আলোর চেয়ে বেশি বেগে নিউট্রিনো-আইনস্টাইন কি ভুল ছিলেন
সম্প্রতি সার্নের একটি পরীক্ষায় আলোর চেয়ে বেশি বেগে গতিশীল কণার ভ্রমণ সংক্রান্ত খবরটি গণমাধ্যমে আলোড়ন তোলে। জনমনে ব্যাপক কৌতূহল তৈরি করে। তৈরি করে কিছু বিভ্রান্তিও। আইনস্টাইন ভুল প্রমাণিত হলো কি-না তা নিয়ে মাথা ঘামানোর চেয়ে বিশ্বজগৎ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি আরও বিস্তৃত করাই জরুরি। এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরাও বসে নেই। এগুলো নিয়ে লিখেছেন অভিজিৎ রায় বিজ্ঞানে কোনো কিছুই স্থির নয়। এ জন্যই বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের একটি
বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটিতে ভুল প্রমাণের সুযোগ থাকতে হবে। সেটিকে আমরা বলি 'বাতিল যোগ্যতা' বা ফলসিফায়াবিলিটি। এটি না হলে সেটি তত্ত্ব হয়ে ওঠে না। নতুন নতুন পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞানসাপেক্ষে বিজ্ঞানের পুরনো তত্ত্ব বাতিল কিংবা বদলে ফেলার দৃষ্টান্ত বিজ্ঞানে আছে বহু। যেমন_ পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণের সঙ্গে মেলেনি বলেই টলেমির ভূকেন্দ্রিক তত্ত্ব বাতিল হয়ে গিয়েছিল কোপার্নিকাস আর গ্যালিলিওর পর্যবেক্ষণের ধাক্কায়। অতীতে ভূকেন্দ্রিক তত্ত্ব, ফ্লোগিস্টন তত্ত্ব, ইথার তত্ত্ব, ল্যামার্কের তত্ত্ব, আলো চলাচলের জন্য নিউটনের কণাতত্ত্ব_ সবই এক সময় ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আমরা পুরনোকে বর্জন করে নতুন 'আলোকেরই ঝরনাধারা'য় নিজেদের সিক্ত করেছি। কারণ বিজ্ঞান 'ডায়নামিক', ধর্ম কিংবা ডগমার মতো স্থবির কিছু নয়। বিজ্ঞানে 'হিরো' আছে। কিন্তু সেই হিরোদের অবদান নিয়ত প্রশ্নবিদ্ধ হয় বিজ্ঞানের জগতে_ তা নিউটনই হোন, ডারউইনই হোন কিংবা হোন না জগদ্বিখ্যাত প্রতিভা আলবার্ট আইনস্টাইন।
প্রাযুক্তিক সভ্যতা আইনস্টাইনের তত্ত্বের ওপর দাড়িয়ে
তারপরও বিজ্ঞানের কিছু তত্ত্ব পর্যবেক্ষণ দিয়ে এতটাই সমর্থিত হয়ে ওঠে যে, সেই তত্ত্বের ওপর আস্থা প্রকাশ করে যান বিজ্ঞানীরা অনেকটাই নির্ভয়ে। এমনি একটি আস্থা ছিল আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব থেকে পাওয়া অনুসিদ্ধান্তগুলো ঘিরে। ১৯০৫ সালের পর থেকে একটি ব্যাপারে পদার্থবিদরা নিশ্চিত ছিলেন, আলোর গতি এক সেকেন্ডে এক লাখ ৮৬ হাজার মাইল এবং আলোর চেয়ে বেশি বেগে কোনো পদার্থের পক্ষে ভ্রমণ করা সম্ভব নয়_ এটি বিজ্ঞানীদের কাছে আস্থার প্রতীক। তা হয়ে উঠেছিল অনেকটা আগামীকাল পূর্ব দিকে সূর্য ওঠার মতোই ধ্রুব সত্য। অবশ্য এ ধরনের আস্থার কারণও সহজেই বোধগম্য। আমাদের আধুনিক টেকনোলজি, জিপিএস, ট্রানজিস্টর, কম্পিউটার, ইন্টারনেটসহ যে অবদানগুলোর প্রতি নির্ভয়ে অহর্নিশি আমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি সেগুলো আইনস্টাইনের তত্ত্বের ভিত্তিতেই নির্মিত। তার চেয়েও বড় কথা, সার্নের এ ফলের আগে কোনো পরীক্ষালব্ধ তথ্যই আইনস্টাইনের তত্ত্বকে কখন প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারেনি।
আমাদের গাড়ি কিংবা আইফোনের জিপিএস সিস্টেমের কথাই ধরা যাক। এই জিপিএস সিস্টেমের বদৌলতে পৃথিবীতে আমাদের অবস্থান, এমনকি কয়েক ফুটের পরিসীমায়ও আমরা এখন সূক্ষ্মভাবে বলে দিতে সক্ষম। অথচ জিপিএস ঠিকমতো কাজই করত না যদি আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা থেকে পাওয়া 'সংশোধনীগুলো' গোনায় না নেওয়া হতো। আমাদের মতো আমজনতার কথা না হয় বাদ দিই। আমেরিকার পেন্টাগনের জেনারেলদেরও নাকি এখন পদার্থবিদদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত 'আপেক্ষিকতার সবক' নিতে হচ্ছে। কারণ শত্রুদের অবস্থান স্যাটেলাইট কিংবা জিপিএসের মাধ্যমে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানার জন্য এটি ছাড়া গতি নেই। তারা বুঝতে পেরেছে, বেগ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর ওপরে অবস্থিত জিপিএস ঘড়ির সময় বদলে আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের গণনা অনুসরণ করে। কাজেই আইনস্টাইনকে বৈজ্ঞানিক পরিমণ্ডল থেকে হটানো 'মামার হাতের মোয়া' টাইপের কোনো সহজ ব্যাপার নয়।
অপেরা' নামের সারা জাগানো পরীক্ষাটি
সুইজারল্যান্ডের জগদ্বিখ্যাত সার্ন ল্যাবে তাদের নিউট্রিনো উৎপাদক যন্ত্র দিয়ে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন। এর মধ্যে একটি প্রজেক্টের নাম ছিল 'অপেরা' [ঙচঊজঅ (ঙংপরষষধঃরহম চৎড়লবপঃ রিঃয ঊসঁষংরড়হ : জধপশরহম অঢ়ঢ়ধৎধঃঁং)]। সেই প্রজেক্টের বিজ্ঞানীরা তাদের যন্ত্রের মাধ্যমে নিউট্রিনো প্রক্ষিপ্ত করছিলেন। এগুলো এক অদ্ভুতুড়ে কণা যেগুলো সবচেয়ে বেশি ঘনত্বের বস্তুও অবলীলায় ভেদ করে যেতে পারে। এ প্রজেক্টের আরেকটি অংশ ছিল আবার ইতালিতে। সেখানে মাটির প্রায় এক হাজার ৪০০ মিটার গভীরে গ্রান সাসো ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে বসে আরেক দল বিজ্ঞানী সার্ন থেকে ছুড়ে দেওয়া নিউট্রিনো রশ্মিগুলো সংগ্রহের চেষ্টায় ছিলেন। প্রায় ৭৩০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ইতালিতে পেঁৗছানো প্রায় ১৫ হাজার নিউট্রিনোগুলোকে তাদের সংবেদনশীল ডিটেক্টর যন্ত্র দিয়ে মেপে দেখলেন, সেগুলো আলোর চেয়ে তাড়াতাড়ি এসে পেঁৗছাচ্ছে। কতটা তাড়াতাড়ি_ ৬০ ন্যানো সেকেন্ড, মানে এক সেকেন্ডের ৬০০ কোটি ভাগের এক ভাগ কম সময়ে।
