আলোচনা- 'ইভ টিজিং : দায়ী কে?' by ফখরে আলম

আমার একটিই মেয়ে। সে ক্লাস নাইনে পড়ে। স্কুলে একাই যাতায়াত করে। সাম্প্রতিক সময়ের ইভ টিজিংয়ের নানা ঘটনায় আমার মেয়েটি রোগা হয়ে গেছে। একা একা সে খবরের কাগজ পড়ে। একা একা চুপ করে বসে থাকে। আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলি। কিন্তু আমরা কোনো সিদ্ধান্তে পেঁৗছাতে পারি না। একজন সংবাদকর্মী হয়েও মেয়েকে আমি কোনো অভয় দিতে পারি না। একবার মনে করি কুংফু কারাত শেখাব। একবার মনে করি, তাকে সাহসী করে তুলব। কিন্তু মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে ইভ টিজিংয়ের নানা খবর শুনে আমিও তার মতো রোগা হয়ে যাই। বিষয়টি নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গেও কথা বলি।
যাঁরা মেয়ের বাবা তাঁরা আমার মতোই উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তাঁরা বলেন, রাতারাতি এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো কেন? কেন ছাত্র শিক্ষকের ওপর মোটরসাইকেল তুলে দিচ্ছে? কেন মদ বিক্রেতার ছেলে মোটরসাইকেল চাপা দিয়ে চাঁপা রানীদের হত্যা করছে? এসব প্রশ্নেরও কোনো সমাধান হয় না। তবে মেয়ের বাবারা মাথা নিচু করে আমাকে বলেছেন, মেয়ের বাবা হয়েই আমরা অপরাধ করেছি। মেয়ের মায়েদেরও একই বক্তব্য। তাঁরাও মেয়ে নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে বসবাস করছেন। এখন লক্ষ্য করছি, অনেক মা মেয়ের সঙ্গে স্কুল-কলেজে যাচ্ছেন। মেয়েকে বুকে আগলে রাখছেন। পুরো বাংলাদেশের একই চিত্র। আমি এর কারণ খোঁজার চেষ্টা করি।
ইভ টিজিং সম্পর্কে আমি যতটুক জানি ভারত, বাংলাদেশে পুরুষ দ্বারা মেয়েদের যৌন নিপীড়নের শিকার বা নিগৃহীত হওয়ার আরেক নাম বা প্রতিশব্দ হচ্ছে ইভ টিজিং। ভারত, বাংলাদেশ বাদে পৃথিবীর অন্য কোথাও ইভ টিজিং নেই। এমনকি পার্শবর্তী ভারতেও ইভ টিজিং এখন নেই বললেই চলে। আমাদের সীমান্ত অতিক্রম করলেই ভারতের পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের মেয়েরা এখনো ফ্রক পরে থাকে। এমনকি তারা ওড়নার ব্যবহার খুব কমই করে। শহরের মেয়েরা এখন গেঞ্জি, টি-শার্ট, জিন্স পরছে। হাতাকাটা স্লিপ লেস ব্লাউজের চলও সেখানে খুব বেশি। তারা সংক্ষিপ্ত ব্লাউজ পরতে বেশি পছন্দ করে। পোশাকের উগ্রতার কারণে যদি বখাটেরা কটূক্তি করে পশ্চিমবঙ্গের শহর, গ্রামে তাও নেই। কলকাতার হাইকমিশনের একজন কূটনীতিকের স্ত্রী এ প্রসঙ্গে আমাকে বলেছেন, বাংলাদেশে আমার ছেলের বয়সীরা আমার দিকে অকারণে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু কলকাতায় হাতাকাটা ব্লাউজ পরে একা কোনো মেয়ে পথ দিয়ে হেঁটে গেলেও তাকে নিয়ে কটূক্তি করার কোনো সাহস কারো নেই। যদি কেউ কটূক্তি করে তাহলে সে গণপিটুনিতে মারা যাবে। এখানকার মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক সচেতন। কটূক্তি করার সময় সাহস কারো নেই। কিন্তু আমরা ইভ টিজিংয়ের অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি। আমার কাছে মনে হয়, এর জন্য আমরাই দায়ী। মানুষের স্বপ্নহীনতা, বেকার সমস্যা, মাদক, কালো টাকা, নষ্ট রাজনীতি ইভ টিজিংকে উস্কে দিয়েছে। এর পাশাপাশি আমরা আরো লক্ষ্য করছি, ছাত্রছাত্রী, তরুণ, যুবক, কম বয়সী ছেলেমেয়েদের মোবাইল, ইন্টারনেট, মোটরসাইকেল ব্যবহার অতীতের তুলনায় অনেকাংশে বৃদ্ধি পাওয়ায় ইভ টিজিংয়ের মাত্রা দিনদিন বেড়েই চলেছে। টিভি নাটক, সিনেমা, বইপুস্তক, গান, সিডি, ভিসিডি, বিজ্ঞাপনচিত্র, ডিস লাইন, সাইবার ক্যাফে, চায়ের দোকানের টিভি-ভিসিডি, অকার্যকর আইন এই বিষয়গুলো ইভ টিজিংয়ের প্ররোচনায় বখাটেদের অনেকাংশে সহায়তা করছে। গ্রামগঞ্জে সর্বত্র টিভি, সিডিতে বাজছে অশ্লীল গান। তার সঙ্গে অশ্লীল নাচ। সব বয়সের মানুষ চায়ের দোকানে, রাস্তার মোড়ে, সেলুনে, রেলস্টেশনে, সিডির দোকানে, বাস স্ট্যান্ডে, স্টিমার ঘাটে এই অশ্লীল গান শুনছে, অশ্লীল নাচ দেখছে। নার্গিসের 'ট্যাংকি ছেদা' এই ভিসিডি এখন গ্রামগঞ্জে হটকেক। নার্গিসের এই গানগুলোর সঙ্গে অর্ধ উলঙ্গ মহিলার নাচও রয়েছে। গ্রামের হাটবাজারে গেলেই এখন শোনা যায় এমন গান, 'বোরখা পরা মেয়ে আমায় পাগল করেছে।' 'ও টুনির মা তোমার টুনি কথা শোনে না। যার তার সাথে ডেটিং মারে আমায় চেনে না।' এই গানগুলো আমরাই লিখেছি। আমরাই গেয়েছি। আমরাই তরুণ যুবকদের হাতে পেঁৗছে দিয়েছি। অশ্লীল, যৌন আবেদন কুরুচিপূর্ণ এই গান, এই নাচ দেখে শুনে যদি কোনো তরুণ যুবক ইভ টিজিং করে তাহলে তার জন্য দায়ী কে? আমরা ফেনসিডিল সেবনকারী ছেলের হাতে কড়কড়ে নোট তুলে দিচ্ছি, তাকে চকচকে পালসার মোটরসাইকেল কিনে দিচ্ছি। সে ৪২০০ টাকা দামের ছেড়া জিন্সের প্যান্ট পরছে। কান ফুটিয়ে গলায় রুমাল জড়িয়ে ইভ টিজিং করছে। এর জন্য কে দায়ী? ওই বখাটে, না তার মা-বাবা। বিষয়গুলো অবশ্যই ভাবনার। কেন পাড়া-মহল্লার দোকানে টিভি সিডি রাত ২টা পর্যন্ত বাজবে? কেন মোড়ে মোড়ে গাঁজা, ফেনসিডিলের আসর জমবে? কেন স্কুলের ছাত্র মোটরসাইকেল চালাবে? কেন রাত ১২টার সময় সে বাড়ি ফিরবে? কেন সিনেমা হলের সামনে অর্ধউলঙ্গ নায়িকার পোস্টার সাঁটা হবে? কেন টিভি নাটকে বখাটেপনার দৃশ্য দেখানো হবে? কেন বিজ্ঞাপনচিত্রে নারীকে অশ্লীল, মুখ্য পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করা হবে? এসব প্রশ্নের জবাব খোঁজা প্রয়োজন। আর কত মিজান স্যার, আর কত চাঁপা রানী, আর কত রুপালি রানীর মৃত্যু হলে আওয়ামী লীগ, বিএনপির নেতারা বলবেন, আমাদের দলে বখাটেদের কোনো স্থান নেই। যারা ইভ টিজিং করবে তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। তাদের কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে। আমার মতো উদ্বিগ্ন মেয়ের বাবারা এমন দিনেরই প্রতীক্ষা করছেন।
=============================
কল্প গল্প- '...আজব খাওয়া, ভোজ কয় যাহারে!' by আলী আলী হাবিব  রাজনৈতিক আলোচনা- ''উচিত কথায় ননদ বেজার, গরম ভাতে ভাতে বিলাই (বিড়াল)' by আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী  প্রকৃতি- 'জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃক্ষশত্রু' by মেহেদী উল্লাহ  ইতিহাস- 'ইতিহাসে মওলানা ভাসানীর আসন' by সৈয়দ আবুল মকসুদ  ইতিহাস- 'টিকে থাকুক ‘টেগর লজ’' by আশীষ-উর-রহমান  আলোচনা- 'কর্মশক্তি ও টাকার অপচয়!' by রোজিনা ইসলাম  রাজনৈতিক আলোচনা- 'আশির দশকে রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন' by আবুল কাসেম ফজলুল হক  আলোচনা- 'বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব আকাশচুম্বী' by ড. নিয়াজ আহম্মেদ  ইতিহাস- 'প্রত্যন্ত জনপদে ইতিহাস-সঙ্গী হয়ে' by সাযযাদ কাদির  আন্তর্জাতিক- 'জাতিসংঘ বনাম যুক্তরাষ্ট্র' by শহিদুল শহিদুল ইসলাম  গল্পালোচনা- 'দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ?' by মহসীন মহসীন হাবিব  স্বাস্থ্য আলোচনা- 'প্রসূতিসেবায় পিছিয়ে দেশ' by শেখ সাবিহা আলম  রাজনৈতিক আলোচনা- 'বন্দিত কান্না, নিন্দিত হরতাল আর রাজকীয় অশ্রুপাতের গল্প' by ফারুক ওয়াসিফ  খবর- উত্তর কোরিয়ার নতুন পরমাণু প্ল্যান্ট দেখে 'তাজ্জব' মার্কিন বিজ্ঞানীরা


কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ ফখরে আলম


এই লেখা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.