মহাযজ্ঞে মহাবিভ্রাট by দিবাকর আচার্য্য
এবারের অলিম্পিক শুরুর আগের দিনই আর্চারিতে বিশ্ব রেকর্ড করে ফেললেন ইম ডং-হিউন নামের দক্ষিণ কোরিয়ান এক আর্চার। বর্তমান দুনিয়ার অন্যতম সেরা এই আর্চার চিকিৎসাবিজ্ঞানের হিসেবে প্রায় অন্ধ! এ কথা শুনে সহকর্মীরা প্রায় সবাই নিশ্চিত হয়ে গেলেন, আর্চারির চেয়ে সহজ কাজ আর নেই।
ডং-হিউন যখন পারেন, আমরাও পারব! আমাদের আরেক সহকর্মী, ধরা যাক নাম তাঁর যাযাবর পান্থ, তিনি আরেক ধাপ এগিয়ে এসে বললেন, ‘পারব মানে কী! আমি তো পেরেছি।’
এত দিন পান্থ সাহেবের অনেক রাজা-উজির মারার গল্পে আমরা ভয় পাইনি; কিন্তু এবার আমরা সত্যিই ভয় পেয়ে গেলাম। আমাদের পান্থ সাহেব কি দু-একটা অলিম্পিক পদকের মালিক নাকি!
না, অলিম্পিক নয়; কাছাকাছি মানের জেলা পর্যায়ের এক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন তিনি একবার। তা-ও আর্চারিতে নয়, শ্যুটিংয়ে—৫০ মিটার রাইফেল শ্যুটিং। ভদ্রলোকের আত্মবিশ্বাসের কমতি ছিল না। কারণ, অনেকবার তিনি পার্কে বন্দুক দিয়ে বেলুন ফুটিয়েছেন।
তাই আশপাশে না তাকিয়ে পা শক্ত করে বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে পড়লেন। যদিও ৫০ মিটার দূরের বোর্ড সন্ধে হয়ে আসায় দেখতে একটু সমস্যা হচ্ছিল, তার পরও একে একে ১০টা গুলিই করে ফেললেন। অন্য কোনো প্রতিযোগীর ১০টা গুলি বোর্ডে লাগল না। কী বিস্ময়কর ঘটনা! আমাদের পান্থ সাহেবের ১০টা গুলিই টকটক শব্দ করে বোর্ডে লেগে গেল!
এবার পুরস্কারের পালা, সেই সঙ্গে পান্থ সাহেবের চোখ কপাল ছেড়ে তালুতে ওঠার পালা। তিনি দেখলেন, নয়টি গুলি লাগানো প্রতিযোগী থেকে শুরু করে ছয়টি গুলি পর্যন্ত তিনজন পুরস্কার পেয়ে গেল; কিন্তু ১০-এ ১০ করা পান্থর খোঁজ নেই। তাঁর নাম কেউ বলে না। চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে পান্থ বিচারকদের কাছে গেলেন—ঘটনা কী?
এক বিচারক গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘দেখুন পান্থ সাহেব, আপনার ১০টা গুলিই বোর্ডে লেগেছে, এটা সত্যি। কিন্তু সমস্যা হলো, একটা গুলিও আপনার নিজের বোর্ডে লাগেনি। ওগুলো দুই পাশের প্রতিযোগীদের বোর্ডে গিয়ে লেগেছে।’
হাসবেন না। এমন ঘটনা খোদ অলিম্পিকেও ঘটে থাকে। এই তো ২০০০ সালের সিডনি অলিম্পিকের ঘটনা। গিনির এরিক মুসাম্বানি এসেছিলেন অলিম্পিক সাঁতারে অংশ নিতে। সাঁতারে অংশ নেওয়া তো কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা হলো, মুসাম্বানি ৫০ মিটার পুল দেখে রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন, এত বড় পুল তো জীবনে কখনো দেখেননি; সাঁতরাবেন কী করে!
হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন। মুসাম্বানি অলিম্পিকে আসার মাস খানেক আগে লাইফ জ্যাকেট-ট্যাকেট পরে সাঁতার শিখেছেন। কিন্তু ‘এত্ত বড়’ পুল একা একা পাড়ি দেননি। তার পরও জীবন হাতের মুঠোয় পুরে লাফ দিয়ে পড়লেন পুলে। লাফ তো দিলেন, কিন্তু আর এগোতে পারেন না। হাত-পা ছুড়তেই ডুবে ডুবে যাচ্ছেন। আয়োজকেরা বারবার বললেন, সাহায্য লাগবে কি না। তাঁর অবস্থা তখন সত্যিই শোচনীয়; পানি-টানি গিলে প্রাণ যায় যায়। তার পরও মুসাম্বানি সাঁতার শেষ করলেন!
অলিম্পিকে এখনো মুসাম্বানির নাম উচ্চারিত হলে সবাই ‘স্যালুট’ শব্দটা উচ্চারণ করে। এই মুসাম্বানি, ডং-হিউন নিজেদের সীমাবদ্ধতায় আটকে না থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে লড়াইয়ের সাহস দেখিয়েছেন এবং দেখিয়েছেন, মানুষ চাইলে অনেক কিছু পারে।
এ রকম আরেকজন মানুষের গল্প মনে করা যেতে পারে এই বেলা। এটা অবশ্য ঠিক শারীরিক সীমাবদ্ধতার গল্প নয়, শারীরিক বৃদ্ধির গল্প।
ঘটনা এই ২০০৪ সালের এথেন্স অলিম্পিকের। ইরানি জুডো খেলোয়াড় আশরাফ মিরেসমালি অলিম্পিকে আসার আগে বেশ কাঠখড় পুড়িয়ে নিজের ওজন কমিয়েছেন। ফলে এক ধাপ নিচের ওজন ক্যাটাগরিতে খেলতে পারছেন। সেই ক্যাটাগরিতে বাছাই পর্বও পার হয়ে গেলেন। কিন্তু গোল লাগল এসে ফাইনালে। এক বিচারক ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘আপনার ওজন বেশি মনে হচ্ছে?’
আশরাফ চুপ করে রইলেন। চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করতে ওজন নেওয়া হলো। কী আশ্চর্য! আশরাফের ওজন বেড়ে উচ্চতর ক্যাটাগরিও ছাড়িয়ে যায় যায়!
ব্যাপার কী? ইরানের কর্মকর্তারা এসে ধরলেন আশরাফকে—এই ক দিনে ওজন বেড়ে গেল কী করে? জানা গেল, আগের রাতে বেশি খেয়ে ফেলায় ওজনটা বেড়ে গেছে!
পরে অবশ্য আশরাফ বলেছিলেন, ইসরায়েলকে আইওসি স্বীকৃতি দেওয়ায় তিনি ইচ্ছে করে খেয়ে ওজন বাড়িয়ে খেলায় অংশ না নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
এমন প্রতিবাদ বিভিন্ন সময়ই প্রতিযোগীদের করতে হয়েছে। অলিম্পিকের ইতিহাসে অন্যতম বড় দুটি আলোচিত প্রতিবাদ হয়েছে পতাকা নিয়ে। ১৯০৮ সালে এই লন্ডন অলিম্পিকেই সুইডেন আর যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা জোগাড় করতে ভুলে গিয়েছিলেন আয়োজকেরা। ফলে সুইডিশরা রাগ করে চলে গিয়েছিল। আর যুক্তরাষ্ট্র দল করল আরও ভয়ানক কাজ!
তাদের পতাকা জোগাড় হলো, মার্চপাস্ট শুরু হলো। একটা একটা করে দল ব্রিটেনের রাজা সপ্তম এডওয়ার্ডের সামনে দিয়ে পতাকা নিচু করে সম্মান জানিয়ে চলে গেল। আর যুক্তরাষ্ট্রের পতাকাবাহক রাজার সামনে এসে পতাকাটা আরেকটু বেশি উঁচু করে ধরলেন!
এবারও লন্ডনে উত্তর কোরিয়ান নারী ফুটবলাররা প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কারণ, তাঁদের নামের পাশে দক্ষিণ কোরিয়ার পতাকা দেখানো হচ্ছিল!
তবে এসব ঘটনাকে ছাড়িয়ে যায় ১৯০০ সালে প্যারিস অলিম্পিকে বেশ কিছু অ্যাথলেটের গণপ্রতিবাদ। প্রতিবাদ এমন মারাত্মক কিছু ছিল না। ‘মারাত্মক’ ছিল আয়োজকদের পদক বিতরণের ব্যাপারে সিদ্ধান্তটা। আয়োজকেরা সিদ্ধান্ত নিলেন, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারীকে যথারীতি রুপা ও ব্রোঞ্জ পদক দেওয়া হবে। কিন্তু প্রথম স্থান অধিকারীকে সোনার পদক দেওয়া হবে না; বদলে একটা পেইন্টিং দেওয়া হবে।
এটাই মেনে নিতে পারেননি অনেকে। সবাই কি আর ফরাসি চিত্রকলার সমঝদার নাকি!
এত দিন পান্থ সাহেবের অনেক রাজা-উজির মারার গল্পে আমরা ভয় পাইনি; কিন্তু এবার আমরা সত্যিই ভয় পেয়ে গেলাম। আমাদের পান্থ সাহেব কি দু-একটা অলিম্পিক পদকের মালিক নাকি!
না, অলিম্পিক নয়; কাছাকাছি মানের জেলা পর্যায়ের এক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন তিনি একবার। তা-ও আর্চারিতে নয়, শ্যুটিংয়ে—৫০ মিটার রাইফেল শ্যুটিং। ভদ্রলোকের আত্মবিশ্বাসের কমতি ছিল না। কারণ, অনেকবার তিনি পার্কে বন্দুক দিয়ে বেলুন ফুটিয়েছেন।
তাই আশপাশে না তাকিয়ে পা শক্ত করে বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে পড়লেন। যদিও ৫০ মিটার দূরের বোর্ড সন্ধে হয়ে আসায় দেখতে একটু সমস্যা হচ্ছিল, তার পরও একে একে ১০টা গুলিই করে ফেললেন। অন্য কোনো প্রতিযোগীর ১০টা গুলি বোর্ডে লাগল না। কী বিস্ময়কর ঘটনা! আমাদের পান্থ সাহেবের ১০টা গুলিই টকটক শব্দ করে বোর্ডে লেগে গেল!
এবার পুরস্কারের পালা, সেই সঙ্গে পান্থ সাহেবের চোখ কপাল ছেড়ে তালুতে ওঠার পালা। তিনি দেখলেন, নয়টি গুলি লাগানো প্রতিযোগী থেকে শুরু করে ছয়টি গুলি পর্যন্ত তিনজন পুরস্কার পেয়ে গেল; কিন্তু ১০-এ ১০ করা পান্থর খোঁজ নেই। তাঁর নাম কেউ বলে না। চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে পান্থ বিচারকদের কাছে গেলেন—ঘটনা কী?
এক বিচারক গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘দেখুন পান্থ সাহেব, আপনার ১০টা গুলিই বোর্ডে লেগেছে, এটা সত্যি। কিন্তু সমস্যা হলো, একটা গুলিও আপনার নিজের বোর্ডে লাগেনি। ওগুলো দুই পাশের প্রতিযোগীদের বোর্ডে গিয়ে লেগেছে।’
হাসবেন না। এমন ঘটনা খোদ অলিম্পিকেও ঘটে থাকে। এই তো ২০০০ সালের সিডনি অলিম্পিকের ঘটনা। গিনির এরিক মুসাম্বানি এসেছিলেন অলিম্পিক সাঁতারে অংশ নিতে। সাঁতারে অংশ নেওয়া তো কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা হলো, মুসাম্বানি ৫০ মিটার পুল দেখে রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন, এত বড় পুল তো জীবনে কখনো দেখেননি; সাঁতরাবেন কী করে!
হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন। মুসাম্বানি অলিম্পিকে আসার মাস খানেক আগে লাইফ জ্যাকেট-ট্যাকেট পরে সাঁতার শিখেছেন। কিন্তু ‘এত্ত বড়’ পুল একা একা পাড়ি দেননি। তার পরও জীবন হাতের মুঠোয় পুরে লাফ দিয়ে পড়লেন পুলে। লাফ তো দিলেন, কিন্তু আর এগোতে পারেন না। হাত-পা ছুড়তেই ডুবে ডুবে যাচ্ছেন। আয়োজকেরা বারবার বললেন, সাহায্য লাগবে কি না। তাঁর অবস্থা তখন সত্যিই শোচনীয়; পানি-টানি গিলে প্রাণ যায় যায়। তার পরও মুসাম্বানি সাঁতার শেষ করলেন!
অলিম্পিকে এখনো মুসাম্বানির নাম উচ্চারিত হলে সবাই ‘স্যালুট’ শব্দটা উচ্চারণ করে। এই মুসাম্বানি, ডং-হিউন নিজেদের সীমাবদ্ধতায় আটকে না থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে লড়াইয়ের সাহস দেখিয়েছেন এবং দেখিয়েছেন, মানুষ চাইলে অনেক কিছু পারে।
এ রকম আরেকজন মানুষের গল্প মনে করা যেতে পারে এই বেলা। এটা অবশ্য ঠিক শারীরিক সীমাবদ্ধতার গল্প নয়, শারীরিক বৃদ্ধির গল্প।
ঘটনা এই ২০০৪ সালের এথেন্স অলিম্পিকের। ইরানি জুডো খেলোয়াড় আশরাফ মিরেসমালি অলিম্পিকে আসার আগে বেশ কাঠখড় পুড়িয়ে নিজের ওজন কমিয়েছেন। ফলে এক ধাপ নিচের ওজন ক্যাটাগরিতে খেলতে পারছেন। সেই ক্যাটাগরিতে বাছাই পর্বও পার হয়ে গেলেন। কিন্তু গোল লাগল এসে ফাইনালে। এক বিচারক ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘আপনার ওজন বেশি মনে হচ্ছে?’
আশরাফ চুপ করে রইলেন। চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করতে ওজন নেওয়া হলো। কী আশ্চর্য! আশরাফের ওজন বেড়ে উচ্চতর ক্যাটাগরিও ছাড়িয়ে যায় যায়!
ব্যাপার কী? ইরানের কর্মকর্তারা এসে ধরলেন আশরাফকে—এই ক দিনে ওজন বেড়ে গেল কী করে? জানা গেল, আগের রাতে বেশি খেয়ে ফেলায় ওজনটা বেড়ে গেছে!
পরে অবশ্য আশরাফ বলেছিলেন, ইসরায়েলকে আইওসি স্বীকৃতি দেওয়ায় তিনি ইচ্ছে করে খেয়ে ওজন বাড়িয়ে খেলায় অংশ না নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
এমন প্রতিবাদ বিভিন্ন সময়ই প্রতিযোগীদের করতে হয়েছে। অলিম্পিকের ইতিহাসে অন্যতম বড় দুটি আলোচিত প্রতিবাদ হয়েছে পতাকা নিয়ে। ১৯০৮ সালে এই লন্ডন অলিম্পিকেই সুইডেন আর যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা জোগাড় করতে ভুলে গিয়েছিলেন আয়োজকেরা। ফলে সুইডিশরা রাগ করে চলে গিয়েছিল। আর যুক্তরাষ্ট্র দল করল আরও ভয়ানক কাজ!
তাদের পতাকা জোগাড় হলো, মার্চপাস্ট শুরু হলো। একটা একটা করে দল ব্রিটেনের রাজা সপ্তম এডওয়ার্ডের সামনে দিয়ে পতাকা নিচু করে সম্মান জানিয়ে চলে গেল। আর যুক্তরাষ্ট্রের পতাকাবাহক রাজার সামনে এসে পতাকাটা আরেকটু বেশি উঁচু করে ধরলেন!
এবারও লন্ডনে উত্তর কোরিয়ান নারী ফুটবলাররা প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কারণ, তাঁদের নামের পাশে দক্ষিণ কোরিয়ার পতাকা দেখানো হচ্ছিল!
তবে এসব ঘটনাকে ছাড়িয়ে যায় ১৯০০ সালে প্যারিস অলিম্পিকে বেশ কিছু অ্যাথলেটের গণপ্রতিবাদ। প্রতিবাদ এমন মারাত্মক কিছু ছিল না। ‘মারাত্মক’ ছিল আয়োজকদের পদক বিতরণের ব্যাপারে সিদ্ধান্তটা। আয়োজকেরা সিদ্ধান্ত নিলেন, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারীকে যথারীতি রুপা ও ব্রোঞ্জ পদক দেওয়া হবে। কিন্তু প্রথম স্থান অধিকারীকে সোনার পদক দেওয়া হবে না; বদলে একটা পেইন্টিং দেওয়া হবে।
এটাই মেনে নিতে পারেননি অনেকে। সবাই কি আর ফরাসি চিত্রকলার সমঝদার নাকি!
No comments