চারদিক- দেয়ালের জবানবন্দি by সাইফুল সামিন

বুকের ভেতর হঠাৎ তীব্র মোচড়। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়িতে পা রাখতেই অনুভূতিটা চেপে বসে। বর্তমানে সড়ক নম্বর ১১, বাড়ি নম্বর ১০। তিন তলার ছোট্ট বাড়ি। গাছপালার ছায়াঘেরা। সাদামাটা। কী আশ্চর্য, এটিই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন!


১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর থেকে এ বাড়িতে সপরিবারে বসবাস শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। একসময় এ বাড়ি বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের সূতিকাগারে পরিণত হয়।
আবার এই বাড়িতেই ঘটে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোররাতে এ বাড়ি আক্রমণ করে বিপথগামী একদল উচ্চাভিলাষী সেনা কর্মকর্তা। তারা নির্মমভাবে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু ছাড়াও ঘাতকের বুলেট কেড়ে নেয় তাঁর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশু শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল, রোজী জামাল, ভাই শেখ আবু নাসেরের প্রাণ। দেশের বাইরে থাকায় ঘাতক চক্রের হাত থেকে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই বঙ্গবন্ধুর বিশাল প্রতিকৃতি। উন্নত শির। বজ্রকঠিন ব্যক্তিত্ব। বুক তাঁর বাংলাদেশের হূদয়। পরম শ্রদ্ধায় অবনত হয় মস্তক।
ভবনের নিচের তলার প্রথম কক্ষের দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের অসংখ্য ছবি। ১৯৪৮ সালে হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর সঙ্গে, ১৯৪৯ সালে কারাগার থেকে মুক্তি, ১৯৫৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মওলানা ভাসানীর সঙ্গে প্রভাতফেরিতে, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ, ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ, ইন্দিরা গান্ধী ও ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশে নিয়ে আসার পর তাঁকে স্বাগত জানানোসহ বিভিন্ন ছবি খুলে দেয় ইতিহাসের দরজা। মনের পর্দায় বাঙালির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন জীবন্ত।
এ কক্ষটির ডান পাশে বঙ্গবন্ধুর পাঠাগার। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ১২টার পর এ কক্ষ থেকেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। কক্ষের শেলফে সাজানো আছে নানা রকমের বই। চেয়ার, টেবিলসহ বেশ কিছু জিনিস এখনো অবিকৃত। টেবিলের ওপর রাখা কয়েকটি বইয়ের দিকে হঠাৎ চোখ আটকে যায়। বইয়ের বুকে ১৫ আগস্ট ঘাতকদের চালানো গুলির চিহ্ন। আছে গুলিবিদ্ধ ছবিও।
নিচতলার প্রথম কক্ষের বাঁ পাশে সংকীর্ণ লম্বা করিডর। সেখানকার দুই পাশের দেয়ালের ওপরের দিকে ১৫ আগস্ট নিহত ব্যক্তিদের ছবি।
পেছনের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে হয়। ছোট্ট বারান্দা পেরিয়েই খাওয়ার কক্ষ। ছোট্ট ডাইনিং টেবিল, টেবিলে সাজানো প্লেট-গ্লাসসহ অন্যান্য জিনিসপত্র। এর পাশে খুব সাধারণ কয়েকটি সোফা ও মোড়া। কোনার দিকে একটি টিভি। অবাক লাগে, একটা দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের জীবনযাপন ছিল কতটা সাধারণ! এখানকার দেয়ালেও আছে বেশ কিছু গুলির চিহ্ন।
খাওয়ার জায়গা থেকে বাঁয়ে বঙ্গবন্ধুর শোয়ার ঘর। ১৫ আগস্ট ভোরে এখানেই বেগম মুজিব, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামালকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তাঁদের রক্তাক্ত মরদেহ এ ঘরটিতেই পড়ে ছিল। কক্ষের গুলিবিদ্ধ দেয়াল ঘাতকদের নির্মমতার চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে।
গুলির আঘাতে কারও মাথার মগজ উড়ে গিয়ে ছাদের সঙ্গে আটকে গিয়েছিল। শুকিয়ে যাওয়া সেই মগজের সঙ্গে কয়েকটি চুল রক্ত সহকারে এখনো আটকে আছে। জায়গাটি কাচ দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে।
ডাইনিং ও বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষ পেরিয়ে করিডর দিয়ে যেতে হয় শেখ রেহানার কক্ষে। সেখানে সাজানো বঙ্গবন্ধু পরিবারের নানা স্মারক। দেয়ালে ঝোলানো বঙ্গবন্ধুর গুলিবিদ্ধ ছবি। আছে কফিন আর সমাধিসৌধের ছবি। বেশ কয়েকটি আলমারিতে রাখা বঙ্গবন্ধুর ব্যবহূত পাইপ, শাল, লুঙ্গি ও কোট। আরও আছে বেশ কিছু শাড়ি, স্যান্ডেল, ব্যাগ, কোরআন শরিফ, তজবিসহ নানা জিনিস। এ কক্ষের দেয়ালেও আছে গুলির চিহ্ন।
এর পরে ডানদিকে শেখ জামালের কক্ষ। এখানে শেখ জামালের বিয়ের নাগড়া, রোজীর বিয়ের জুতা, একটি খাট, আলনা, কিছু কাপড়, ড্রেসিং টেবিলে চুড়ি ও চুলের কাঁটা, চেয়ার, টেবিল, শোকেসে সাজানো জিনিসপত্র, আলমারি, ফোন, ক্রিকেট ব্যাটসহ নানা জিনিস।
এ ঘর থেকে বেরিয়ে করিডর ধরে নিচে যাওয়ার জন্য একটি সিঁড়ি আছে। বাংলাদেশের ইতিহাস এ সিঁড়িতেই থমকে গেছে। সিঁড়ির কাছে আসতেই কানে বাজে ঘাতকদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধুর সেই হাঁক, ‘তোরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?’
সিঁড়ির দুই-তিন ধাপ নামতেই বৃষ্টির মতো গুলি। ঘাতকদের গুলিতে বঙ্গবন্ধুর শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যায়। তাঁর নিথর দেহটা সিঁড়ির মধ্যে পড়ে থাকে। সারা সিঁড়ি ভেসে যায় রক্তে। কাচে ঢাকা সিঁড়ির দিকে তাকাতেই ভেতরটা কেমন হু হু করে। শোকে, ক্ষোভে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। চোখে ভাসে জাতির জনকের রক্তস্রোত। রক্তের দাগ এখন কিছুটা ঝাপসা। তবে গুলির চিহ্নগুলো তাজা।
সিঁড়ির পাশের দেয়ালে বাংলাদেশের পতাকা ঝোলানো। পতাকার সবুজ জমিনের মাঝখানে টকটকে লাল বৃত্ত, এ যেন বঙ্গবন্ধুর রক্তাক্ত হূদয়েরই চিত্র। সিঁড়ির নিচের দিকের দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর গুলিবিদ্ধ, রক্তাক্ত দেহের প্রতীকী ছবি। নির্বাক দেয়াল এ দৃশ্যের প্রত্যক্ষদর্শী।
এখানকার মতো এ বাড়ির প্রতিটি দেয়ালই ১৫ আগস্টের নির্মমতার নীরব সাক্ষী। কান পাতলেই শোনা যায়—দেয়ালের জবানবন্দি।
সাইফুল সামিন
saiful.samin@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.