এত কম বা বেশি লাগল_ তা নিয়ে আমাদের মতো ছাপোষা মানুষের হয়তো কিছু যায় এসে না। কিন্তু পদার্থ বিজ্ঞানীদের আক্ষরিক অর্থেই মাথায় বাজ পড়ার উপক্রম হলো এ খবরটি পেয়ে। কারণ খবরটি সত্য হলে আইনস্টাইনের তত্ত্বের মূল ভিত্তিটাই ধসে পড়ে! আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব অনুযায়ী বেগ যত বাড়তে থাকবে তত আপনার জন্য সময় 'ধীরে' চলবে, আপনার ভর বাড়তে থাকবে এবং দৈর্ঘ্য সংকুচিত হতে থাকবে। এখন আপনি যদি আলোর চেয়ে বেশি বেগে ভ্রমণ করে তাহলে বিভিন্ন অস্বাভাবিক ব্যাপার ঘটতে থাকবে। আপনার জন্য সময়ের চাকা সামনে না চলে পেছনের দিকে চলতে থাকবে। আপনার ভর অসীমতার স্তর পার করে হয়ে যাবে কাল্পনিক এবং দৈর্ঘ্য হয়ে যাবে ঋণাত্মক। সামগিকভাবে এ ব্যাপারগুলো যুক্তিবহির্ভূত কেবল নয়, হাস্যকরও। এ জন্যই আইনস্টাইনের যৌক্তিক সিদ্ধান্ত ছিল, কোনো বস্তুকণার পক্ষেই আলোর গতিবেগ অতিক্রম করা সম্ভব নয়।
নিউট্রিনোর গতি নিয়ে বিভিন্ন অভিমত
এ ফলে সার্নের বিজ্ঞানীরা এতটাই অবাক হয়েছিলেন যে, তারা প্রায় ছয় মাস ধরে বারবার নিজেদের পরীক্ষার ভুল বের করার চেষ্টা করেছেন। কেননা তারা জানতেন, এ ফল প্রকাশ পেলে অপদস্থ হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। কিন্তু বারবার সব কিছু দেখেও কোনো ভুল না পেয়ে অবশেষে তারা এ ফল প্রকাশ করে দেন। তাদের গবেষণাপত্রে এ ফলের কোনো ব্যাখ্যা দেননি। তবে সার্নের দ্বিতীয় পরীক্ষাতেও একই ফল পাওয়া গেছে। এ অবিশ্বাস্য ফল প্রকাশের পর গণমাধ্যম তো বটেই, এমনকি খ্যাতিমান বিজ্ঞানীদের মধ্যেও বিভিন্ন দিক থেকে সাড়া পড়ে গেল সঙ্গে সঙ্গেই। অনেক বিজ্ঞানীর মধ্যে বয়ে গেল ভয়ের হিমশীতল স্রোত। কারণ গবেষণার ফল সত্য হলে পুরো পদার্থ বিজ্ঞানের ভিত্তিই নতুন করে সাজাতে হবে। প্রতিটি পাঠ্যপুস্তক নতুন করে লিখতে হবে। প্রতিটি পরীক্ষণ নতুন করে রি-ক্যালিব্রেট করতে হবে। শুধু যন্ত্রপাতি নয়, পুরো মহাবিশ্বের চেহারাই যাবে আমূল বদলে। পৃথিবী থেকে নক্ষত্ররাজি আর নিহারিকার দূরত্ব থেকে শুরু করে মহাবিশ্বের বয়স পর্যন্ত সব কিছুই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়বে। এমনকি মহাবিশ্বের প্রসারণ, মহাবিস্টেম্ফারণ, কৃষ্ণগহ্বরসহ সব কিছুই নতুনভাবে ব্যাখ্যা ও পুনর্পরীক্ষণ করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত পদার্থবিদ মিচিও কাকু বলেন, 'এত কিছুও যদি আপনার কাছে খারাপ বলে না মনে হয় তাহলে শুনে রাখুন, এর মানে দাঁড়াবে পদার্থ বিজ্ঞানের মূলনীতিগুলোই সংকটাপন্ন। আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞান দুটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে। একটি হলো আপেক্ষিকতা, অন্যটি কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। কাজেই পদার্থ বিজ্ঞানের অর্ধেকটাই নতুন ধারণা দিয়ে বদলাতে হবে। আমার ক্ষেত্রে স্ট্রিং তত্ত্বও এর ব্যতিক্রম নয়। কেননা স্ট্রিং তত্ত্ব একদম শুরু থেকেই আপেক্ষিকতার ওপর নির্ভর করে রচিত।'
