থ্যাংকস দীপু মনি, ইউ মেড মাই ডে! by ডঃ আবুল হাসনাৎ মিল্টন
নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছি সাত বছর। এ সময়ে সহস্রাধিক ছাত্র-ছাত্রীকে এপিডেমিওলজি পড়িয়েছি। এদের প্রায় ২৫% নন-অস্ট্রেলিয়ান, বাংলাদেশ, ভারত, আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, মরক্কো, তানজানিয়াসহ নানা দেশের লেখাপড়ার পাঠ চুকলেও এদের অনেকের সঙ্গে আমার মাঝেমধ্যেই যোগাযোগ হয়। বিশেষ করে পেশাগত পরামর্শের জন্য কেউ কেউ আমাকে মেইল করে।
আমার ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে আমি নতুন করে শিখেছি- একজন শিক্ষক সারাজীবনের জন্যই শিক্ষক, অভিভাবকের মত। গত ২০ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার সাত সকালে আমার প্রাক্তন ছাত্রী এলিয়েনরার ফোনে ঘুম ভাঙলো। মেক্সিকোর মেয়ে ডাঃ এলিয়েনরা ২০০৭ সালে পাবলিক হেলথে মাস্টার্স করে এখন লন্ডনে সেটেলড। মাঝে-মধ্যে ইমেইল করে। কিন্তু ফোন এই প্রথম! আমি তাই কিছুটা অবাক হই।
আমি কি তোমাকে অনেক ভোরে ঘুম থেকে উঠালাম? এলিয়েনরা জানতে চায়। আমি ঘুমচোখে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সকাল সাতটা বিশ। আমার জন্য ঢের সকালই বটে। আমি যে দেরি করে ঘুম থেকে উঠি, ডিপার্টমেন্টে যাই ও রাত করে বাড়ি ফিরি। এটা মোটামুটি আমার সব সহকর্মীই জানে ও মেনে নিয়েছে।
ব্যক্তিগত কুশলাদি বিনিময়ের পরে নিজেই বলে, জানো, কেন তোমাকে এই সাতসকালে ফোন করেছি? এলিয়েনরার গলায় উচ্ছ্বাসের ছটা। আমাকে উত্তরের সুযোগ না দিয়ে নিজেই বলল, আজ (লন্ডনে তখন ১৯ ডিসেম্বর) লন্ডনের ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকায় তোমাদের বাংলাদেশের উপর ‘অ্যাকমপ্লিশমেন্ট বিয়ন্ড এক্সপেক্টেশন’ শিরোনামে একটা ক্রোড়পত্র বেরিয়েছে।
ক্রোড়পত্রটি দেখেই আমার তোমার কথা মনে পড়েছে। আমি অনেক মন দিয়ে পুরো ক্রোড়পত্রটা পড়েছি। মনে আছে, তুমি একদিন বিকেলের আড্ডায় তোমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলেছিলে, তোমাদের দেশে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম গণহত্যা সংগঠিত হয়েছিল। আমি বললাম, তোমার দেখি সব কথাই মনে আছে।
প্রত্যুত্তরে এলিয়েনরা বলল, এটা কি ভোলা যায় মিল্টন? সেই তোমাদের দেশ নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আজ এত ভাল করছে জেনে খুব আনন্দ লাগছে। এই ক্রোড়পত্রটা না পড়লে বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক কিছুই অজানা থাকত। আমি কিন্তু তোমাদের দেশে বেড়াতে যাব। অবশ্যই, আমি বললাম- ‘আগে থেকে আমাকে জানিয়ে যেও, আমিও তাহলে ওই সময় দেশে যাবার চেষ্টা করব। আমি তোমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেশটাকে দেখাবো। তুমি দেখবে, পৃথিবীতে এখনও কত চমৎকার মানুষ বাস করে।
এলিয়েনরার ফোন পেয়ে আমার মনটা ভাল হয়ে যায়। একটা সুন্দর দিনের শুরুতে মনে মনে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ দীপুমনি ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ দিই। আমার বিশ্বাস কেবল এলিয়েনরা নয়, বহু পাঠকই এই ক্রোড়পত্রটি পড়ে বাংলাদেশকে নতুন করে জানবে, দেশটার প্রতি তাদের নতুন করে আগ্রহ জন্মাবে।
যদিও কতিপয় ছিদ্রান্বেষী এই ক্রোড়পত্র প্রকাশেও অসংখ্য ত্রুটি খুঁজে পেয়েছেন। এমন বহুল প্রচারিত একটি ক্রোড়পত্রের জন্য মাত্র সোয়া এককোটি টাকা খরচ হয়েছে, একটি দেশের জন্য যা সামান্যই অর্থ। তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
