তোমার আসন শূন্য আজি by ওয়াহিদ নবি
আজ তাঁর হত্যা দিবসে তাঁর আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। ইতিহাসের নির্লজ্জতম নিষ্ঠুর এই হত্যাকাণ্ড জাতির মুখে কলঙ্কের কালিমা লেপন করে দিয়েছে। আট বছরের বালককে খুঁজে এনে রাইফেলের গুলিতে হত্যা করা সম্ভবত আর কোনো দেশে কোনোকালে ঘটেনি।
রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূকে হত্যা করা পৃথিবীর আর কোনো দেশে ঘটেছে- এমনটি কেউ কোনো দিন শোনেনি। আসলে হত্যাকারীদের পরিকল্পনা ছিল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যাঁদের সম্পর্ক রয়েছে তাঁদের সবাইকে পৃথিবীর বুক থেকে সরিয়ে দেওয়া। কী হৃদয়হীন উন্মাদনা!
হত্যাকারীরা বয়সে তরুণ জুনিয়র সেনা কর্মকর্তা। যে পদে তাঁরা অধিষ্ঠিত ছিলেন সে পদে তাঁরা উন্নীত হতেন না যদি বাংলাদেশে জন্ম না হতো। এমনি নানা কারণে তাঁদের মাথা গরম ছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই জুনিয়র সেনা অফিসাররা নিজেরাই কি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এমন জঘন্য কাজ করার? বিভিন্ন তথ্যে যা জানা গেছে তাতে এমনটা মনে হয় না। যে জঘন্য ঘটনা সেদিন ঘটেছিল, তা বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন আজও ফুরায়নি। এই বিশ্লেষণ আমাদের সাহায্য করবে- এ ধরনের ঘটনা প্রতিহত করতে।
এই বিশ্লেষণের প্রয়োজনে প্রথমেই আমাদের পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখতে হবে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর থেকে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে কী ঘটেছিল। সব ঘটনা আলোচনা করা সম্ভব নয়। আবার সব ঘটনার ব্যাখ্যা সবাই এককভাবে দেবেন না। তাই এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা প্রয়োজন। আলোচনা অবশ্য অনেক হয়েছে; কিন্তু মেনে নিতে হবে যে সেগুলো কেমন যেন গা-বাঁচানো ধরনের আলোচনা। মেনে নিতে হবে এই আলোচনাগুলো হয়েছে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বা বড়জোর আদর্শগত দৃষ্টিকোণ থেকে।
প্রথমেই ধরা যাক, স্বাধীনতার কাছে সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা কী ছিল? এটা বললে ভুল হবে না যে অধিকাংশের প্রত্যাশা বাস্তবসম্মত ছিল না। এ জন্য অবশ্য সম্পূর্ণ তাদের দায়ী করা ঠিক হবে না। বহু বছর থেকে তারা শুনে এসেছে যে পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরাট বৈষম্য রয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তান শোষণ করছে পূর্ব পাকিস্তানকে। ছলেবলে কৌশলে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। এসব কথা মিথ্যা নয়। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ অত্যন্ত সহজভাবে ধরে নিল যে যেহেতু এখন আর বাংলাদেশের সম্পদ বাইরে চলে যাবে না, তাই তাদের আর্থিক অবস্থা শিগগিরই ভালো হয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধু দলীয় মানুষের প্রতি কঠোর হতে পারলেন না। আওয়ামী লীগের কর্মীরা বিভিন্ন সময়ে, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সময় কত ভোগান্তির শিকার হয়েছিল, এ জন্যই হয়তো তিনি কঠোর হতে পারেননি। কিন্তু এতে করে প্রশাসন দুর্বল হয়ে পড়েছিল। স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগ নেতারা পুলিশের ওপর প্রভাব বিস্তার করে দুষ্কৃতকারীদের শাস্তি বিধানে বাধার সৃষ্টি করেন। সেনাবাহিনীর কিছু নেতা উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে পড়েছিলেন। সিভিল অফিসাররা যাঁরা পাকিস্তান সেনাশাসনের আমলে সর্বেসর্বা হয়ে পড়েছিলেন তাঁরা রাজনৈতিক নেতৃত্ব সহ্য করতে পারছিলেন না। এ ছাড়া ছিল সিএসপি বনাম ইপিসিএস সমস্যা। ভারত ফেরা ও না ফেরা ইত্যাদি সমস্যা। যে জাতি স্বাধীনতাযুদ্ধে সর্বস্ব ত্যাগে ব্রতী হয়েছিল, সেই একই জাতি স্বাধীনতার পর আত্মকেন্দ্রিকতার শীর্ষে আরোহণ করল।
চাটুকারিতা এই সুযোগে চরম আকার ধারণ করল। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে, বঙ্গবন্ধুর জোলিও কুরি পুরস্কার পাওয়ার কথা। দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ মিছিলের পর মিছিল বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানাতে আসে। এরা নিজেদের কাজ তো ভালোভাবে করেইনি, একটা সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাজেও এরা ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। বিনয়াবনত বঙ্গবন্ধু এসব সহ্য করেছিলেন; কিন্তু জাতির ক্ষতি হয়েছে। চাটুকার কখনো নিঃস্বার্থ হয় না, এটা বঙ্গবন্ধু পরে বুঝেছিলেন। একজন অসহায় মানুষের আকুল আর্তনাদের মতো শুনিয়েছিল যখন তিনি বলেছিলেন, 'আমি ভিক্ষা করে আনি আর চাটার দল সব খেয়ে ফেলে।'
আওয়ামী লীগেরই লোকজন বিশেষণযুক্ত সমাজতন্ত্রের কথা বলে অন্য একটি দল গঠন করে ভীষণ সমস্যার সৃষ্টি করে, যা শেষে রক্তপাত পর্যন্ত গড়ায়। এরা ভারতের 'রণদিভ থিওরির' ব্যর্থতার কথা ভুলে গিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু 'মুক্তির' কথা বলেছিলেন। কেউ কর্ণপাত করেনি। সমাজতন্ত্রের কথা অবহেলিত হয়েছে। কলকারখানার জাতীয়করণ নানা কারণে ব্যর্থ হয়েছে, যা পরবর্তীকালে স্বাধীনতার শত্রুরা নিজেদের কাজে ব্যবহার করেছে।
শিক্ষাব্যবস্থায়ও একটা অরাজকতার সৃষ্টি হতে শুরু হয় এ সময়। ব্যাপক নকল ইন্ডাস্ট্রির সূচনা হয়।
আর একটা ভয়াবহ প্রবণতার সৃষ্টি হয় এ সময় আর তা হচ্ছে ব্যক্তিপূজা। বঙ্গবন্ধু নিশ্চয়ই শ্রদ্ধার পাত্র। কিন্তু এমন অবস্থার সৃষ্টি হলো যে সব সিদ্ধান্ত তাঁকেই নিতে হবে। অন্য কারো সিদ্ধান্ত কেউ পাত্তা দিতে রাজি নয়। একটা প্রায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হলো প্রশাসনে। এমনই সব অবস্থার সৃষ্টি হলো, যা না হলেই ভালো হতো।
শত্রুরা শত্রুতা করবে- এটাই স্বাভাবিক। ইসলামপন্থী স্বাধীনতার শত্রুরা সুযোগ পেলেই স্বাধীনতার ক্ষতি করবে- এটাই স্বাভাবিক। তাদের সঙ্গে যোগ দিল উগ্র বামপন্থীরা। হেগেলের অমর বাণী আর একবার সত্য বলে প্রমাণিত হলো, 'টু এক্সট্রিমস উইল গেট টুগেদার'। যা হোক, এটা হয়তো মনে করা উচিত নয় যে পরাজিত শক্তি দুনিয়া ছেড়ে চলে যায়। তারা শুধু ঘাপটি মেরেও ওত পেতে থাকে।
সন্ত্রাস প্রতিরোধ করার মানসে বঙ্গবন্ধু রক্ষীবাহিনী সৃষ্টি করেছিলেন। নিয়মিত বাহিনী ছাড়াও অন্য বাহিনী সৃষ্টির প্রয়োজনে অন্য দেশেও গঠিত হয়েছিল। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক জনগণ রক্ষীবাহিনীকে ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। এর জন্য তাঁরা নিজেরাও দায়ী। খুলনার এক হাসপাতালে একজন সিনিয়র চিকিৎসককে ভীষণভাবে প্রহার করায় ডাক্তাররা খেপে যান। কিন্তু এই বাহিনী কাজের সময় কোনো কাজেই আসেনি। ফারুক-রশিদের বিরুদ্ধে এরা টুঁ-শব্দ করেনি।
একদলীয় ব্যবস্থা মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। সেদিনের সেই অবস্থায় কেন একদলীয় ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়েছিল এ কথা জনসাধারণের কাছে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা হয়নি।
অবিভক্ত ভারতে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র থাকাবস্থায় বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের শুরু। ঢাকায় আসার পর প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। এই রাজনৈতিক চলার পথে অনেক দুঃখ-যাতনার ভেতর দিয়ে তাঁকে যেতে হয়েছে। কারাগার ছিল তাঁর দ্বিতীয় বাসস্থান। আইয়ুব সরকার বিভিন্ন জায়গায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করে তাঁকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে। ছয় দফার আন্দোলনের সময় দলের অনেক শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি দল ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানের অবাস্তবতা বুঝতে মানুষের অনেক সময় লেগেছে। দীর্ঘ সংগ্রামের জন্য তাঁকে জাতি বঙ্গবন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছে। হঠাৎ করে রাজনৈতিক অঙ্গনে এসে বাজিমাত করার চেষ্টা করেছে কেউ কেউ। অবাস্তব সব গালভরা উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে তাদের। সরকারের প্রচারযন্ত্র ব্যবহার করে নানা রকমের নাটকীয় সব জিনিসপত্র দেখিয়ে ব্যক্তিগত গুণাগুণ জাহির করার চেষ্টা করা হয়েছে। তাঁর খুনিদের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত করেছে এসব গুণান্বিত ব্যক্তি।
বঙ্গবন্ধু বিরোধীরা বলে, তাঁকে তাঁর হত্যার পর জনগণ পথে নামেনি। এরা কি জানে না সামরিক অভ্যুত্থানের প্রচণ্ড ধাক্কা সামলে নিয়ে তার মোকাবিলা করার জন্য জনগণের সময় দরকার। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের দিকে তাকিয়ে দেখুক তারা। মাত্র কয়েক বছর পর বঙ্গবন্ধু কন্যার প্রত্যাবর্তন দিবসে জনসমাগমের দিকে তাকিয়ে দেখুক তারা। আর আমরা সবাই আরেকবার রবীন্দ্রনাথের 'শিশুতীর্থ' কবিতাটি পড়ে নিই। আরেকবার বিখ্যাত ফরাসি লেখক আলেকজান্ডার ডুমার বিখ্যাত বই 'ব্লাক টিউলিপ' পড়ে নিই।
জাতি হিসেবে আমাদের সামনে আরো অনেক পথচলা বাকি। জাতির মনের মণিকোঠায় বঙ্গবন্ধু যে স্থানে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন, সে স্থানে আর কে কবে অধিষ্ঠিত হবেন, জানি না। কিন্তু তাঁর পথচলার স্মৃতি তো রইল। তাঁর অভিজ্ঞতা আমাদের পথচলায় পাথেয় হোক। আসলে তাঁর কর্মকাণ্ডের আর আমাদের দেশের বাস্তবতার বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণের প্রয়োজন।
লেখক : লন্ডন প্রবাসী চিকিৎসক
হত্যাকারীরা বয়সে তরুণ জুনিয়র সেনা কর্মকর্তা। যে পদে তাঁরা অধিষ্ঠিত ছিলেন সে পদে তাঁরা উন্নীত হতেন না যদি বাংলাদেশে জন্ম না হতো। এমনি নানা কারণে তাঁদের মাথা গরম ছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই জুনিয়র সেনা অফিসাররা নিজেরাই কি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এমন জঘন্য কাজ করার? বিভিন্ন তথ্যে যা জানা গেছে তাতে এমনটা মনে হয় না। যে জঘন্য ঘটনা সেদিন ঘটেছিল, তা বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন আজও ফুরায়নি। এই বিশ্লেষণ আমাদের সাহায্য করবে- এ ধরনের ঘটনা প্রতিহত করতে।
এই বিশ্লেষণের প্রয়োজনে প্রথমেই আমাদের পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখতে হবে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর থেকে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে কী ঘটেছিল। সব ঘটনা আলোচনা করা সম্ভব নয়। আবার সব ঘটনার ব্যাখ্যা সবাই এককভাবে দেবেন না। তাই এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা প্রয়োজন। আলোচনা অবশ্য অনেক হয়েছে; কিন্তু মেনে নিতে হবে যে সেগুলো কেমন যেন গা-বাঁচানো ধরনের আলোচনা। মেনে নিতে হবে এই আলোচনাগুলো হয়েছে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বা বড়জোর আদর্শগত দৃষ্টিকোণ থেকে।
প্রথমেই ধরা যাক, স্বাধীনতার কাছে সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা কী ছিল? এটা বললে ভুল হবে না যে অধিকাংশের প্রত্যাশা বাস্তবসম্মত ছিল না। এ জন্য অবশ্য সম্পূর্ণ তাদের দায়ী করা ঠিক হবে না। বহু বছর থেকে তারা শুনে এসেছে যে পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরাট বৈষম্য রয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তান শোষণ করছে পূর্ব পাকিস্তানকে। ছলেবলে কৌশলে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। এসব কথা মিথ্যা নয়। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ অত্যন্ত সহজভাবে ধরে নিল যে যেহেতু এখন আর বাংলাদেশের সম্পদ বাইরে চলে যাবে না, তাই তাদের আর্থিক অবস্থা শিগগিরই ভালো হয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধু দলীয় মানুষের প্রতি কঠোর হতে পারলেন না। আওয়ামী লীগের কর্মীরা বিভিন্ন সময়ে, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সময় কত ভোগান্তির শিকার হয়েছিল, এ জন্যই হয়তো তিনি কঠোর হতে পারেননি। কিন্তু এতে করে প্রশাসন দুর্বল হয়ে পড়েছিল। স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগ নেতারা পুলিশের ওপর প্রভাব বিস্তার করে দুষ্কৃতকারীদের শাস্তি বিধানে বাধার সৃষ্টি করেন। সেনাবাহিনীর কিছু নেতা উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে পড়েছিলেন। সিভিল অফিসাররা যাঁরা পাকিস্তান সেনাশাসনের আমলে সর্বেসর্বা হয়ে পড়েছিলেন তাঁরা রাজনৈতিক নেতৃত্ব সহ্য করতে পারছিলেন না। এ ছাড়া ছিল সিএসপি বনাম ইপিসিএস সমস্যা। ভারত ফেরা ও না ফেরা ইত্যাদি সমস্যা। যে জাতি স্বাধীনতাযুদ্ধে সর্বস্ব ত্যাগে ব্রতী হয়েছিল, সেই একই জাতি স্বাধীনতার পর আত্মকেন্দ্রিকতার শীর্ষে আরোহণ করল।
চাটুকারিতা এই সুযোগে চরম আকার ধারণ করল। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে, বঙ্গবন্ধুর জোলিও কুরি পুরস্কার পাওয়ার কথা। দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ মিছিলের পর মিছিল বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানাতে আসে। এরা নিজেদের কাজ তো ভালোভাবে করেইনি, একটা সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাজেও এরা ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। বিনয়াবনত বঙ্গবন্ধু এসব সহ্য করেছিলেন; কিন্তু জাতির ক্ষতি হয়েছে। চাটুকার কখনো নিঃস্বার্থ হয় না, এটা বঙ্গবন্ধু পরে বুঝেছিলেন। একজন অসহায় মানুষের আকুল আর্তনাদের মতো শুনিয়েছিল যখন তিনি বলেছিলেন, 'আমি ভিক্ষা করে আনি আর চাটার দল সব খেয়ে ফেলে।'
আওয়ামী লীগেরই লোকজন বিশেষণযুক্ত সমাজতন্ত্রের কথা বলে অন্য একটি দল গঠন করে ভীষণ সমস্যার সৃষ্টি করে, যা শেষে রক্তপাত পর্যন্ত গড়ায়। এরা ভারতের 'রণদিভ থিওরির' ব্যর্থতার কথা ভুলে গিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু 'মুক্তির' কথা বলেছিলেন। কেউ কর্ণপাত করেনি। সমাজতন্ত্রের কথা অবহেলিত হয়েছে। কলকারখানার জাতীয়করণ নানা কারণে ব্যর্থ হয়েছে, যা পরবর্তীকালে স্বাধীনতার শত্রুরা নিজেদের কাজে ব্যবহার করেছে।
শিক্ষাব্যবস্থায়ও একটা অরাজকতার সৃষ্টি হতে শুরু হয় এ সময়। ব্যাপক নকল ইন্ডাস্ট্রির সূচনা হয়।
আর একটা ভয়াবহ প্রবণতার সৃষ্টি হয় এ সময় আর তা হচ্ছে ব্যক্তিপূজা। বঙ্গবন্ধু নিশ্চয়ই শ্রদ্ধার পাত্র। কিন্তু এমন অবস্থার সৃষ্টি হলো যে সব সিদ্ধান্ত তাঁকেই নিতে হবে। অন্য কারো সিদ্ধান্ত কেউ পাত্তা দিতে রাজি নয়। একটা প্রায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হলো প্রশাসনে। এমনই সব অবস্থার সৃষ্টি হলো, যা না হলেই ভালো হতো।
শত্রুরা শত্রুতা করবে- এটাই স্বাভাবিক। ইসলামপন্থী স্বাধীনতার শত্রুরা সুযোগ পেলেই স্বাধীনতার ক্ষতি করবে- এটাই স্বাভাবিক। তাদের সঙ্গে যোগ দিল উগ্র বামপন্থীরা। হেগেলের অমর বাণী আর একবার সত্য বলে প্রমাণিত হলো, 'টু এক্সট্রিমস উইল গেট টুগেদার'। যা হোক, এটা হয়তো মনে করা উচিত নয় যে পরাজিত শক্তি দুনিয়া ছেড়ে চলে যায়। তারা শুধু ঘাপটি মেরেও ওত পেতে থাকে।
সন্ত্রাস প্রতিরোধ করার মানসে বঙ্গবন্ধু রক্ষীবাহিনী সৃষ্টি করেছিলেন। নিয়মিত বাহিনী ছাড়াও অন্য বাহিনী সৃষ্টির প্রয়োজনে অন্য দেশেও গঠিত হয়েছিল। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক জনগণ রক্ষীবাহিনীকে ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। এর জন্য তাঁরা নিজেরাও দায়ী। খুলনার এক হাসপাতালে একজন সিনিয়র চিকিৎসককে ভীষণভাবে প্রহার করায় ডাক্তাররা খেপে যান। কিন্তু এই বাহিনী কাজের সময় কোনো কাজেই আসেনি। ফারুক-রশিদের বিরুদ্ধে এরা টুঁ-শব্দ করেনি।
একদলীয় ব্যবস্থা মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। সেদিনের সেই অবস্থায় কেন একদলীয় ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়েছিল এ কথা জনসাধারণের কাছে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা হয়নি।
অবিভক্ত ভারতে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র থাকাবস্থায় বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের শুরু। ঢাকায় আসার পর প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। এই রাজনৈতিক চলার পথে অনেক দুঃখ-যাতনার ভেতর দিয়ে তাঁকে যেতে হয়েছে। কারাগার ছিল তাঁর দ্বিতীয় বাসস্থান। আইয়ুব সরকার বিভিন্ন জায়গায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করে তাঁকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে। ছয় দফার আন্দোলনের সময় দলের অনেক শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি দল ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানের অবাস্তবতা বুঝতে মানুষের অনেক সময় লেগেছে। দীর্ঘ সংগ্রামের জন্য তাঁকে জাতি বঙ্গবন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছে। হঠাৎ করে রাজনৈতিক অঙ্গনে এসে বাজিমাত করার চেষ্টা করেছে কেউ কেউ। অবাস্তব সব গালভরা উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে তাদের। সরকারের প্রচারযন্ত্র ব্যবহার করে নানা রকমের নাটকীয় সব জিনিসপত্র দেখিয়ে ব্যক্তিগত গুণাগুণ জাহির করার চেষ্টা করা হয়েছে। তাঁর খুনিদের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত করেছে এসব গুণান্বিত ব্যক্তি।
বঙ্গবন্ধু বিরোধীরা বলে, তাঁকে তাঁর হত্যার পর জনগণ পথে নামেনি। এরা কি জানে না সামরিক অভ্যুত্থানের প্রচণ্ড ধাক্কা সামলে নিয়ে তার মোকাবিলা করার জন্য জনগণের সময় দরকার। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের দিকে তাকিয়ে দেখুক তারা। মাত্র কয়েক বছর পর বঙ্গবন্ধু কন্যার প্রত্যাবর্তন দিবসে জনসমাগমের দিকে তাকিয়ে দেখুক তারা। আর আমরা সবাই আরেকবার রবীন্দ্রনাথের 'শিশুতীর্থ' কবিতাটি পড়ে নিই। আরেকবার বিখ্যাত ফরাসি লেখক আলেকজান্ডার ডুমার বিখ্যাত বই 'ব্লাক টিউলিপ' পড়ে নিই।
জাতি হিসেবে আমাদের সামনে আরো অনেক পথচলা বাকি। জাতির মনের মণিকোঠায় বঙ্গবন্ধু যে স্থানে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন, সে স্থানে আর কে কবে অধিষ্ঠিত হবেন, জানি না। কিন্তু তাঁর পথচলার স্মৃতি তো রইল। তাঁর অভিজ্ঞতা আমাদের পথচলায় পাথেয় হোক। আসলে তাঁর কর্মকাণ্ডের আর আমাদের দেশের বাস্তবতার বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণের প্রয়োজন।
লেখক : লন্ডন প্রবাসী চিকিৎসক
No comments