এই মার্চ ওরা কীভাবে পালন করছে by আনিসুল হক
সম্প্রতি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার পলান সরকারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। নারায়ণগঞ্জ সুধীজন পাঠাগার এই বইপ্রেমী মানুষটাকে সংবর্ধনা ও পদক দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ করে এনেছিল। সেখানেই, এই মার্চ মাসেই দেখা পলান সরকারের সঙ্গে। বর্তমানে তাঁর বয়স নাকি ৯০ বছর। পলান সরকার তাঁর এলাকার মানুষদের হেঁটে হেঁটে বই বিতরণ করেন। হাঁটেন বলেই তাঁর শরীরটা ভালো আছে। রাজশাহী থেকে ঢাকা হয়ে নারায়ণগঞ্জ এসেছেন, দিব্যি কথাবার্তা-চলাফেরায় বলিষ্ঠতা আছে।
একজন ৯০ বছরের মানুষ দিব্যি চলতে-ফিরতে পারছেন, দেখে ভালো লাগে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যদি বেঁচে থাকতেন, তাঁর বয়সও ৯০ বছর হতো। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্ম হয়েছিল। এ বছর ১৭ মার্চ ছিল সরকারি ছুটির দিন। ১৭ মার্চের পত্রপত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর ছবিসহ তাঁর জন্মদিনের খবর ছিল। ১৮ মার্চের পত্রিকায় ছিল তাঁর জন্মদিন পালনের খবর।
কিন্তু জন্মদিনের খবরের পাশেই ছিল ছাত্রলীগের আরও কিছু খবর। ১৭ মার্চের সংবাদপত্রের শিরোনাম: ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের দুই পক্ষে সংঘর্ষ। আহত ১০। ১০ জন আটক। ওই দিনের সব কাগজে ছিল আরেকটা খবর: এবার প্রথম হয়ে কাঁদালেন বকর। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে গত ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলে আহত হয়েছিলেন আবু বকর। ৩ ফেব্রুয়ারি তিনি মারা যান। তিনি কোনো দল করতেন না। নিম্নবিত্ত ঘরের এই ছেলের সাধনা ছিল লেখাপড়া। জীবনটা ছিল ঘামঝরা পরিশ্রমের। তিনি মারা গেছেন। এবার বেরিয়েছে তাঁর পরীক্ষার ফল। আবু বকর প্রথম স্থান অধিকার করেছেন। ১৮ মার্চ তারিখের সংবাদপত্র আকীর্ণ ছিল ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সংঘর্ষ আর ৫৮ জন কর্মী গ্রেপ্তারের খবরে। প্রথম আলো আরেকটা খবরে ওই দিন লিখেছে: প্রান্ত থেকে কেন্দ্র একই অবস্থায় ছাত্রলীগ। ‘ইডেন কলেজে ভর্তি-বাণিজ্য, যশোর জেলা সম্মেলনে গুলি-বোমা, হবিগঞ্জে পাল্টাপাল্টি কমিটি গঠন, ঢাকা কলেজে সংঘর্ষ—সব মিলিয়ে আবারও উল্টো পথে ছাত্রলীগ।’ যশোরে ছাত্রলীগের নেতা হত্যা সম্পর্কিত খবরের বলা হয়েছে, ‘জড়িত পাঁচ ভাড়াটে খুনি, আ.লীগের দুই পক্ষ একে অপরকে দুষছে।’ ১২ মার্চের প্রথম আলোর খবর, চট্টগ্রাম মেডিকেল, দালালদের দৌরাত্ম্যের পেছনে ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি। সারা দেশে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন এলাকায় ছাত্রলীগ নামধারীরা যা করছে, এই কটা খবর তার সামান্য নিদর্শন মাত্র। এবং এই যে ছাত্রলীগের কোন্দল, দ্বন্দ্ব, সংঘাত, তার পেছনে আছে চাঁদাবাজি, ভর্তি-বাণিজ্য অর্থাৎ টাকার খেলা। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টো, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে এই দুষ্কর্মগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই, বরং আছে দুস্তর ব্যবধান।
মার্চ মাস বঙ্গবন্ধুর জন্মমাস। মার্চ মাস বাংলাদেশেরও জন্মমাস। স্বাধীনতার মাস মার্চে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি বলে গণ্য ছাত্রলীগাররা, আওয়ামী লীগাররা যদি পত্রপত্রিকার পাতাকে দুঃসংবাদে কণ্টকিত-রক্তাক্ত করে রাখে, সেই দুঃখ কোথায় রাখি?
