বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি-এবার সরবরাহ নিশ্চিত করুন

ভোগান্তির নাম বিদ্যুৎ_এটা সবারই জানা। সরবরাহ নিশ্চিত না করেই আরো এক দফা বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম। আরেক দফা দাম বাড়বে আসছে বছরের ফেব্রুয়ারিতে। মূল্যবৃদ্ধির প্রথম দফা কার্যকর হবে এ বছরের ডিসেম্বর থেকে। গ্রাহকপর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের খুচরা মূল্য গড়ে দুই ধাপে ২১ দশমিক ২৮ শতাংশ বাড়িয়ে চার টাকা ১৬ পয়সা থেকে পাঁচ টাকা দুই পয়সায় নির্ধারণ করেছে বিইআরসি। এ নিয়ে চলতি বছরেই দুই দফা খুচরা বিদ্যুতের দাম


বাড়ল। এর আগে গ্রাহকপর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছিল গত ফেব্রুয়ারিতে। দ্বিতীয় দফা দাম বাড়ানোর জন্য গত এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিতরণকারী সব সংস্থার গণশুনানি হয়। বিদ্যুতের এই মূল্যবৃদ্ধির চাপ ভোক্তাপর্যায়ে সব দিক থেকেই পড়বে। এর পাশাপাশি কৃষিক্ষেত্রেও বিদ্যুতের এই বাড়তি মূল্যের বিরূপ প্রভাব পড়বে_এমন আশঙ্কাও অমূলক নয়। বেড়ে যাবে উৎপাদন খরচ। বিদ্যুৎ এবার বোরো চাষের জন্যও ঝামেলা সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাবেই বোরো মৌসুমে সেচপাম্প চালাতে গড়ে প্রয়োজন হয় অতিরিক্ত এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।
সংশ্লিষ্ট বিভাগের একটি তথ্যে জানা গেছে, গ্রাহকপর্যায়ে গত ২০ বছরে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১৭ বার। এ ক্ষেত্রে নূ্যনতম বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৬৫ শতাংশ। পাশাপাশি বিদ্যুতের উৎপাদন বেড়েছে ১১ শতাংশ। বর্তমান সরকারসহ বিগত চারটি সরকারের আমলে এই দাম বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯১ সালে দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুতের উৎপাদন ছিল প্রায় এক হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। বর্তমানে ২০১১-১২ অর্থবছরে তা এসে দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ২৪ মেগাওয়াটে। সে হিসাবে বিদ্যুতের উৎপাদন বেড়েছে ১১ শতাংশের কিছু বেশি। কিন্তু এই উৎপাদন চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিদ্যুতের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে না। ফলে বিদ্যুৎ নিয়ে গ্রাহকপর্যায়ে অসন্তোষ রয়েছে।
মূল্যবৃদ্ধির পক্ষে একটা সাফাই-যুক্তি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সব সময়ই থাকে। এর আগে মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের সময় বিইআরসি কিছু যুক্তি দেখিয়েছিল। এবার মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়ার সময়ও প্রায় একই যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে। বিইআরসি বলছে, অর্থনীতি চাপের মধ্যে আছে। সরকারের ভর্তুকি দেওয়ার ক্ষমতা সীমিত হয়ে এসেছে। এভাবে আর ভর্তুকি দেওয়া সম্ভব নয়। আর এ কারণেই বাড়াতে হচ্ছে বিদ্যুতের দাম। তবে বিইআরসির এই যুক্তির সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন দেশের অর্থনীতিবিদরা। তাঁদের মতে, বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকির চাপ কমানোর পরিবর্তে সরকারের অগ্রাধিকার দিতে হবে সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর। বেসরকারি খাতে কয়লা ও গ্যাসভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনার পক্ষে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। অর্থনীতিবিদদের অভিমত, গ্রাহকপর্যায়ে বিদ্যুতের এই মূল্যবৃদ্ধি বিদ্যুৎভিত্তিক উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং জনগণের ক্রয়ক্ষমতার ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে। মূল্যস্ফীতির ওপরও বাড়তি চাপ সৃষ্টি হবে। ভর্তুকির বিষয়ে বিইআরসির সাফাইয়ের ব্যাপারে অর্থনীতিবিদদের অভিমত, ভর্তুকির যে চাপের মধ্যে এখন সরকার আছে, তারও একটা নেতিবাচক প্রভাব মূল্যস্ফীতিসহ সমগ্র অর্থনীতিতে আছে। আবার বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোয় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং অন্যদিক থেকে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বাড়বে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির চাপ শেষ পর্যন্ত সাধারণ ভোক্তাদেরই বহন করতে হবে। গ্রাহকপর্যায়ে এই মূল্যবৃদ্ধির ফলে যে মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা বিশেষজ্ঞরা করছেন, সেটা স্বাভাবিক। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত, সাশ্রয়ী উৎপাদনে মনোযোগী হওয়া। উৎপাদন বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে অনেক সময় বাড়তি দাম খুব একটা প্রভাব ফেলে না। কাজেই বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করুন।

No comments

Powered by Blogger.