মিচিও কাকুর অভিমত হলো_ সার্নের এ ফল আসলে একটি 'ফলস অ্যালার্ম'। এ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীদের পরীক্ষার মধ্যে কোথাও না কোথাও কিছু ত্রুটি লুকিয়ে আছে। তা সাদা চোখে ধরা পড়ছে না। একই ধরনের সংশয়ী মনোভাব ব্যক্ত করেছেন নোবেল বিজয়ী প্রখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিভেন ওয়েইনবার্গ, মার্টিন রিস এবং লরেন্স ক্রাউসসহ অনেক বিজ্ঞানীই। তাদের মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে সায়েন্টিফিক আমেরিকান ম্যাগাজিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকাগুলোতে। যেমন_ অ্যারিজোনা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী লরেন্স ক্রাউস গবেষণার ফল নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে খুব স্পষ্টভাবেই বলেন, 'এটি আসলে লজ্জাজনক। কোনো পরীক্ষার ফল ব্যাখ্যা ছাড়া কোনো গবেষণা-নিবন্ধ দাখিল করা অযৌক্তিক কিছু নয়। কিন্তু এমন একটি ফলের ওপর প্রেস কনফারেন্স করা যেটি ভুল হওয়ার আশঙ্কাই আসলে বেশি, এমনকি পেপারটি কোথাও রেফার করার আগেই। দুর্ভাগ্যজনক শুধু সার্নের জন্যই নয়, বিজ্ঞানের জন্যও।'
প্রাযুক্তিক সভ্যতা আইনস্টাইনের তত্ত্বের ওপর দাড়িয়ে
তারপরও বিজ্ঞানের কিছু তত্ত্ব পর্যবেক্ষণ দিয়ে এতটাই সমর্থিত হয়ে ওঠে যে, সেই তত্ত্বের ওপর আস্থা প্রকাশ করে যান বিজ্ঞানীরা অনেকটাই নির্ভয়ে। এমনি একটি আস্থা ছিল আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব থেকে পাওয়া অনুসিদ্ধান্তগুলো ঘিরে। ১৯০৫ সালের পর থেকে একটি ব্যাপারে পদার্থবিদরা নিশ্চিত ছিলেন, আলোর গতি এক সেকেন্ডে এক লাখ ৮৬ হাজার মাইল এবং আলোর চেয়ে বেশি বেগে কোনো পদার্থের পক্ষে ভ্রমণ করা সম্ভব নয়_ এটি বিজ্ঞানীদের কাছে আস্থার প্রতীক। তা হয়ে উঠেছিল অনেকটা আগামীকাল পূর্ব দিকে সূর্য ওঠার মতোই ধ্রুব সত্য। অবশ্য এ ধরনের আস্থার কারণও সহজেই বোধগম্য। আমাদের আধুনিক টেকনোলজি, জিপিএস, ট্রানজিস্টর, কম্পিউটার, ইন্টারনেটসহ যে অবদানগুলোর প্রতি নির্ভয়ে অহর্নিশি আমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি সেগুলো আইনস্টাইনের তত্ত্বের ভিত্তিতেই নির্মিত। তার চেয়েও বড় কথা, সার্নের এ ফলের আগে কোনো পরীক্ষালব্ধ তথ্যই আইনস্টাইনের তত্ত্বকে কখন প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারেনি।
আমাদের গাড়ি কিংবা আইফোনের জিপিএস সিস্টেমের কথাই ধরা যাক। এই জিপিএস সিস্টেমের বদৌলতে পৃথিবীতে আমাদের অবস্থান, এমনকি কয়েক ফুটের পরিসীমায়ও আমরা এখন সূক্ষ্মভাবে বলে দিতে সক্ষম। অথচ জিপিএস ঠিকমতো কাজই করত না যদি আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা থেকে পাওয়া 'সংশোধনীগুলো' গোনায় না নেওয়া হতো। আমাদের মতো আমজনতার কথা না হয় বাদ দিই। আমেরিকার পেন্টাগনের জেনারেলদেরও নাকি এখন পদার্থবিদদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত 'আপেক্ষিকতার সবক' নিতে হচ্ছে। কারণ শত্রুদের অবস্থান স্যাটেলাইট কিংবা জিপিএসের মাধ্যমে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানার জন্য এটি ছাড়া গতি নেই। তারা বুঝতে পেরেছে, বেগ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর ওপরে অবস্থিত জিপিএস ঘড়ির সময় বদলে আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের গণনা অনুসরণ করে। কাজেই আইনস্টাইনকে বৈজ্ঞানিক পরিমণ্ডল থেকে হটানো 'মামার হাতের মোয়া' টাইপের কোনো সহজ ব্যাপার নয়।
অপেরা' নামের সারা জাগানো পরীক্ষাটি
সুইজারল্যান্ডের জগদ্বিখ্যাত সার্ন ল্যাবে তাদের নিউট্রিনো উৎপাদক যন্ত্র দিয়ে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন। এর মধ্যে একটি প্রজেক্টের নাম ছিল 'অপেরা' [ঙচঊজঅ (ঙংপরষষধঃরহম চৎড়লবপঃ রিঃয ঊসঁষংরড়হ : জধপশরহম অঢ়ঢ়ধৎধঃঁং)]। সেই প্রজেক্টের বিজ্ঞানীরা তাদের যন্ত্রের মাধ্যমে নিউট্রিনো প্রক্ষিপ্ত করছিলেন। এগুলো এক অদ্ভুতুড়ে কণা যেগুলো সবচেয়ে বেশি ঘনত্বের বস্তুও অবলীলায় ভেদ করে যেতে পারে। এ প্রজেক্টের আরেকটি অংশ ছিল আবার ইতালিতে। সেখানে মাটির প্রায় এক হাজার ৪০০ মিটার গভীরে গ্রান সাসো ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে বসে আরেক দল বিজ্ঞানী সার্ন থেকে ছুড়ে দেওয়া নিউট্রিনো রশ্মিগুলো সংগ্রহের চেষ্টায় ছিলেন। প্রায় ৭৩০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ইতালিতে পেঁৗছানো প্রায় ১৫ হাজার নিউট্রিনোগুলোকে তাদের সংবেদনশীল ডিটেক্টর যন্ত্র দিয়ে মেপে দেখলেন, সেগুলো আলোর চেয়ে তাড়াতাড়ি এসে পেঁৗছাচ্ছে। কতটা তাড়াতাড়ি_ ৬০ ন্যানো সেকেন্ড, মানে এক সেকেন্ডের ৬০০ কোটি ভাগের এক ভাগ কম সময়ে।
এত কম বা বেশি লাগল_ তা নিয়ে আমাদের মতো ছাপোষা মানুষের হয়তো কিছু যায় এসে না। কিন্তু পদার্থ বিজ্ঞানীদের আক্ষরিক অর্থেই মাথায় বাজ পড়ার উপক্রম হলো এ খবরটি পেয়ে। কারণ খবরটি সত্য হলে আইনস্টাইনের তত্ত্বের মূল ভিত্তিটাই ধসে পড়ে! আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব অনুযায়ী বেগ যত বাড়তে থাকবে তত আপনার জন্য সময় 'ধীরে' চলবে, আপনার ভর বাড়তে থাকবে এবং দৈর্ঘ্য সংকুচিত হতে থাকবে। এখন আপনি যদি আলোর চেয়ে বেশি বেগে ভ্রমণ করে তাহলে বিভিন্ন অস্বাভাবিক ব্যাপার ঘটতে থাকবে। আপনার জন্য সময়ের চাকা সামনে না চলে পেছনের দিকে চলতে থাকবে। আপনার ভর অসীমতার স্তর পার করে হয়ে যাবে কাল্পনিক এবং দৈর্ঘ্য হয়ে যাবে ঋণাত্মক। সামগিকভাবে এ ব্যাপারগুলো যুক্তিবহির্ভূত কেবল নয়, হাস্যকরও। এ জন্যই আইনস্টাইনের যৌক্তিক সিদ্ধান্ত ছিল, কোনো বস্তুকণার পক্ষেই আলোর গতিবেগ অতিক্রম করা সম্ভব নয়।
নিউট্রিনোর গতি নিয়ে বিভিন্ন অভিমত
এ ফলে সার্নের বিজ্ঞানীরা এতটাই অবাক হয়েছিলেন যে, তারা প্রায় ছয় মাস ধরে বারবার নিজেদের পরীক্ষার ভুল বের করার চেষ্টা করেছেন। কেননা তারা জানতেন, এ ফল প্রকাশ পেলে অপদস্থ হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। কিন্তু বারবার সব কিছু দেখেও কোনো ভুল না পেয়ে অবশেষে তারা এ ফল প্রকাশ করে দেন। তাদের গবেষণাপত্রে এ ফলের কোনো ব্যাখ্যা দেননি। তবে সার্নের দ্বিতীয় পরীক্ষাতেও একই ফল পাওয়া গেছে। এ অবিশ্বাস্য ফল প্রকাশের পর গণমাধ্যম তো বটেই, এমনকি খ্যাতিমান বিজ্ঞানীদের মধ্যেও বিভিন্ন দিক থেকে সাড়া পড়ে গেল সঙ্গে সঙ্গেই। অনেক বিজ্ঞানীর মধ্যে বয়ে গেল ভয়ের হিমশীতল স্রোত। কারণ গবেষণার ফল সত্য হলে পুরো পদার্থ বিজ্ঞানের ভিত্তিই নতুন করে সাজাতে হবে। প্রতিটি পাঠ্যপুস্তক নতুন করে লিখতে হবে। প্রতিটি পরীক্ষণ নতুন করে রি-ক্যালিব্রেট করতে হবে। শুধু যন্ত্রপাতি নয়, পুরো মহাবিশ্বের চেহারাই যাবে আমূল বদলে। পৃথিবী থেকে নক্ষত্ররাজি আর নিহারিকার দূরত্ব থেকে শুরু করে মহাবিশ্বের বয়স পর্যন্ত সব কিছুই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়বে। এমনকি মহাবিশ্বের প্রসারণ, মহাবিস্টেম্ফারণ, কৃষ্ণগহ্বরসহ সব কিছুই নতুনভাবে ব্যাখ্যা ও পুনর্পরীক্ষণ করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত পদার্থবিদ মিচিও কাকু বলেন, 'এত কিছুও যদি আপনার কাছে খারাপ বলে না মনে হয় তাহলে শুনে রাখুন, এর মানে দাঁড়াবে পদার্থ বিজ্ঞানের মূলনীতিগুলোই সংকটাপন্ন। আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞান দুটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে। একটি হলো আপেক্ষিকতা, অন্যটি কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। কাজেই পদার্থ বিজ্ঞানের অর্ধেকটাই নতুন ধারণা দিয়ে বদলাতে হবে। আমার ক্ষেত্রে স্ট্রিং তত্ত্বও এর ব্যতিক্রম নয়। কেননা স্ট্রিং তত্ত্ব একদম শুরু থেকেই আপেক্ষিকতার ওপর নির্ভর করে রচিত।'
মিচিও কাকুর অভিমত হলো_ সার্নের এ ফল আসলে একটি 'ফলস অ্যালার্ম'। এ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীদের পরীক্ষার মধ্যে কোথাও না কোথাও কিছু ত্রুটি লুকিয়ে আছে। তা সাদা চোখে ধরা পড়ছে না। একই ধরনের সংশয়ী মনোভাব ব্যক্ত করেছেন নোবেল বিজয়ী প্রখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিভেন ওয়েইনবার্গ, মার্টিন রিস এবং লরেন্স ক্রাউসসহ অনেক বিজ্ঞানীই। তাদের মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে সায়েন্টিফিক আমেরিকান ম্যাগাজিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকাগুলোতে। যেমন_ অ্যারিজোনা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী লরেন্স ক্রাউস গবেষণার ফল নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে খুব স্পষ্টভাবেই বলেন, 'এটি আসলে লজ্জাজনক। কোনো পরীক্ষার ফল ব্যাখ্যা ছাড়া কোনো গবেষণা-নিবন্ধ দাখিল করা অযৌক্তিক কিছু নয়। কিন্তু এমন একটি ফলের ওপর প্রেস কনফারেন্স করা যেটি ভুল হওয়ার আশঙ্কাই আসলে বেশি, এমনকি পেপারটি কোথাও রেফার করার আগেই। দুর্ভাগ্যজনক শুধু সার্নের জন্যই নয়, বিজ্ঞানের জন্যও।'
No comments