তাল তাল হরতাল by ফারুক ওয়াসিফ
বিরোধী দলের বড় জনসভা মানেই বড় হরতালের ঘোষণা। দুটো যেন এক প্যাকেজের জিনিস, একটি হলেই অপরটি অবধারিত প্রায়। প্রায় দেড় বছর ঢাক-ঢাক গুড়গুড় করার পর ১৯ মের জনসভায় হঠাৎ সরকার পতনের হরতালের ডাক তাই যেন ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি’। বিএনপি তবুও ‘সহনশীল’, ১৬ মাস বিরোধী দলে থাকার বিড়ম্বনা সওয়ার পর হরতাল দিল। আওয়ামী লীগ তো বিএনপি ক্ষমতাসীন হওয়ার তিন মাসের মাথায়ই হরতালের অস্ত্র প্রয়োগ করে বসেছিল। হরতাল যেন এই দুই দলের পারস্পরিক উপহার। একজন ক্ষমতায় গেলে অন্যজনকে সান্ত্বনা বাবদ হরতালের অস্ত্রে সজ্জিত করে দেন। অপরজন তখন বিনা বিবেচনায় একেই মওকা মনে করে হরতাল-অস্ত্র প্রয়োগ করে নিজেই ধরাশায়ী হন। ধরাশায়ী বললাম এ কারণে যে গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ বা বিএনপির কোনো হরতাল জনপ্রিয় হয়েছে, কিংবা কোনো জরিপে তার পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন দেখা গেছে, তার প্রমাণ নেই। বরং উল্টো প্রমাণই বেশি। তবুও হরতাল দেওয়া হয় এবং দিনশেষে ‘তাল তাল হরতাল, সফল হলো হরতাল’ বলে স্লোগান দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে একটি গল্প চলে আসে। গল্পটি এ রকম:
উলুখাগড়া নামক এক দেশ কোথাও ছিল। সে দেশে ছিলেন এক হঠাৎ নবাব। হঠাৎ নবাবের ইচ্ছাগুলোও যে হঠাৎ হঠাৎই হবে, তাতে আর বিস্ময় কী! একদিন নবাব মশায়ের এক বন্ধুর দেওয়া উপহারটি পরিধানের ইচ্ছা হলো। উলুখাগড়ার বন্ধুও যে-সে নন। তিনি বেনোবনের মহারাজা। মহারাজার দেওয়া উপহারসামগ্রীটি হাতে নিয়ে নবাব মুসিবতেই পড়লেন। এক জোড়া জরির জিনিস; সেটা কোথায় কীভাবে পরা যাবে, তা কেউ বলে দেয়নি। তাঁর রাজ্যে তিনিই সবচেয়ে বড় অভিজাত। লজ্জায় কাউকে জিজ্ঞেসও করতে পারেন না। যদি রটে যায়, নবাব দামি জিনিসের ব্যবহার জানেন না! এই ভয়ে তিনি নিজেই বুদ্ধির দৌড়ে নামলেন। বহু সাধ্য-সাধনা আর কসরতের পর নবাব ঠিক করলেন, উপহারটি তাঁর মুকুটের সঙ্গে দারুণ মানায়। অতএব, সেটাই ফাইনাল। তিনি বেনোবনের রাজার দেওয়া জরির উপহার জোড়ার একপাটি মুকুটে আটকে দরবারে দেখা দিলেন। সভাসদেরা সবাই যারপরনাই প্রশংসাই করল, জিন্দাবাদ উঠল। নবাবের দরবারে সেদিন বাবার সঙ্গে আসা এক বালকও ছিল। মুকুটের সঙ্গে বাঁধা জরির জিনিসটি দেখে তার বইয়ের ছবিতে দেখা কোনো এক সম্রাটের পায়ের জুতোর কথা মনে পড়ল। অনেক সময় বালকদের মুখে লাগাম থাকে না, এরও ছিল না। সে অকস্মাৎ মুখ ফসকে বলে ফেলে, ‘নবাব, নাগড়াই জুতা পায়ে না দিয়ে মাথায় পরেছেন কেন?’