কেউ আবার বলছে- এই অর্থ ব্যয়ে ক্রোড়পত্র প্রকাশ না করে বিলেতে বসবাসকারী বাঙালি কম্যুনিটি ও ছাত্র-ছাত্রীদের দিয়ে সেমিনার-সিম্পেজিয়াম করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি তুলে ধরা যেত। আমিতো বুঝি না তাতে অসুবিধা কোথায়? ক্রোড়পত্র যেমন প্রকাশ করা হয়েছে, প্রয়োজনে সেমিনার সিম্পেজিয়ামও করা হবে।
একটা করলে যে আরেকটা করা যাবে না এমনতো কোন কথা নাই। ক্রোড়পত্রের ভেতরের বিষয়বস্তু নিয়েও সমালোচনা করা হয়েছে। একটা বিষয় আমার কিছুতেই বোধগম্য হয় না। নিজেদের দেশের ভাবমূর্তি উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রচারিত ক্রোড়পত্রে তো আমাদের ভাল দিকগুলোর কথাই প্রচার করা হবে।
নাকি গাঁটের পয়সা খরচ করে নিজেদের দুর্বলতার কথা ফলাও করে বিশ্ববাসীকে জানাতে হবে? আমাদের পছন্দ হোক বা না হোক- বাস্তবতা হল অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে দ্রুত অগ্রসরমান। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তৃণমূল পর্যন্ত যে কার্যক্রম প্রসারিত করা হচ্ছে, আগামী দশ বছরের মধ্যেই জনগণ তার সুফল পাবে বলেই আমার বিশ্বাস।
সরকার বর্তমানে চেষ্টা করছে যাতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে জনগণ যেন তাদের সরকারি অফিসের নিত্য-গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো অনলাইনে করতে পারে। তার ফলে সরকারি অফিসের নিত্যদিনের ঘুষ-দুর্নীতিগুলো অন্তত কমবে। বিদেশ থেকে দেশের এইসব প্রতিদিনকার উন্নয়নগুলো হয়তো আমাদের অনেকেরই চোখ এড়িয়ে যায়।
তাছাড়া, আমাদের মধ্যে যারা বিদেশে ভিক্ষের ঝুলি হাতে ঘোরে, বন্যা-খরা-দারিদ্রপীড়িত বাংলাদেশের ছবি দেখিয়ে সাহায্যের অর্থ এনে নিজেদের ভোগ-বিলাসী জীবন সাজাই, তাদের হয়তো বাংলাদেশের এহেন উজ্জ্বল ভাবমূর্তি ভাল লাগবে না।
আর ভাল লাগবে না বিদেশে কর্মরত এক শ্রেণীর (সবাই নয়) মাইগ্রেশন এজেন্টের। যারা নিজেদের সামান্য ব্যবসার স্বার্থে মক্কেলের রাজনৈতিক শরণার্থী ভিসা পাইয়ে দেবার লক্ষ্যে বিদেশি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বাংলাদেশের বিকৃত ইমেজ তুলে ধরতেও দ্বিধাবোধ করে না। এহেন কাজ করার সময় তারা একবারও ভেবে দেখে না যে- এর ফলে দেশের ললাটে কত বড় মিথ্যে অপবাদের কলঙ্ক লাগে!
বিবিসি টেলিভিশন খুললেই দেখা যায়, ভারতের বিজ্ঞাপন ‘ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া’। মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশেরও বিজ্ঞাপন নিয়মিত দেখা যায়। সেসব বিজ্ঞাপন সফলভাবেই পর্যটকদের আকর্ষণ করে। বর্তমান বিশ্বে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পণ্যের প্রসার ঘটানো একটা বাস্তবতা। বাংলাদেশেরর উচিত তার ইতিবাচক ভাবমূর্তি বিশ্বের বুকে তুলে ধরার জন্য নানামুখী কার্যক্রম গ্রহণ করা।
সেইসঙ্গে বিদেশে অবস্থানরত আমাদের দূতাবাসগুলোকেও আরও সক্রিয় করে তুলতে হবে। আগামী দিনে ‘বাংলাদেশ, দ্য আনডিসকভার্ড প্যারাডাইস’ হতে পারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উন্নয়নের লক্ষে প্রচারিত সব বিজ্ঞাপনমুখী কার্যক্রমের প্রধান স্লোগান।
-ডঃ আবুল হাসনাৎ মিল্টন, অস্ট্রেলিয়ায় স্বেচ্ছানির্বাসিত কবি, চিকিৎসক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
No comments