চরাচর-ছোট ফেনী নদীর পাড়ে
প্রাথমিক শিক্ষাটি অর্জন করতে হয়েছে পারিবারিক সদস্যদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুণক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। স্কুলটি পারিবারিকই। কেননা এই স্কুল থেকে আমাদের পরিবারের সব সদস্যই প্রাথমিকের বৈতরণী পার করেছেন। স্কুলটি ছিল আমাদের গ্রাম আড়কাইম থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পূর্বে। গুণক গ্রামেই জন্মগ্রহণ করেছেন আবদুল জব্বার খদ্দর, যিনি ১৯৭১ সালের অগি্নঝরা দিনগুলোতে স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার কারণে নাগরিকত্ব
হারান। গুণক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একটু উত্তরে তাঁর বাড়ি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের পূর্বাপর পাকিস্তান সরকারের দালালি করায় বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। মনে পড়ে ১৯৬৯ সালের উত্তাল দিনগুলোর কথা। যখন গ্রামেগঞ্জে মিছিল বের হতো। আজকের টোকাইদের মতো আমি এবং আমার তখনকার বাল্যবন্ধুরা হাজারো জনতার মিছিলে মিলিত হতাম। জনতার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আমাদের মুখ থেকেও উচ্চারিত হতো_'স্বাধীন কর স্বাধীন কর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর', 'স্বাধীন বাংলার মহান নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব', 'গ্রামে গ্রামে দুর্গ গড়, মুক্তিবাহিনী গঠন কর', 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর' ইত্যাদি স্লোগান।
মুক্তিকামী নেতা-কর্মীদের আস্তানা ছিল আমাদের বাড়ি। যুদ্ধ শুরু হলে আমার আর স্কুলে যাওয়া হলো না। দেখতাম, বাদুরিয়া গ্রামের মহিউদ্দীন (ছাত্র), সিদ্দিক আহাম্মদ (আওয়ামী লীগ নেতা), বড়হালিয়া গ্রামের মোস্তফা, আওয়ামী লীগ নেতা কবির আহাম্মদ, ন্যাপ নেতা সিরাজ উদ্দিন আহাম্মদ, আড়কাইম গ্রামের শরীয়ত উল্লাহ এবং আবদুর রউফসহ অনেকেই আমাদের বাড়িতে আসতেন। তাঁদের মধ্যে বড়হালিয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা কবির আহাম্মদ এবং আড়কাইম গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা শরীয়ত উল্লাহ মেম্বারকে ২০০১ সালে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সন্ত্রাসীরা নির্মমভাবে হত্যা করে। ন্যাপ নেতা সিরাজ উদ্দিন আহমেদ ক্যান্সারের ছোবলে ২০০১ সালে প্রাণ হারান। যুদ্ধকালে মহিউদ্দীন তখন বিষ্ণুপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্লাস নাইনে লেখাপড়া করতেন। আমাদের এলাকায় মহিউদ্দীনই খুব কম বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বাড়ির মুরবি্বরা গল্প-গুজব করতেন, তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা। দেশের স্বাধীনতা চান। তাঁরা সবাই সারা রাত থাকতেন আমাদের বাড়িতে। অন্যদিকে বাড়ির মহিলা এবং আমরা যারা ছোট ছিলাম, তারা রাত কাটাতাম পাশের বিভিন্ন মুসলিম বাড়িতে। আমাদের পরিবারের সদস্যরা বেশির ভাগ সময় বাড়ি থেকে একটু দক্ষিণে আবদুর রউফের বাড়িতে, আবার কখনো কখনো রুহুল আমীন ও হাশেম মাস্টারের ঘরে রাতযাপন করতেন। আবদুর রউফের ছেলে খাজা আহাম্মদ প্রায়ই এসে কোলে করে আমাকে নিয়ে যেতেন তাঁদের বাড়িতে। দেখতাম, হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে কী অপূর্ব সম্প্রীতির বন্ধন, যা আজও ভুলে যাওয়ার নয়।
আমার বাবা নলিনী কুমার বসাক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। বাবার দেশপ্রেম ও সমাজপ্রীতি রাজাকারদের চক্ষুশূল হয়। যুদ্ধকালে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নেন আমাদের বাড়িতে। প্রথমে নিরস্ত্র অবস্থায় স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতিহত করা হতো। রাজাকাররা আমাদের বাড়ি আক্রমণ করতে এলে তাদের কাছ থেকে রাইফেল কেড়ে নেয় মুক্তিকামী জনতা।
একপর্যায়ে আমাদের পক্ষে দেশে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ল। আমরা সীমান্ত অতিক্রম করে গিয়ে উঠলাম শরণার্থী শিবিরে। স্বাধীনতার পর আমরা ফিরে আসতে চাইলে মামা এবং ভারতের আত্মীয়স্বজন বাবাকে বারবার বারণ করেন বাংলাদেশে ফিরে না আসতে। কিন্তু বাবার ছিল দেশপ্রেম। তাই বাবাকে মামা এবং আত্মীয়স্বজনের বারণ উপেক্ষা করে দেশে ফিরে আসতে হয়েছে। দেশে এসে দেখি, আমাদের ঘরবাড়ি কিছুই নেই। সবই নিয়ে গেছে রাজাকাররা। বাড়িতে আবার নতুন করে ঘর নির্মাণের কাজে লেগে গেলেন বাবা।
আমাদের স্কুলেরই একসময়কার ছাত্র ওবায়দুল হক ছিলেন রাজাকারদের প্রধান। তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত হতো নির্যাতন কেন্দ্র ও জল্লাদখানা। জনশ্রুতি আছে, ওই নির্যাতন কেন্দ্র ও জল্লাদখানায় মুক্তিযুদ্ধকালে ফেনীর দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ৩৮০ জনকে হত্যা করা হয়। নির্যাতন করা হয় হাজার হাজার মানুষকে। ফেনীর দক্ষিণে নির্যাতন কেন্দ্রের মধ্যে ধলিয়া হাইস্কুল, মতিগঞ্জ সিও অফিস এবং সোনাগাজী থানাও ছিল। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে বিষ্ণুপুর উচ্চ বিদ্যালয় নির্যাতন কেন্দ্র ও জল্লাদখানায়। এই জল্লাদখানার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট ফেনী নদী। নদীর পশ্চিম পারে বিষ্ণুপুর গ্রামের নামে স্কুলটির নামকরণ করা হয় বিষ্ণুপুর উচ্চ বিদ্যালয়। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে এ বি এম তালেব আলী ফিরে আসেন রাজনীতির নায়ক হয়ে, আর ওবায়দুল হক পালিয়ে যান রাজনীতির খলনায়ক হয়ে। আমরা যখন বিষ্ণুপুর স্কুলে পড়তাম, তখনো স্কুলের দেয়ালে যুদ্ধকালীন গুলির দাগ ছিল। ক্লাস শেষে আমরা দেয়ালের মধ্যে লেগে থাকা গুলির দাগগুলো দেখতাম।
তুষার কান্তি বসাক
মুক্তিকামী নেতা-কর্মীদের আস্তানা ছিল আমাদের বাড়ি। যুদ্ধ শুরু হলে আমার আর স্কুলে যাওয়া হলো না। দেখতাম, বাদুরিয়া গ্রামের মহিউদ্দীন (ছাত্র), সিদ্দিক আহাম্মদ (আওয়ামী লীগ নেতা), বড়হালিয়া গ্রামের মোস্তফা, আওয়ামী লীগ নেতা কবির আহাম্মদ, ন্যাপ নেতা সিরাজ উদ্দিন আহাম্মদ, আড়কাইম গ্রামের শরীয়ত উল্লাহ এবং আবদুর রউফসহ অনেকেই আমাদের বাড়িতে আসতেন। তাঁদের মধ্যে বড়হালিয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা কবির আহাম্মদ এবং আড়কাইম গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা শরীয়ত উল্লাহ মেম্বারকে ২০০১ সালে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সন্ত্রাসীরা নির্মমভাবে হত্যা করে। ন্যাপ নেতা সিরাজ উদ্দিন আহমেদ ক্যান্সারের ছোবলে ২০০১ সালে প্রাণ হারান। যুদ্ধকালে মহিউদ্দীন তখন বিষ্ণুপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্লাস নাইনে লেখাপড়া করতেন। আমাদের এলাকায় মহিউদ্দীনই খুব কম বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বাড়ির মুরবি্বরা গল্প-গুজব করতেন, তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা। দেশের স্বাধীনতা চান। তাঁরা সবাই সারা রাত থাকতেন আমাদের বাড়িতে। অন্যদিকে বাড়ির মহিলা এবং আমরা যারা ছোট ছিলাম, তারা রাত কাটাতাম পাশের বিভিন্ন মুসলিম বাড়িতে। আমাদের পরিবারের সদস্যরা বেশির ভাগ সময় বাড়ি থেকে একটু দক্ষিণে আবদুর রউফের বাড়িতে, আবার কখনো কখনো রুহুল আমীন ও হাশেম মাস্টারের ঘরে রাতযাপন করতেন। আবদুর রউফের ছেলে খাজা আহাম্মদ প্রায়ই এসে কোলে করে আমাকে নিয়ে যেতেন তাঁদের বাড়িতে। দেখতাম, হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে কী অপূর্ব সম্প্রীতির বন্ধন, যা আজও ভুলে যাওয়ার নয়।
আমার বাবা নলিনী কুমার বসাক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। বাবার দেশপ্রেম ও সমাজপ্রীতি রাজাকারদের চক্ষুশূল হয়। যুদ্ধকালে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নেন আমাদের বাড়িতে। প্রথমে নিরস্ত্র অবস্থায় স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতিহত করা হতো। রাজাকাররা আমাদের বাড়ি আক্রমণ করতে এলে তাদের কাছ থেকে রাইফেল কেড়ে নেয় মুক্তিকামী জনতা।
একপর্যায়ে আমাদের পক্ষে দেশে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ল। আমরা সীমান্ত অতিক্রম করে গিয়ে উঠলাম শরণার্থী শিবিরে। স্বাধীনতার পর আমরা ফিরে আসতে চাইলে মামা এবং ভারতের আত্মীয়স্বজন বাবাকে বারবার বারণ করেন বাংলাদেশে ফিরে না আসতে। কিন্তু বাবার ছিল দেশপ্রেম। তাই বাবাকে মামা এবং আত্মীয়স্বজনের বারণ উপেক্ষা করে দেশে ফিরে আসতে হয়েছে। দেশে এসে দেখি, আমাদের ঘরবাড়ি কিছুই নেই। সবই নিয়ে গেছে রাজাকাররা। বাড়িতে আবার নতুন করে ঘর নির্মাণের কাজে লেগে গেলেন বাবা।
আমাদের স্কুলেরই একসময়কার ছাত্র ওবায়দুল হক ছিলেন রাজাকারদের প্রধান। তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত হতো নির্যাতন কেন্দ্র ও জল্লাদখানা। জনশ্রুতি আছে, ওই নির্যাতন কেন্দ্র ও জল্লাদখানায় মুক্তিযুদ্ধকালে ফেনীর দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ৩৮০ জনকে হত্যা করা হয়। নির্যাতন করা হয় হাজার হাজার মানুষকে। ফেনীর দক্ষিণে নির্যাতন কেন্দ্রের মধ্যে ধলিয়া হাইস্কুল, মতিগঞ্জ সিও অফিস এবং সোনাগাজী থানাও ছিল। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে বিষ্ণুপুর উচ্চ বিদ্যালয় নির্যাতন কেন্দ্র ও জল্লাদখানায়। এই জল্লাদখানার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট ফেনী নদী। নদীর পশ্চিম পারে বিষ্ণুপুর গ্রামের নামে স্কুলটির নামকরণ করা হয় বিষ্ণুপুর উচ্চ বিদ্যালয়। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে এ বি এম তালেব আলী ফিরে আসেন রাজনীতির নায়ক হয়ে, আর ওবায়দুল হক পালিয়ে যান রাজনীতির খলনায়ক হয়ে। আমরা যখন বিষ্ণুপুর স্কুলে পড়তাম, তখনো স্কুলের দেয়ালে যুদ্ধকালীন গুলির দাগ ছিল। ক্লাস শেষে আমরা দেয়ালের মধ্যে লেগে থাকা গুলির দাগগুলো দেখতাম।
তুষার কান্তি বসাক
No comments