২০২০ সালে দেশের গ্যাস মজুদ নিঃশেষ হবে না by বদরূল ইমাম
বাংলাদেশের বর্তমান গ্যাস মজুদ ২০২০ সাল নাগাদ শেষ হবে না। আর কোনো নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত না হলেও বর্তমান গ্যাসক্ষেত্রগুলোর হিসাবকৃত প্রমাণিত ও সম্ভাব্য মজুদ (২পি রিজার্ভ) ২০২০ সালের মধ্যে ফুরিয়ে যাবে না। এমনকি ২০২৫ সালেও দেশ গ্যাসশূন্য হবে না। ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশের বড় গ্যাসক্ষেত্রগুলো—যেমন তিতাস, হবিগঞ্জ, বিবিয়ানা, কৈলাসটিলা—তাদের উৎপাদন অন্তত মধ্যম মাত্রায় বজায় রাখতে পারবে। তবে অনেক ছোট গ্যাসক্ষেত্র নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং এ সময় নাগাদ দেশে গ্যাসের বিরাট ঘাটতি দেখা দেবে। প্রকৃতপক্ষে দেশে গ্যাসের চাহিদার সমপরিমাণ গ্যাস সরবরাহ ২০২০ সালের অনেক আগে থেকেই সম্ভব হবে না। পেট্রোবাংলার হিসাবমতে, ২০২০ সালে দেশের গ্যাসের চাহিদা হবে প্রতিদিন আনুমানিক ৩৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু সে সময় দেশে গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহের মাত্রা দৈনিক আনুমানিক ২০০০ মিলিয়ন ঘনফুট হবে বলে মনে করা হয়। ফলে গ্যাস ঘাটতি দেখা দিতে পারে দৈনিক আনুমানিক ১৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট। ২০২০ সালের পর থেকে গ্যাসের উৎপাদনমাত্রা ক্রমাগত দ্রুত কমতে থাকবে এবং ২০২৫ সাল নাগাদ বর্তমানের অধিকাংশ গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদনে ধস নামবে এবং দেশ গ্যাসশূন্য হওয়ার পথে এগিয়ে যাবে।
বাংলাদেশে গ্যাসের এই ভবিষ্যৎ চিত্র অঙ্কনে দেশের বর্তমান জানা মজুদকে বিবেচনায় আনা হয়েছে মাত্র। ওপরের এ ভবিষ্যদ্বাণী পেট্রোবাংলা ও তার দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত পরামর্শকদের বিশ্লেষণলব্ধ প্রতিবেদনগুলোর ওপর নির্ভর করে টানা হয়েছে। এ ধরনের ভবিষ্যৎ জ্বালানি চাহিদা-সরবরাহবিষয়ক বিশ্লেষণ, অনেকসংখ্যক অনিশ্চিত উপাদানের ওপর ভর করে সম্পাদন করতে হয় বিধায় তা সব ক্ষেত্রে সঠিক নাও হতে পারে। তবু এ ধরনের বিশ্লেষণ মোটামুটিভাবে ভবিষ্যৎ অবস্থার একটি বাস্তব ধারণা দিতে সক্ষম হয় বটে। দেশে ভবিষ্যতে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হলে এবং তা থেকে গ্যাস সরবরাহ শুরু হলে উপরিউক্ত চিত্রে পরিবর্তন আসবে, যা কিনা গ্যাসনির্ভর বাংলাদেশের ভয়াবহ সংকটকে লাঘব করতে সহায়ক হবে।
দেশে গ্যাসের চাহিদা কীভাবে বাড়বে এবং তা মেটাতে গ্যাস সরবরাহের অবস্থা কী হবে তা ভবিষ্যৎ গ্যাস-কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণের অন্যতম প্রধান বিষয়। বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা প্রতিদিন প্রায় ২৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর বিপরীতে প্রকৃত উৎপাদন প্রতিদিন প্রায় ১৯৮০ মিলিয়ন ঘনফুট। অর্থাৎ বর্তমানে গ্যাস ঘাটতির পরিমাণ প্রতিদিন প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। আগামী বছরগুলোতে গ্যাসের চাহিদা প্রতিবছর ১০ শতাংশ হারে বাড়বে মনে করা হয়। পেট্রোবাংলার সূত্রমতে, ২০১৫ সালে গ্যাসের চাহিদা হবে প্রতিদিন আনুমাণিক ২৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট, ২০২০ সালে ৩৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট এবং ২০২৫ সালে এ চাহিদা গিয়ে দাঁড়াবে প্রতিদিন প্রায় ৫৬০০ মিলিয়ন ঘনফুটে। আশঙ্কার কথা হলো, এ রকম ক্রমবর্ধমান চাহিদার বিপরীতে গ্যাস উৎপাদন চাহিদা অনুযায়ী বাড়তে থাকবে না। ফলে যদি নতুন মজুদ আবিষ্কার ও উৎপাদনে না আসে, তবে বর্তমানের দৈনিক ঘাটতি ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়ে গিয়ে ২০২০ সালে আনুমানিক ১৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট এবং ২০২৫ সালে আনুমানিক ৫০০০ মিলিয়ন ঘনফুট হতে পারে।
বাংলাদেশে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হচ্ছে না কেন? দেশের ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ইঙ্গিত দেয়, দেশের ভূখণ্ডে ও সমুদ্রবক্ষে আরও নতুন গ্যাস পাওয়ার ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু তা খুঁজে বের করার জন্য যে অনুসন্ধান কার্যক্রম প্রয়োজন, বাংলাদেশে তার অভাব তীব্র। ভারত, পাকিস্তান বা মিয়ানমারের অনুসন্ধান কার্যক্রমের তুলনায় এ দেশের অনুসন্ধান কার্যক্রম অনেক কম তো বটেই, বরং বিশ্ব অনুসন্ধান ধারার যেকোনো মানদণ্ডে বাংলাদেশের অনুসন্ধান-কার্যক্রম নেহাতই অল্প। প্রতি ১০ বছরে বাংলাদেশে কটি করে অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয় তার হিসাবটি নিলে বিষয়টি বোঝা যাবে। হিসাবটি এ রকম: ১৯৫০—১৯৫৯ সালে ১২টি, ১৯৬০—১৯৬৯ সালে নয়টি, ১৯৭০—১৯৭৯ সালে ১২টি, ১৯৮০—১৯৮৯ সালে ১২টি, ১৯৯০—১৯৯৯ সালে ১৬টি এবং ২০০০—২০০৯ সালে সাতটি।
অর্থাৎ প্রতি ১০ বছরে খননকৃত অনুসন্ধান-কূপের সংখ্যা গড়ে ১১টি, অর্থাৎ প্রতিবছর গড়ে মাত্র একটি। এ হিসাবটি যেকোনো দায়িত্বশীল গ্যাস অনুসন্ধানী ব্যক্তির জন্য হাস্যকর মনে হতে পারে। বিশেষভাবে লক্ষণীয়, ২০০০—২০০৯ সালে যখন পৃথিবীর অধিকাংশ তেল-গ্যাসের সম্ভাবনাময় এলাকায় অনুসন্ধানের তীব্রতা আগের তুলনায় বেশি, তখন বাংলাদেশে বছরে মোটে একটি থেকেও কম।
বাংলাদেশের ভূখণ্ডে আর কী পরিমাণ গ্যাস পাওয়ার আশা করা যায়? এ বিষয়ে তথ্যবিভ্রাট ঘটানোর জন্য দায়ী রপ্তানি করতে ইচ্ছুক কিছু বিদেশি গ্যাস কোম্পানি ও তাদের স্বার্থ রক্ষাকারী মার্কিন সরকারের দপ্তর। ২০০০ সালে মার্কিন সরকারের ইউএসজিএ বিভাগ বাংলাদেশে ৩০ বছরে ৩২ টিসিএফ গ্যাস পাওয়ার যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল, তা আর এখন কেউ বিশ্বাস করে না। সম্প্রতি সম্পাদিত সার্ক রিজিওনাল এনার্জি ট্রেড স্টাডি ফোরামে বাংলাদেশ কান্ট্রি রিপোর্ট পর্বে যথার্থ মন্তব্য করা হয়, বাংলাদেশ ভূখণ্ডে নতুন গ্যাস আবিষ্কারের সম্ভাবনা রয়েছে, কিন্তু নতুন বড় আকারের গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের সম্ভাবনা খুব কম। তাহলে সাগরবক্ষের অবস্থা কী রকম? বঙ্গোপসাগরে