আফগানিস্তান- কার জন্য এই বিভীষিকা? by মশিউল আলম

গত শুক্রবার সকালে আফগানিস্তানে একজন পুলিশ কর্মকর্তা তিনজন আমেরিকান সেনাকে গুলি করে হত্যা করেছেন। একই দিন রাতের বেলা আরও তিনজন ন্যাটো সেনাকে একইভাবে হত্যা করেছেন আরেকজন পুলিশ সদস্য। ন্যাটো কর্তৃপক্ষ এখনো বলেনি পরের তিন সেনা কোন দেশের, কিন্তু আফগান কর্তৃপক্ষ বলেছে, তাঁরাও মার্কিন সেনা।


আফগান কর্তৃপক্ষের ভাষ্য সত্য হলে সেদিন ২৪ ঘণ্টায় আফগানিস্তানে নিহত হয়েছেন ছয়জন মার্কিন সেনা। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার, প্রতিরক্ষা বিভাগ ও জনগণের জন্য এটা বিরাট দুঃসংবাদ।
ওই মার্কিন সেনারা তালেবান বা কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীর হাতে নিহত হননি। তাঁদের হত্যা করেছেন আফগান সরকারের পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তারা, যাঁদের ন্যাটো বাহিনীর সদস্যরা প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। গত সাড়ে সাত মাসে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীর সদস্যদের ওপর আফগান নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর সদস্যরা এ রকম হামলা করেছেন ২৭ বার, হত্যা করেছেন ৩৭ জন ন্যাটো সেনাকে। তাঁদের অধিকাংশই মার্কিন।
নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, গত ১০ বছরে আফগানিস্তানের যুদ্ধে এক হাজার ৮৩৪ জন মার্কিন সেনা প্রাণ হারিয়েছেন। গার্ডিয়ান বলছে, আফগানিস্তানে নিহত ব্রিটিশ সেনার সংখ্যা এ পর্যন্ত ৪২৫। তালেবানসহ বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর সশস্ত্র যোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে তাঁরা মারা গেছেন। কিন্তু কয়েক বছর ধরে ন্যাটো সেনাদের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছেন আফগান সরকারি বাহিনীগুলোর সদস্যরা। ২০১১ সালে এ রকম আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে ২১টি, মোট নিহত হয়েছেন ৩৫ জন। আর এ বছরের সাড়ে সাত মাসেই এমন আক্রমণে নিহতের সংখ্যা হয়েছে ৩৭।
আক্রমণের ঘটনাগুলোও বেশ লক্ষ করার মতো: শুক্রবার ভোরে হেলমান্দ প্রদেশের এক পুলিশ ফাঁড়িতে পুলিশের কর্মকর্তারা মার্কিন সেনাদের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করেন। তারপর হঠাৎ পুলিশের এক কর্মকর্তা গুলি করে তিন মার্কিন সেনাকে হত্যা করেন। সেদিন রাত নয়টার দিকে এক সেনাঘাঁটির কাছে তিন ন্যাটো সেনার ওপর আক্রমণ চালান আরেকজন পুলিশ সদস্য। গত মঙ্গলবার পূর্বাঞ্চলীয় পাকতিয়া প্রদেশে এক আফগান সেনা গুলি করে দুজন মার্কিন সেনাকে হত্যা ও একজনকে আহত করেন। তারপর বৃহস্পতিবার আরেকটি সেনাঘাঁটির বাইরে দুজন আফগান সেনা ন্যাটো সেনাদের ওপর গুলি চালান।
২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত আফগান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ব্যয় করেছে প্রায় ২ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই অর্থ জুগিয়েছে আমেরিকার জনসাধারণ। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে, নাইন-ইলেভেনে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর সন্ত্রাসী হামলা পরিচালনা করেছিল যারা, সেই আল-কায়েদা ঘাঁটি গেড়েছে আফগানিস্তানে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রধানতম শত্রু আল-কায়েদাকে ধ্বংস করে আফগানিস্তানে ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মার্কিন বাহিনী তার ন্যাটোর শরিকদের নিয়ে আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালায়। ১০ বছরে তালেবান হটে গেছে, ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করে আল-কায়েদাকে আফগানিস্তান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে। আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় বসানো হয়েছে ওয়াশিংটন ও তার মিত্রদের বশবর্তী একটি সরকার।
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যখন ঘোষণা করেন, ২০১৪ সালে তিনি তাঁর সেনাদের ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন, তখন বলেছিলেন আফগান যুদ্ধের ব্যয় দুর্বহ হয়ে উঠেছে। সরকারি হিসাবে মোট ব্যয় ২ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন বলে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু বেসরকারি নানা সংস্থা বলেছে, ওই হিসাবের সঙ্গে আরও অন্তত এক ট্রিলিয়ন ডলার যোগ করতে হবে। কারণ, অনেক আনুষঙ্গিক খরচ সরকারি ওই হিসাবের মধ্যে ধরা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ওয়াটসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ‘কস্ট অব ওয়ার’ প্রকল্পের দেওয়া হিসাবে বলা হয়, মার্কিন বাহিনী ২০১৪ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে থাকলে মোট ব্যয় ৪ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে।
মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে বিদায় নেওয়ার আগে নিশ্চিত করতে চায়, তারা চলে যাওয়ার পর আফগানিস্তানের সরকার যেন টিকে থাকে। তারা আফগান সেনা, পুলিশ ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, যেন তারা তালেবান ও অন্যান্য জঙ্গিগোষ্ঠীর হাত থেকে আফগান সরকারকে রক্ষা করার সামর্থ্য অর্জন করে। কিন্তু আফগান সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাদের প্রশিক্ষণদাতাদেরই হত্যা করছে। মার্কিন জনগণের সামনে দেশটির সরকারের জন্য এর চেয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতি আর কী হতে পারে?
যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ বলে, আফগান যুদ্ধ ইতিমধ্যে একটি ‘লস্ট ওয়ার’। যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা ‘মধ্যযুগীয়’, ‘বর্বর’ আফগানিস্তানে ‘গণতন্ত্র ও মুক্তি’ রপ্তানি করতে চায়। নইলে দেশটি বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তা বিপন্ন করবে। কিন্তু আফগানিস্তান কোনো ভাবাদর্শ আমদানি করতে রাজি নয়। এর আগে সোভিয়েতরা সমাজতন্ত্র চাপিয়ে দিয়ে তাদের সুখী ও সভ্য করতে চেয়েছিল, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। আফগানিস্তানে সোভিয়েতদের চেয়ে অনেক খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা। সোভিয়েতদের যুদ্ধ করতে হয়েছে মুজাহিদদের বিরুদ্ধে, আফগানিস্তানের তৎকালীন সরকারের বাহিনীগুলো সোভিয়েত সেনাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুজাহিদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে (আর আমেরিকা ও তার মিত্ররা মুজাহিদদের অস্ত্র, টাকাপয়সা ও বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়েছে)। কিন্তু এখন মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর সদস্যরা নিহত হচ্ছেন খোদ আফগান বাহিনীর সদস্যদের হাতেই, যাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সামর্থ্যবান করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। এর পরও যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলো আফগানিস্তানের কাছে কী আশা করছে?
মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের নীতিনির্ধারকেরাই বা কী ভাবছেন তাঁদের সেনাদের নিয়ে? তাঁরা বলার চেষ্টা করছেন, এটা কোনো ব্যাপার নয়। আফগান নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর মোট সদস্য প্রায় তিন লাখ। তাদের অতি নগণ্য একটি অংশ এ রকম নাশকতামূলক আক্রমণ চালাচ্ছে। তালেবানরা পরিষ্কার ভাষায় বলছে, আফগান সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে তাদের লোক আছে, তারাই একের পর এক মার্কিন, ব্রিটিশ ও অন্যান্য ন্যাটো সেনাকে হত্যা করে চলেছে। কিন্তু ন্যাটো কর্তৃপক্ষ তালেবানের এসব কথা আমলে নিচ্ছে না।
তালেবান বা আল-কায়েদা নয়, মিত্রবেশে যারা আমাদের কাছে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, আমরা যাদের শিখিয়ে-পড়িয়ে সন্ত্রাসবাদ দমনে সক্ষম করে তোলার চেষ্টা করছি, তারাই এখন অতর্কিতে গুলি চালিয়ে আমাদের খতম করে দিচ্ছে!—আফগানিস্তানে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর সদস্যদের মনের অবস্থা কি এখন এই রকম? এমন পরিস্থিতিতে মানুষ প্যারানোইয়া বা ভীতি-বাতিকগ্রস্ত অবস্থার শিকার হয়, নিরন্তর উদ্বেগজনিত মানসিক ঐক্যনাশে ভোগে।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীন মাল্টিমিডিয়া সংবাদপ্রতিষ্ঠান ‘ডেমোক্রেসি নাউ’ বলছে, ২০১২ সালের সাত মাসে ১৫৪ জন মার্কিন সেনা আত্মহত্যা করেছেন। এটা খোদ পেন্টাগনের দেওয়া হিসাব। এই সংখ্যা যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধরত অবস্থায় নিহত সেনাদের সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের অধীনে একটি টাস্কফোর্স আছে, যার কাজ সশস্ত্র বাহিনীগুলোর সদস্যদের আত্মহত্যা রোধ করা। কিন্তু টাস্কফোর্সের ঝুড়িতে সাফল্য কম। মার্কিন সেনাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা কমছে না, বরং উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে। এখন প্রতিদিন গড়ে একজন করে মার্কিন সেনা আত্মহত্যা করছেন।
অন্যায় যুদ্ধ কেবল অন্যকেই মারে না, মারে নিজেকেও। মানুষ স্বভাবতই ন্যায়ের প্রত্যাশী।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.