বিভাগ নয়, প্রয়োজন শক্তিশালী স্থানীয় সরকার by ফারুক মঈনউদ্দীন
গত নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় আচমকা এক অযৌক্তিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল, যাতে সেসব জেলাকে বিভাগে পরিণত করা হয়। সেসব আন্দোলনের ফলে কিংবা সরকারি সিদ্ধান্তে জাতীয় প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস/পুনর্গঠন বাস্তবায়ন কমিটি (নিকার) সারা দেশকে মোট বারোটি বিভাগে ভাগ করার এক প্রস্তাব করেছিল। সে প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলাদেশ গঠিত হওয়ার সময়কার চারটি বিভাগকে বাড়িয়ে সারা দেশে ছয়টি বিভাগ করা হয়েছিল অর্থাৎ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহীর পর সিলেট ও বরিশালকে বিভাগ ঘোষণা করা হয়েছিল। অতিসম্প্রতি রংপুরে সৃষ্টি করা হয়েছে দেশের সপ্তম বিভাগ, রাজশাহী বিভাগ থেকে আটটি জেলা নিয়ে নবগঠিত এই বিভাগে থাকবে মোট আটটি জেলা—রংপুর, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়। নিকারের প্রস্তাব গ্রহণ করা হলে আরও পাঁচটি বিভাগ সৃষ্টি করা হবে পর্যায়ক্রমে।
কোনো একটা নতুন বিভাগ সৃষ্টি হওয়ার পর নতুন কিছু সরকারি প্রশাসনিক পদ সৃষ্টি হওয়া ছাড়া জনগণের বাড়তি কী সুবিধা হয় সেটা উপলব্ধি করার কোনো সুযোগ সেখানকার অধিবাসীরা লাভ করেন না। কারণ বিভাগ সৃষ্টি হলে সাধারণ মানুষের কোনোই উপকার হয় না। পক্ষান্তরে একটা বিভাগীয় সদরে সৃষ্টি হয় অর্ধশতাধিক নতুন পদ। বিভাগের শীর্ষ পদে থাকেন যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার একজন বিভাগীয় কমিশনার, তাঁর অধীনে থাকেন একজন একান্ত সচিব, একজন অতিরিক্ত কমিশনার, দুজন সহকারী কমিশনার। আরও থাকেন চল্লিশ থেকে জনা পঞ্চাশেক নন-গেজেটেড কর্মচারী। বিভাগীয় পুলিশ প্রশাসনে থাকেন পুলিশের একজন উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি), একজন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) এবং জনা দশেক বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তা। এ ছাড়া স্বাস্থ্য ও শিক্ষা অধিদপ্তরের বিভিন্ন পদ সৃষ্টি হবে বিভাগীয় সদরে। এতগুলো নতুন সৃষ্ট পদের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য তৈরি করতে হবে বাসস্থান, দাপ্তরিক ভবন এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো। এই বাড়তি সরকারি অনুৎপাদনশীল খরচের ফলে গণমানুষের যে কোনো উপকার হবে না নবসৃষ্ট বিভাগের উল্লসিত মানুষ অচিরেই তা বুঝতে পারবেন।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রশাসনিক কাঠামোতে জেলা প্রশাসনের হাতে থাকে একটা জেলার সর্বময় ক্ষমতা। এই কাঠামোর শীর্ষ পদে থাকেন জেলা প্রশাসক বা ডেপুটি কমিশনার। উপসচিব পদমর্যাদার জেলা প্রশাসক জেলায় কর্মরত থাকা অবস্থায় একসঙ্গে তিনটি ভূমিকা পালন করে থাকেন। প্রথমত তিনি কমিশনার, তবে বিভাগীয় কমিশনারের অধীনে থাকার কারণে তিনি ডেপুটি কমিশনার। জেলার সব প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের তিনিই মুখ্য সমন্বয়কারী। জেলার সব ধরনের ব্যয়-বরাদ্দ, জমিজমার বিলি-বণ্টনের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা মুখ্য ও প্রধান। দ্বিতীয়ত জেলার সব ভূমি রাজস্ব ও পাওনা আদায়ের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকার কারণে তিনি কালেক্টরও। এ কারণে জেলা প্রশাসকের দপ্তরকে জেলা কালেক্টরেটও বলা হয়ে থাকে। তৃতীয়ত সীমিত আকারের ম্যাজিস্ট্রেসি থাকে জেলা প্রশাসকের অধীনে। বিচার বিভাগ পৃথক্করণের আগে জেলার বিচারিক আদালতও ছিল জেলা প্রশাসকের হাতে। বর্তমানে সীমিত মাত্রার হলেও ম্যাজিস্ট্রেসির দায়িত্ব তাঁর ওপর ন্যস্ত বলে জেলা প্রশাসক একজন ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবেও দায়িত্ববান।