কর্মরত বিদেশি কোম্পানির কর্মকর্তারা তাঁদের অভিজ্ঞতার আলোকে মনে করছেন, বাংলাদেশের অগভীর সমুদ্রে গ্যাসের সম্ভাবনা ভালো, তবে এসব গ্যাসের মজুদ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছোট আকারের হবে। বাকি থাকে গভীর সমুদ্রবক্ষ। বাংলাদেশ অনেক দেরি করে হলেও তার গভীর সমুদ্রবক্ষে অনুসন্ধান কাজ শুরু করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু এ অঞ্চল কেবলই অজ্ঞাত। সুতরাং এর সম্ভাবনা সম্পর্কে সঠিক মন্তব্য করা সম্ভবত কারও পক্ষে সম্ভব নয়।
নতুন গ্যাস আবিষ্কার যেমন গ্যাস-সংকটের ভবিষ্যৎ ভয়াবহতা লাঘব করতে সহায়ক হবে, গ্যাস বিনষ্ট করা বা গ্যাস ব্যবস্থাপনায় দায়িত্বহীনতা তেমনি বাংলাদেশের গ্যাস-সংকটের ভয়াবহতাকে তীব্রতর করবে। দুটি উদাহরণ উল্লেখযোগ্য—
ছাতক (পশ্চিম) গ্যাসক্ষেত্রটি স্বচ্ছ ও সরল প্রকৃতির গ্যাস-ভরপুর ক্ষেত্র, যা খনন ও উৎপাদন করে দেশের বর্তমান গ্যাস-সংকটকে অনেকটা সামাল দেওয়া যেত। একইভাবে তার সংলগ্ন ছাতক (পূর্ব) অপর একটি বৃহত্তর গ্যাসক্ষেত্র, যা উন্নয়ন করলে এই গ্যাস-সংকটের সময় আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিত। আর এ ছিল দেশীয় গ্যাস কোম্পানির জন্য একটি রুটিন কাজ, যার জন্য দরকার ছিল কেবল একটি সরকারি আদেশ। কিন্তু সরকারি প্রশাসন যন্ত্র যখন চৌর্যবৃত্তি লালন করে, দুর্নীতিগ্রস্ত্র মন্ত্রিত্ব যখন ব্যক্তিস্বার্থে দেশের ও জনগণের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে কুণ্ঠা বোধ করে না, তখনই বুঝি এমনটি হয়। ভিনদেশি অযোগ্য নাইকো কোম্পানির দুষ্কর্মের জন্য ছাতক এখন মৃত। যে দেশ গ্যাসের জন্য হাহাকার করে, সেখানে গ্যাসের একটি বড় মজুদ—পুরো একটি গ্যাসক্ষেত্র—কেবল দুষ্টচক্রের কারসাজির কারণে বিনষ্ট হয়ে গেল—এর ব্যাখ্যা কী হতে পারে?
দ্বিতীয় উদাহরণটি তিতাস গ্যাসক্ষেত্র নিয়ে। তিতাস কেবল বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র নয়, বরং এই উপমহাদেশের অন্যতম বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্রগুলোর একটি। কিছুদিন আগ পর্যন্তও তিতাস দেশের সর্বোচ্চ গ্যাস উৎপাদক ছিল। বিগত ছয় বছর তিতাস গ্যাসক্ষেত্রের বিপুল পরিমাণ গ্যাস মাটি ফুঁড়ে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বের হয়ে অনবরত বিনষ্ট হয়ে চলেছে। এ নিয়ে সংবাদমাধ্যম যথেষ্ট প্রচার করলে পেট্রোবাংলা একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করে গ্যাস বের হওয়ার কারণ ও তার প্রতিকারের উপায় নির্ধারণ করতে নির্দেশ দেয়। অথচ তারপর আজ প্রায় দুই বছর সময় গেলেও তিতাস গ্যাস বিনষ্ট হওয়া থামাতে পেট্রোবাংলা কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। তিতাস থেকে প্রতিদিন যে বিপুল পরিমাণ গ্যাস বিনষ্ট হয়ে চলেছে, তার পরিমাণ কত, কর্তৃপক্ষের কাছে তার কোনো হিসাব নেই। কেবল গ্যাস বিনষ্টই নয়, কূপের ভেতর যে সমস্যার কারণে এটি ঘটছে তা গ্যাসক্ষেত্রটির অন্তত একটি অংশকে বিপজ্জনক অবস্থায় নিয়ে গেছে, যার কারণে যেকোনো সময় গ্যাসক্ষেত্রে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। দেশের গ্যাস-সংকটের এই চরম দুর্দিনে তিতাস গ্যাসের এই ক্ষয় কেবল চেয়ে চেয়ে দেখা কর্তৃপক্ষের চরম দায়িত্বহীনতার সাক্ষ্য বহন করে।
বাংলাদেশে গ্যাস-সম্পদের ভবিষ্যৎ, তা ২০২০ সাল হোক বা ২০২৫ সাল, কিংবা আরও দূরবর্তী কোনো সময়, নির্ভর করবে ভূগর্ভ থেকে কতটা গ্যাস আবিষ্কার ও উত্তোলন করে সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করা যায় তার ওপর। আর এর জন্য গ্যাস কার্যক্রমে দক্ষ, একনিষ্ঠ ও সৎ ব্যবস্থাপনা অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করবে।
বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, রেজাইনা বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশে গ্যাসের এই ভবিষ্যৎ চিত্র অঙ্কনে দেশের বর্তমান জানা মজুদকে বিবেচনায় আনা হয়েছে মাত্র। ওপরের এ ভবিষ্যদ্বাণী পেট্রোবাংলা ও তার দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত পরামর্শকদের বিশ্লেষণলব্ধ প্রতিবেদনগুলোর ওপর নির্ভর করে টানা হয়েছে। এ ধরনের ভবিষ্যৎ জ্বালানি চাহিদা-সরবরাহবিষয়ক বিশ্লেষণ, অনেকসংখ্যক অনিশ্চিত উপাদানের ওপর ভর করে সম্পাদন করতে হয় বিধায় তা সব ক্ষেত্রে সঠিক নাও হতে পারে। তবু এ ধরনের বিশ্লেষণ মোটামুটিভাবে ভবিষ্যৎ অবস্থার একটি বাস্তব ধারণা দিতে সক্ষম হয় বটে। দেশে ভবিষ্যতে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হলে এবং তা থেকে গ্যাস সরবরাহ শুরু হলে উপরিউক্ত চিত্রে পরিবর্তন আসবে, যা কিনা গ্যাসনির্ভর বাংলাদেশের ভয়াবহ সংকটকে লাঘব করতে সহায়ক হবে।
দেশে গ্যাসের চাহিদা কীভাবে বাড়বে এবং তা মেটাতে গ্যাস সরবরাহের অবস্থা কী হবে তা ভবিষ্যৎ গ্যাস-কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণের অন্যতম প্রধান বিষয়। বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা প্রতিদিন প্রায় ২৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর বিপরীতে প্রকৃত উৎপাদন প্রতিদিন প্রায় ১৯৮০ মিলিয়ন ঘনফুট। অর্থাৎ বর্তমানে গ্যাস ঘাটতির পরিমাণ প্রতিদিন প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। আগামী বছরগুলোতে গ্যাসের চাহিদা প্রতিবছর ১০ শতাংশ হারে বাড়বে মনে করা হয়। পেট্রোবাংলার সূত্রমতে, ২০১৫ সালে গ্যাসের চাহিদা হবে প্রতিদিন আনুমাণিক ২৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট, ২০২০ সালে ৩৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট এবং ২০২৫ সালে এ চাহিদা গিয়ে দাঁড়াবে প্রতিদিন প্রায় ৫৬০০ মিলিয়ন ঘনফুটে। আশঙ্কার কথা হলো, এ রকম ক্রমবর্ধমান চাহিদার বিপরীতে গ্যাস উৎপাদন চাহিদা অনুযায়ী বাড়তে থাকবে না। ফলে যদি নতুন মজুদ আবিষ্কার ও উৎপাদনে না আসে, তবে বর্তমানের দৈনিক ঘাটতি ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়ে গিয়ে ২০২০ সালে আনুমানিক ১৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট এবং ২০২৫ সালে আনুমানিক ৫০০০ মিলিয়ন ঘনফুট হতে পারে।
বাংলাদেশে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হচ্ছে না কেন? দেশের ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ইঙ্গিত দেয়, দেশের ভূখণ্ডে ও সমুদ্রবক্ষে আরও নতুন গ্যাস পাওয়ার ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু তা খুঁজে বের করার জন্য যে অনুসন্ধান কার্যক্রম প্রয়োজন, বাংলাদেশে তার অভাব তীব্র। ভারত, পাকিস্তান বা মিয়ানমারের অনুসন্ধান কার্যক্রমের তুলনায় এ দেশের অনুসন্ধান কার্যক্রম অনেক কম তো বটেই, বরং বিশ্ব অনুসন্ধান ধারার যেকোনো মানদণ্ডে বাংলাদেশের অনুসন্ধান-কার্যক্রম নেহাতই অল্প। প্রতি ১০ বছরে বাংলাদেশে কটি করে অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয় তার হিসাবটি নিলে বিষয়টি বোঝা যাবে। হিসাবটি এ রকম: ১৯৫০—১৯৫৯ সালে ১২টি, ১৯৬০—১৯৬৯ সালে নয়টি, ১৯৭০—১৯৭৯ সালে ১২টি, ১৯৮০—১৯৮৯ সালে ১২টি, ১৯৯০—১৯৯৯ সালে ১৬টি এবং ২০০০—২০০৯ সালে সাতটি।
অর্থাৎ প্রতি ১০ বছরে খননকৃত অনুসন্ধান-কূপের সংখ্যা গড়ে ১১টি, অর্থাৎ প্রতিবছর গড়ে মাত্র একটি। এ হিসাবটি যেকোনো দায়িত্বশীল গ্যাস অনুসন্ধানী ব্যক্তির জন্য হাস্যকর মনে হতে পারে। বিশেষভাবে লক্ষণীয়, ২০০০—২০০৯ সালে যখন পৃথিবীর অধিকাংশ তেল-গ্যাসের সম্ভাবনাময় এলাকায় অনুসন্ধানের তীব্রতা আগের তুলনায় বেশি, তখন বাংলাদেশে বছরে মোটে একটি থেকেও কম।
বাংলাদেশের ভূখণ্ডে আর কী পরিমাণ গ্যাস পাওয়ার আশা করা যায়? এ বিষয়ে তথ্যবিভ্রাট ঘটানোর জন্য দায়ী রপ্তানি করতে ইচ্ছুক কিছু বিদেশি গ্যাস কোম্পানি ও তাদের স্বার্থ রক্ষাকারী মার্কিন সরকারের দপ্তর। ২০০০ সালে মার্কিন সরকারের ইউএসজিএ বিভাগ বাংলাদেশে ৩০ বছরে ৩২ টিসিএফ গ্যাস পাওয়ার যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল, তা আর এখন কেউ বিশ্বাস করে না। সম্প্রতি সম্পাদিত সার্ক রিজিওনাল এনার্জি ট্রেড স্টাডি ফোরামে বাংলাদেশ কান্ট্রি রিপোর্ট পর্বে যথার্থ মন্তব্য করা হয়, বাংলাদেশ ভূখণ্ডে নতুন গ্যাস আবিষ্কারের সম্ভাবনা রয়েছে, কিন্তু নতুন বড় আকারের গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের সম্ভাবনা খুব কম। তাহলে সাগরবক্ষের অবস্থা কী রকম? বঙ্গোপসাগরে কর্মরত বিদেশি কোম্পানির কর্মকর্তারা তাঁদের অভিজ্ঞতার আলোকে মনে করছেন, বাংলাদেশের অগভীর সমুদ্রে গ্যাসের সম্ভাবনা ভালো, তবে এসব গ্যাসের মজুদ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছোট আকারের হবে। বাকি থাকে গভীর সমুদ্রবক্ষ। বাংলাদেশ অনেক দেরি করে হলেও তার গভীর সমুদ্রবক্ষে অনুসন্ধান কাজ শুরু করার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু এ অঞ্চল কেবলই অজ্ঞাত। সুতরাং এর সম্ভাবনা সম্পর্কে সঠিক মন্তব্য করা সম্ভবত কারও পক্ষে সম্ভব নয়।
নতুন গ্যাস আবিষ্কার যেমন গ্যাস-সংকটের ভবিষ্যৎ ভয়াবহতা লাঘব করতে সহায়ক হবে, গ্যাস বিনষ্ট করা বা গ্যাস ব্যবস্থাপনায় দায়িত্বহীনতা তেমনি বাংলাদেশের গ্যাস-সংকটের ভয়াবহতাকে তীব্রতর করবে। দুটি উদাহরণ উল্লেখযোগ্য—
ছাতক (পশ্চিম) গ্যাসক্ষেত্রটি স্বচ্ছ ও সরল প্রকৃতির গ্যাস-ভরপুর ক্ষেত্র, যা খনন ও উৎপাদন করে দেশের বর্তমান গ্যাস-সংকটকে অনেকটা সামাল দেওয়া যেত। একইভাবে তার সংলগ্ন ছাতক (পূর্ব) অপর একটি বৃহত্তর গ্যাসক্ষেত্র, যা উন্নয়ন করলে এই গ্যাস-সংকটের সময় আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিত। আর এ ছিল দেশীয় গ্যাস কোম্পানির জন্য একটি রুটিন কাজ, যার জন্য দরকার ছিল কেবল একটি সরকারি আদেশ। কিন্তু সরকারি প্রশাসন যন্ত্র যখন চৌর্যবৃত্তি লালন করে, দুর্নীতিগ্রস্ত্র মন্ত্রিত্ব যখন ব্যক্তিস্বার্থে দেশের ও জনগণের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে কুণ্ঠা বোধ করে না, তখনই বুঝি এমনটি হয়। ভিনদেশি অযোগ্য নাইকো কোম্পানির দুষ্কর্মের জন্য ছাতক এখন মৃত। যে দেশ গ্যাসের জন্য হাহাকার করে, সেখানে গ্যাসের একটি বড় মজুদ—পুরো একটি গ্যাসক্ষেত্র—কেবল দুষ্টচক্রের কারসাজির কারণে বিনষ্ট হয়ে গেল—এর ব্যাখ্যা কী হতে পারে?
দ্বিতীয় উদাহরণটি তিতাস গ্যাসক্ষেত্র নিয়ে। তিতাস কেবল বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র নয়, বরং এই উপমহাদেশের অন্যতম বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্রগুলোর একটি। কিছুদিন আগ পর্যন্তও তিতাস দেশের সর্বোচ্চ গ্যাস উৎপাদক ছিল। বিগত ছয় বছর তিতাস গ্যাসক্ষেত্রের বিপুল পরিমাণ গ্যাস মাটি ফুঁড়ে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বের হয়ে অনবরত বিনষ্ট হয়ে চলেছে। এ নিয়ে সংবাদমাধ্যম যথেষ্ট প্রচার করলে পেট্রোবাংলা একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করে গ্যাস বের হওয়ার কারণ ও তার প্রতিকারের উপায় নির্ধারণ করতে নির্দেশ দেয়। অথচ তারপর আজ প্রায় দুই বছর সময় গেলেও তিতাস গ্যাস বিনষ্ট হওয়া থামাতে পেট্রোবাংলা কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। তিতাস থেকে প্রতিদিন যে বিপুল পরিমাণ গ্যাস বিনষ্ট হয়ে চলেছে, তার পরিমাণ কত, কর্তৃপক্ষের কাছে তার কোনো হিসাব নেই। কেবল গ্যাস বিনষ্টই নয়, কূপের ভেতর যে সমস্যার কারণে এটি ঘটছে তা গ্যাসক্ষেত্রটির অন্তত একটি অংশকে বিপজ্জনক অবস্থায় নিয়ে গেছে, যার কারণে যেকোনো সময় গ্যাসক্ষেত্রে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। দেশের গ্যাস-সংকটের এই চরম দুর্দিনে তিতাস গ্যাসের এই ক্ষয় কেবল চেয়ে চেয়ে দেখা কর্তৃপক্ষের চরম দায়িত্বহীনতার সাক্ষ্য বহন করে।
বাংলাদেশে গ্যাস-সম্পদের ভবিষ্যৎ, তা ২০২০ সাল হোক বা ২০২৫ সাল, কিংবা আরও দূরবর্তী কোনো সময়, নির্ভর করবে ভূগর্ভ থেকে কতটা গ্যাস আবিষ্কার ও উত্তোলন করে সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করা যায় তার ওপর। আর এর জন্য গ্যাস কার্যক্রমে দক্ষ, একনিষ্ঠ ও সৎ ব্যবস্থাপনা অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করবে।
বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, রেজাইনা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments