১৫ আগস্ট ও কর্নেল জামিল by জাহীদ রেজা নূর
গণভবনের মধ্যেই একটি বাড়ি। সেই বাড়িতে স্ত্রী-কন্যাদের নিয়ে থাকতেন কর্নেল জামিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোররাত তিনটা-সাড়ে তিনটার দিকে বেজে উঠল লাল ফোনটা। লাল ফোন মানে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলা যায় যে ফোনে। ফোন ধরলেন কর্নেল জামিলের স্ত্রী আনজুমান আরা।
‘হ্যালো!’
‘তুই জামিলকে দে।’ বঙ্গবন্ধুর গম্ভীর কণ্ঠ।
আনজুমান আরা একটু ভয় পান। কর্নেল জামিল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলেন, আনজুমান আরা টেলিফোনের কাছেই দাঁড়িয়ে থাকেন। জামিল বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘স্যার, আপনি ভয় পাবেন না। আমি এখনই আসছি। ঘর বন্ধ রাখুন। কেউ খুলতে বললেও খুলবেন না।’
কর্নেল জামিল এরপর ফোন করলেন সেনাবাহিনীর প্রধান সফিউল্লাহকে। ইংরেজিতে কথা হলো। কথার সারসংক্ষেপ হলো, বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ফেলেছে মিসক্রিয়েন্টরা। ফোর্স পাঠান। সফিউল্লাহ ফোর্স পাঠাবেন বলে জানালেন। এরপর জামিল ফোন করলেন পুলিশ সুপার ও রক্ষীবাহিনীর প্রধানকে। তাঁদের সঙ্গে কথা বলার পর শার্ট-প্যান্ট পরে নিলেন।
গণভবনে ছিল ৩০০ গার্ড রেজিমেন্ট। জামিল তাদের বললেন, ‘প্রস্তুত হও। যেতে হবে।’
তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হলো বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়ির দিকে।
জামিলের হাত টেনে ধরলেন আনজুমান আরা। বললেন, ‘কোথায় যাও?’
জামিল বললেন, ‘ভয় পেয়ো না। বঙ্গবন্ধু বিপদে।’ হাতের তাবিজ দেখিয়ে বললেন, ‘বিপদ হবে না।’
দোতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন কর্নেল জামিল। বাড়িতে অরক্ষিত স্ত্রী ও তিন কন্যাকে রেখে।
জামিল ওঁর ছোট্ট লাল রঙের প্রাইভেট কারে উঠে বসলেন। সঙ্গে ড্রাইভার।
আনজুমান আরার মনটা কেমন করে ওঠে। তিনি ফোন করেন ভাশুর জালালউদ্দিন আহমেদকে। তিনি থাকতেন লালমাটিয়ায়। জালাল ভাই বললেন, ‘তুমি চিন্তা কোরো না। ও তো এই রাস্তা দিয়েই যাবে। আমি দেখছি।’
আনজুমান আরা বসে দোয়া পড়তে থাকেন। শোনা যায় গুলির শব্দ। তাঁর মন কেঁপে ওঠে। ঘরে তখন ১৪ বছরের মেয়ে তাহমিনা আহমেদ, ১২ বছরের আফরোজা জামিল আর সাড়ে চার বছরের ফাহমিদা আহমেদ। গুলির শব্দ শুনে ওরা কান্নাকাটি করছে। রেডিওতে ভেসে আসছে ভয়ংকর বার্তা। বঙ্গবন্ধুকে নাকি হত্যা করা হয়েছে।
এ সময় জামিল কোথায়?
অবশেষে ফোন আসে। সেনাপ্রধান সফিউল্লাহর ফোন। মন শক্ত করে ফোন ধরেন আনজুমান আরা। তিনি স্থির কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, ‘জামিল কোথায়?’
সফিউল্লাহ বলেন, ‘ভাবি, কী বলব। জামিল ভাই...’
এটুকু শোনার পর আনজুমান আরার হাত থেকে টেলিফোন রিসিভার পড়ে যায়। মোহাম্মদপুর থেকে আনজুমান আরার ছোট বোন পারুল এসেছিলেন। তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘বুবু কী?’
আসলে সফিউল্লাহ কী বলতে চেয়েছিলেন, তা বুঝতে পারেননি আনজুমান আরা।
এর মধ্যে জামিলের গাড়ির চালক আইনুদ্দীন ফিরে এসেছেন কাঁদতে কাঁদতে। তিনি আনজুমান আরার সামনেও এলেন না। শুধু কাঁদলেন।
এই রহস্যময় কালো সময়টিতে গণভবনে হাজির হলো একদল সেনা। মিসেস জামিলকে বলল, ‘আপনি এখানে থাকতে পারবেন না।’
অগত্যা ভাশুরের লালমাটিয়ার বাড়িতেই হলো আশ্রয়। আনজুমান আরার জা বললেন, ‘হতভাগী, তুই আসলি!’
আনজুমান আরা বুঝতে পারেন, কিছু একটা হয়েছে। নইলে শাশুড়িই বা বলবেন কেন, ‘নামাজ পড়, দোয়া-দরুদ পড়।’
২.
কর্নেল জামিল আহমেদের স্ত্রী আনজুমান আরার কাছ থেকে আমরা ১৫ আগস্টের ঘটনা শুনছি। সেদিন সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল বিপথগামী একদল সেনা সদস্য। বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে গিয়েছিলেন কর্নেল জামিল। তিনি তখন ডিরেক্টর, ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স। জামিল বেঁচে ফিরে আসেননি। সোবহানবাগ মসজিদের কাছে পৌঁছালে তাঁর গাড়ি দাঁড় করানো হয়। তাঁকে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যেতে নিষেধ করা হয়। জামিল তা শোনেননি। তখন সেখানেই হত্যা করা হয় জামিলকে।
৩.
১৫ আগস্ট রাতে জানা গেল, জামিলের লাশ পড়ে আছে সোবহানবাগ মসজিদের পাশে। লাশ বাড়িতে আনতে দেবে না। ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাবে। দেখলে ওখানে গিয়েই দেখতে হবে।
আনজুমান আরার ছোট ভাই তপন ওর এক বন্ধু খোকনকে নিয়ে জামিলের লাল গাড়িটা থেকে লাশ নামান। একটি ল্যান্ডরোভারে তোলেন। সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য জামিলের স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে গেল ক্যান্টনমেন্টে। আনজুমান আরা দেখলেন, ল্যান্ডরোভার থেকে জামিলের ফরসা দুটো পা বেরিয়ে আছে। তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন। কাফনের কাপড় কোথায় পাওয়া যাবে? জা’য়ের কাছে ছিল একটি সাদা চাদর, সেটা দিয়েই কাফন হলো। খালেদ মোশাররফের স্ত্রী আজমির থেকে এনেছিলেন লোবান, আতর। সেগুলো দিয়ে গোসল দেওয়া হলো।
ওই সেনা সদস্যরা জানালেন, শেষবারের মতো কর্নেল জামিলের লাশ দেখতে দেওয়া হবে না। তাঁদের কথা, কান্নাকাটি করা চলবে না। আনজুমান আরা বললেন, কাঁদবেন না। তবু দেখবেন স্বামীর লাশ।
সাদা চাদরে ঢাকা কর্নেল জামিলের লাশটি নিথর পড়ে আছে। গোসল দেওয়ার পরও সাদা চাদর ছাপিয়ে বুক ভরে গেছে কাঁচা রক্তে। মুখের মধ্যে কাপড় গুঁজে কান্না সংবরণ করার চেষ্টা করেন আনজুমান আরা ও তাঁর সন্তানেরা। জামিলকে নিয়ে যাওয়া হয় বনানীর সেনা গোরস্তানে।
তখনো আনজুমান আরা জানতেন না, পেটে জামিলের চতুর্থ সন্তান। কারিশমা জামিলের জন্ম হয় কর্নেল জামিল হত্যার আট মাস পর।
‘তুই জামিলকে দে।’ বঙ্গবন্ধুর গম্ভীর কণ্ঠ।
আনজুমান আরা একটু ভয় পান। কর্নেল জামিল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলেন, আনজুমান আরা টেলিফোনের কাছেই দাঁড়িয়ে থাকেন। জামিল বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘স্যার, আপনি ভয় পাবেন না। আমি এখনই আসছি। ঘর বন্ধ রাখুন। কেউ খুলতে বললেও খুলবেন না।’
কর্নেল জামিল এরপর ফোন করলেন সেনাবাহিনীর প্রধান সফিউল্লাহকে। ইংরেজিতে কথা হলো। কথার সারসংক্ষেপ হলো, বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ফেলেছে মিসক্রিয়েন্টরা। ফোর্স পাঠান। সফিউল্লাহ ফোর্স পাঠাবেন বলে জানালেন। এরপর জামিল ফোন করলেন পুলিশ সুপার ও রক্ষীবাহিনীর প্রধানকে। তাঁদের সঙ্গে কথা বলার পর শার্ট-প্যান্ট পরে নিলেন।
গণভবনে ছিল ৩০০ গার্ড রেজিমেন্ট। জামিল তাদের বললেন, ‘প্রস্তুত হও। যেতে হবে।’
তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হলো বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়ির দিকে।
জামিলের হাত টেনে ধরলেন আনজুমান আরা। বললেন, ‘কোথায় যাও?’
জামিল বললেন, ‘ভয় পেয়ো না। বঙ্গবন্ধু বিপদে।’ হাতের তাবিজ দেখিয়ে বললেন, ‘বিপদ হবে না।’
দোতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন কর্নেল জামিল। বাড়িতে অরক্ষিত স্ত্রী ও তিন কন্যাকে রেখে।
জামিল ওঁর ছোট্ট লাল রঙের প্রাইভেট কারে উঠে বসলেন। সঙ্গে ড্রাইভার।
আনজুমান আরার মনটা কেমন করে ওঠে। তিনি ফোন করেন ভাশুর জালালউদ্দিন আহমেদকে। তিনি থাকতেন লালমাটিয়ায়। জালাল ভাই বললেন, ‘তুমি চিন্তা কোরো না। ও তো এই রাস্তা দিয়েই যাবে। আমি দেখছি।’
আনজুমান আরা বসে দোয়া পড়তে থাকেন। শোনা যায় গুলির শব্দ। তাঁর মন কেঁপে ওঠে। ঘরে তখন ১৪ বছরের মেয়ে তাহমিনা আহমেদ, ১২ বছরের আফরোজা জামিল আর সাড়ে চার বছরের ফাহমিদা আহমেদ। গুলির শব্দ শুনে ওরা কান্নাকাটি করছে। রেডিওতে ভেসে আসছে ভয়ংকর বার্তা। বঙ্গবন্ধুকে নাকি হত্যা করা হয়েছে।
এ সময় জামিল কোথায়?
অবশেষে ফোন আসে। সেনাপ্রধান সফিউল্লাহর ফোন। মন শক্ত করে ফোন ধরেন আনজুমান আরা। তিনি স্থির কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, ‘জামিল কোথায়?’
সফিউল্লাহ বলেন, ‘ভাবি, কী বলব। জামিল ভাই...’
এটুকু শোনার পর আনজুমান আরার হাত থেকে টেলিফোন রিসিভার পড়ে যায়। মোহাম্মদপুর থেকে আনজুমান আরার ছোট বোন পারুল এসেছিলেন। তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘বুবু কী?’
আসলে সফিউল্লাহ কী বলতে চেয়েছিলেন, তা বুঝতে পারেননি আনজুমান আরা।
এর মধ্যে জামিলের গাড়ির চালক আইনুদ্দীন ফিরে এসেছেন কাঁদতে কাঁদতে। তিনি আনজুমান আরার সামনেও এলেন না। শুধু কাঁদলেন।
এই রহস্যময় কালো সময়টিতে গণভবনে হাজির হলো একদল সেনা। মিসেস জামিলকে বলল, ‘আপনি এখানে থাকতে পারবেন না।’
অগত্যা ভাশুরের লালমাটিয়ার বাড়িতেই হলো আশ্রয়। আনজুমান আরার জা বললেন, ‘হতভাগী, তুই আসলি!’
আনজুমান আরা বুঝতে পারেন, কিছু একটা হয়েছে। নইলে শাশুড়িই বা বলবেন কেন, ‘নামাজ পড়, দোয়া-দরুদ পড়।’
২.
কর্নেল জামিল আহমেদের স্ত্রী আনজুমান আরার কাছ থেকে আমরা ১৫ আগস্টের ঘটনা শুনছি। সেদিন সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল বিপথগামী একদল সেনা সদস্য। বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে গিয়েছিলেন কর্নেল জামিল। তিনি তখন ডিরেক্টর, ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স। জামিল বেঁচে ফিরে আসেননি। সোবহানবাগ মসজিদের কাছে পৌঁছালে তাঁর গাড়ি দাঁড় করানো হয়। তাঁকে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যেতে নিষেধ করা হয়। জামিল তা শোনেননি। তখন সেখানেই হত্যা করা হয় জামিলকে।
৩.
১৫ আগস্ট রাতে জানা গেল, জামিলের লাশ পড়ে আছে সোবহানবাগ মসজিদের পাশে। লাশ বাড়িতে আনতে দেবে না। ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাবে। দেখলে ওখানে গিয়েই দেখতে হবে।
আনজুমান আরার ছোট ভাই তপন ওর এক বন্ধু খোকনকে নিয়ে জামিলের লাল গাড়িটা থেকে লাশ নামান। একটি ল্যান্ডরোভারে তোলেন। সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য জামিলের স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে গেল ক্যান্টনমেন্টে। আনজুমান আরা দেখলেন, ল্যান্ডরোভার থেকে জামিলের ফরসা দুটো পা বেরিয়ে আছে। তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন। কাফনের কাপড় কোথায় পাওয়া যাবে? জা’য়ের কাছে ছিল একটি সাদা চাদর, সেটা দিয়েই কাফন হলো। খালেদ মোশাররফের স্ত্রী আজমির থেকে এনেছিলেন লোবান, আতর। সেগুলো দিয়ে গোসল দেওয়া হলো।
ওই সেনা সদস্যরা জানালেন, শেষবারের মতো কর্নেল জামিলের লাশ দেখতে দেওয়া হবে না। তাঁদের কথা, কান্নাকাটি করা চলবে না। আনজুমান আরা বললেন, কাঁদবেন না। তবু দেখবেন স্বামীর লাশ।
সাদা চাদরে ঢাকা কর্নেল জামিলের লাশটি নিথর পড়ে আছে। গোসল দেওয়ার পরও সাদা চাদর ছাপিয়ে বুক ভরে গেছে কাঁচা রক্তে। মুখের মধ্যে কাপড় গুঁজে কান্না সংবরণ করার চেষ্টা করেন আনজুমান আরা ও তাঁর সন্তানেরা। জামিলকে নিয়ে যাওয়া হয় বনানীর সেনা গোরস্তানে।
তখনো আনজুমান আরা জানতেন না, পেটে জামিলের চতুর্থ সন্তান। কারিশমা জামিলের জন্ম হয় কর্নেল জামিল হত্যার আট মাস পর।
No comments