নকআউট পর্বের ট্র্যাজেডি by মোহীত উল আলম
বিশ্বকাপের নকআউট পর্বের প্রথম দুটি ম্যাচ দেখে জার্মান দার্শনিক ফ্রেডেরিক হেগেলের ট্র্যাজেডির সংজ্ঞা মনে না এসে পারল না। এ বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘ট্র্যাজেডি তখনই ঘটে যখন দুটি ভালো চরিত্র কিংবা আদর্শের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে: ট্র্যাজেডি ইজ দ্য কনফ্লিক্ট অব টু গুডস।’
কালকে (২৬ জুন) প্রথমে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলো দক্ষিণ কোরিয়া আর উরুগুয়ের মধ্যে। মনের একটা অংশ কোরিয়াকে সমর্থন দিচ্ছিল আর আরেকটি অংশ হেগেলীয় কায়দায় উরুগুয়ের পক্ষ নিচ্ছিল। দক্ষিণ কোরিয়া আমার মহাদেশ এশিয়ার একটি দল, কিন্তু উরুগুয়ে যে ম্যারাডোনার আগে আমার প্রিয় খেলোয়াড় ফ্রান্সিস কোলির দেশ! কী করি? ফোরলান আর সুয়ারেজের চোখজুড়ানো শৈল্পিক ফুটবল উপভোগ করব, নাকি গতিশীল অ্যাক্রোবেটিক স্বমহাদেশীয় দল কোরিয়াকে সমর্থন দেব। মার্ক অ্যান্টনি যেমন রোম ও ক্লিওপেট্রার মধ্যে ক্লিওপেট্রাকে বেছে নিয়েছিলেন, আমিও তেমনই নান্দনিক দল উরুগুয়েকে বেছে নিলাম। কোরিয়া গোল দিয়ে দ্বিতীয়ার্ধে সমতায় পৌঁঁছালে আমার সত্যি সত্যি খারাপ লাগা শুরু হলো। যা হোক, সুয়ারেজ যখন দ্বিতীয় গোলটিও করে ফেললেন এবং খেলা ওই ২-১ ফলাফলে শেষ হলো, তখন আবার মাঠজুড়ে উরুগুয়ের খেলোয়াড়দের বিজয়োল্লাসের পাশাপাশি কোরীয়দের কান্না দেখে নিজেরও কান্না পেতে শুরু করল। ভাবলাম, ওরাও তো ভালো খেলেছে। বাদ পড়ার মতো দল তো ওরা নয়! আবার সেই হেগেলীয় দোটানায় ভুগতে ভুগতে একসময় মনে হলো, দ্বিতীয় রাউন্ড যেন নকআউট পর্ব নয়, একটা ফায়ারিং স্কোয়াড। দুটি ভালো দলের একটিকে বিদায় নিতেই হবে।
পরের খেলায় ঘানা পড়ল যুক্তরাষ্ট্রের সামনে। এখন অবশ্য মন আগের মতো দুই ভাগ হলো না, ঘানা একমাত্র আফ্রিকান দেশ যারা এখনো টিকে আছে। স্বভাবতই মন তাদেরই টানল। কিন্তু প্যাভিলিয়নে যে লাল রঙের জ্যাকেট পরে বসে আছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন! আমি যে কী কারণে ক্লিনটনের ভক্ত, সেটি পাঠককে জানানোর দরকার নেই, কিন্তু তাঁর উপস্থিতির কারণে মনটা আবার হেগেলীয় কায়দায় খানিকটা বিচলিত হয়ে উঠল। কিন্তু ঘানার গোলই প্রথমে এল। করলেন কেভিন প্রিন্স বোয়েটাং, যিনি এফএ কাপের ফাইনালে পোর্টসমাউথের পক্ষে খেলে চেলসির জার্মান মহাতারকা মাইকেল বালাককে খোঁড়া করে দিয়ে বিশ্বকাপ থেকেই আউট করে দেন। জার্মানি যদি এবার দ্বিতীয় রাউন্ড পার হতে না পারে, তাহলে খলনায়ক হিসেবে বিবেচিত হবেন এ বোয়েটাংই, কেননা তিনি ঘানার বংশোদ্ভূত হলেও জার্মানির নাগরিক।
বোয়েটাংয়ের গোলটি খুব সুন্দর। মাঠের বাঁ প্রান্ত দিয়ে প্রতিপক্ষের দুজন খেলোয়াড়কে অবজ্ঞা করে একটা নিচু শট, যেটি অবলীলায় জালে ঢুকে গেল। এরপর ঘানা ল্যানডন ডনোভানের পেনাল্টি খেয়ে ফেললে খেলা অতিরিক্ত সময়ে গড়ায়, কিন্তু এর প্রথম তিন মিনিটের মধ্যেই প্রতিযোগিতার একটি শ্রেষ্ঠ গোল করেন ঘানার আসোমোয়া জিয়ান। বুক দিয়ে ঠেকিয়ে বলটি মাটি ছোঁয়ার আগেই বাঁ পায়ে তাকে উড়িয়ে দিলেন জার্মানির জালে। ইংরেজ ভাষ্যকার সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘আ ক্লাসিক স্ট্রাইকারস গোল’।
প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়া মার্কিনদের কান্নার পর্ব শুরু হয়। দেখা গেল, ক্লিনটন নিজেই ডাগ-আউটে চলে গেছেন খেলোয়াড়দের সান্ত্বনা দিতে।
আজকের খেলা (২৭ জুন) আর্জেন্টিনা বনাম মেক্সিকো এবং জার্মানি বনাম ইংল্যান্ড। আর্জেন্টিনাকে নিয়ে চিন্তা নেই। মেক্সিকোর বিরুদ্ধে জেতা উচিত তাদের। নকআউটের খাঁড়া অবশ্য যেকোনো দলের ওপরই নেমে আসতে পারে। সব চিন্তা জার্মানি আর ইংল্যান্ডের ম্যাচ নিয়ে। ইংল্যান্ডের কোচ ইতালিয়ান ফ্যাবিও ক্যাপেলো ধরেই নিয়েছেন, ম্যাচ অমীমাংসিত থেকে পেনাল্টি শ্যুট-আউটে গড়াবে। তাই তিনি পাঁচজন টেকারও (স্ট্রাইকার) ঠিক করে ফেলেছেন। কারণ বিশ্বকাপে গত দুই দশকের পেনাল্টি শ্যুট-আউটে ইংল্যান্ডের ইতিহাস খুব খারাপ। তারা আগে জার্মানি, ইতালি ও পর্তুগালের কাছে শ্যুট-আউটে হেরেছে।
পেনাল্টি ঠেকিয়ে খুবই নাম করেছিলেন আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক সের্জিও গোয়েকোচিয়া। তিনি ১৯৯০-এর ইতালি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে দু-দুটি পেনাল্টি রক্ষা করে স্বাগতিক দেশকে আউট করে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, পেনাল্টি শ্যুট-আউটকে অনেকে যে ভাগ্য, লটারি বা রাশিয়ান রুলেটের (পিস্তল নিজের মাথায় ঠেকিয়ে গুলি করার মতো বিপজ্জনক জুয়া খেলা) সঙ্গে তুলনা করেন, সে মতের সঙ্গে তিনি একমত নন। এটি আসলে ইচ্ছাশক্তির যুদ্ধ, গোলরক্ষক এবং টেকারের মধ্যে। জার্মানির বিশ্বখ্যাত সাবেক গোলরক্ষক অলিভার কানও অনেকটা একই রকম কথা বলেছেন। ২০০১ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে ভ্যালেন্সিয়ার পেনাল্টি ঠেকিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে বলেছেন কান: তখন আমি দর্শক দেখিনি, সহ-খেলোয়াড়দের দেখিনি, দেখিনি প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দেরও, আমি শুধু নিবিষ্টচিত্তে টেকারদের মনোভাব বুঝতে চাইছিলাম। তাদের বুঝতে দিচ্ছিলাম যে মানসিক শক্তিতে আমিই এগিয়ে।’
কালকে (২৬ জুন) প্রথমে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলো দক্ষিণ কোরিয়া আর উরুগুয়ের মধ্যে। মনের একটা অংশ কোরিয়াকে সমর্থন দিচ্ছিল আর আরেকটি অংশ হেগেলীয় কায়দায় উরুগুয়ের পক্ষ নিচ্ছিল। দক্ষিণ কোরিয়া আমার মহাদেশ এশিয়ার একটি দল, কিন্তু উরুগুয়ে যে ম্যারাডোনার আগে আমার প্রিয় খেলোয়াড় ফ্রান্সিস কোলির দেশ! কী করি? ফোরলান আর সুয়ারেজের চোখজুড়ানো শৈল্পিক ফুটবল উপভোগ করব, নাকি গতিশীল অ্যাক্রোবেটিক স্বমহাদেশীয় দল কোরিয়াকে সমর্থন দেব। মার্ক অ্যান্টনি যেমন রোম ও ক্লিওপেট্রার মধ্যে ক্লিওপেট্রাকে বেছে নিয়েছিলেন, আমিও তেমনই নান্দনিক দল উরুগুয়েকে বেছে নিলাম। কোরিয়া গোল দিয়ে দ্বিতীয়ার্ধে সমতায় পৌঁঁছালে আমার সত্যি সত্যি খারাপ লাগা শুরু হলো। যা হোক, সুয়ারেজ যখন দ্বিতীয় গোলটিও করে ফেললেন এবং খেলা ওই ২-১ ফলাফলে শেষ হলো, তখন আবার মাঠজুড়ে উরুগুয়ের খেলোয়াড়দের বিজয়োল্লাসের পাশাপাশি কোরীয়দের কান্না দেখে নিজেরও কান্না পেতে শুরু করল। ভাবলাম, ওরাও তো ভালো খেলেছে। বাদ পড়ার মতো দল তো ওরা নয়! আবার সেই হেগেলীয় দোটানায় ভুগতে ভুগতে একসময় মনে হলো, দ্বিতীয় রাউন্ড যেন নকআউট পর্ব নয়, একটা ফায়ারিং স্কোয়াড। দুটি ভালো দলের একটিকে বিদায় নিতেই হবে।
পরের খেলায় ঘানা পড়ল যুক্তরাষ্ট্রের সামনে। এখন অবশ্য মন আগের মতো দুই ভাগ হলো না, ঘানা একমাত্র আফ্রিকান দেশ যারা এখনো টিকে আছে। স্বভাবতই মন তাদেরই টানল। কিন্তু প্যাভিলিয়নে যে লাল রঙের জ্যাকেট পরে বসে আছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন! আমি যে কী কারণে ক্লিনটনের ভক্ত, সেটি পাঠককে জানানোর দরকার নেই, কিন্তু তাঁর উপস্থিতির কারণে মনটা আবার হেগেলীয় কায়দায় খানিকটা বিচলিত হয়ে উঠল। কিন্তু ঘানার গোলই প্রথমে এল। করলেন কেভিন প্রিন্স বোয়েটাং, যিনি এফএ কাপের ফাইনালে পোর্টসমাউথের পক্ষে খেলে চেলসির জার্মান মহাতারকা মাইকেল বালাককে খোঁড়া করে দিয়ে বিশ্বকাপ থেকেই আউট করে দেন। জার্মানি যদি এবার দ্বিতীয় রাউন্ড পার হতে না পারে, তাহলে খলনায়ক হিসেবে বিবেচিত হবেন এ বোয়েটাংই, কেননা তিনি ঘানার বংশোদ্ভূত হলেও জার্মানির নাগরিক।
বোয়েটাংয়ের গোলটি খুব সুন্দর। মাঠের বাঁ প্রান্ত দিয়ে প্রতিপক্ষের দুজন খেলোয়াড়কে অবজ্ঞা করে একটা নিচু শট, যেটি অবলীলায় জালে ঢুকে গেল। এরপর ঘানা ল্যানডন ডনোভানের পেনাল্টি খেয়ে ফেললে খেলা অতিরিক্ত সময়ে গড়ায়, কিন্তু এর প্রথম তিন মিনিটের মধ্যেই প্রতিযোগিতার একটি শ্রেষ্ঠ গোল করেন ঘানার আসোমোয়া জিয়ান। বুক দিয়ে ঠেকিয়ে বলটি মাটি ছোঁয়ার আগেই বাঁ পায়ে তাকে উড়িয়ে দিলেন জার্মানির জালে। ইংরেজ ভাষ্যকার সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘আ ক্লাসিক স্ট্রাইকারস গোল’।
প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়া মার্কিনদের কান্নার পর্ব শুরু হয়। দেখা গেল, ক্লিনটন নিজেই ডাগ-আউটে চলে গেছেন খেলোয়াড়দের সান্ত্বনা দিতে।
আজকের খেলা (২৭ জুন) আর্জেন্টিনা বনাম মেক্সিকো এবং জার্মানি বনাম ইংল্যান্ড। আর্জেন্টিনাকে নিয়ে চিন্তা নেই। মেক্সিকোর বিরুদ্ধে জেতা উচিত তাদের। নকআউটের খাঁড়া অবশ্য যেকোনো দলের ওপরই নেমে আসতে পারে। সব চিন্তা জার্মানি আর ইংল্যান্ডের ম্যাচ নিয়ে। ইংল্যান্ডের কোচ ইতালিয়ান ফ্যাবিও ক্যাপেলো ধরেই নিয়েছেন, ম্যাচ অমীমাংসিত থেকে পেনাল্টি শ্যুট-আউটে গড়াবে। তাই তিনি পাঁচজন টেকারও (স্ট্রাইকার) ঠিক করে ফেলেছেন। কারণ বিশ্বকাপে গত দুই দশকের পেনাল্টি শ্যুট-আউটে ইংল্যান্ডের ইতিহাস খুব খারাপ। তারা আগে জার্মানি, ইতালি ও পর্তুগালের কাছে শ্যুট-আউটে হেরেছে।
পেনাল্টি ঠেকিয়ে খুবই নাম করেছিলেন আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক সের্জিও গোয়েকোচিয়া। তিনি ১৯৯০-এর ইতালি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে দু-দুটি পেনাল্টি রক্ষা করে স্বাগতিক দেশকে আউট করে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, পেনাল্টি শ্যুট-আউটকে অনেকে যে ভাগ্য, লটারি বা রাশিয়ান রুলেটের (পিস্তল নিজের মাথায় ঠেকিয়ে গুলি করার মতো বিপজ্জনক জুয়া খেলা) সঙ্গে তুলনা করেন, সে মতের সঙ্গে তিনি একমত নন। এটি আসলে ইচ্ছাশক্তির যুদ্ধ, গোলরক্ষক এবং টেকারের মধ্যে। জার্মানির বিশ্বখ্যাত সাবেক গোলরক্ষক অলিভার কানও অনেকটা একই রকম কথা বলেছেন। ২০০১ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে ভ্যালেন্সিয়ার পেনাল্টি ঠেকিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে বলেছেন কান: তখন আমি দর্শক দেখিনি, সহ-খেলোয়াড়দের দেখিনি, দেখিনি প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দেরও, আমি শুধু নিবিষ্টচিত্তে টেকারদের মনোভাব বুঝতে চাইছিলাম। তাদের বুঝতে দিচ্ছিলাম যে মানসিক শক্তিতে আমিই এগিয়ে।’
No comments