রিমান্ডে ডিমান্ড কী? by মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান
‘রিমান্ড’ একটি ইংরেজি শব্দ। ‘ডিমান্ড’ও তাই। ‘রিমান্ড’ মানে পুনঃপ্রেরণ। বিশেষত তদন্তের প্রয়োজনে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রেরণ। কিন্তু কোথায় প্রেরণ? কোনো অজ্ঞাত বা গুপ্তস্থানে? চোখ বেঁধে? বিগত তত্ত্বাবধায়ক নামের বর্বরতার দু’বছরের সরকার আমলে অমনটিই আমরা দেখেছি। কিন্তু যে দেশে সভ্য সরকার আছে, সেখানে প্রেরিত অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তার আইনজীবীর উপস্থিতিতে।
কারণ ভদ্র সরকারশাসিত দেশে রিমান্ডের ব্যবস্থা করা হয় অভিযোগের সত্যতা নির্ণয় এবং ঘটনার প্রকৃত তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য। চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে অথবা তার কোনো স্বজন বা পক্ষের আইনজীবীকে উপস্থিত না রেখে যথেচ্ছ মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করে, ঘাড়-হাড় ভেঙে দিয়ে নির্ধারিত কথা অভিযুক্তের মুখ দিয়ে বলানোর জন্য নয়। এ দেশে রিমান্ডের আরেক নাম হয়েছে ‘ডিমান্ড’। ডিমান্ড অর্থ দাবি। এখানে রিমান্ড দাবি করে সরকার পক্ষ। এ দাবি করার পেছনের দাবিটি হচ্ছে, আমি যা স্বীকার করানোর জন্য দাবি করব, নির্যাতনের শিকার হয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি যতক্ষণ তা স্বীকার না করবে—ততক্ষণ সে আমার শিকারি হাত থেকে রক্ষা পাবে না। বর্বরতার দু’বছরে এমন অনেক রিমান্ড, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন এবং নির্যাতনের মাধ্যমে আদায় করা স্বীকারোক্তির খবর আমরা পেয়েছি। শুধু তাই নয়, বিশেষ কোনো কোনো স্বীকারোক্তির সিডিও ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল দেশ-বিদেশে। এসব স্বীকারোক্তিতে বিশেষ বিশেষ বিবরণ ছিল—বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও। কতখানি বিদ্বেষপরায়ণ, বিকৃত প্রবৃত্তির অমানুষ হলে এমন মিথ্যাচার অবলীলায় করা যেতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। ‘মিথ্যাচার’ বললাম এ নিশ্চয়তায় যে, বিশেষত আবদুল জলিল ও শেখ সেলিমের মুখ দিয়ে যা বলিয়ে নেয়া হয়েছিল, তা নির্লজ্জ মিথ্যা না হলে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে প্রধানমন্ত্রী হওয়া তো দূরের কথা—নির্বাচনে দাঁড়ানোও সম্ভব হতো না। তখনকার বর্বর সরকার, জনবিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে ‘মাইনাস টু’-এর অর্বাচীন স্বপেম্ন বিভোর ছিল। ‘নির্লজ্জ মিথ্যা’ শব্দটি ব্যবহার করেছি এ কারণে যে, ঘৃণ্যতম নির্লজ্জ ছাড়া আর কে পারে থুথু ফেলে আবার তা চেটে তুলতে? যত রকমের মিথ্যার গদিতে সওয়ার হয়ে তারা রুই-কাতলা শিকার করার দম্ভ করেছিল, সত্যের পদাঘাতে সেসব দম্ভ হতভম্ব হয়ে গেছে। তবে আমাদের দুর্ভাগ্যের কিন্তু অন্ত হয়নি। কারণ ভালো কিছু শিখতে আমাদের প্রবৃত্তি না হলেও খারাপ বিষয়টা, মদ-গাঁজা-চরস-হেরোইনের নেশার মতো, ঝট করে রপ্ত করে ফেলি এবং আর তা ছাড়তে পারি না। তাই রিমান্ডে নিয়ে মিথ্যা বলানোর রেওয়াজ আজও চলছে।দুটি দিনের কথা আমার খুবই স্পষ্টভাবে মনে পড়ে। দিন দুটি হলো আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এবং বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের। সেই দুটি দিনে কোর্ট প্রাঙ্গণে যে হাজার হাজার নারী-পুরুষ হাহাকার করে কেঁদে ছিলেন, কেউ তাদের ভাড়া করে আনেননি। জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত তাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রীদ্বয়ের প্রতি, ঘৃণ্য কর্তৃপক্ষের আচরণে ক্ষুব্ধ-ব্যথিত-মর্মাহত হয়ে তারা ছুটে এসেছিলেন। যারা সেদিন এই দুই নেত্রীকে প্রায় টেনে-হিঁচড়ে কোর্টে হাজির করেছিল, তারা কেউ একবার চোখ বন্ব্দ করেও কী কল্পনা করতে পারে যে, তাদের ওভাবে কোর্টে হাজির করা হলে জনমানুষ তো দূরের কথা, তাদের স্ত্রী-সন্তান, এমনকি পোষা প্রাণীটিও আসবে কিনা! জনসাধারণের কেউ যদি আসেও, অপশাসক ‘বুশ’-এর প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের মহান সাংবাদিক ভাইটি যে কর্মটি করেছেন সেই কর্মের জন্যই আসবে। শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া দু’জনের কেউই সেদিন ক্ষমতায় ছিলেন না। তা ছাড়াও তাদের নামে অপপ্রচারের জোয়ার বইয়ে দেয়ার জন্য কয়েকটি টিভি চ্যানেল এবং কয়েকটি পত্রিকাকে যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে তারা গায়ের জোরে। অবশ্য কোনো কোনো পত্রিকা নিজেরাও পরম উত্সাহে হরিলুটের আয়োজন করেছিল। জনগণ কী এত দ্রুত সে কথা ভুলে গেছেন? ভুলে গেছেন কী সেই অবৈধ সরকারের তাঁবেদার নির্বাচন কমিশনের ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’র কথা? তারপর আবার সেই ফেলে দেয়া থু থু হেঁ-হেঁ হেসে গেলার কথা? না, মানুষ ভোলেনি। গ্রামগঞ্জের মানুষ প্রসঙ্গ উঠলেই বলে, ‘ভোট দিলাম কারে, আর জিতল কে?’ মানুষ ভোলেনি বলেই গত নির্বাচনের ফলকে বলে, ভূতের ভোটের ফল। এই ভূত যে কারা তাও মানুষ জানে।
না, মানুষ কিছুই ভোলেনি। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, নির্বাচিত সরকারের কাছে মানুষ ওই ‘রুই-কাতলা’ ধরা ঘড়িয়ালদের যে বিচার প্রত্যাশা করেছিল সে বিচারের ছিটেফোঁটাও পায়নি। কেন এমন হলো? যারা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে দীর্ঘ নির্জন কারাবাসে বাধ্য করল, তার দলীয় লোক—এমনকি নিকটাত্মীয়কে দিয়ে তার বিরুদ্ধে নানা অপবাদ-কুত্সা উচ্চারণে বাধ্য করল, এমনকি বন্দি জীবনে তাকে বিষ-প্রয়োগও করা হলো, (সূত্র আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেত্রীর বক্তব্য) সেই হার্মাদদের কোনো বিচার তো দূরের কথা—নির্বাচনের আগে ইউরোপ ও আমেরিকা সফরকালে কোন মন্ত্রণায় জানি না, তিনি হঠাত্ ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে, মমতাময়ী হয়ে উঠলেন সেই অবৈধদের প্রতি। কী সমঝোতা হয়েছিল তা বলা কঠিন। তবে বিদেশি স্বার্থের নগ্ন ও ঘৃণ্যতম দাস সেই দু’বছরের অতি অপশাসকদের চালু করা সব ব্যবস্থা, দেশের স্বার্থবিরোধী সব চুক্তি, পীড়ন-নির্যাতনের সব অমানবিকতার ধারাবাহিকতাই এখনও বহমান। তারই একটি অতি অগণতান্ত্রিক ‘রিমান্ড’ ব্যবস্থা। রিমান্ডে নিয়ে অভিযুক্তকে দিয়ে যা বলিয়ে নেয়া হয়—আশা করি, প্রধানমন্ত্রী তা বিশ্বাস করেন না। তবু কেন, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অভিযুক্তকে রিমান্ডে নিয়ে ‘ডিমান্ড’ অনুযায়ী স্বীকারোক্তি দেয়ার জন্য বাধ্য করার প্রথা চলতেই থাকবে?
লেখক : কবি, গীতিকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments