রাজনীতি-ভারতে ক্ষমতার শীর্ষে ওঠার দ্বৈরথ by পার্থ চট্টোপাধ্যায়
মমতার আরেকটি জয় হলো সিঙ্গুর নিয়ে। সিঙ্গুরে সাবেক বামফ্রন্ট সরকার অধিকৃত চাষিদের ধানি জমিতে টাটারা তাদের মোটর কারখানা তৈরি করছিল। মমতার আন্দোলনের ফলে সেই কাজ অসমাপ্ত রেখে তারা গুজরাটে চলে গিয়ে সেখান থেকে ন্যানো মোটরগাড়ি বার করে। সিঙ্গুরের ওই হাজার একর পরিত্যক্ত জমি মমতার সরকার আইন করে আবার দখল করে নিয়েছে। টাটারা ওই অধিগ্রহণ বেআইনি বলে হাইকোর্টে মামলা করে ভারতের রাজনীতিতে এখন
দাপিয়ে বেড়ান দুই বাঙালি রাজনীতিক। একজন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব কুমার মুখোপাধ্যায়, আরেকজন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা, যা গত বৃহস্পতিবার শেষ হয়েছে। এবারের পূজায় সবচেয়ে সুখী ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর সবচেয়ে উদ্বিগ্ন ও নিরানন্দভাবে পূজার দিনগুলো কেটেছে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের।
প্রণব বাবুর পৈতৃক বাড়ি বীরভূম জেলার কীণাহার গ্রামে। গ্রামের বাড়িতে প্রতি বছর খুব ঘটা করে দুর্গাপূজা করেন প্রণব বাবু। সব রাজকাজ ফেলে রেখে পূজার তিন দিন গ্রামের বাড়িতে চলে এসে নিজেই পূজায় বসে যান। এবারও তাই করেছেন। কিন্তু মনে প্রচুর দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ ছিল। প্রধানমন্ত্রীকে লেখা অর্থ মন্ত্রকের একটি নোট ফাঁস হয়ে যাওয়ায় লঙ্কাকাণ্ড বেধে গেছে। ওই নোটে অর্থ মন্ত্রক প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছিল, ২-জি স্পেকট্রাম বণ্টনের ব্যাপারে সাবেক অর্থমন্ত্রী চিদাম্বরম সব জানতেন। তিনি চাইলে আগে আসলে আগে লাইসেন্স দেওয়া হবে এই নীতি বর্জন করে নিলাম করে স্পেকট্রাম বণ্টনের লাইসেন্স দিতে পারতেন।
নিলামের বদলে পছন্দমতো ব্যক্তিদের (আগে আসলে আগে পাওয়া যাবে) স্পেকট্রাম বণ্টন করে সরকারের কোটি কোটি টাকা লোকসান ঘটানোর দায়ে সাবেক টেলিকমমন্ত্রী রাজা ও তার টেলিকম সচিবসহ ১৩ জন পদস্থ ব্যক্তি এখন তিহার জেলে। তাদের মধ্যে তামিলনাড়ূর সাবেক মুখ্যমন্ত্রী করুণানিধির মেয়েও (যিনি একজন এমপি) আছেন।
২-জি স্পেকট্রাম বণ্টন ইউপিএ সরকারের আমলে যতগুলো স্ক্যাম হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড়। বর্তমানে সিবিআই এই স্ক্যামের তদন্ত করে চার্জশিট দিয়েছে। বিশেষ আদালতে তার শুনানি চলছে। সিবিআই আরও চার্জশিট দেবে, তাতে আরেকজন সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মারান গ্রেফতার হতে পারেন।
অর্থ মন্ত্রকের ওই নোটটিতে অভিযোগের তীর ছিল খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকে। আর এই নোট দেওয়া হয়েছে অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশে। কে না জানে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায়, তাই দুইয়ে দুইয়ে চার করে চিদাম্বরম অনুগামীরা বলতে চান স্বয়ং অর্থমন্ত্রী প্রণব বাবুই ওই নোটটি ফাঁস করতে মদদ জুগিয়েছেন। কারণ ওই নোট ফাঁসের ব্যাপারে মদদ জুগিয়ে তিনি চিদাম্বরম কাঁটাকে হটাতে চান। প্রণব বাবু এই অভিযোগ অস্বীকার করলেও এ ঘটনায় সোনিয়া গান্ধী ও প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যেভাবে চিদাম্বরমকে সমর্থন করতে এগিয়ে এসেছেন তাতে করে সাধারণ লোকের মনে হচ্ছে, কংগ্রেস হাইকমান্ডেরও প্রণব বাবুর ওপর আর আগের মতো আস্থা নেই। চিঠি ফাঁসের খবর প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রণব বাবু দিলি্ল থেকে নিউইয়র্ক উড়ে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে তার অবস্থান বুঝিয়ে এসেছেন। কারণ সে সময় প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় যোগ দেওয়ার জন্য নিউইয়র্ক ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে দিলি্ল ফিরে তড়িঘড়ি সাংবাদিক বৈঠক ডেকে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। সব দোষটা বিরোধীদের ঘাড়ে চাপিয়ে তিনি দেশবাসীকে বোঝাতে চাইছেন, এটি বিরোধীদের ষড়যন্ত্র। তারা ইউপিএ সরকারের ভাঙন ধরিয়ে এই সরকার ফেলে দিয়ে অন্তর্বর্তী নির্বাচন করার ষড়যন্ত্র করছেন। ২০১৪ পর্যন্ত এই সরকারের আয়ু। এই সরকার ২০১৪ পর্যন্ত থাকবে।
কিন্তু মনমোহন জানেন, তার সরকার নিত্যনতুন স্ক্যামে জড়িয়ে ক্রমেই কমজোরি হয়ে পড়ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিদাম্বরমের মতো শক্তিশালী নেতা যদি ২-জি কাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন ও তাকে পদত্যাগ করতে হয় তাহলে হয়তো সেটাই হবে শেষ আঘাত। চিদাম্বরম এখনই পদত্যাগ করতে চান। কিন্তু তাকে নিরস্ত করে রেখেছেন সোনিয়া ও মনমোহন। কিন্তু সিপিএম ও বিজেপি মিলে একসঙ্গে এই সরকারের বিরুদ্ধে যেভাবে একাট্টা হয়েছে ও ২-জি মামলায় শীর্ষ আদালতে যেভাবে একের পর এক চমকপ্রদ তথ্য বেরিয়ে আসছে তাতে চিদাম্বরম রেহাই পাবেন কি-না তা তার ভাগ্যই বিচার করবে। তবে এটি সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে। চিদাম্বরমের লবি খুবই শক্তিশালী। তারা এখন বলতে শুরু করবেন প্রণব বাবুই শেষ কোপটা মারলেন চিদাম্বরমের ঘাড়ে। অথচ প্রণব বাবু বারবার বলতে চেয়েছেন, তার কোনো অভিসন্ধিই ছিল না। সম্পূর্ণ প্রশাসনিক স্বার্থে আমলারা নোটটি তৈরি করেছিলেন। আর ওটা একদমই গোপন নোট। এরপর কী হলো তা জানার আগে আমি পাঠকদের এবার পূজায় সবচেয়ে একজন সুখী বাঙালির কথা জানাতে চাই। তিনি আর কেউ নন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তুঙ্গে বৃহস্পতি : গত ২৫ সেপ্টেম্বর কলকাতার বনেদিপাড়া ভবানীপুরের উপনির্বাচনের দিন দুপুর পর্যন্ত এমন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল যে, ভবানীপুরের অর্ধেক ভোটারই ওই বৃষ্টি মাথায় করে আর ভোট দিতে আসেননি।
কোনো কোনো বুথে ভোট পড়ে মাত্র ২২ শতাংশ। সবসুদ্ধ ৫০ শতাংশের মতো ভোট পড়ে এই উপনির্বাচনে। তাতেই ৫৪ হাজার ভোট জিতে জয়ী হন মমতা। তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে সিপিএম দাঁড় করায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিভাগের অধ্যাপিকা নন্দিনী মুখোপাধ্যায়কে। তার পক্ষে প্রচারে নামেন স্বয়ং সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সিপিএম মমতাকে হারাতে পারবে এই আশা করেনি, তারা চেয়েছে শুধু ব্যবধান কমিয়ে আনতে। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ভোটদানের হার এত কম হওয়ায় তৃণমূল শিবিরও ভাবে জয়ের ব্যবধান কমে যাবে। কিন্তু দেখা গেল কম ভোট পড়া সত্ত্বেও মমতা ৫৪ হাজার ভোটে জয়ী হয়েছেন। গত নির্বাচনে এই কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী ৫০ হাজার ভোটে জিতে ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, একই সঙ্গে বসিরহাটের উপনির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী এটিএম আবদাল্লা সিপিএমের জেতা আসনটি কেড়ে নেন। ফলে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় তৃণমূলের আরও একটি আসন বাড়ল। মোট আসন দাঁড়াল ১৮৫। সিপিএমের একটি আসন কমে দাঁড়াল মাত্র ৩৯।
এই দুটি উপনির্বাচন প্রমাণ করে দিল গত পাঁচ মাসে মমতার সরকার চোখে পড়ার মতো কোনো পরিবর্তন আনতে না পারলেও এবং আইন-শৃঙ্খলার উত্তরোত্তর অবনতি ঘটা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সিপিএমকে সমর্থন করছে না। কারণ ৩৪ বছরে সিপিএম আমলের সন্ত্রাসের স্মৃতি এখনও লোকের মন থেকে মুছে যায়নি। তাই তৃণমূল কর্মীরা যখন সিপিএম সমর্থকদের ওপর পাল্টা সন্ত্রাস চালাচ্ছে, তখন লোকে বলছে ওদের আমলে যারা মার খেয়েছিল জামানা বদল হওয়ায় এরা তাদের ওপর এখন প্রতিশোধ নিচ্ছে। সিপিএমের মুখপত্র গণশক্তিতে প্রতিদিন জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে সিপিএমের ওপর তৃণমূলের হামলার খবর ফলাও করে বার হচ্ছে। তা সত্ত্বেও জনসাধারণের মনে এসব খবর কোনো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে না। বরং এতদিন যারা সক্রিয় সিপিএম সমর্থক ছিল এখন তারা রাতারাতি ভোল বদলে তৃণমূল হয়ে আগের মতোই তোলা তুলছে। মানুষের ওপর জুলুম করছে। শুধু পতাকার রঙ বদলেছে।
মমতার আরেকটি জয় হলো সিঙ্গুর নিয়ে। সিঙ্গুরে সাবেক বামফ্রন্ট সরকার অধিকৃত চাষিদের ধানি জমিতে টাটারা তাদের মোটর কারখানা তৈরি করছিল। মমতার আন্দোলনের ফলে সেই কাজ অসমাপ্ত রেখে তারা গুজরাটে চলে গিয়ে সেখান থেকে ন্যানো মোটরগাড়ি বার করে। সিঙ্গুরের ওই হাজার একর পরিত্যক্ত জমি মমতার সরকার আইন করে আবার দখল করে নিয়েছে। টাটারা ওই অধিগ্রহণ বেআইনি বলে হাইকোর্টে মামলা করে। হাইকোর্ট রায়ে বলেছেন, বর্তমান সরকার জনস্বার্থে টাটাদের লিজ দেওয়া ওই জমি যে পুনঃঅধিগ্রহণ করেছে তা আইনসঙ্গত। তবে টাটাকে এ জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং টাটারা এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করতেই পারে।
মমতার কাছে এই রায় বিরাট জয়। সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক চাষিরা যারা সাবেক সরকারের জোর করে জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতা করেন ও কোনো ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার করেন তাদের সংখ্যা কম হলেও মমতা তাদের জমি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতেই আন্দোলন করেছিলেন। এখন তার সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের সময় এসেছে। তাই এবার পূজা তার কাছে মহাসুখের সময়। তা ছাড়া তিনি এখন যা ধরছেন তাতেই সোনা ফলছে। স্বয়ং মনমোহন সিংই সাংবাদিকদের কাছে সম্প্রতি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতর রাজ্যের সম্মতি ছাড়া তিস্তা চুক্তি সম্ভব নয়। তিনি এখন নিজে মমতাকে এ বিষয়ে বুঝিয়ে রাজি করাবেন। কলকাতার একটি সংবাদপত্র লিখছে, শেখ হাসিনা নাকি বলেছেন দরকার হলে তিস্তা চুক্তি সই করতে তিনি নিজেই কলকাতা চলে আসবেন। মমতাকে এখন পায় কে!
সর্বশেষ সংবাদ :মনমোহন-সোনিয়ার হস্তক্ষেপে চিদাম্বরম ও প্রণব দু'জনই আপাতত সন্ধি করেছেন। প্রণব বাবু বলেছেন, অর্থ মন্ত্রকের নোটটিতে সাবেক অর্থমন্ত্রী চিদাম্বরম ইচ্ছা করলে সরকারি লোকসান ঠেকাতে পারতেন বলে যে মন্তব্য করা হয়েছে, তা আমলাদের মন্তব্য_ অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নয়।
কিন্তু সবাই জানেন, প্রণব-চিদাম্বরমের বিরোধের ক্ষেত্র অত হালকা ব্যাপার নয়। ক্ষমতার শীর্ষে ওঠার এক দ্বৈরথ। রাজায় রাজায় যুদ্ধ। আর চিদাম্বরম যেভাবে ফেঁসে গেছেন বিরোধীরা তাকে সহজে ছাড়বে না। অতএব সরকারের মাথার ওপরের খাঁড়া ঝুলেই রইল।
ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায় :ভারতীয় সাংবাদিক
প্রণব বাবুর পৈতৃক বাড়ি বীরভূম জেলার কীণাহার গ্রামে। গ্রামের বাড়িতে প্রতি বছর খুব ঘটা করে দুর্গাপূজা করেন প্রণব বাবু। সব রাজকাজ ফেলে রেখে পূজার তিন দিন গ্রামের বাড়িতে চলে এসে নিজেই পূজায় বসে যান। এবারও তাই করেছেন। কিন্তু মনে প্রচুর দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ ছিল। প্রধানমন্ত্রীকে লেখা অর্থ মন্ত্রকের একটি নোট ফাঁস হয়ে যাওয়ায় লঙ্কাকাণ্ড বেধে গেছে। ওই নোটে অর্থ মন্ত্রক প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছিল, ২-জি স্পেকট্রাম বণ্টনের ব্যাপারে সাবেক অর্থমন্ত্রী চিদাম্বরম সব জানতেন। তিনি চাইলে আগে আসলে আগে লাইসেন্স দেওয়া হবে এই নীতি বর্জন করে নিলাম করে স্পেকট্রাম বণ্টনের লাইসেন্স দিতে পারতেন।
নিলামের বদলে পছন্দমতো ব্যক্তিদের (আগে আসলে আগে পাওয়া যাবে) স্পেকট্রাম বণ্টন করে সরকারের কোটি কোটি টাকা লোকসান ঘটানোর দায়ে সাবেক টেলিকমমন্ত্রী রাজা ও তার টেলিকম সচিবসহ ১৩ জন পদস্থ ব্যক্তি এখন তিহার জেলে। তাদের মধ্যে তামিলনাড়ূর সাবেক মুখ্যমন্ত্রী করুণানিধির মেয়েও (যিনি একজন এমপি) আছেন।
২-জি স্পেকট্রাম বণ্টন ইউপিএ সরকারের আমলে যতগুলো স্ক্যাম হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড়। বর্তমানে সিবিআই এই স্ক্যামের তদন্ত করে চার্জশিট দিয়েছে। বিশেষ আদালতে তার শুনানি চলছে। সিবিআই আরও চার্জশিট দেবে, তাতে আরেকজন সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মারান গ্রেফতার হতে পারেন।
অর্থ মন্ত্রকের ওই নোটটিতে অভিযোগের তীর ছিল খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকে। আর এই নোট দেওয়া হয়েছে অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশে। কে না জানে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায়, তাই দুইয়ে দুইয়ে চার করে চিদাম্বরম অনুগামীরা বলতে চান স্বয়ং অর্থমন্ত্রী প্রণব বাবুই ওই নোটটি ফাঁস করতে মদদ জুগিয়েছেন। কারণ ওই নোট ফাঁসের ব্যাপারে মদদ জুগিয়ে তিনি চিদাম্বরম কাঁটাকে হটাতে চান। প্রণব বাবু এই অভিযোগ অস্বীকার করলেও এ ঘটনায় সোনিয়া গান্ধী ও প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যেভাবে চিদাম্বরমকে সমর্থন করতে এগিয়ে এসেছেন তাতে করে সাধারণ লোকের মনে হচ্ছে, কংগ্রেস হাইকমান্ডেরও প্রণব বাবুর ওপর আর আগের মতো আস্থা নেই। চিঠি ফাঁসের খবর প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রণব বাবু দিলি্ল থেকে নিউইয়র্ক উড়ে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে তার অবস্থান বুঝিয়ে এসেছেন। কারণ সে সময় প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় যোগ দেওয়ার জন্য নিউইয়র্ক ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে দিলি্ল ফিরে তড়িঘড়ি সাংবাদিক বৈঠক ডেকে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। সব দোষটা বিরোধীদের ঘাড়ে চাপিয়ে তিনি দেশবাসীকে বোঝাতে চাইছেন, এটি বিরোধীদের ষড়যন্ত্র। তারা ইউপিএ সরকারের ভাঙন ধরিয়ে এই সরকার ফেলে দিয়ে অন্তর্বর্তী নির্বাচন করার ষড়যন্ত্র করছেন। ২০১৪ পর্যন্ত এই সরকারের আয়ু। এই সরকার ২০১৪ পর্যন্ত থাকবে।
কিন্তু মনমোহন জানেন, তার সরকার নিত্যনতুন স্ক্যামে জড়িয়ে ক্রমেই কমজোরি হয়ে পড়ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিদাম্বরমের মতো শক্তিশালী নেতা যদি ২-জি কাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন ও তাকে পদত্যাগ করতে হয় তাহলে হয়তো সেটাই হবে শেষ আঘাত। চিদাম্বরম এখনই পদত্যাগ করতে চান। কিন্তু তাকে নিরস্ত করে রেখেছেন সোনিয়া ও মনমোহন। কিন্তু সিপিএম ও বিজেপি মিলে একসঙ্গে এই সরকারের বিরুদ্ধে যেভাবে একাট্টা হয়েছে ও ২-জি মামলায় শীর্ষ আদালতে যেভাবে একের পর এক চমকপ্রদ তথ্য বেরিয়ে আসছে তাতে চিদাম্বরম রেহাই পাবেন কি-না তা তার ভাগ্যই বিচার করবে। তবে এটি সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে। চিদাম্বরমের লবি খুবই শক্তিশালী। তারা এখন বলতে শুরু করবেন প্রণব বাবুই শেষ কোপটা মারলেন চিদাম্বরমের ঘাড়ে। অথচ প্রণব বাবু বারবার বলতে চেয়েছেন, তার কোনো অভিসন্ধিই ছিল না। সম্পূর্ণ প্রশাসনিক স্বার্থে আমলারা নোটটি তৈরি করেছিলেন। আর ওটা একদমই গোপন নোট। এরপর কী হলো তা জানার আগে আমি পাঠকদের এবার পূজায় সবচেয়ে একজন সুখী বাঙালির কথা জানাতে চাই। তিনি আর কেউ নন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তুঙ্গে বৃহস্পতি : গত ২৫ সেপ্টেম্বর কলকাতার বনেদিপাড়া ভবানীপুরের উপনির্বাচনের দিন দুপুর পর্যন্ত এমন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল যে, ভবানীপুরের অর্ধেক ভোটারই ওই বৃষ্টি মাথায় করে আর ভোট দিতে আসেননি।
কোনো কোনো বুথে ভোট পড়ে মাত্র ২২ শতাংশ। সবসুদ্ধ ৫০ শতাংশের মতো ভোট পড়ে এই উপনির্বাচনে। তাতেই ৫৪ হাজার ভোট জিতে জয়ী হন মমতা। তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে সিপিএম দাঁড় করায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিভাগের অধ্যাপিকা নন্দিনী মুখোপাধ্যায়কে। তার পক্ষে প্রচারে নামেন স্বয়ং সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সিপিএম মমতাকে হারাতে পারবে এই আশা করেনি, তারা চেয়েছে শুধু ব্যবধান কমিয়ে আনতে। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ভোটদানের হার এত কম হওয়ায় তৃণমূল শিবিরও ভাবে জয়ের ব্যবধান কমে যাবে। কিন্তু দেখা গেল কম ভোট পড়া সত্ত্বেও মমতা ৫৪ হাজার ভোটে জয়ী হয়েছেন। গত নির্বাচনে এই কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী ৫০ হাজার ভোটে জিতে ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, একই সঙ্গে বসিরহাটের উপনির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী এটিএম আবদাল্লা সিপিএমের জেতা আসনটি কেড়ে নেন। ফলে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় তৃণমূলের আরও একটি আসন বাড়ল। মোট আসন দাঁড়াল ১৮৫। সিপিএমের একটি আসন কমে দাঁড়াল মাত্র ৩৯।
এই দুটি উপনির্বাচন প্রমাণ করে দিল গত পাঁচ মাসে মমতার সরকার চোখে পড়ার মতো কোনো পরিবর্তন আনতে না পারলেও এবং আইন-শৃঙ্খলার উত্তরোত্তর অবনতি ঘটা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সিপিএমকে সমর্থন করছে না। কারণ ৩৪ বছরে সিপিএম আমলের সন্ত্রাসের স্মৃতি এখনও লোকের মন থেকে মুছে যায়নি। তাই তৃণমূল কর্মীরা যখন সিপিএম সমর্থকদের ওপর পাল্টা সন্ত্রাস চালাচ্ছে, তখন লোকে বলছে ওদের আমলে যারা মার খেয়েছিল জামানা বদল হওয়ায় এরা তাদের ওপর এখন প্রতিশোধ নিচ্ছে। সিপিএমের মুখপত্র গণশক্তিতে প্রতিদিন জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে সিপিএমের ওপর তৃণমূলের হামলার খবর ফলাও করে বার হচ্ছে। তা সত্ত্বেও জনসাধারণের মনে এসব খবর কোনো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে না। বরং এতদিন যারা সক্রিয় সিপিএম সমর্থক ছিল এখন তারা রাতারাতি ভোল বদলে তৃণমূল হয়ে আগের মতোই তোলা তুলছে। মানুষের ওপর জুলুম করছে। শুধু পতাকার রঙ বদলেছে।
মমতার আরেকটি জয় হলো সিঙ্গুর নিয়ে। সিঙ্গুরে সাবেক বামফ্রন্ট সরকার অধিকৃত চাষিদের ধানি জমিতে টাটারা তাদের মোটর কারখানা তৈরি করছিল। মমতার আন্দোলনের ফলে সেই কাজ অসমাপ্ত রেখে তারা গুজরাটে চলে গিয়ে সেখান থেকে ন্যানো মোটরগাড়ি বার করে। সিঙ্গুরের ওই হাজার একর পরিত্যক্ত জমি মমতার সরকার আইন করে আবার দখল করে নিয়েছে। টাটারা ওই অধিগ্রহণ বেআইনি বলে হাইকোর্টে মামলা করে। হাইকোর্ট রায়ে বলেছেন, বর্তমান সরকার জনস্বার্থে টাটাদের লিজ দেওয়া ওই জমি যে পুনঃঅধিগ্রহণ করেছে তা আইনসঙ্গত। তবে টাটাকে এ জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং টাটারা এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করতেই পারে।
মমতার কাছে এই রায় বিরাট জয়। সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক চাষিরা যারা সাবেক সরকারের জোর করে জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতা করেন ও কোনো ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার করেন তাদের সংখ্যা কম হলেও মমতা তাদের জমি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতেই আন্দোলন করেছিলেন। এখন তার সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের সময় এসেছে। তাই এবার পূজা তার কাছে মহাসুখের সময়। তা ছাড়া তিনি এখন যা ধরছেন তাতেই সোনা ফলছে। স্বয়ং মনমোহন সিংই সাংবাদিকদের কাছে সম্প্রতি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতর রাজ্যের সম্মতি ছাড়া তিস্তা চুক্তি সম্ভব নয়। তিনি এখন নিজে মমতাকে এ বিষয়ে বুঝিয়ে রাজি করাবেন। কলকাতার একটি সংবাদপত্র লিখছে, শেখ হাসিনা নাকি বলেছেন দরকার হলে তিস্তা চুক্তি সই করতে তিনি নিজেই কলকাতা চলে আসবেন। মমতাকে এখন পায় কে!
সর্বশেষ সংবাদ :মনমোহন-সোনিয়ার হস্তক্ষেপে চিদাম্বরম ও প্রণব দু'জনই আপাতত সন্ধি করেছেন। প্রণব বাবু বলেছেন, অর্থ মন্ত্রকের নোটটিতে সাবেক অর্থমন্ত্রী চিদাম্বরম ইচ্ছা করলে সরকারি লোকসান ঠেকাতে পারতেন বলে যে মন্তব্য করা হয়েছে, তা আমলাদের মন্তব্য_ অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নয়।
কিন্তু সবাই জানেন, প্রণব-চিদাম্বরমের বিরোধের ক্ষেত্র অত হালকা ব্যাপার নয়। ক্ষমতার শীর্ষে ওঠার এক দ্বৈরথ। রাজায় রাজায় যুদ্ধ। আর চিদাম্বরম যেভাবে ফেঁসে গেছেন বিরোধীরা তাকে সহজে ছাড়বে না। অতএব সরকারের মাথার ওপরের খাঁড়া ঝুলেই রইল।
ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায় :ভারতীয় সাংবাদিক
No comments