জুতা মাথায় করে বওয়া যেমন হাস্যকর, জনসমর্থনহীন হরতালকে আশ্রয় করা রাজনৈতিক দলের জন্য তেমনই আহাম্মকি।
১৯ মের জনসভায় নতুন নির্বাচন দাবি করেছেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। কেন করেছেন? কারণ তাঁর ভাষায়, ‘এ সরকার অবৈধ’। সরকার অবৈধ হয় নির্বাচন অবৈধ হলে অথবা সংবিধান লঙ্ঘন করলে কিংবা বেশির ভাগ সাংসদদের সমর্থন হারালে। গত জাতীয় নির্বাচন অবৈধ হওয়ার অভিযোগ অর্থপূর্ণভাবে বিএনপি কখনো করেনি। সরকার যদি সংবিধানের গুরুতর লঙ্ঘন করেই থাকে, তাহলে সেটা সাব্যস্ত হওয়ার জায়গা সুপ্রিম কোর্ট, পল্টন ময়দান নয়। যত দূর জানা, বিএনপি বা আর কেউ এই অভিযোগ নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়নি। আওয়ামী লীগের সুশাসন বা দুঃশাসন যা-ই চলুক, তা কিন্তু দলীয় সাংসদদের পূর্ণ সমর্থনের জোরেই চলছে। অতএব, সংসদ ভেঙে দেওয়ার কোনো বাস্তব কারণও রাষ্ট্রপতির সামনে উত্থাপিত হয়নি। সংসদ যদি একেবারে ব্যর্থই হবে, তাহলে সংসদ সদস্য হিসেবে বেতন-ভাতা সুবিধাদি নিতে তাঁরা অসুবিধা বোধ করেননি কেন? প্রশ্নটা যতটাই রাজনৈতিক ততটাই নৈতিক।
বিএনপির পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ সরকারকে ‘অকার্যকর’ ও ‘ব্যর্থ’ বলারও কোনো বিরতি নেই। এটা ঠিক যে চাল-ডাল-তেলসহ দ্রব্যমূল্য কমানোর যে প্রতিশ্রুতি শেখ হাসিনা দিয়েছিলেন, তা পূরণ হয়নি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যা এ আমলে প্রকট। দলীয়করণ-সন্ত্রাস-ক্রসফায়ার ইত্যাদি তো বন্ধ হয়ইনি, বরং আরও বেড়েছে। সমস্যাসংকুল বাংলাদেশে যেকোনো সমস্যা নিয়েই আন্দোলন করে জনপ্রিয়তা অর্জন করা কঠিন নয়। সে রকম তেজস্ক্রিয় ইস্যুর অভাব বাংলাদেশে কখনো হয়নি। এ আমলেও তার ঘাটতি হওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু গত ১৬ মাসে এসব ইস্যুতে বিএনপি কি ধারাবাহিকভাবে অর্থপূর্ণ কোনো আন্দোলন করেছে? মৌখিক প্রতিবাদ ছাড়া বিদ্যুৎ-জ্বালানি-দ্রব্যমূল্য-সন্ত্রাস নিয়ে দলটি কি ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে জনগণের কাছে গিয়েছে? হাজির করেছে সমাধানের কোনো প্রস্তাব? হাওয়ার ওপর তাওয়া গরম করা যায় না।
বিদ্যুৎ-জ্বালানি প্রশ্নে আওয়ামী লীগ তা-ই করছে, যা বিএনপি তথা চারদলীয় জোট করে এসেছে। কেউই স্থায়ী সমাধানের দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ নেয়নি। এখনো নেওয়া হচ্ছে না। সন্ত্রাস-দখলদারির আজাব চারদলীয় জোট সরকারের আমলের থেকে এমন কী কম? বিএনপি দ্বিতীয় বৃহত্তম দল। যেকোনো বিষয়ে সত্যিকার কোনো গঠনমূলক আন্দোলন করা তাদের জন্য অসম্ভব ছিল না। বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নের জন্য ভুক্তভোগী ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সমাধানের বাস্তব সুপারিশ তৈরি করতে পারত। পারত, তার পক্ষে জনসমর্থন আদায়ে প্রচার চালাতে। গ্যাসক্ষেত্রে বিপুল অনিয়ম ও লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে। সেটা নিয়েও কোনো জাতীয় তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি তোলা যেত। সন্ত্রাস ও যৌন নিপীড়ন প্রশ্নে স্থানে স্থানে নাগরিক ও অভিভাবকদের নিয়ে নাগরিক কমিটি করে প্রতিরোধের বৃত্ত রচনা করতে পারত। প্রতিবছরের মতো এ বছরও কৃষক ফসলের ন্যায্য দাম পায়নি। প্রধান বিরোধী দল এসব দাবিদাওয়ার বেলায় আন্তরিক হলে জনগণের মধ্যে আলোড়ন আসত, আর সরকারের পক্ষে সত্যিকার সমালোচনা ও গঠনমূলক প্রস্তাবকে তুবড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হতো না। তাতে দলেরও লাভ ছিল, লাভ হতো মানুষেরও। কিন্তু তারা তা করল না, তারা গেল সরাসরি সরকার পতনের হরতালীয় পথে। এ থেকেই বোঝা যায়, তাদের আগ্রহ যত না জনজীবনে শান্তি ও নাগরিক সেবার অধিকার প্রতিষ্ঠা করার দিকে, তার থেকে বেশি ক্ষমতার মসনদের দিকে। কবি রণজিৎ দাশের কবিতায় আছে, ‘যে দিকে দু’চোখ যায় চলে যাব/ সম্ভবত গড়িয়াহাটার দিকে।’ উভয় দলই কেবল ক্ষমতার গড়িয়াহাটা চিনেছে, জনগণের গণতন্ত্র ও মঙ্গল চেনেনি।
গত ১৬ মাসের মধ্যে বিএনপির প্রধান সক্রিয়তা ছিল টিপাইমুখে ভারতের বাঁধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে জনমত গঠন করা। শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময় সেটাই ছিল বিএনপির প্রধান সমালোচনার তীর। অথচ দিল্লিতে টিপাইমুখ ইস্যু আনুষ্ঠানিক এজেন্ডায় ছিল না। বরং ভারতের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে নিরাপত্তা, ট্রানজিট, বন্দর ও বাণিজ্যের মতো বিষয়ে। এসব চুক্তির অনেক শর্ত বাংলাদেশের স্বার্থের বিপক্ষে বলে অনেকের অভিমত। তাহলে এমন জাজ্বল্যমান জাতীয় স্বার্থ নিয়ে ঝোপ না পিটিয়ে তারা কেন সংসদে কথা তুলল না? চুক্তির বিভিন্ন দিক নিয়ে সংসদে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের চাপ তৈরি করলো না কেন? শেখ হাসিনা ভালো চুক্তি করেছেন না মন্দ চুক্তি করেছেন, সেটা তো তখন প্রমাণ হতো। এমন মোক্ষম সুযোগ বিএনপি ছাড়ল কেন? কেন সম্ভাব্য টিপাইমুখ বাঁধের আড়ালে অন্য সব সত্যিকার ইস্যুকে ঢেকে দিল? এটাই কি দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী দলের উচিত কাজ?
এসব কারণেই প্রশ্ন ওঠে, পল্টন ময়দানে বিএনপির এই হঠাৎ জাগরণের আসল মাজেজা কী? আমরা তাদের কোন কথাটাকে সত্য ধরব? সরকারের ব্যর্থতার জন্যই তারা নতুন নির্বাচন চায়, নাকি বিরোধী দল হিসেবে নিজেদের দায়িত্বহীনতা ঢাকার কৌশলই হলো এই নতুন ডামাডোল?
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘চিনিলাম আপনারে/ আঘাতে আঘাতে/ বেদনায় বেদনায়।’ ক্ষমতাসীন দল ঠিক করেছে সন্ত্রাস, দুর্নীতি আর অনিয়মের আঘাতে আঘাতে তারা তাদের স্বরূপ চেনাবে। আর বিরোধী দলের ইচ্ছা, তাল তাল হরতালের কঠিন পথে দেশকে ঠেলে দিয়ে জনমনে বেদনার অক্ষয় ছাপ ফেলবে। তাদের জয় হোক।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
উলুখাগড়া নামক এক দেশ কোথাও ছিল। সে দেশে ছিলেন এক হঠাৎ নবাব। হঠাৎ নবাবের ইচ্ছাগুলোও যে হঠাৎ হঠাৎই হবে, তাতে আর বিস্ময় কী! একদিন নবাব মশায়ের এক বন্ধুর দেওয়া উপহারটি পরিধানের ইচ্ছা হলো। উলুখাগড়ার বন্ধুও যে-সে নন। তিনি বেনোবনের মহারাজা। মহারাজার দেওয়া উপহারসামগ্রীটি হাতে নিয়ে নবাব মুসিবতেই পড়লেন। এক জোড়া জরির জিনিস; সেটা কোথায় কীভাবে পরা যাবে, তা কেউ বলে দেয়নি। তাঁর রাজ্যে তিনিই সবচেয়ে বড় অভিজাত। লজ্জায় কাউকে জিজ্ঞেসও করতে পারেন না। যদি রটে যায়, নবাব দামি জিনিসের ব্যবহার জানেন না! এই ভয়ে তিনি নিজেই বুদ্ধির দৌড়ে নামলেন। বহু সাধ্য-সাধনা আর কসরতের পর নবাব ঠিক করলেন, উপহারটি তাঁর মুকুটের সঙ্গে দারুণ মানায়। অতএব, সেটাই ফাইনাল। তিনি বেনোবনের রাজার দেওয়া জরির উপহার জোড়ার একপাটি মুকুটে আটকে দরবারে দেখা দিলেন। সভাসদেরা সবাই যারপরনাই প্রশংসাই করল, জিন্দাবাদ উঠল। নবাবের দরবারে সেদিন বাবার সঙ্গে আসা এক বালকও ছিল। মুকুটের সঙ্গে বাঁধা জরির জিনিসটি দেখে তার বইয়ের ছবিতে দেখা কোনো এক সম্রাটের পায়ের জুতোর কথা মনে পড়ল। অনেক সময় বালকদের মুখে লাগাম থাকে না, এরও ছিল না। সে অকস্মাৎ মুখ ফসকে বলে ফেলে, ‘নবাব, নাগড়াই জুতা পায়ে না দিয়ে মাথায় পরেছেন কেন?’
জুতা মাথায় করে বওয়া যেমন হাস্যকর, জনসমর্থনহীন হরতালকে আশ্রয় করা রাজনৈতিক দলের জন্য তেমনই আহাম্মকি।
১৯ মের জনসভায় নতুন নির্বাচন দাবি করেছেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। কেন করেছেন? কারণ তাঁর ভাষায়, ‘এ সরকার অবৈধ’। সরকার অবৈধ হয় নির্বাচন অবৈধ হলে অথবা সংবিধান লঙ্ঘন করলে কিংবা বেশির ভাগ সাংসদদের সমর্থন হারালে। গত জাতীয় নির্বাচন অবৈধ হওয়ার অভিযোগ অর্থপূর্ণভাবে বিএনপি কখনো করেনি। সরকার যদি সংবিধানের গুরুতর লঙ্ঘন করেই থাকে, তাহলে সেটা সাব্যস্ত হওয়ার জায়গা সুপ্রিম কোর্ট, পল্টন ময়দান নয়। যত দূর জানা, বিএনপি বা আর কেউ এই অভিযোগ নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়নি। আওয়ামী লীগের সুশাসন বা দুঃশাসন যা-ই চলুক, তা কিন্তু দলীয় সাংসদদের পূর্ণ সমর্থনের জোরেই চলছে। অতএব, সংসদ ভেঙে দেওয়ার কোনো বাস্তব কারণও রাষ্ট্রপতির সামনে উত্থাপিত হয়নি। সংসদ যদি একেবারে ব্যর্থই হবে, তাহলে সংসদ সদস্য হিসেবে বেতন-ভাতা সুবিধাদি নিতে তাঁরা অসুবিধা বোধ করেননি কেন? প্রশ্নটা যতটাই রাজনৈতিক ততটাই নৈতিক।
বিএনপির পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ সরকারকে ‘অকার্যকর’ ও ‘ব্যর্থ’ বলারও কোনো বিরতি নেই। এটা ঠিক যে চাল-ডাল-তেলসহ দ্রব্যমূল্য কমানোর যে প্রতিশ্রুতি শেখ হাসিনা দিয়েছিলেন, তা পূরণ হয়নি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যা এ আমলে প্রকট। দলীয়করণ-সন্ত্রাস-ক্রসফায়ার ইত্যাদি তো বন্ধ হয়ইনি, বরং আরও বেড়েছে। সমস্যাসংকুল বাংলাদেশে যেকোনো সমস্যা নিয়েই আন্দোলন করে জনপ্রিয়তা অর্জন করা কঠিন নয়। সে রকম তেজস্ক্রিয় ইস্যুর অভাব বাংলাদেশে কখনো হয়নি। এ আমলেও তার ঘাটতি হওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু গত ১৬ মাসে এসব ইস্যুতে বিএনপি কি ধারাবাহিকভাবে অর্থপূর্ণ কোনো আন্দোলন করেছে? মৌখিক প্রতিবাদ ছাড়া বিদ্যুৎ-জ্বালানি-দ্রব্যমূল্য-সন্ত্রাস নিয়ে দলটি কি ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে জনগণের কাছে গিয়েছে? হাজির করেছে সমাধানের কোনো প্রস্তাব? হাওয়ার ওপর তাওয়া গরম করা যায় না।
বিদ্যুৎ-জ্বালানি প্রশ্নে আওয়ামী লীগ তা-ই করছে, যা বিএনপি তথা চারদলীয় জোট করে এসেছে। কেউই স্থায়ী সমাধানের দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ নেয়নি। এখনো নেওয়া হচ্ছে না। সন্ত্রাস-দখলদারির আজাব চারদলীয় জোট সরকারের আমলের থেকে এমন কী কম? বিএনপি দ্বিতীয় বৃহত্তম দল। যেকোনো বিষয়ে সত্যিকার কোনো গঠনমূলক আন্দোলন করা তাদের জন্য অসম্ভব ছিল না। বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নের জন্য ভুক্তভোগী ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সমাধানের বাস্তব সুপারিশ তৈরি করতে পারত। পারত, তার পক্ষে জনসমর্থন আদায়ে প্রচার চালাতে। গ্যাসক্ষেত্রে বিপুল অনিয়ম ও লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে। সেটা নিয়েও কোনো জাতীয় তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি তোলা যেত। সন্ত্রাস ও যৌন নিপীড়ন প্রশ্নে স্থানে স্থানে নাগরিক ও অভিভাবকদের নিয়ে নাগরিক কমিটি করে প্রতিরোধের বৃত্ত রচনা করতে পারত। প্রতিবছরের মতো এ বছরও কৃষক ফসলের ন্যায্য দাম পায়নি। প্রধান বিরোধী দল এসব দাবিদাওয়ার বেলায় আন্তরিক হলে জনগণের মধ্যে আলোড়ন আসত, আর সরকারের পক্ষে সত্যিকার সমালোচনা ও গঠনমূলক প্রস্তাবকে তুবড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হতো না। তাতে দলেরও লাভ ছিল, লাভ হতো মানুষেরও। কিন্তু তারা তা করল না, তারা গেল সরাসরি সরকার পতনের হরতালীয় পথে। এ থেকেই বোঝা যায়, তাদের আগ্রহ যত না জনজীবনে শান্তি ও নাগরিক সেবার অধিকার প্রতিষ্ঠা করার দিকে, তার থেকে বেশি ক্ষমতার মসনদের দিকে। কবি রণজিৎ দাশের কবিতায় আছে, ‘যে দিকে দু’চোখ যায় চলে যাব/ সম্ভবত গড়িয়াহাটার দিকে।’ উভয় দলই কেবল ক্ষমতার গড়িয়াহাটা চিনেছে, জনগণের গণতন্ত্র ও মঙ্গল চেনেনি।
গত ১৬ মাসের মধ্যে বিএনপির প্রধান সক্রিয়তা ছিল টিপাইমুখে ভারতের বাঁধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে জনমত গঠন করা। শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময় সেটাই ছিল বিএনপির প্রধান সমালোচনার তীর। অথচ দিল্লিতে টিপাইমুখ ইস্যু আনুষ্ঠানিক এজেন্ডায় ছিল না। বরং ভারতের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে নিরাপত্তা, ট্রানজিট, বন্দর ও বাণিজ্যের মতো বিষয়ে। এসব চুক্তির অনেক শর্ত বাংলাদেশের স্বার্থের বিপক্ষে বলে অনেকের অভিমত। তাহলে এমন জাজ্বল্যমান জাতীয় স্বার্থ নিয়ে ঝোপ না পিটিয়ে তারা কেন সংসদে কথা তুলল না? চুক্তির বিভিন্ন দিক নিয়ে সংসদে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের চাপ তৈরি করলো না কেন? শেখ হাসিনা ভালো চুক্তি করেছেন না মন্দ চুক্তি করেছেন, সেটা তো তখন প্রমাণ হতো। এমন মোক্ষম সুযোগ বিএনপি ছাড়ল কেন? কেন সম্ভাব্য টিপাইমুখ বাঁধের আড়ালে অন্য সব সত্যিকার ইস্যুকে ঢেকে দিল? এটাই কি দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী দলের উচিত কাজ?
এসব কারণেই প্রশ্ন ওঠে, পল্টন ময়দানে বিএনপির এই হঠাৎ জাগরণের আসল মাজেজা কী? আমরা তাদের কোন কথাটাকে সত্য ধরব? সরকারের ব্যর্থতার জন্যই তারা নতুন নির্বাচন চায়, নাকি বিরোধী দল হিসেবে নিজেদের দায়িত্বহীনতা ঢাকার কৌশলই হলো এই নতুন ডামাডোল?
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘চিনিলাম আপনারে/ আঘাতে আঘাতে/ বেদনায় বেদনায়।’ ক্ষমতাসীন দল ঠিক করেছে সন্ত্রাস, দুর্নীতি আর অনিয়মের আঘাতে আঘাতে তারা তাদের স্বরূপ চেনাবে। আর বিরোধী দলের ইচ্ছা, তাল তাল হরতালের কঠিন পথে দেশকে ঠেলে দিয়ে জনমনে বেদনার অক্ষয় ছাপ ফেলবে। তাদের জয় হোক।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com
No comments