আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম
বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের সঙ্গে কবে পরিচয়, সেটা আর মনে নেই। তবে সেই রাতের কথা বেশ মনে পড়ে। তখন তাঁর বয়স ৬৫ বছরের কাছাকাছি। আর আমি স্কুলপড়ুয়া বালক। ছোটবেলা থেকেই ছিল গানের নেশা। তাঁর গানের সুর শুনলেই সব দুরন্তপনা এক নিমেষেই থেমে যেত। সেই রাতে ছিল আমাদের গ্রামে বাউল গানের আসর। তবে বাবার কোলে বসে গান শুনতে শুনতে সেদিন কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। যখন ঘুম ভাঙল, তখন দেখি আসরে সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা লম্বা চুলের দেবতুল্য এক ব্যক্তি দোতারা বাজিয়ে একমনে গান গাইছেন।
ছোটবেলায় দেখা সেই শাহ আবদুল করিম পরবর্তী জীবনে আমার অতি ঘনিষ্ঠজনদের একজন হয়ে ওঠেন। সুরের পাখায় ভর করে হয়েছেন বাউল গানের কিংবদন্তিতুল্য শিল্পী। শাহ আবদুল করিমের সাক্ষা ৎ দর্শনের সুতীব্র ইচ্ছায় কত দিন যে ছুটে গিয়েছি তাঁর গ্রামে! যখনই গিয়েছি, তখনই শুনেছি বাউলসম্রাটের ভাবশিষ্য আবদুর রহমান, রোহী ঠাকুর, কাইয়ুম শাহ, রণেশ ঠাকুর আর বশিরউদ্দিন সরকারদের মায়াবী কণ্ঠের প্রচলিত-অপ্রচলিত কত গান।
বাউলসম্রাট শত অভাব-অনটনে থেকেও রাখঢাক না রেখে স্পষ্ট কথা বলতেন। অন্যায়-অবিচার দেখলেই প্রতিবাদ করতেন। গানে গানে প্রতিবাদ তো ছিলই। তিনি ছিলেন সার্থক শিল্পী। ছোট্ট একটি উদাহরণ দিলে সেটা আরও পরিষ্কার হবে। এটা আমার নিজ চোখে দেখা ঘটনা—শেষ বয়সে সিলেটে একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বাউলসম্রাট এসেছিলেন। তাঁর স্মৃতিশক্তি তখন অনেকটাই বিলুপ্ত। স্মৃতিভ্রমের সেই ক্রান্তিলগ্নে ওই অনুষ্ঠানে বাউলসম্রাটের হাতে আয়োজকেরা সোয়া তিন লাখ টাকার চেক তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ভেবেছিলেন, সেটা ছিল সোয়া তিন হাজার টাকার চেক!
বাউলসম্রাট চেক হাতে নিয়ে আয়োজকদের উদ্দেশে মন্তব্য করলেন, ‘আপনাদের ভালোলাগায় আমি মুগ্ধ। আমার মতো নিতান্তই অভাজন এক ব্যক্তির হাতে আপনারা সোয়া তিন হাজার টাকা তুলে দিলেন। আপনাদের ভালোবাসার এই অশেষ ঋণ আমি আজীবন মনে রাখব।’ তা ৎ ক্ষণিকভাবে উপস্থিত সুধীজন বাউলের ভুল ভাঙিয়ে জানান যে এই অনুষ্ঠানে সোয়া তিন হাজার নয়, সোয়া তিন লাখ টাকার চেক সম্মাননা স্বরূপ তাঁকে দেওয়া হয়েছে।
সুধীজনদের কথা শুনে বাউলসম্রাট চমকে উঠলেন। চেয়ারে বসা ছিলেন, মুহূর্তেই উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘অসম্ভব! এটা আমি নেব না। আমার এত টাকার প্রয়োজন নেই। আমি চাই শুধু আপনাদের ভালোবাসা।’ বাউলসম্রাটের নির্লোভ চরিত্রের বিষয়টি প্রত্যক্ষ করে সেদিন মিলনায়তনভর্তি সুধীদের চোখ ভিজে উঠেছিল। সবাই দাঁড়িয়ে মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে বাউলসম্রাটের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এই হলো শাহ আবদুল করিম। সারা জীবন এমনিভাবে নির্লোভ-নিরহংকার জীবন যাপন করেছেন। তাই সংগত কারণেই পেয়েছেন গণমানুষের ভালোবাসা।
প্রসঙ্গক্রমে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মুহম্মদ জাফর ইকবালের মুখে শোনা কথার উল্লেখ করা যেতে পারে। তখন ২০০৬ সাল, বাউলসম্রাটের একমাত্র সন্তান শাহ নূরজালালের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে প্রথমবারের মতো আমরা ‘শাহ আবদুল করিম লোকউ ৎ সব’-এর আয়োজন করেছিলাম। এই উ ৎ সবে আমাদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলেন জাফর ইকবাল স্যার। বক্তৃতা শেষে তিনি বাউলসম্রাটকে নিয়ে একটি গল্প শোনান।
জাফর ইকবাল স্যার ওই দিন বলেছিলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রয়াত মোহাম্মদ হাবিবুর রহমানের কাছে “আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম” গানটি নিয়ে একটি গল্প শুনেছিলাম। তিনি উপাচার্য থাকাকালীন একবার ভারতবর্ষে গেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নিয়ে সেই সেমিনার ওয়ার্কশপের শেষে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সেই অনুষ্ঠানে একজন শাহ আবদুল করিমের লেখা “আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম” গানটি গেয়ে শোনালেন। সবাই মুগ্ধ হয়ে গানটি শুনলেন। কিন্তু আমাদের উপাচার্য অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, গানটি কে লিখেছেন সে সম্পর্কে গায়ক কিছুই বললেন না। মনে হলো, সবাই ধরে নিলেন যে গানটি লিখেছেন তাঁদের দেশের কোনো গীতিকার! অধ্যাপক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান তখন অনুমতি নিয়ে মঞ্চে উঠে বললেন, এইমাত্র আপনারা যে অপূর্ব সুন্দর গানটি শুনেছেন, এই গানটি লিখেছেন আমাদের এলাকার বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম।’
এরপর মুহম্মদ জাফর ইকবাল বললেন, ‘প্রফেসর মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান আমাকে বলেছিলেন, ভারতবর্ষের জ্ঞানী-গুণী মানুষের সামনে বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের কথা বলতে গিয়ে তাঁর বুক গর্বে ফুলে উঠেছিল! এত দিন পর আমারও সেই কথাটি মনে করে গর্বে বুক ফুলে উঠছে।’
বাউলসম্রাটের প্রয়াণের পর এখন দেখা যাচ্ছে, করিম-প্রদত্ত সুরের বাইরে তাঁর গান বেসুরে গাওয়া হচ্ছে। যেন কারও কোনো দায়বোধ নেই। বাউলসম্রাটের ঘনিষ্ঠজনদের অন্যতম কবি-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শুভেন্দু ইমামকে এ নিয়ে মাঝেমধ্যেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে শুনি। ‘এমন তো নয় যে সুরগুলো পাওয়া যাচ্ছে না। যেখানে করিম ভাইয়ের গানের সুরগুলো আমাদের প্রায় সবার জানা, সেখানে তাঁর সুর পাল্টিয়ে ফেলা মোটেই উচিত নয়।’ কবি শুভেন্দু ইমামের এ কথাগুলো ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে।
সুমনকুমার দাশ
ছোটবেলায় দেখা সেই শাহ আবদুল করিম পরবর্তী জীবনে আমার অতি ঘনিষ্ঠজনদের একজন হয়ে ওঠেন। সুরের পাখায় ভর করে হয়েছেন বাউল গানের কিংবদন্তিতুল্য শিল্পী। শাহ আবদুল করিমের সাক্ষা ৎ দর্শনের সুতীব্র ইচ্ছায় কত দিন যে ছুটে গিয়েছি তাঁর গ্রামে! যখনই গিয়েছি, তখনই শুনেছি বাউলসম্রাটের ভাবশিষ্য আবদুর রহমান, রোহী ঠাকুর, কাইয়ুম শাহ, রণেশ ঠাকুর আর বশিরউদ্দিন সরকারদের মায়াবী কণ্ঠের প্রচলিত-অপ্রচলিত কত গান।
বাউলসম্রাট শত অভাব-অনটনে থেকেও রাখঢাক না রেখে স্পষ্ট কথা বলতেন। অন্যায়-অবিচার দেখলেই প্রতিবাদ করতেন। গানে গানে প্রতিবাদ তো ছিলই। তিনি ছিলেন সার্থক শিল্পী। ছোট্ট একটি উদাহরণ দিলে সেটা আরও পরিষ্কার হবে। এটা আমার নিজ চোখে দেখা ঘটনা—শেষ বয়সে সিলেটে একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বাউলসম্রাট এসেছিলেন। তাঁর স্মৃতিশক্তি তখন অনেকটাই বিলুপ্ত। স্মৃতিভ্রমের সেই ক্রান্তিলগ্নে ওই অনুষ্ঠানে বাউলসম্রাটের হাতে আয়োজকেরা সোয়া তিন লাখ টাকার চেক তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ভেবেছিলেন, সেটা ছিল সোয়া তিন হাজার টাকার চেক!
বাউলসম্রাট চেক হাতে নিয়ে আয়োজকদের উদ্দেশে মন্তব্য করলেন, ‘আপনাদের ভালোলাগায় আমি মুগ্ধ। আমার মতো নিতান্তই অভাজন এক ব্যক্তির হাতে আপনারা সোয়া তিন হাজার টাকা তুলে দিলেন। আপনাদের ভালোবাসার এই অশেষ ঋণ আমি আজীবন মনে রাখব।’ তা ৎ ক্ষণিকভাবে উপস্থিত সুধীজন বাউলের ভুল ভাঙিয়ে জানান যে এই অনুষ্ঠানে সোয়া তিন হাজার নয়, সোয়া তিন লাখ টাকার চেক সম্মাননা স্বরূপ তাঁকে দেওয়া হয়েছে।
সুধীজনদের কথা শুনে বাউলসম্রাট চমকে উঠলেন। চেয়ারে বসা ছিলেন, মুহূর্তেই উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘অসম্ভব! এটা আমি নেব না। আমার এত টাকার প্রয়োজন নেই। আমি চাই শুধু আপনাদের ভালোবাসা।’ বাউলসম্রাটের নির্লোভ চরিত্রের বিষয়টি প্রত্যক্ষ করে সেদিন মিলনায়তনভর্তি সুধীদের চোখ ভিজে উঠেছিল। সবাই দাঁড়িয়ে মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে বাউলসম্রাটের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এই হলো শাহ আবদুল করিম। সারা জীবন এমনিভাবে নির্লোভ-নিরহংকার জীবন যাপন করেছেন। তাই সংগত কারণেই পেয়েছেন গণমানুষের ভালোবাসা।
প্রসঙ্গক্রমে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক মুহম্মদ জাফর ইকবালের মুখে শোনা কথার উল্লেখ করা যেতে পারে। তখন ২০০৬ সাল, বাউলসম্রাটের একমাত্র সন্তান শাহ নূরজালালের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে প্রথমবারের মতো আমরা ‘শাহ আবদুল করিম লোকউ ৎ সব’-এর আয়োজন করেছিলাম। এই উ ৎ সবে আমাদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলেন জাফর ইকবাল স্যার। বক্তৃতা শেষে তিনি বাউলসম্রাটকে নিয়ে একটি গল্প শোনান।
জাফর ইকবাল স্যার ওই দিন বলেছিলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রয়াত মোহাম্মদ হাবিবুর রহমানের কাছে “আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম” গানটি নিয়ে একটি গল্প শুনেছিলাম। তিনি উপাচার্য থাকাকালীন একবার ভারতবর্ষে গেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নিয়ে সেই সেমিনার ওয়ার্কশপের শেষে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সেই অনুষ্ঠানে একজন শাহ আবদুল করিমের লেখা “আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম” গানটি গেয়ে শোনালেন। সবাই মুগ্ধ হয়ে গানটি শুনলেন। কিন্তু আমাদের উপাচার্য অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, গানটি কে লিখেছেন সে সম্পর্কে গায়ক কিছুই বললেন না। মনে হলো, সবাই ধরে নিলেন যে গানটি লিখেছেন তাঁদের দেশের কোনো গীতিকার! অধ্যাপক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান তখন অনুমতি নিয়ে মঞ্চে উঠে বললেন, এইমাত্র আপনারা যে অপূর্ব সুন্দর গানটি শুনেছেন, এই গানটি লিখেছেন আমাদের এলাকার বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম।’
এরপর মুহম্মদ জাফর ইকবাল বললেন, ‘প্রফেসর মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান আমাকে বলেছিলেন, ভারতবর্ষের জ্ঞানী-গুণী মানুষের সামনে বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের কথা বলতে গিয়ে তাঁর বুক গর্বে ফুলে উঠেছিল! এত দিন পর আমারও সেই কথাটি মনে করে গর্বে বুক ফুলে উঠছে।’
বাউলসম্রাটের প্রয়াণের পর এখন দেখা যাচ্ছে, করিম-প্রদত্ত সুরের বাইরে তাঁর গান বেসুরে গাওয়া হচ্ছে। যেন কারও কোনো দায়বোধ নেই। বাউলসম্রাটের ঘনিষ্ঠজনদের অন্যতম কবি-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শুভেন্দু ইমামকে এ নিয়ে মাঝেমধ্যেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে শুনি। ‘এমন তো নয় যে সুরগুলো পাওয়া যাচ্ছে না। যেখানে করিম ভাইয়ের গানের সুরগুলো আমাদের প্রায় সবার জানা, সেখানে তাঁর সুর পাল্টিয়ে ফেলা মোটেই উচিত নয়।’ কবি শুভেন্দু ইমামের এ কথাগুলো ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে।
সুমনকুমার দাশ
No comments