কেউ হাজতে আর কেউ হাসপাতালে by সৈয়দ আবুল মকসুদ
তাত্ক্ষণিক বিষয়ে অপূর্ব কবিতা লেখায় আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন সারা পৃথিবীতে অদ্বিতীয়। উনিশ শ বিশের দশকে হিন্দু-মুসলমানে যখন মাথা ফাটাফাটি শুরু হয় এবং নেতারা আবার বন্ধুত্ব প্যাক্টও করেন, তখন তিনি লিখেছিলেন ‘প্যাক্ট’ নামে কমিক-গানটি। এখন কবি বেঁচে থাকলে লিখতেন:
বদনা-গাড়ুতে গলাগলি করে
নব-প্যাক্টের আস্নাই,
মুয়াজ্জিনের হাতে নাই ছুরি,
ইমামের হাতে বাঁশ নাই।
অবশ্য এখন লিখলে ভিন্ন শব্দ চয়ন করতে হতো। বাঁশ আসলে ইমামের হাতেই আছে। মুয়াজ্জিনের আছে শুধু হাত। তাই মাথাটা ফেটেছে তাঁরই। ঘটনার অকুস্থল বঙ্গভবনের স্টাফ কোয়ার্টার। বৃহস্পতিবারের জাতীয় দৈনিকগুলোর একটি খবরের শিরোনাম ছিল এ রকম: বঙ্গভবন মসজিদের মুয়াজ্জিনকে মারধর [প্রথম আলো], ইমাম হেল্ড ফলোইং স্কুফল উইথ মুয়াজ্জিন [ডেইলি স্টার], বঙ্গভবন স্টাফ কোয়ার্টার মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন মারামারি [কালের কণ্ঠ], ইমাম-মুয়াজ্জিন মারামারি দুই বউয়ে চুলাচুলি [বাংলাদেশ প্রতিদিন] প্রভৃতি।
পত্রপত্রিকা থেকে যা জানা গেছে, তা হলো: স্টাফ কোয়ার্টারের ইমাম ও মুয়াজ্জিনের বাসা পাশাপাশি। তাঁদের গোসলখানাও পাশাপাশি। বুধবার দুপুরের আগে ইমাম সাহেবের বেগম ঘরের সামনে কাপড় কাচছিলেন। তাঁর অভিযোগ, মুয়াজ্জিন তাঁর দিকে তাকাচ্ছিলেন। এর পরের ঘটনাগুলো ঘটেছে পর্যায়ক্রমে। প্রথমে ‘কটূক্তি’, তারপর ‘গালাগালি’, তারপর ‘হাতাহাতি’, দুজনের বিবির মধ্যে ‘চুলাচুলি’ এবং অবশেষে ‘লাঠির আঘাত’। ইমামের লাঠ্যাঘাতে মুয়াজ্জিনের মাথা চৌচির। তারপর রক্তস্রোত। লাঠির আঘাত থেকে মুয়াজ্জিনের স্ত্রীও রেহাই পাননি। সপত্নীক মুয়াজ্জিনের স্থান হয়েছে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে এবং ইমাম সাহেবের ঠাঁই হয়েছে হাজতে।
মারামারি যখন কোনো সমাজের মানুষের প্রচলিত রীতি হয়, তখন বিদ্যালয় থেকে উপাসনালয়, সচিবালয় থেকে যেকোনো আলয়ে হতে পারে এবং মারামারিতে নারী-পুরুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। ঢাকা কলেজের সঙ্গে ইডেন কলেজের পার্থক্য থাকবে কেন? বঙ্গভবনের স্টাফ কোয়ার্টারের ঘটনায় আহত হয়েছেন দুই জন, গ্রেপ্তার করা হয়েছে একজনকে, উদ্ধার করা হয়েছে বাঁশের লাঠি। একই দিন ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত হয়েছে ১০ জন, গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৫৮ জনকে, উদ্ধার করা হয়েছে ৫২টি কার্তুজ। ছাত্রাবাস থেকে আটক করা ছাত্রদের ছবি বেরিয়েছে পত্রিকায়। মুখ ঢেকে আছে ওরা লজ্জায়। ইমাম সাহেবের কোনো ছবি ছাপা হয়নি। সুতরাং লজ্জায় মুখ ঢাকার প্রশ্নই আসে না। আসলে লজ্জায় মুখ ঢাকতে ইচ্ছা হচ্ছে আমাদের।
গালাগালি, হাতাহাতি বা মাথা ফাটানো তো দূরের কথা, কোনো সাংবাদিক যদি কোনো ইমাম বা মুয়াজ্জিনের সম্পর্কে সামান্য বিরূপ মন্তব্য করতেন, পরের দিন স্টেডিয়ামগেট থেকে পল্টন মোড় পর্যন্ত মিছিল হতো। উত্তাল হতো রাজপথ। উঠত জেহাদি স্লোগান এবং ফাঁসির দাবি। নিজেরা নিজেরা গোসলখানার সামনে মাথা ফাটানোর ফলে কে কার বিরুদ্ধে মিছিল করবেন? যিনি হাসপাতালে আছেন, আমরা তাঁর দ্রুত আরোগ্য কামনা করি। যিনি হাজতে আছেন, তাঁরও দ্রুত মুক্তি দাবি করি।
তবে জীবন থেমে থাকে না। যাঁর মাথা ফেটেছে, কয়েকটি সেলাই দিয়ে পাগড়ির মতো ব্যান্ডেজ বেঁধে তিনি কোয়ার্টারে ফিরে আসবেন। আবার মিনারে উঠে তিনি আজানও দেবেন। নেলসন ম্যান্ডেলাও যখন কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। যিনি হাজতে আছেন তিনিও মুক্তি পাবেন। আবার ইমামতি করবেন। তাঁর পেছনেও মুসল্লিরা নামাজ আদায় করবেন। খুত্বা পাঠ করবেন। জামাতের সবাই তা মনোযোগ দিয়ে শুনবেন। যাঁর প্রমোশন অন্যায়ভাবে আটকে আছে, তিনি গভীর মনোযোগে শুনবেন। যে ঠিকাদারের কাজের বিল টেন পারসেন্ট দেওয়ার পরেও আটকে আছে, তিনিও অন্যমনস্কভাবে হলেও শুনবেন। তাঁদের হাসপাতালে ও হাজতে যাওয়ার কথা মানুষ ভুলে যাবে। এ সমাজে কেউ কাউকে প্রশ্ন করে না। চক্ষুলজ্জা বলে একটা কথা তো আছে।
কিছু কিছু পদ ও পোশাককে আমরা খুবই সম্মান করি ও মর্যাদা দিয়ে থাকি। যেমন কোনো আদালতের বিচারক, মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রভৃতি। কোনো মানুষই মানবিক দুর্বলতা মুক্ত নয়। তবু ওই সব পেশার মানুষের চরিত্র অন্যদের চেয়ে বেশি নির্মল ও মাধুর্যমণ্ডিত থাকাই প্রত্যাশিত। তাঁদের হতে হয় দৃষ্টান্তস্থানীয়। তাই তাঁদের চরিত্রে যখন স্খলন ঘটে, তখন তাঁদের আর ওই পদে থাকার নৈতিক অধিকার থাকে না। সবচেয়ে ভালো হয়, যদি তাঁরা স্বেচ্ছায় সেখান থেকে সরে যান।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
বদনা-গাড়ুতে গলাগলি করে
নব-প্যাক্টের আস্নাই,
মুয়াজ্জিনের হাতে নাই ছুরি,
ইমামের হাতে বাঁশ নাই।
অবশ্য এখন লিখলে ভিন্ন শব্দ চয়ন করতে হতো। বাঁশ আসলে ইমামের হাতেই আছে। মুয়াজ্জিনের আছে শুধু হাত। তাই মাথাটা ফেটেছে তাঁরই। ঘটনার অকুস্থল বঙ্গভবনের স্টাফ কোয়ার্টার। বৃহস্পতিবারের জাতীয় দৈনিকগুলোর একটি খবরের শিরোনাম ছিল এ রকম: বঙ্গভবন মসজিদের মুয়াজ্জিনকে মারধর [প্রথম আলো], ইমাম হেল্ড ফলোইং স্কুফল উইথ মুয়াজ্জিন [ডেইলি স্টার], বঙ্গভবন স্টাফ কোয়ার্টার মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন মারামারি [কালের কণ্ঠ], ইমাম-মুয়াজ্জিন মারামারি দুই বউয়ে চুলাচুলি [বাংলাদেশ প্রতিদিন] প্রভৃতি।
পত্রপত্রিকা থেকে যা জানা গেছে, তা হলো: স্টাফ কোয়ার্টারের ইমাম ও মুয়াজ্জিনের বাসা পাশাপাশি। তাঁদের গোসলখানাও পাশাপাশি। বুধবার দুপুরের আগে ইমাম সাহেবের বেগম ঘরের সামনে কাপড় কাচছিলেন। তাঁর অভিযোগ, মুয়াজ্জিন তাঁর দিকে তাকাচ্ছিলেন। এর পরের ঘটনাগুলো ঘটেছে পর্যায়ক্রমে। প্রথমে ‘কটূক্তি’, তারপর ‘গালাগালি’, তারপর ‘হাতাহাতি’, দুজনের বিবির মধ্যে ‘চুলাচুলি’ এবং অবশেষে ‘লাঠির আঘাত’। ইমামের লাঠ্যাঘাতে মুয়াজ্জিনের মাথা চৌচির। তারপর রক্তস্রোত। লাঠির আঘাত থেকে মুয়াজ্জিনের স্ত্রীও রেহাই পাননি। সপত্নীক মুয়াজ্জিনের স্থান হয়েছে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে এবং ইমাম সাহেবের ঠাঁই হয়েছে হাজতে।
মারামারি যখন কোনো সমাজের মানুষের প্রচলিত রীতি হয়, তখন বিদ্যালয় থেকে উপাসনালয়, সচিবালয় থেকে যেকোনো আলয়ে হতে পারে এবং মারামারিতে নারী-পুরুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। ঢাকা কলেজের সঙ্গে ইডেন কলেজের পার্থক্য থাকবে কেন? বঙ্গভবনের স্টাফ কোয়ার্টারের ঘটনায় আহত হয়েছেন দুই জন, গ্রেপ্তার করা হয়েছে একজনকে, উদ্ধার করা হয়েছে বাঁশের লাঠি। একই দিন ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত হয়েছে ১০ জন, গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৫৮ জনকে, উদ্ধার করা হয়েছে ৫২টি কার্তুজ। ছাত্রাবাস থেকে আটক করা ছাত্রদের ছবি বেরিয়েছে পত্রিকায়। মুখ ঢেকে আছে ওরা লজ্জায়। ইমাম সাহেবের কোনো ছবি ছাপা হয়নি। সুতরাং লজ্জায় মুখ ঢাকার প্রশ্নই আসে না। আসলে লজ্জায় মুখ ঢাকতে ইচ্ছা হচ্ছে আমাদের।
গালাগালি, হাতাহাতি বা মাথা ফাটানো তো দূরের কথা, কোনো সাংবাদিক যদি কোনো ইমাম বা মুয়াজ্জিনের সম্পর্কে সামান্য বিরূপ মন্তব্য করতেন, পরের দিন স্টেডিয়ামগেট থেকে পল্টন মোড় পর্যন্ত মিছিল হতো। উত্তাল হতো রাজপথ। উঠত জেহাদি স্লোগান এবং ফাঁসির দাবি। নিজেরা নিজেরা গোসলখানার সামনে মাথা ফাটানোর ফলে কে কার বিরুদ্ধে মিছিল করবেন? যিনি হাসপাতালে আছেন, আমরা তাঁর দ্রুত আরোগ্য কামনা করি। যিনি হাজতে আছেন, তাঁরও দ্রুত মুক্তি দাবি করি।
তবে জীবন থেমে থাকে না। যাঁর মাথা ফেটেছে, কয়েকটি সেলাই দিয়ে পাগড়ির মতো ব্যান্ডেজ বেঁধে তিনি কোয়ার্টারে ফিরে আসবেন। আবার মিনারে উঠে তিনি আজানও দেবেন। নেলসন ম্যান্ডেলাও যখন কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। যিনি হাজতে আছেন তিনিও মুক্তি পাবেন। আবার ইমামতি করবেন। তাঁর পেছনেও মুসল্লিরা নামাজ আদায় করবেন। খুত্বা পাঠ করবেন। জামাতের সবাই তা মনোযোগ দিয়ে শুনবেন। যাঁর প্রমোশন অন্যায়ভাবে আটকে আছে, তিনি গভীর মনোযোগে শুনবেন। যে ঠিকাদারের কাজের বিল টেন পারসেন্ট দেওয়ার পরেও আটকে আছে, তিনিও অন্যমনস্কভাবে হলেও শুনবেন। তাঁদের হাসপাতালে ও হাজতে যাওয়ার কথা মানুষ ভুলে যাবে। এ সমাজে কেউ কাউকে প্রশ্ন করে না। চক্ষুলজ্জা বলে একটা কথা তো আছে।
কিছু কিছু পদ ও পোশাককে আমরা খুবই সম্মান করি ও মর্যাদা দিয়ে থাকি। যেমন কোনো আদালতের বিচারক, মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রভৃতি। কোনো মানুষই মানবিক দুর্বলতা মুক্ত নয়। তবু ওই সব পেশার মানুষের চরিত্র অন্যদের চেয়ে বেশি নির্মল ও মাধুর্যমণ্ডিত থাকাই প্রত্যাশিত। তাঁদের হতে হয় দৃষ্টান্তস্থানীয়। তাই তাঁদের চরিত্রে যখন স্খলন ঘটে, তখন তাঁদের আর ওই পদে থাকার নৈতিক অধিকার থাকে না। সবচেয়ে ভালো হয়, যদি তাঁরা স্বেচ্ছায় সেখান থেকে সরে যান।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments