকারি সব কাজকর্ম বাংলা ভাষায়ই পরিচালিত হবে। তিনি জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দেন এবং দেশের মধ্যে বারবার নির্দেশ দিয়েছেন সরকারি কাজের সর্বস্তরে যেন বাংলার ব্যাপক ব্যবহার চালু করা হয়।
সদ্য সমাপ্ত যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ৯ মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত এবং পঙ্গু হয়েছিলেন হাজার হাজার শিক্ষক এবং ধ্বংস হয়েছিল প্রায় ৩০ হাজারের মতো স্কুলঘর। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত একটি দৈনিক পত্রিকার মতে, শিক্ষা খাতে মোট ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ১৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিপুলসংখ্যক শিক্ষক ও ছাত্রের মৃত্যুজনিত শূন্যতা কারো পক্ষেই পূরণ করা সম্ভব ছিল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছেন দৃঢ়তার সঙ্গে। মিশনারিদের মতো নিষ্ঠা নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠন করেছেন। তিনি জানতেন, দেশের শিক্ষক সমাজকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া না হলে দেশ ও জাতির উন্নতি সম্ভব নয়। এ জন্য তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সরকারি কর্মচারীর মর্যাদা দেন এবং এটি ১৯৭৩ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকর করা হয়। প্রাথমিক শিক্ষার ইতিহাসে যা একটি মাইলফলক ঘটনা। শিক্ষা ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ক্ষতিপূরণের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আরো কতগুলো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যেমন- স্বাধীনতার পর ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষক ও ছাত্রদের পুনর্বাসনের জন্য ১৯৭২ সালে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যয় করেন প্রায় ১০ কোটি টাকা। এ ছাড়া প্রাথমিক পর্যায়ে বিনা মূল্যে এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে নামমাত্র মূল্যে বই দেওয়া হয়। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু প্রথম থেকেই চেয়েছিলেন বাঙালি জাতিকে উন্নত করতে হলে শিক্ষাদীক্ষায় উন্নত করতে হবে। তবে শুধু অর্থই শিক্ষার সমস্যা দূর করবে না। সরকার যদি বাজেটের সিংহভাগও শিক্ষার জন্য বরাদ্দ করে, তাহলেও আমাদের লক্ষ্যে উপনীত হতে পারব না যদি প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত জাতি গড়ে তোলা না যায়। তবুও বঙ্গবন্ধু সরকার তাঁর শাসনামলেই শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিয়েছিল। ১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নির্বাচনী ইশতেহারেও বলা হয় : সমাজতান্ত্রিক দর্শনের নিরিখে জনসাধারণ যাতে শিক্ষা গ্রহণের পূর্ণাঙ্গ সুযোগ লাভ করতে পারে, এ জন্য একটি গণমুখী শিক্ষানীতি প্রণয়নের উদ্দেশ্যে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়েছে। শিক্ষানীতিতে অর্থনৈতিক ও জাতীয় প্রয়োজনে দক্ষ জনশক্তি গঠনের ওপর জোর দেওয়া হবে এবং কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণ করে জনশক্তিতে উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করার চেষ্টা চালানো হবে।' শিক্ষানীতির ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু এতটাই উদ্বেলিত ছিলেন এ কারণে ১৯৭৩ সালের ৮ জুন ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্ট তাঁর কাছে হস্তান্তর করেন। এ রিপোর্টে যথার্থভাবেই বাংলাদেশের একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার শিক্ষানীতির কথা বলা হয়, যাতে মাধ্যমিক স্তরে বৃত্তিমূলক ও কর্মসংস্থানমুখী শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ এবং অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়। এ রিপোর্টকে স্বাগত জানিয়ে দৈনিক বাংলা তার এক সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করেছিল : অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাংলাদেশের জনগণের শুধু পুরাতন একটি দাবিই নয়, আমাদের জাতীয় অগ্রগতি আর অর্থনৈতিক ভাগ্যোন্নয়নেরও এটা হলো চাবিকাঠি। শিক্ষিত এবং দক্ষ তথা উৎপাদনশীল জনশক্তি ছাড়া আমাদের পক্ষে কখনো সম্ভব হবে না আকাশছোঁয়া অর্থনৈতিক সমস্যার বহুমুখী চাপের সুষ্ঠু মোকাবিলা করা। এ জন্য প্রথমে দরকার নিরক্ষতার অভিশাপ দূর করার পাশাপাশি বৃত্তিমূলক শিক্ষার সার্বিক প্রবর্তন। অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার সুপারিশ করে কমিশন দেশের একটি অপরিহার্য চাহিদার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছে। কর্মসংস্থানমুখী শিক্ষার সুপারিশও আমাদের অর্থনৈতিক বাস্তবতা এবং যুগের প্রয়োজনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।' স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকালে হতাশাব্যঞ্জক চিত্র পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশে স্বাক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন লোকের সংখ্যা ছিল ৮০ শতাংশের নিচে। এ ছাড়া নারীশিক্ষা ছিল চরম অবহেলিত ও উপেক্ষিত। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার শোচনীয় অবস্থার কথা জানতেন। শুধু দারিদ্র্যের কারণে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতো হাজারো শিশু। এ ছাড়া অনেকেরই মাঝপথে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যেত। এ সমস্যা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু যথেষ্ট সচেতন ছিলেন বলেই তাঁর সরকার ১৯৭৩ সাল থেকে দেশে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর শিক্ষার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজস্ব মতামত প্রকাশ করেছেন। তিনি চেয়েছেন উচ্চতর শিক্ষায় স্বাধীন চিন্তা প্রকাশ পাবে। এ কারণে উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণ, উন্নয়ন পরিকল্পনা, সুচিন্তিত গবেষণাকর্ম যাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বাধীনভাবে গ্রহণ করতে পারে এ জন্য তিনি ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স পাস করেন। শুধু তা-ই নয়, ১৯৭৩ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রতিষ্ঠা করেন। উল্লেখ্য, আজকের দিনে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে স্বায়ত্তশাসন ভোগ করছে, তা এরই ধারাবাহিকতার ফসল। শিক্ষাবিষয়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চিন্তাভাবনা ছিল আধুনিক ও উন্নত জাতি গঠনের জন্য অপরিহার্য। সামগ্রিকভাবে আজ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার চিত্র হতাশাব্যঞ্জক ও সমস্যায় জর্জরিত। শিক্ষার মান নেমে যাচ্ছে বলে শিক্ষাবিদরা প্রায়ই অভিযোগ করে থাকেন। এ থেকে উত্তরণে এবং একটি আধুনিক, উন্নত ও শিক্ষিত জাতি হিসেবে আমরা বিকশিত হতে চাইলে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শন ও তাঁর সময়ে প্রণীত কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষানীতির সাহায্য গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
anwarhist@yahoo.com
বঙ্গবন্ধু প্রচলিত শিক্ষায় কেরানি তৈরির মনমানসিকতার পরিবর্তে আধুনিক যুগোপযোগী শিক্ষার দিকে আকৃষ্ট ছিলেন। দেশের তরুণ সমাজকে কার্যকর ও অর্থপূর্ণ শিক্ষায় প্রকৃত শিক্ষিত করে তোলার ওপর তিনি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি চেয়েছিলেন জাতিকে এমন এক বাস্তবমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে, যা কেবল তাদের উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের দিকেই নিয়ে যাবে না, বরং দেশের পুনর্গঠনের কাজে আত্মনিয়োগে উৎসাহ জোগাবে। শিক্ষা দর্শনের মূল তত্ত্বকথাও একই। আমরা জানি, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতালব্ধ যে মত বা পথ সামগ্রিকভাবে শিক্ষাপ্রক্রিয়ার গতি-প্রকৃতি নির্ণয়ে, অর্থ অনুধাবনে লক্ষ্যপদ্ধতি পাঠক্রম শিক্ষার্থীর প্রয়োজন নির্ধারণে সাহায্য করে তাকে শিক্ষা দর্শন বলে। বিখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল মনে করেন, শিক্ষা দ্বারা আমরা কেমন মানুষ প্রস্তুত করতে চাই সে সম্পর্কে একটা ধারণা থাকা প্রয়োজন এবং এটাই হবে শিক্ষা দর্শনের মূল লক্ষ্য। শিক্ষা দর্শনের তত্ত্বের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাতত্ত্বের একটা আদর্শিক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সংগত কারণে খুদা কমিশনের কাছে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাশা ছিল, 'দেশের নতুন শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে গঠন করতে হবে, যাতে মানবিক মূল্যবোধের উৎকর্ষ সাধিত হয় এবং সেই সঙ্গে উৎপাদনের সর্বক্ষেত্রে নতুন গতিধারা যেন সংযোজিত হয়। দেশের দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে নয়া কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তার প্রতি কমিশন বিশেষভাবে লক্ষ রাখবে।' শিক্ষা দর্শনের আরো একটি দিক হলো শিক্ষার মাধ্যম। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দিতে গিয়ে মাতৃভাষা শিক্ষার মাধ্যম হওয়া উচিত বলে অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। পাকিস্তান শাসনামলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদার দাবিতে নিজেই বাংলা ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এ কারণে দেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাকে পূর্ণ মর্যাদাদানের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু স্থির করেন, বাংলাই হবে রাষ্ট্রভাষা এবং সরকারি সব কাজকর্ম বাংলা ভাষায়ই পরিচালিত হবে। তিনি জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দেন এবং দেশের মধ্যে বারবার নির্দেশ দিয়েছেন সরকারি কাজের সর্বস্তরে যেন বাংলার ব্যাপক ব্যবহার চালু করা হয়।
সদ্য সমাপ্ত যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ৯ মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত এবং পঙ্গু হয়েছিলেন হাজার হাজার শিক্ষক এবং ধ্বংস হয়েছিল প্রায় ৩০ হাজারের মতো স্কুলঘর। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত একটি দৈনিক পত্রিকার মতে, শিক্ষা খাতে মোট ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ১৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিপুলসংখ্যক শিক্ষক ও ছাত্রের মৃত্যুজনিত শূন্যতা কারো পক্ষেই পূরণ করা সম্ভব ছিল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছেন দৃঢ়তার সঙ্গে। মিশনারিদের মতো নিষ্ঠা নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠন করেছেন। তিনি জানতেন, দেশের শিক্ষক সমাজকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া না হলে দেশ ও জাতির উন্নতি সম্ভব নয়। এ জন্য তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সরকারি কর্মচারীর মর্যাদা দেন এবং এটি ১৯৭৩ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকর করা হয়। প্রাথমিক শিক্ষার ইতিহাসে যা একটি মাইলফলক ঘটনা। শিক্ষা ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ক্ষতিপূরণের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আরো কতগুলো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যেমন- স্বাধীনতার পর ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষক ও ছাত্রদের পুনর্বাসনের জন্য ১৯৭২ সালে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যয় করেন প্রায় ১০ কোটি টাকা। এ ছাড়া প্রাথমিক পর্যায়ে বিনা মূল্যে এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে নামমাত্র মূল্যে বই দেওয়া হয়। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু প্রথম থেকেই চেয়েছিলেন বাঙালি জাতিকে উন্নত করতে হলে শিক্ষাদীক্ষায় উন্নত করতে হবে। তবে শুধু অর্থই শিক্ষার সমস্যা দূর করবে না। সরকার যদি বাজেটের সিংহভাগও শিক্ষার জন্য বরাদ্দ করে, তাহলেও আমাদের লক্ষ্যে উপনীত হতে পারব না যদি প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত জাতি গড়ে তোলা না যায়। তবুও বঙ্গবন্ধু সরকার তাঁর শাসনামলেই শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিয়েছিল। ১৯৭৩ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নির্বাচনী ইশতেহারেও বলা হয় : সমাজতান্ত্রিক দর্শনের নিরিখে জনসাধারণ যাতে শিক্ষা গ্রহণের পূর্ণাঙ্গ সুযোগ লাভ করতে পারে, এ জন্য একটি গণমুখী শিক্ষানীতি প্রণয়নের উদ্দেশ্যে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়েছে। শিক্ষানীতিতে