বর্ণিত তিনটি প্রধান কর্মের শীর্ষ ব্যক্তি হিসেবে অধিষ্ঠিত থেকে একজন জেলা প্রশাসক প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী থাকেন। সে কারণে বর্তমান বিদ্যমান প্রশাসনিক কাঠামোতে এই ত্রিমাত্রিক পদাভিষিক্ত জেলা প্রশাসকের কর্মপরিধির বাইরে কোনো কার্যকর ক্ষমতাবলয় সৃষ্টি করার অবকাশ সীমিত। তাহলে সংগতভাবে প্রশ্ন জাগতে পারে, একজন বিভাগীয় কমিশনারের ভূমিকা কী এবং কতখানি?
বলাবাহুল্য, একটা বিভাগ হচ্ছে কয়েকটা জেলার সমষ্টি, সে হিসেবে বিভাগীয় কমিশনার হচ্ছেন মূলত তাঁর অধীন জেলাগুলোর (ডেপুটি) কমিশনারদের কাজের মূল সমন্বয়কারী। তবে জেলার ভূমি রাজস্ব সংগ্রহ, সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সমন্বয় এবং ম্যাজিস্ট্রেসির পূর্ণ দায়িত্বে দায়িত্ববান থাকা ডেপুটি কমিশনারদের কার্যপরিধির বাইরেও জেলা প্রশাসকদের কাজকর্মের দেখভাল করা ছাড়া বিভাগীয় কমিশনারদের তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা নেই। বিভাগীয় কমিশনাররা কেবল একটিমাত্র ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকদের ক্ষমতাবলয়ের বাইরে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেন। সেটি হচ্ছে ভূমিসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে দেওয়ানি আদালতবহির্ভূত সিদ্ধান্তে জেলা প্রশাসকের রায়ের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ পক্ষ বিভাগীয় কমিশনারের দপ্তরে আপিল করতে পারে। এই একটিমাত্র বিষয়ে বিভাগীয় কমিশনার জেলা প্রশাসকের সিদ্ধান্তের ওপর আপিল নিষ্পত্তি করতে পারেন।
নব্বই দশকের সেই বিভাগ বাস্তবায়নের অযৌক্তিক আন্দোলন এক সময় স্তিমিত হয়ে এসেছিল। হয়তোবা আন্দোলনকারী নেতারা এই আন্দোলনের অসারতা বুঝতে পেরেছিলেন। কারণ ওপরের অতিসরলীকৃত আলোচনার আলোকে বিভাগীয় প্রশাসনের যে কর্মপরিধি সম্পর্কে জানা গেল, তার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায় নতুন বিভাগ সৃষ্টি হলে সাধারণ মানুষের জীবনে কোনোই ইতিবাচক প্রভাব পড়ে না। কারণ বিভাগীয় সদরে নিয়োজিত প্রশাসনের সঙ্গে সাধারণ মানুষের কোনো সরাসরি সম্পৃক্ততার প্রয়োজন পড়ে না। নিকারের ব্যবস্থাপত্রে সারা দেশে আরও পাঁচটি বিভাগ সৃষ্টির যে প্রস্তাব রাখা হয়েছে তাতে কী অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক যৌক্তিকতা দেখিয়ে প্রস্তাব অনুমোদন করানো হয়েছে আমাদের জানা নেই, তবে যুক্তি যাই দেখানো হোক তার সঙ্গে সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের কিংবা ন্যূনপক্ষে তাদের কোনো বাড়তি সুবিধার কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা আছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের দারিদ্র্যের প্রকৃতি এবং সাধারণ মানুষের বঞ্চনার বিচারে যেখানে আরও বেশি বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজন, সেখানে কেবল বিভাগ সৃষ্টি করে প্রশাসনিক ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন কতটুকু কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে সে প্রশ্ন জরুরি ভিত্তিতে পুনর্বিবেচনা করা উচিত।
দেশের উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় গণমানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য স্থানীয় সরকার পদ্ধতি শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই। নতুন নতুন বিভাগ সৃষ্টির মাধ্যমে নতুন কিছু আমলার পদ সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের অলীক আত্মতৃপ্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে, কিন্তু জেলায় জেলায় মানুষের এই আকাঙ্ক্ষার ভেতর দিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের উঠে দাঁড়ানোর যে প্রয়াস ও শক্তিকে প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে, সেটাকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে কিছু গুণগত অবদান রাখা সম্ভব। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি লক্ষণীয় সেটি হচ্ছে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, যাদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সব কাজে অত্যাবশ্যক—বিভাগ সৃষ্টির অলীক আনন্দে মশগুল জেলা সদরের মানুষদের মধ্যে তাদের প্রতিনিধিত্ব নেই। তাই জেলা সদরকে বিভাগ করা হোক কিংবা প্রদেশই করা হোক তাতে তাদের অবস্থার সামান্যতম পরিবর্তনও ঘটবে না।
রংপুরকে বিভাগীয় সদর ঘোষণা করার পর সেখানকার উল্লাসমুখর মানুষের আবেগের প্রতি পূর্ণ সহানুভূতি জানিয়ে ধারণা করা যায়, এই আবেগ ও উচ্ছ্বাস উত্তরবঙ্গের উন্নয়নবঞ্চিত মানুষের প্রাপ্তির একটা অলীক আস্বাদ। কিন্তু সেসব উচ্ছ্বাসমুখর মানুষের মুখের হাসি ম্লান হয়ে যাবে, যখন তারা দেখবে যে বিভাগ সৃষ্টির পর রংপুর জেলা সদরে নতুন কয়েকটা সরকারি দপ্তর ছাড়া তাদের আর কোনো উপকার হয়নি। অথচ উত্তরবঙ্গবাসীর জন্য প্রয়োজন ছিল বিভাগ নয়, অধিক পরিমাণে কলকারখানা এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। তার জন্য প্রয়োজন সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক ব্যবস্থাপত্র নয়। বর্তমান সরকারের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা ও প্রত্যাশা অত্যধিক, সুশীল সমাজের অকুণ্ঠ সমর্থনও বর্তমান সরকারের এক বড় শক্তি। তাই সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে অর্থনীতির চাকাকে বেগবান করার জন্য প্রয়াসই হওয়া উচিত সরকারের প্রধানতম লক্ষ্য।
নিকারের প্রস্তাবনায় আরও কোন কোন জেলাকে বিভাগে পরিণত করার সুপারিশ আছে আমাদের জানা নেই। সেসব সুপারিশ পুনর্বিবেচনা করে বিভাগ সৃষ্টির বাড়তি ব্যয়কে যদি জেলার উন্নয়নকাজে প্রবাহিত করা হয় সেটাই হবে প্রকৃত জনকল্যাণমুখী কাজ। কারণ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পড়ে থাকা অবহেলিত দরিদ্র মানুষকে যেকোনো সৃষ্টিশীল কাজে সম্পৃক্ত করতে পারলে তার ফল হবে সুদূরপ্রসারী। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য এর কোনো বিকল্পও নেই। তাই প্রয়োজনহীন বিভাগ সৃষ্টির পরিবর্তে আমাদের দরকার শক্তিশালী স্থানীয় সরকার, যা নিশ্চিত করতে পারে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সুযোগহীন স্থানীয় মানুষের প্রত্যক্ষ ও কার্যকর অংশগ্রহণ।
ফারুক মঈনউদ্দীন: ব্যাংকার ও লেখক।
fmainuddin@hotmail.com
কোনো একটা নতুন বিভাগ সৃষ্টি হওয়ার পর নতুন কিছু সরকারি প্রশাসনিক পদ সৃষ্টি হওয়া ছাড়া জনগণের বাড়তি কী সুবিধা হয় সেটা উপলব্ধি করার কোনো সুযোগ সেখানকার অধিবাসীরা লাভ করেন না। কারণ বিভাগ সৃষ্টি হলে সাধারণ মানুষের কোনোই উপকার হয় না। পক্ষান্তরে একটা বিভাগীয় সদরে সৃষ্টি হয় অর্ধশতাধিক নতুন পদ। বিভাগের শীর্ষ পদে থাকেন যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার একজন বিভাগীয় কমিশনার, তাঁর অধীনে থাকেন একজন একান্ত সচিব, একজন অতিরিক্ত কমিশনার, দুজন সহকারী কমিশনার। আরও থাকেন চল্লিশ থেকে জনা পঞ্চাশেক নন-গেজেটেড কর্মচারী। বিভাগীয় পুলিশ প্রশাসনে থাকেন পুলিশের একজন উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি), একজন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) এবং জনা দশেক বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তা। এ ছাড়া স্বাস্থ্য ও শিক্ষা অধিদপ্তরের বিভিন্ন পদ সৃষ্টি হবে বিভাগীয় সদরে। এতগুলো নতুন সৃষ্ট পদের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য তৈরি করতে হবে বাসস্থান, দাপ্তরিক ভবন এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো। এই বাড়তি সরকারি অনুৎপাদনশীল খরচের ফলে গণমানুষের যে কোনো উপকার হবে না নবসৃষ্ট বিভাগের উল্লসিত মানুষ অচিরেই তা বুঝতে পারবেন।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রশাসনিক কাঠামোতে জেলা প্রশাসনের হাতে থাকে একটা জেলার সর্বময় ক্ষমতা। এই কাঠামোর শীর্ষ পদে থাকেন জেলা প্রশাসক বা ডেপুটি কমিশনার। উপসচিব পদমর্যাদার জেলা প্রশাসক জেলায় কর্মরত থাকা অবস্থায় একসঙ্গে তিনটি ভূমিকা পালন করে থাকেন। প্রথমত তিনি কমিশনার, তবে বিভাগীয় কমিশনারের অধীনে থাকার কারণে তিনি ডেপুটি কমিশনার। জেলার সব প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের তিনিই মুখ্য সমন্বয়কারী। জেলার সব ধরনের ব্যয়-বরাদ্দ, জমিজমার বিলি-বণ্টনের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা মুখ্য ও প্রধান। দ্বিতীয়ত জেলার সব ভূমি রাজস্ব ও পাওনা আদায়ের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকার কারণে তিনি কালেক্টরও। এ কারণে জেলা প্রশাসকের দপ্তরকে জেলা কালেক্টরেটও বলা হয়ে থাকে। তৃতীয়ত সীমিত আকারের ম্যাজিস্ট্রেসি থাকে জেলা প্রশাসকের অধীনে। বিচার বিভাগ পৃথক্করণের আগে জেলার বিচারিক আদালতও ছিল জেলা প্রশাসকের হাতে। বর্তমানে সীমিত মাত্রার হলেও ম্যাজিস্ট্রেসির দায়িত্ব তাঁর ওপর ন্যস্ত বলে জেলা প্রশাসক একজন ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবেও দায়িত্ববান।
বর্ণিত তিনটি প্রধান কর্মের শীর্ষ ব্যক্তি হিসেবে অধিষ্ঠিত থেকে একজন জেলা প্রশাসক প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী থাকেন। সে কারণে বর্তমান বিদ্যমান প্রশাসনিক কাঠামোতে এই ত্রিমাত্রিক পদাভিষিক্ত জেলা প্রশাসকের কর্মপরিধির বাইরে কোনো কার্যকর ক্ষমতাবলয় সৃষ্টি করার অবকাশ সীমিত। তাহলে সংগতভাবে প্রশ্ন জাগতে পারে, একজন বিভাগীয় কমিশনারের ভূমিকা কী এবং কতখানি?
বলাবাহুল্য, একটা বিভাগ হচ্ছে কয়েকটা জেলার সমষ্টি, সে হিসেবে বিভাগীয় কমিশনার হচ্ছেন মূলত তাঁর অধীন জেলাগুলোর (ডেপুটি) কমিশনারদের কাজের মূল সমন্বয়কারী। তবে জেলার ভূমি রাজস্ব সংগ্রহ, সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সমন্বয় এবং ম্যাজিস্ট্রেসির পূর্ণ দায়িত্বে দায়িত্ববান থাকা ডেপুটি কমিশনারদের কার্যপরিধির বাইরেও জেলা প্রশাসকদের কাজকর্মের দেখভাল করা ছাড়া বিভাগীয় কমিশনারদের তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা নেই। বিভাগীয় কমিশনাররা কেবল একটিমাত্র ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকদের ক্ষমতাবলয়ের বাইরে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেন। সেটি হচ্ছে ভূমিসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে দেওয়ানি আদালতবহির্ভূত সিদ্ধান্তে জেলা প্রশাসকের রায়ের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ পক্ষ বিভাগীয় কমিশনারের দপ্তরে আপিল করতে পারে। এই একটিমাত্র বিষয়ে বিভাগীয় কমিশনার জেলা প্রশাসকের সিদ্ধান্তের ওপর আপিল নিষ্পত্তি করতে পারেন।
নব্বই দশকের সেই বিভাগ বাস্তবায়নের অযৌক্তিক আন্দোলন এক সময় স্তিমিত হয়ে এসেছিল। হয়তোবা আন্দোলনকারী নেতারা এই আন্দোলনের অসারতা বুঝতে পেরেছিলেন। কারণ ওপরের অতিসরলীকৃত আলোচনার আলোকে বিভাগীয় প্রশাসনের যে কর্মপরিধি সম্পর্কে জানা গেল, তার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায় নতুন বিভাগ সৃষ্টি হলে সাধারণ মানুষের জীবনে কোনোই ইতিবাচক প্রভাব পড়ে না। কারণ বিভাগীয় সদরে নিয়োজিত প্রশাসনের সঙ্গে সাধারণ মানুষের কোনো সরাসরি সম্পৃক্ততার প্রয়োজন পড়ে না। নিকারের ব্যবস্থাপত্রে সারা দেশে আরও পাঁচটি বিভাগ সৃষ্টির যে প্রস্তাব রাখা হয়েছে তাতে কী অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক যৌক্তিকতা দেখিয়ে প্রস্তাব অনুমোদন করানো হয়েছে আমাদের জানা নেই, তবে যুক্তি যাই দেখানো হোক তার সঙ্গে সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের কিংবা ন্যূনপক্ষে তাদের কোনো বাড়তি সুবিধার কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা আছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের দারিদ্র্যের প্রকৃতি এবং সাধারণ মানুষের বঞ্চনার বিচারে যেখানে আরও বেশি বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজন, সেখানে কেবল বিভাগ সৃষ্টি করে প্রশাসনিক ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন কতটুকু কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে সে প্রশ্ন জরুরি ভিত্তিতে পুনর্বিবেচনা করা উচিত।
দেশের উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় গণমানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য স্থানীয় সরকার পদ্ধতি শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই। নতুন নতুন বিভাগ সৃষ্টির মাধ্যমে নতুন কিছু আমলার পদ সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের অলীক আত্মতৃপ্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে, কিন্তু জেলায় জেলায় মানুষের এই আকাঙ্ক্ষার ভেতর দিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের উঠে দাঁড়ানোর যে প্রয়াস ও শক্তিকে প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে, সেটাকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে কিছু গুণগত অবদান রাখা সম্ভব। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি লক্ষণীয় সেটি হচ্ছে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, যাদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সব কাজে অত্যাবশ্যক—বিভাগ সৃষ্টির অলীক আনন্দে মশগুল জেলা সদরের মানুষদের মধ্যে তাদের প্রতিনিধিত্ব নেই। তাই জেলা সদরকে বিভাগ করা হোক কিংবা প্রদেশই করা হোক তাতে তাদের অবস্থার সামান্যতম পরিবর্তনও ঘটবে না।
রংপুরকে বিভাগীয় সদর ঘোষণা করার পর সেখানকার উল্লাসমুখর মানুষের আবেগের প্রতি পূর্ণ সহানুভূতি জানিয়ে ধারণা করা যায়, এই আবেগ ও উচ্ছ্বাস উত্তরবঙ্গের উন্নয়নবঞ্চিত মানুষের প্রাপ্তির একটা অলীক আস্বাদ। কিন্তু সেসব উচ্ছ্বাসমুখর মানুষের মুখের হাসি ম্লান হয়ে যাবে, যখন তারা দেখবে যে বিভাগ সৃষ্টির পর রংপুর জেলা সদরে নতুন কয়েকটা সরকারি দপ্তর ছাড়া তাদের আর কোনো উপকার হয়নি। অথচ উত্তরবঙ্গবাসীর জন্য প্রয়োজন ছিল বিভাগ নয়, অধিক পরিমাণে কলকারখানা এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। তার জন্য প্রয়োজন সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক ব্যবস্থাপত্র নয়। বর্তমান সরকারের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা ও প্রত্যাশা অত্যধিক, সুশীল সমাজের অকুণ্ঠ সমর্থনও বর্তমান সরকারের এক বড় শক্তি। তাই সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে অর্থনীতির চাকাকে বেগবান করার জন্য প্রয়াসই হওয়া উচিত সরকারের প্রধানতম লক্ষ্য।
নিকারের প্রস্তাবনায় আরও কোন কোন জেলাকে বিভাগে পরিণত করার সুপারিশ আছে আমাদের জানা নেই। সেসব সুপারিশ পুনর্বিবেচনা করে বিভাগ সৃষ্টির বাড়তি ব্যয়কে যদি জেলার উন্নয়নকাজে প্রবাহিত করা হয় সেটাই হবে প্রকৃত জনকল্যাণমুখী কাজ। কারণ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পড়ে থাকা অবহেলিত দরিদ্র মানুষকে যেকোনো সৃষ্টিশীল কাজে সম্পৃক্ত করতে পারলে তার ফল হবে সুদূরপ্রসারী। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য এর কোনো বিকল্পও নেই। তাই প্রয়োজনহীন বিভাগ সৃষ্টির পরিবর্তে আমাদের দরকার শক্তিশালী স্থানীয় সরকার, যা নিশ্চিত করতে পারে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সুযোগহীন স্থানীয় মানুষের প্রত্যক্ষ ও কার্যকর অংশগ্রহণ।
ফারুক মঈনউদ্দীন: ব্যাংকার ও লেখক।
fmainuddin@hotmail.com
No comments