এসব খবর পড়ে মনটা ভীষণ দমে যায়। বেশ কিছুদিন আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজের একজন ছাত্রলীগের নেতা নিহত হয়েছিলেন সংগঠনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে, তার পেছনে ছিল মেডিকেল হাসপাতাল চত্বরে চাঁদাবাজির লাখ লাখ টাকার নিয়ন্ত্রণের লড়াই। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় খবরের কাগজের শিরোনাম হয়ে এসেছে, ক্যান্টিনের ইজারাদারের কাছে চাঁদা দাবি করায় ক্যান্টিন বন্ধ। কারা দাবি করেছে? ছাত্রলীগের নেতারা। আমি নিজে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। সেও যে খুব বেশি দিন আগে, তা নয়। আমাদের সময় এটা তো আমাদের চিন্তারও অতীত ছিল যে কেউ ক্যান্টিনের ম্যানেজারের কাছে গিয়ে চাঁদা দাবি করবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্ররা, তারা কেন এই রকম অবৈধ আয়ের পেছনে ছুটবে। রাজনীতি আমাদের কালে আমরা করতাম আদর্শের জন্য, একটা সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলার বড় স্বপ্ন আমাদের ছাত্রকর্মী ও নেতাদের চোখমুখে টগবগ করত, একে মেরে ওকে ধরে দুটো টাকা পকেটে পোরার কথা তখন ছিল অকল্পনীয়।
এরা এতটা বিপথগামীই বা কেন হলো? আর এরা এতটা আশ্রয়-প্রশ্রয়ই বা পাচ্ছে কোথা থেকে? আমি বিশ্বাস করি না, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চান যে সারা দেশে ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের কর্মীরা সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি, গুণ্ডামিতে জড়িয়ে পড়ুক। পত্রিকান্তরে পড়লাম, আওয়ামী লীগের নেতা ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ছাত্রলীগের এই দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পেছনে আছে বড় আওয়ামী লীগের নেতা ও কোনো কোনো মন্ত্রীর ইন্ধন। হায় হায়, এটা কী শুনলাম! অবশ্য খুব যে বিস্ময়কর খবর এটা, তা নয়। অতীতে এসব কাণ্ড এই দেশে বহু ঘটেছে। সেই রেওয়াজই চলছে আসলে। দিনবদল খুব সহজ কাজ নয়। এসব চাঁদাবাজি থেকে হাতবদল হয় লাখ লাখ টাকা, আর তার বখরা নাকি বহুদূর পর্যন্ত পৌঁছায়।
মার্চ মাসে এসব খবর পড়তে ভালো লাগে না। টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচারিত হচ্ছে। সাতই মার্চের ভাষণ যতবার প্রচারিত হয়, ততবারই থমকে দাঁড়াই। এতবার শোনা হলো, এত দিন পরও শরীর রোমাঞ্চিত হয়। কী এক মহান নেতাই না আমরা পেয়েছিলাম আমাদের ইতিহাসে! আজকে যারা হাঙ্গামা, চাঁদাবাজি, খুনোখুনি করে বেড়াচ্ছে, তাদের মুখে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণও কি বেমানান নয়?
বারবার মনে পড়ে বঙ্গবন্ধুর লেখা একটা চিঠির কথা। ১৯৫৮ সালের নভেম্বর মাসে শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা কারাগার থেকে এই চিঠিটা লিখেছিলেন তাঁর আব্বাকে। আইয়ুব খান পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করেছেন, সামরিক আইন জারি করা হয়েছে, দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতার নামে নানা ধরনের মামলা করা হচ্ছে। বেশির ভাগ নেতাই তখন কারাবন্দী। শেখ মুজিবুর রহমানের নামেও একটা দুর্নীতির মামলা করা হয়েছিল। চার্জশিট দেওয়া হয়েছিল। পরে আদালতের রায়ে শেখ মুজিব বেকসুর খালাস পান। ওই মামলা দেওয়ার পরে শেখ মুজিব তাঁর বাবাকে এই চিঠিটা লিখেছিলেন।
চিঠিটা বাজেয়াপ্ত হয়েছিল, তাই এখনো সরকারি আর্কাইভে রয়ে গেছে।
ঢাকা জেল, ১২-১১-৫৮
আব্বা,
আমার ভক্তিপূর্ণ ছালাম গ্রহণ করবেন ও মাকে দিবেন। মা এবার খুব কষ্ট পেয়েছিলেন, কারণ এবার তাঁর সামনেই আমাকে গ্রেপ্তার করেছিল। দোয়া করবেন মিথ্যা মামলায় আমার কিছুই করতে পারবে না। আমাকে ডাকাতি মামলার আসামিও একবার করেছিল। আল্লাহ আছে, সত্যের জয় হবেই। আপনি জানেন, বাসায় কিছুই নাই। দয়া করে ছেলেমেয়েদের দিকে খেয়াল রাখবেন। বাড়ি যেতে বলে দিতাম। কিন্তু ওদের লেখাপড়া নষ্ট হয়ে যাবে। আমাকে আবার রাজবন্দী করেছে, দরকার ছিল না। কারণ রাজনীতি আর নাই এবং আর রাজনীতি করব না। সরকার অনুমতি দিলেও করব না। যে দেশের মানুষ বিশ্বাস করতে পারে যে আমি ঘুষ খেতে পারি, সে দেশে কাজই করা উচিত না। এ দেশে ত্যাগ ও সাধনার কোনো দামই নাই। যদি কোনো দিন জেল হতে বের হতে পারি, তবে কোনো কিছু একটা করে ছেলেমেয়ে ও আপনাদের নিয়ে ভালোভাবে সংসার করব। নিজেও কষ্ট করেছি, আপনাদেরও দিয়েছি। বাড়ির সকলকে আমার ছালাম দিবেন। দোয়া করতে বলবেন। আপনার ও মায়ের শরীরের প্রতি যত্ন নিবেন। চিন্তা করে মন খারাপ করবেন না। মাকে কাঁদতে নিষেধ করবেন। আমি ভালো আছি।
আপনার স্নেহের মুজিব
শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের ঝানু গোয়েন্দারা এর আগে অনেকবার কারাগারের ভেতরে চাপ দিয়েছেন, আর রাজনীতি করব না, এই মুচলেকায় সই করলে মুক্তি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়েছেন, কোনো দিনই তাঁকে নোয়াতে পারেননি। এই সরকারি গোয়েন্দারা তাঁদের প্রতিবেদনে বলেছেন, এই বন্দীর মনোবল খুব দৃঢ়, তাঁকে বশীভূত করা যায় না। সেই ইস্পাতদৃঢ় মানুষটা এই চিঠিতে কত অভিমানই না প্রকাশ করেছেন! কেন? হয়তো কারও কাছে শুনেছেন, কেউ বিশ্বাস করেছে যে শেখ মুজিব ঘুষ গ্রহণ করতে পারেন। যে দেশের মানুষ এ কথা বিশ্বাস করতে পারে, সেই দেশে তিনি রাজনীতি করতে চান না। কারণ তিনি সারাটা জীবন তো আত্মত্যাগ আর স্বার্থত্যাগই করেছেন।
সেই বঙ্গবন্ধুর নামে জয়ধ্বনি দিয়ে, সেই শেখ মুজিবের ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে চারদিকে এরা কী করছে? আর সেসব খবর পড়তে হচ্ছে ১৭ মার্চের সংবাদপত্রে? ১৮ মার্চের সংবাদপত্রে?