অর্থনৈতিক ও জাতীয় প্রয়োজনে দক্ষ জনশক্তি গঠনের ওপর জোর দেওয়া হবে এবং কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণ করে জনশক্তিতে উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করার চেষ্টা চালানো হবে।' শিক্ষানীতির ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু এতটাই উদ্বেলিত ছিলেন এ কারণে ১৯৭৩ সালের ৮ জুন ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্ট তাঁর কাছে হস্তান্তর করেন। এ রিপোর্টে যথার্থভাবেই বাংলাদেশের একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার শিক্ষানীতির কথা বলা হয়, যাতে মাধ্যমিক স্তরে বৃত্তিমূলক ও কর্মসংস্থানমুখী শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ এবং অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়। এ রিপোর্টকে স্বাগত জানিয়ে দৈনিক বাংলা তার এক সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করেছিল : অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাংলাদেশের জনগণের শুধু পুরাতন একটি দাবিই নয়, আমাদের জাতীয় অগ্রগতি আর অর্থনৈতিক ভাগ্যোন্নয়নেরও এটা হলো চাবিকাঠি। শিক্ষিত এবং দক্ষ তথা উৎপাদনশীল জনশক্তি ছাড়া আমাদের পক্ষে কখনো সম্ভব হবে না আকাশছোঁয়া অর্থনৈতিক সমস্যার বহুমুখী চাপের সুষ্ঠু মোকাবিলা করা। এ জন্য প্রথমে দরকার নিরক্ষতার অভিশাপ দূর করার পাশাপাশি বৃত্তিমূলক শিক্ষার সার্বিক প্রবর্তন। অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার সুপারিশ করে কমিশন দেশের একটি অপরিহার্য চাহিদার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছে। কর্মসংস্থানমুখী শিক্ষার সুপারিশও আমাদের অর্থনৈতিক বাস্তবতা এবং যুগের প্রয়োজনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।' স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকালে হতাশাব্যঞ্জক চিত্র পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশে স্বাক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন লোকের সংখ্যা ছিল ৮০ শতাংশের নিচে। এ ছাড়া নারীশিক্ষা ছিল চরম অবহেলিত ও উপেক্ষিত। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার শোচনীয় অবস্থার কথা জানতেন। শুধু দারিদ্র্যের কারণে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতো হাজারো শিশু। এ ছাড়া অনেকেরই মাঝপথে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যেত। এ সমস্যা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু যথেষ্ট সচেতন ছিলেন বলেই তাঁর সরকার ১৯৭৩ সাল থেকে দেশে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর শিক্ষার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজস্ব মতামত প্রকাশ করেছেন। তিনি চেয়েছেন উচ্চতর শিক্ষায় স্বাধীন চিন্তা প্রকাশ পাবে। এ কারণে উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণ, উন্নয়ন পরিকল্পনা, সুচিন্তিত গবেষণাকর্ম যাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বাধীনভাবে গ্রহণ করতে পারে এ জন্য তিনি ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স পাস করেন। শুধু তা-ই নয়, ১৯৭৩ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রতিষ্ঠা করেন। উল্লেখ্য, আজকের দিনে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে স্বায়ত্তশাসন ভোগ করছে, তা এরই ধারাবাহিকতার ফসল। শিক্ষাবিষয়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চিন্তাভাবনা ছিল আধুনিক ও উন্নত জাতি গঠনের জন্য অপরিহার্য। সামগ্রিকভাবে আজ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার চিত্র হতাশাব্যঞ্জক ও সমস্যায় জর্জরিত। শিক্ষার মান নেমে যাচ্ছে বলে শিক্ষাবিদরা প্রায়ই অভিযোগ করে থাকেন। এ থেকে উত্তরণে এবং একটি আধুনিক, উন্নত ও শিক্ষিত জাতি হিসেবে আমরা বিকশিত হতে চাইলে বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শন ও তাঁর সময়ে প্রণীত কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষানীতির সাহায্য গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
anwarhist@yahoo.com
No comments