এর প্রতিবিধান কে করবে? শেখ হাসিনাকেই নির্দেশনা দিতে হবে। ছাত্রলীগকে অবশ্যই শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে। ছাত্রদের সামনে অবশ্যই নগদ চাঁদার লোভ নয়, মহত্তর মানবিক স্বপ্ন ও আদর্শ তুলে ধরতে হবে, তাদের ব্যাপৃত করতে হবে দেশগড়ার কোনো একটা কর্মযজ্ঞে। মন্ত্রী, এমপি, নেতা, যুবনেতা, ছাত্রনেতা, তাঁদের আত্মীয়-পরিজন-ক্যাডারদের সংযত করতে হবে, আইনকানুনের আওতায় রাখতে হবে। দলীয়করণ, দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ-বাণিজ্য-টেন্ডার প্রদান ইত্যাদি বন্ধ করতে হবে। এটা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ওয়াদাও বটে।
দেশে অনেক সমস্যা। গরম বাড়ছে, সঙ্গে বাড়ছে বিদ্যুৎ-সংকট, পানিসংকট। জনশক্তি রপ্তানির হার কমছে। দেশে বিনিয়োগ কম। বেকার সমস্যা প্রকট। তবু বলব, সরকার আওয়ামী লীগ খারাপ চালায় না। এবং আওয়ামী লীগের সরকারের নীতি ও পদক্ষেপের মধ্যে গ্রাম, কৃষক, গরিব মানুষ, খেটেখাওয়া মানুষের প্রতি পক্ষপাতও প্রকাশ পায়। এসবই ভালো। কিন্তু আওয়ামী লীগের সমস্যা তার আচরণে। দেশের মানুষ অতিষ্ঠ হয় এই আচরণের অতি-আচারে। সরকার পরিচালনার পাশাপাশি দল-কর্মী-নেতাদের আচরণে লাগাম টেনে ধরার কাজটাও একটা বড় কাজ। এবং খুবই জরুরি কাজ। এটা কেবল প্রশাসনিক বা পুলিশি পদক্ষেপ দিয়ে সম্ভব নয়, এটা করতে হবে একটা রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে। সরকারি দলের সেই রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই, সে ব্যাপারে কোনো উপলব্ধি নেই, কোনো গরজ নেই, এটাকে তারা প্রয়োজন বলে আদৌ মনেও করে কি না সন্দেহ। এ রকম চলতে থাকলে দল ও তার অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠনগুলোর কারণেই সরকার দ্রুত তার জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলবে। দল সরকারের জন্য সম্পদ না হয়ে হয়ে উঠবে বিপদ। মার্চ মাসের সংবাদপত্রের পাতাগুলো সেই বিপদের সংকেতই যেন ঘোষণা করছে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
একজন ৯০ বছরের মানুষ দিব্যি চলতে-ফিরতে পারছেন, দেখে ভালো লাগে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যদি বেঁচে থাকতেন, তাঁর বয়সও ৯০ বছর হতো। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্ম হয়েছিল। এ বছর ১৭ মার্চ ছিল সরকারি ছুটির দিন। ১৭ মার্চের পত্রপত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর ছবিসহ তাঁর জন্মদিনের খবর ছিল। ১৮ মার্চের পত্রিকায় ছিল তাঁর জন্মদিন পালনের খবর।
কিন্তু জন্মদিনের খবরের পাশেই ছিল ছাত্রলীগের আরও কিছু খবর। ১৭ মার্চের সংবাদপত্রের শিরোনাম: ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের দুই পক্ষে সংঘর্ষ। আহত ১০। ১০ জন আটক। ওই দিনের সব কাগজে ছিল আরেকটা খবর: এবার প্রথম হয়ে কাঁদালেন বকর। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে গত ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলে আহত হয়েছিলেন আবু বকর। ৩ ফেব্রুয়ারি তিনি মারা যান। তিনি কোনো দল করতেন না। নিম্নবিত্ত ঘরের এই ছেলের সাধনা ছিল লেখাপড়া। জীবনটা ছিল ঘামঝরা পরিশ্রমের। তিনি মারা গেছেন। এবার বেরিয়েছে তাঁর পরীক্ষার ফল। আবু বকর প্রথম স্থান অধিকার করেছেন। ১৮ মার্চ তারিখের সংবাদপত্র আকীর্ণ ছিল ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সংঘর্ষ আর ৫৮ জন কর্মী গ্রেপ্তারের খবরে। প্রথম আলো আরেকটা খবরে ওই দিন লিখেছে: প্রান্ত থেকে কেন্দ্র একই অবস্থায় ছাত্রলীগ। ‘ইডেন কলেজে ভর্তি-বাণিজ্য, যশোর জেলা সম্মেলনে গুলি-বোমা, হবিগঞ্জে পাল্টাপাল্টি কমিটি গঠন, ঢাকা কলেজে সংঘর্ষ—সব মিলিয়ে আবারও উল্টো পথে ছাত্রলীগ।’ যশোরে ছাত্রলীগের নেতা হত্যা সম্পর্কিত খবরের বলা হয়েছে, ‘জড়িত পাঁচ ভাড়াটে খুনি, আ.লীগের দুই পক্ষ একে অপরকে দুষছে।’ ১২ মার্চের প্রথম আলোর খবর, চট্টগ্রাম মেডিকেল, দালালদের দৌরাত্ম্যের পেছনে ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি। সারা দেশে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন এলাকায় ছাত্রলীগ নামধারীরা যা করছে, এই কটা খবর তার সামান্য নিদর্শন মাত্র। এবং এই যে ছাত্রলীগের কোন্দল, দ্বন্দ্ব, সংঘাত, তার পেছনে আছে চাঁদাবাজি, ভর্তি-বাণিজ্য অর্থাৎ টাকার খেলা। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টো, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে এই দুষ্কর্মগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই, বরং আছে দুস্তর ব্যবধান।
মার্চ মাস বঙ্গবন্ধুর জন্মমাস। মার্চ মাস বাংলাদেশেরও জন্মমাস। স্বাধীনতার মাস মার্চে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি বলে গণ্য ছাত্রলীগাররা, আওয়ামী লীগাররা যদি পত্রপত্রিকার পাতাকে দুঃসংবাদে কণ্টকিত-রক্তাক্ত করে রাখে, সেই দুঃখ কোথায় রাখি?
এসব খবর পড়ে মনটা ভীষণ দমে যায়। বেশ কিছুদিন আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজের একজন ছাত্রলীগের নেতা নিহত হয়েছিলেন সংগঠনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে, তার পেছনে ছিল মেডিকেল হাসপাতাল চত্বরে চাঁদাবাজির লাখ লাখ টাকার নিয়ন্ত্রণের লড়াই। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় খবরের কাগজের শিরোনাম হয়ে এসেছে, ক্যান্টিনের ইজারাদারের কাছে চাঁদা দাবি করায় ক্যান্টিন বন্ধ। কারা দাবি করেছে? ছাত্রলীগের নেতারা। আমি নিজে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। সেও যে খুব বেশি দিন আগে, তা নয়। আমাদের সময় এটা তো আমাদের চিন্তারও অতীত ছিল যে কেউ ক্যান্টিনের ম্যানেজারের কাছে গিয়ে চাঁদা দাবি করবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্ররা, তারা কেন এই রকম অবৈধ আয়ের পেছনে ছুটবে। রাজনীতি আমাদের কালে আমরা করতাম আদর্শের জন্য, একটা সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলার বড় স্বপ্ন আমাদের ছাত্রকর্মী ও নেতাদের চোখমুখে টগবগ করত, একে মেরে ওকে ধরে দুটো টাকা পকেটে পোরার কথা তখন ছিল অকল্পনীয়।
এরা এতটা বিপথগামীই বা কেন হলো? আর এরা এতটা আশ্রয়-প্রশ্রয়ই বা পাচ্ছে কোথা থেকে? আমি বিশ্বাস করি না, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চান যে সারা দেশে ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের কর্মীরা সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি, গুণ্ডামিতে জড়িয়ে পড়ুক। পত্রিকান্তরে পড়লাম, আওয়ামী লীগের নেতা ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ছাত্রলীগের এই দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পেছনে আছে বড় আওয়ামী লীগের নেতা ও কোনো কোনো মন্ত্রীর ইন্ধন। হায় হায়, এটা কী শুনলাম! অবশ্য খুব যে বিস্ময়কর খবর এটা, তা নয়। অতীতে এসব কাণ্ড এই দেশে বহু ঘটেছে। সেই রেওয়াজই চলছে আসলে। দিনবদল খুব সহজ কাজ নয়। এসব চাঁদাবাজি থেকে হাতবদল হয় লাখ লাখ টাকা, আর তার বখরা নাকি বহুদূর পর্যন্ত পৌঁছায়।
মার্চ মাসে এসব খবর পড়তে ভালো লাগে না। টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচারিত হচ্ছে। সাতই মার্চের ভাষণ যতবার প্রচারিত হয়, ততবারই থমকে দাঁড়াই। এতবার শোনা হলো, এত দিন পরও শরীর রোমাঞ্চিত হয়। কী এক মহান নেতাই না আমরা পেয়েছিলাম আমাদের ইতিহাসে! আজকে যারা হাঙ্গামা, চাঁদাবাজি, খুনোখুনি করে বেড়াচ্ছে, তাদের মুখে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণও কি বেমানান নয়?
বারবার মনে পড়ে বঙ্গবন্ধুর লেখা একটা চিঠির কথা। ১৯৫৮ সালের নভেম্বর মাসে শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা কারাগার থেকে এই চিঠিটা লিখেছিলেন তাঁর আব্বাকে। আইয়ুব খান পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করেছেন, সামরিক আইন জারি করা হয়েছে, দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতার নামে নানা ধরনের মামলা করা হচ্ছে। বেশির ভাগ নেতাই তখন কারাবন্দী। শেখ মুজিবুর রহমানের নামেও একটা দুর্নীতির মামলা করা হয়েছিল। চার্জশিট দেওয়া হয়েছিল। পরে আদালতের রায়ে শেখ মুজিব বেকসুর খালাস পান। ওই মামলা দেওয়ার পরে শেখ মুজিব তাঁর বাবাকে এই চিঠিটা লিখেছিলেন।
চিঠিটা বাজেয়াপ্ত হয়েছিল, তাই এখনো সরকারি আর্কাইভে রয়ে গেছে।
ঢাকা জেল, ১২-১১-৫৮
আব্বা,
আমার ভক্তিপূর্ণ ছালাম গ্রহণ করবেন ও মাকে দিবেন। মা এবার খুব কষ্ট পেয়েছিলেন, কারণ এবার তাঁর সামনেই আমাকে গ্রেপ্তার করেছিল। দোয়া করবেন মিথ্যা মামলায় আমার কিছুই করতে পারবে না। আমাকে ডাকাতি মামলার আসামিও একবার করেছিল। আল্লাহ আছে, সত্যের জয় হবেই। আপনি জানেন, বাসায় কিছুই নাই। দয়া করে ছেলেমেয়েদের দিকে খেয়াল রাখবেন। বাড়ি যেতে বলে দিতাম। কিন্তু ওদের লেখাপড়া নষ্ট হয়ে যাবে। আমাকে আবার রাজবন্দী করেছে, দরকার ছিল না। কারণ রাজনীতি আর নাই এবং আর রাজনীতি করব না। সরকার অনুমতি দিলেও করব না। যে দেশের মানুষ বিশ্বাস করতে পারে যে আমি ঘুষ খেতে পারি, সে দেশে কাজই করা উচিত না। এ দেশে ত্যাগ ও সাধনার কোনো দামই নাই। যদি কোনো দিন জেল হতে বের হতে পারি, তবে কোনো কিছু একটা করে ছেলেমেয়ে ও আপনাদের নিয়ে ভালোভাবে সংসার করব। নিজেও কষ্ট করেছি, আপনাদেরও দিয়েছি। বাড়ির সকলকে আমার ছালাম দিবেন। দোয়া করতে বলবেন। আপনার ও মায়ের শরীরের প্রতি যত্ন নিবেন। চিন্তা করে মন খারাপ করবেন না। মাকে কাঁদতে নিষেধ করবেন। আমি ভালো আছি।
আপনার স্নেহের মুজিব
শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের ঝানু গোয়েন্দারা এর আগে অনেকবার কারাগারের ভেতরে চাপ দিয়েছেন, আর রাজনীতি করব না, এই মুচলেকায় সই করলে মুক্তি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়েছেন, কোনো দিনই তাঁকে নোয়াতে পারেননি। এই সরকারি গোয়েন্দারা তাঁদের প্রতিবেদনে বলেছেন, এই বন্দীর মনোবল খুব দৃঢ়, তাঁকে বশীভূত করা যায় না। সেই ইস্পাতদৃঢ় মানুষটা এই চিঠিতে কত অভিমানই না প্রকাশ করেছেন! কেন? হয়তো কারও কাছে শুনেছেন, কেউ বিশ্বাস করেছে যে শেখ মুজিব ঘুষ গ্রহণ করতে পারেন। যে দেশের মানুষ এ কথা বিশ্বাস করতে পারে, সেই দেশে তিনি রাজনীতি করতে চান না। কারণ তিনি সারাটা জীবন তো আত্মত্যাগ আর স্বার্থত্যাগই করেছেন।
সেই বঙ্গবন্ধুর নামে জয়ধ্বনি দিয়ে, সেই শেখ মুজিবের ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে চারদিকে এরা কী করছে? আর সেসব খবর পড়তে হচ্ছে ১৭ মার্চের সংবাদপত্রে? ১৮ মার্চের সংবাদপত্রে?
এর প্রতিবিধান কে করবে? শেখ হাসিনাকেই নির্দেশনা দিতে হবে। ছাত্রলীগকে অবশ্যই শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে। ছাত্রদের সামনে অবশ্যই নগদ চাঁদার লোভ নয়, মহত্তর মানবিক স্বপ্ন ও আদর্শ তুলে ধরতে হবে, তাদের ব্যাপৃত করতে হবে দেশগড়ার কোনো একটা কর্মযজ্ঞে। মন্ত্রী, এমপি, নেতা, যুবনেতা, ছাত্রনেতা, তাঁদের আত্মীয়-পরিজন-ক্যাডারদের সংযত করতে হবে, আইনকানুনের আওতায় রাখতে হবে। দলীয়করণ, দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ-বাণিজ্য-টেন্ডার প্রদান ইত্যাদি বন্ধ করতে হবে। এটা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ওয়াদাও বটে।
দেশে অনেক সমস্যা। গরম বাড়ছে, সঙ্গে বাড়ছে বিদ্যুৎ-সংকট, পানিসংকট। জনশক্তি রপ্তানির হার কমছে। দেশে বিনিয়োগ কম। বেকার সমস্যা প্রকট। তবু বলব, সরকার আওয়ামী লীগ খারাপ চালায় না। এবং আওয়ামী লীগের সরকারের নীতি ও পদক্ষেপের মধ্যে গ্রাম, কৃষক, গরিব মানুষ, খেটেখাওয়া মানুষের প্রতি পক্ষপাতও প্রকাশ পায়। এসবই ভালো। কিন্তু আওয়ামী লীগের সমস্যা তার আচরণে। দেশের মানুষ অতিষ্ঠ হয় এই আচরণের অতি-আচারে। সরকার পরিচালনার পাশাপাশি দল-কর্মী-নেতাদের আচরণে লাগাম টেনে ধরার কাজটাও একটা বড় কাজ। এবং খুবই জরুরি কাজ। এটা কেবল প্রশাসনিক বা পুলিশি পদক্ষেপ দিয়ে সম্ভব নয়, এটা করতে হবে একটা রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে। সরকারি দলের সেই রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই, সে ব্যাপারে কোনো উপলব্ধি নেই, কোনো গরজ নেই, এটাকে তারা প্রয়োজন বলে আদৌ মনেও করে কি না সন্দেহ। এ রকম চলতে থাকলে দল ও তার অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠনগুলোর কারণেই সরকার দ্রুত তার জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলবে। দল সরকারের জন্য সম্পদ না হয়ে হয়ে উঠবে বিপদ। মার্চ মাসের সংবাদপত্রের পাতাগুলো সেই বিপদের সংকেতই যেন ঘোষণা করছে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments