সরকারি খবরদারি নয়, চাই গণমাধ্যমের দায়বোধ by আনিসুল হক
টেলিভিশনের খবর দেখছিলাম। হঠাৎই একটা খবর কানে এল। তথ্য মন্ত্রণালয় গণমাধ্যমের কর্তাব্যক্তিদের এক পরামর্শসভায় ডেকেছে। তাতে গণমাধ্যমগুলোকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বাংলা ভাষার বিকৃতি রোধে ভূমিকা রাখতে। জগাখিচুড়ি ভাষা, অশুদ্ধ ভাষা প্রচারের মাধ্যমে ভাষার দূষণ যেন কেউ না ঘটায়। যদি কেউ এ ধরনের বিকৃতি ঘটাতেই থাকে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। টেলিভিশনে শোনা খবর স্মৃতি থেকে বললাম। ‘কঠোর ব্যবস্থা’র হুঁশিয়ারিটা স্পষ্ট মনে আছে। বাকি কথাগুলো হুবহু কী ছিল, তা ঠিকঠাক বলতে পারছি, এমন নয়। তবে অন্তর্নিহিত বার্তাটা এ রকমই।
বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের যে গভীর মমত্ববোধ, সেটা খুবই খাঁটি একটা জিনিস, বানিয়ে তোলা কিছু নয়। তথ্য মন্ত্রণালয়ের এই উদ্যোগও সেই আন্তরিক ভালোবাসা, বেদনা ও উদ্বেগেরই প্রকাশ। তবে ধমক দিয়ে, পরামর্শ দিয়ে বা কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দিয়ে সৎ উদ্দেশ্যও চরিতার্থ হবে কি না, এ বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
এ বিষয়ে গণমাধ্যমগুলোর নিজেকেই দায়িত্বশীল হতে হবে সবার আগে। গণমাধ্যমের কাজ কী— পাঠ্যপুস্তকে লেখা আছে—গণমাধ্যম তথ্য দেবে, বিনোদন দেবে, শিক্ষা দেবে, আর প্রেরণা জোগাবে। কাজেই শ্রোতা বা দর্শক বা পাঠককে সুশিক্ষা দেওয়া, উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করার দায় প্রতিটা গণমাধ্যমের ওপরে আপনাআপনিই বর্তায়। আর সেই দায়িত্ব গণমাধ্যমকে নিজের গরজে, নিজের দায়বোধ থেকেই করতে হয়। সরকার খবরদারি করে সেটা করতে পারবে বলে মনে হয় না। এটা সরকারের কাজও নয়। সৃষ্টিশীলতার কাজে সরকারের সব চেয়ে ভালো ভূমিকা হলো সবচেয়ে কম জড়িত হওয়া, কম হস্তক্ষেপ করা।
গণমাধ্যম তার নিজের ওপরে অর্পিত পাবলিক ট্রাস্টের দায় এড়াতে পারে না। আমাদের বেতারের উপস্থাপকেরা মান বাংলায় কথা বলতে জানবেন, প্রমিত কথ্যভাষা বলায় তাঁরা হয়ে উঠবেন একেকজন আদর্শ, এটা বেশ জোরের সঙ্গেই আমরা দাবি করতে পারি। এবিসি রেডিওতেও যথাসম্ভব প্রমিত বাংলা ব্যবহার করা হয় ও ইংরেজি শব্দ পরিহার করা হয়, কিন্তু তাতে এই বেতারটির জনপ্রিয়তা কমেনি, বরং খুবই অল্প সময়ের মধ্যে বেতারটি শ্রোতাদের মনে একটা স্থান অধিকার করে নিতে পেরেছে। প্রথম আলোরও সম্পাদকীয় নীতি হলো, ইংরেজি শব্দ পারতপক্ষে ব্যবহার না করা। কই, প্রথম আলোর জনপ্রিয়তা তো কমেনি, বরং প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। গণমাধ্যম কর্তৃপক্ষকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। যখন একজন উপস্থাপক নেওয়া হয়, তখন তাঁকে পরীক্ষার মাধ্যমে বাছাই করে নিশ্চিত হতে হবে যে, তিনি মান বাংলাটা সঠিকভাবে বলতে পারেন। একই কথা টেলিভিশন চ্যানেলের জন্যও প্রযোজ্য। অনেকগুলো অনুষ্ঠান, বিশেষ করে ব্যান্ডের গানের অনুষ্ঠানের উপস্থাপকেরা বাংলা বলেন, নাকি হিন্দি বলেন, নাকি ইংরেজি বলেন, বোঝা খুবই দুষ্কর। আর এত ইংরেজি শিরোনামের অনুষ্ঠানই বা কেন?
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তথ্য মন্ত্রণালয় বা সরকারের কোনো মন্ত্রণালয় এগুলোকে পাহারা দিয়ে রাখতে পারবে কি না? এটা তার কাজ কি না? কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়াটা মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে কি না! আমরা গণমাধ্যমের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতার পক্ষে এবং সরকারের ন্যূনতম হস্তক্ষেপেরও বিরুদ্ধে। আমেরিকা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ। ওই দেশের সংবাদমাধ্যমে কোনো ধরনের সরকারি হস্তক্ষেপ সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ। ইউনাইটেড স্টেটস ইনফরমেশন এজেন্সি প্রকাশিত আনফেটারড প্রেস গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘একটা সংবাদপত্রের অধিকার আছে ছিদ্রান্বেষী, দলীয় পক্ষপাতদুষ্ট, অথবা অসত্যবাদী, সংকীর্ণতাবাদী, অথবা যা খুশি তাই হওয়ার, যা তার বিবেক তাকে হতে বলে।’ (পৃষ্ঠা ৩৫)। আমেরিকায় একটা সংবাদমাধ্যম মিথ্যা কথা বলারও অধিকার রাখে। কেন তারা সংবাদমাধ্যমকে এই স্বাধীনতা দিয়েছে? না হলে সরকার খবরদারি করবে, বলবে তুমি মিথ্যা বলছ। সরকারি খবরদারির একটা অজুহাত তৈরি হবে মাত্র। সেটা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করবে। তার বদলে পাঠক সিদ্ধান্ত নিক, কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা। মিথ্যা কথা বলে কোনো সংবাদমাধ্যম শেষতক গ্রহণযোগ্যতা পায় না। তো এই অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে আমেরিকা কি তার রাষ্ট্রটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে? নাকি তারাই আজ পৃথিবীর এক নম্বর শক্তি হিসেবে টিকে আছে?
তার পরের প্রশ্ন হলো, কোনটা প্রমিত কোনটা প্রমিত নয়, এটা ঠিক করবে কে? ভাষা তো বহমান একটা জিনিস, এটা স্থির নয়। আজ যাকে প্রমিত বলছি, ১০০ বছর আগে সেটা প্রমিত ছিল না, ১০০ বছর পরেও থাকবে না। প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, ‘ভাষা মানুষের মুখ হতে কলমের মুখে আসে, কলমের মুখ হতে মানুষের মুখে নয়। উল্টোটা করতে গেলে মুখে শুধু কালি পড়ে।’ (প্রমথ চৌধুরী, কথার কথা, প্রবন্ধসংগ্রহ)। আমি লেখার সময় বাংলা একাডেমীর প্রমিত বানান অভিধান মেনে চলি, কিন্তু বাংলাদেশের বহু গুরুত্বপূর্ণ লেখক আছেন, যাঁরা ওই বানানরীতি মানেন না। তাঁদের কি আমরা বলতে পারব, আপনারা আইন লঙ্ঘন করছেন? বানানের ক্ষেত্রেই যদি আমরা বাংলা একাডেমীর প্রমিত বানান অভিধান সবাইকে মানতে বাধ্য করতে না পারি, তাহলে উচ্চারণের ক্ষেত্রে কীভাবে পারব? প্রমিত বাংলা নষ্ট হয়ে যাবে, এই ভয়ে কি আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের চরমপত্র পাঠ নিষিদ্ধ করে দেব? অথচ ওইটাই ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান! আমরা কি বেতারে কি টেলিভিশনে ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালি-লালন-হাসন প্রচার করব না! আমরা কি সাতই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ‘দাবায়া রাখতে পারবা না’ বাক্যটাকে সম্পাদিত করে ‘দাবিয়ে রাখতে পারবে না’ করতে বলব? অসম্ভব। আমরা কি টেলিভিশন নাটক নির্মাণের সময় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝির সংলাপ বা দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকের সংলাপ বদলে প্রমিত মান বাংলা করে দেব? আবার আমাদের সংবিধান লেখা সাধু ভাষায়, আমরা কি তাহলে সাধু ভাষাকে প্রমিত ভাষা ধরে নিয়ে বেতার-টেলিভিশনে সাধু ভাষা বাধ্যতামূলক করব? রবীন্দ্রনাথের একটা গল্প ‘ল্যাবরেটরি’ থেকে তিনটা বাক্য উদ্ধৃত করি, খেয়াল করে দেখুন তিনি কত ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেছেন, ‘নন্দনকিশোর ছিলেন লন্ডন য়ুনিভার্সিটি থেকে পাস করা এঞ্জিনিয়ার। যাকে সাধুভাষায় বলে দেদীপ্যমান ছাত্র, অর্থাত্ ব্রিলিয়ান্ট, তিনি ছিলেন তাই।...এসব দেনা-পাওনা নাকি কোম্পানি নামক একটা অ্যাব্স্ট্রাক্ট সত্তার সঙ্গে জড়িত...।’ এখন রবিবাবুর এই গল্পকে জগাখিচুড়ি ভাষা বলে আমরা বাতিলের খাতায় পাঠাতে পারব কি?
তাই বলি, প্রথমেই একটা সীমারেখা টানতে হবে। তা হলো, সৃজনশীল এলাকা আর আনুষ্ঠানিক এলাকা। শিল্পী-সাহিত্যিক-নাট্যকারেরা স্বাধীনভাবে লিখবেন। একটা বেতার বা টেলিভিশন বা সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় নীতি বলে দেবে, এটা তারা প্রকাশ বা প্রচার করতে পারবে কি না। যেমন হাসান আজিজুল হক একটা অপূর্ব উপন্যাস লিখেছেন আগুনপাখি নামে। এটা প্রথম আলোর বর্ষসেরা বইয়ের পুরস্কার পেয়েছে এই বাংলাদেশে, পশ্চিমবঙ্গে পেয়েছে আনন্দ পুরস্কার। বইটা লেখা হয়েছে রাঢ় অঞ্চলের কথ্য ভাষায়। ‘আমার মায়ের য্যাকন মিত্যু হলো আমার বয়েস ত্যাকন আট-ল’ বছর হবে। ভাইটোর বয়েস দেড়-দু বছর। এই দুই ভাই-বুনকে অকূলে ভাসিয়ে মা আমার চোখ বুজল। ত্যাকনকার দিনে কে যি কিসে মরত ধরবার বাগ ছিল না।’ পুরো বইটার বর্ণনা এই ভাষায়। এটাকে তো আপনি প্রমিত নয় বলে নিষিদ্ধ করে দিতে পারেন না।
আমরা কি টেলিভিশনে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, নূরলদীনের সারাজীবন বা হাতহদাই প্রচারে বাধা দেব? নাটকের সংলাপ হবে চরিত্রানুগ, সেটা দীনবন্ধু মিত্রও লিখেছেন, মধুসূদন দত্তও লিখেছেন, সেটা নিয়ে কোনো বিতর্ক কখনো ছিল না, আশা করি এখনো নাই। আবার সৃষ্টিশীল লেখক তাঁর বর্ণনার ভাষাও নিজের মতো করে তৈরি করে নিতে পারেন, আঞ্চলিক ভাষায় লিখতে পারেন—আইন করে সেটাকে ঠেকানোর কথা কেউ কল্পনাও করে না।
কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে যখন আমরা বেতারে বা টেলিভিশনে কথা বলব, শ্রেণীকক্ষে বা আলোচনা সভায় বক্তৃতা করব, আমরা তখন প্রমিত কথ্য ভাষা ব্যবহারের চেষ্টা করব ১০০ ভাগ। সেখানে যখন অন্যথা দেখি, আমরা আমাদের উদ্বেগের কথা নিশ্চয়ই জানাব। আমাদের কোনো পরামর্শ থাকলে সেটা দেবও। আমরা চাইব, আমাদের সংবাদপাঠকেরা প্রমিত বাংলায় খবর পরিবেশন করবেন। আমরা চাইব আমাদের আলোচনা অনুষ্ঠানগুলোর আলোচকেরা মান বাংলায় আলোচনা করবেন। কিন্তু সেটাও পাহারা দিয়ে রাখা মুশকিল। আমরা কি আমাদের জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পিকার আবদুল হামিদের সংসদে বলা উক্তিগুলো প্রচার করব না? নিশ্চয়ই করব। অসাধারণ দক্ষতায় তিনি সংসদ পরিচালনা করেন এবং তাঁর মুখের কথা শুনতে আমাদের ভালো লাগে।
বলতে চাচ্ছি, এটা অসম্ভব যে কোন বেতারে, কোন টেলিভিশনে, কোন সংবাদপত্রে দূষণীয় ভাষা পরিবেশিত হচ্ছে, সরকারের পক্ষে তা পাহারা দিয়ে রাখা, তা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা। এ ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমকেই যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। যে যত জনপ্রিয় হবে, তাকে তত বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। এমনকি শিল্পীরও দায়িত্ব আছে। দায়বদ্ধতা আছে। শিল্পী নিশ্চয়ই এ বিষয়ে সচেতন হবেন।
প্রমিত বাংলা আমাদের শিখতে হবে। আমরা শুদ্ধ বাংলা বলতে ও লিখতে পারার কষ্টটা স্বীকার করব না, এটা খুব কাজের কথা নয়। আমাদের স্কুলগুলোকে, আমাদের নাগরিকদেরকে এ ব্যাপারে দায়িত্ব পালন করতে হবে। পাশাপাশি এটাও বলি, আঞ্চলিক ভাষা বাংলা ভাষার শত্রু নয়, আঞ্চলিক ভাষা বাংলার প্রধান সম্পদ। এটাকে যেন আমরা অবহেলা না করি, আঞ্চলিক ভাষায় যাঁরা কথা বলেন, তাঁদের যেন আমরা হেয় না করি। আমাদের যেন আবার লিখতে না হয়, ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়।’ একুশের চেতনা মানে বহুস্বরের চেতনা, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের চেতনা আমাদের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর ভাষাগুলোকেও গুরুত্ব ও মর্যাদা দেওয়ার চেতনা। সংস্কৃতি মানে কেবল কেন্দ্রের বা মধ্যবিত্তের স্বর নয়, শাসক শ্রেণীর স্বর নয়; প্রান্তেরও স্বর, শত ফুল ফুটতে দেবার সাধনা, গরিব মানুষ, কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের কণ্ঠস্বরও যেন আমাদের শিল্প-সাহিত্য-গণমাধ্যমে স্থান পায়। আমরা যেন কথায় কথায় হাতে-পায়ে শেকল পরানোর ভুল চেষ্টা না করি।
বাংলা ভাষার প্রধান শত্রু কে? আমাদের আঞ্চলিক ভাষাগুলো মোটেও নয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ যে বিভিন্ন উপভাষায় কথা বলেন, সেসবের বদলে রাষ্ট্র একটা কেন্দ্র-নির্দেশিত ভাষা প্রবর্তন করবে, এই চিন্তার মতো স্বৈরাচারী ও একুশের চেতনাবিরোধী আর কিছুই হতে পারে না। বাংলা ভাষার প্রধান শত্রু বিশ্বায়নের চাপে মুক্তবাজারের খোলা দরজা-জানালা দিয়ে ঢুকে পড়া পণ্যবাদী সংস্কৃতির আগ্রাসন। সরকারের এসব ক্ষেত্রে করার আছে অনেক কিছু। একবার এই দেশে আইন করা হয়েছিল, অফিস-আদালত, দোকানের নামফলক বাংলায় লিখতে হবে। সাইনবোর্ডে বাংলা থাকতে হবে, এই আইনটা যদি থেকে থাকে, তাহলে সেটাকে পুরোপুরি কার্যকর করা হোক, যদি না থাকে, তাহলে এই আইন আবার চালু করতে হবে। বাংলা ভাষার আরেকটা বড় শত্রু অবশ্যই হিন্দি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো আর বাংলাদেশের চ্যানেল দেখে না। তথ্য মন্ত্রণালয় যদি সত্যি সত্যি বাংলা ভাষার জন্য একটা কিছু করতে চায়, তাহলে তার প্রথম কাজ হওয়া উচিত এই দেশে হিন্দি চ্যানেলের ওপরে বিধিনিষেধ আরোপ করা। এটা ভীষণ অজনপ্রিয় একটা পদক্ষেপ হবে, কারণ আমরা এই হিন্দি ধারাবাহিকগুলোতে মাদকের মতো নেশাসক্ত হয়ে পড়েছি। শিশুদের একটা হিন্দি চ্যানেলে হিন্দি কার্টুন দেখানো হয়, ওর দ্বারা শিশুরা বাংলা বলা ভুলে যাচ্ছে। এটা অবিলম্বে বন্ধ করে দেওয়া উচিত। আমাদের ভোগ্যপণ্যগুলোর মোড়কে বাংলা লেখা থাকা বাধ্যতামূলক করা যায়। আমাদের বিজ্ঞাপনচিত্রে ইংরেজির ব্যবহার সহজেই বন্ধ করে দেওয়া যায়। এসব পদক্ষেপ যদি তথ্য মন্ত্রণালয় গ্রহণ করে, বাংলা ভাষার ভীষণ উপকার হবে। অফিস-আদালতে বাংলা ব্যবহারের সাংবিধানিক অঙ্গীকার পালনে আন্তরিক হতে হবে সরকারকেই। প্রথম আলো ২০১০ একুশে সংখ্যায় মিশা হোসেন একটা চমত্কার প্রবন্ধ লিখেছেন, আজকে দেশের মানুষ ইংরেজি জানা ও ইংরেজি না জানা এ দুই শ্রেণীতে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। একুশের চেতনা হলো বৈষম্যহীনতা, রাষ্ট্রকে এই বৈষম্য বিলোপে কাজ করতে হবে। আমাদের ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়গুলোয় ভারতের ইতিহাস পড়ানো হয়, ব্রিটেনের ইতিহাস পড়ানো হয়, তাদের বাংলার ইতিহাস পড়াতে হবে। সেসব না করে রাষ্ট্র যদি বহু মানুষের কণ্ঠস্বরকে সংস্কৃতিতে আসতে বাধা দেয়, তা হবে পণ্ডশ্রম, তা আমাদের মনে করিয়ে দেয় শহীদ কাদরীর কবিতা, ‘রাষ্ট্র মানেই লেফ্ট রাইট লেফ্ট রাইট।’ একুশের চেতনা এ রকম লেফট রাইট মার্কা রাষ্ট্র নয়, একটা বৈষম্যহীন উদার অসাম্প্রদায়িক সুখী আলোকিত মুক্ত রাষ্ট্র—যে রাষ্ট্রে বর্ণমালা যাবে প্রতিটা ভূমিহীনেরও ঘরে, ভূমিহীনের কণ্ঠস্বরও ধ্বনিত হবে জাতীয় গণমাধ্যমে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক, সাংবাদিক।
বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের যে গভীর মমত্ববোধ, সেটা খুবই খাঁটি একটা জিনিস, বানিয়ে তোলা কিছু নয়। তথ্য মন্ত্রণালয়ের এই উদ্যোগও সেই আন্তরিক ভালোবাসা, বেদনা ও উদ্বেগেরই প্রকাশ। তবে ধমক দিয়ে, পরামর্শ দিয়ে বা কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দিয়ে সৎ উদ্দেশ্যও চরিতার্থ হবে কি না, এ বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
এ বিষয়ে গণমাধ্যমগুলোর নিজেকেই দায়িত্বশীল হতে হবে সবার আগে। গণমাধ্যমের কাজ কী— পাঠ্যপুস্তকে লেখা আছে—গণমাধ্যম তথ্য দেবে, বিনোদন দেবে, শিক্ষা দেবে, আর প্রেরণা জোগাবে। কাজেই শ্রোতা বা দর্শক বা পাঠককে সুশিক্ষা দেওয়া, উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করার দায় প্রতিটা গণমাধ্যমের ওপরে আপনাআপনিই বর্তায়। আর সেই দায়িত্ব গণমাধ্যমকে নিজের গরজে, নিজের দায়বোধ থেকেই করতে হয়। সরকার খবরদারি করে সেটা করতে পারবে বলে মনে হয় না। এটা সরকারের কাজও নয়। সৃষ্টিশীলতার কাজে সরকারের সব চেয়ে ভালো ভূমিকা হলো সবচেয়ে কম জড়িত হওয়া, কম হস্তক্ষেপ করা।
গণমাধ্যম তার নিজের ওপরে অর্পিত পাবলিক ট্রাস্টের দায় এড়াতে পারে না। আমাদের বেতারের উপস্থাপকেরা মান বাংলায় কথা বলতে জানবেন, প্রমিত কথ্যভাষা বলায় তাঁরা হয়ে উঠবেন একেকজন আদর্শ, এটা বেশ জোরের সঙ্গেই আমরা দাবি করতে পারি। এবিসি রেডিওতেও যথাসম্ভব প্রমিত বাংলা ব্যবহার করা হয় ও ইংরেজি শব্দ পরিহার করা হয়, কিন্তু তাতে এই বেতারটির জনপ্রিয়তা কমেনি, বরং খুবই অল্প সময়ের মধ্যে বেতারটি শ্রোতাদের মনে একটা স্থান অধিকার করে নিতে পেরেছে। প্রথম আলোরও সম্পাদকীয় নীতি হলো, ইংরেজি শব্দ পারতপক্ষে ব্যবহার না করা। কই, প্রথম আলোর জনপ্রিয়তা তো কমেনি, বরং প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। গণমাধ্যম কর্তৃপক্ষকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। যখন একজন উপস্থাপক নেওয়া হয়, তখন তাঁকে পরীক্ষার মাধ্যমে বাছাই করে নিশ্চিত হতে হবে যে, তিনি মান বাংলাটা সঠিকভাবে বলতে পারেন। একই কথা টেলিভিশন চ্যানেলের জন্যও প্রযোজ্য। অনেকগুলো অনুষ্ঠান, বিশেষ করে ব্যান্ডের গানের অনুষ্ঠানের উপস্থাপকেরা বাংলা বলেন, নাকি হিন্দি বলেন, নাকি ইংরেজি বলেন, বোঝা খুবই দুষ্কর। আর এত ইংরেজি শিরোনামের অনুষ্ঠানই বা কেন?
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তথ্য মন্ত্রণালয় বা সরকারের কোনো মন্ত্রণালয় এগুলোকে পাহারা দিয়ে রাখতে পারবে কি না? এটা তার কাজ কি না? কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়াটা মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে কি না! আমরা গণমাধ্যমের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতার পক্ষে এবং সরকারের ন্যূনতম হস্তক্ষেপেরও বিরুদ্ধে। আমেরিকা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ। ওই দেশের সংবাদমাধ্যমে কোনো ধরনের সরকারি হস্তক্ষেপ সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ। ইউনাইটেড স্টেটস ইনফরমেশন এজেন্সি প্রকাশিত আনফেটারড প্রেস গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘একটা সংবাদপত্রের অধিকার আছে ছিদ্রান্বেষী, দলীয় পক্ষপাতদুষ্ট, অথবা অসত্যবাদী, সংকীর্ণতাবাদী, অথবা যা খুশি তাই হওয়ার, যা তার বিবেক তাকে হতে বলে।’ (পৃষ্ঠা ৩৫)। আমেরিকায় একটা সংবাদমাধ্যম মিথ্যা কথা বলারও অধিকার রাখে। কেন তারা সংবাদমাধ্যমকে এই স্বাধীনতা দিয়েছে? না হলে সরকার খবরদারি করবে, বলবে তুমি মিথ্যা বলছ। সরকারি খবরদারির একটা অজুহাত তৈরি হবে মাত্র। সেটা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করবে। তার বদলে পাঠক সিদ্ধান্ত নিক, কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা। মিথ্যা কথা বলে কোনো সংবাদমাধ্যম শেষতক গ্রহণযোগ্যতা পায় না। তো এই অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে আমেরিকা কি তার রাষ্ট্রটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে? নাকি তারাই আজ পৃথিবীর এক নম্বর শক্তি হিসেবে টিকে আছে?
তার পরের প্রশ্ন হলো, কোনটা প্রমিত কোনটা প্রমিত নয়, এটা ঠিক করবে কে? ভাষা তো বহমান একটা জিনিস, এটা স্থির নয়। আজ যাকে প্রমিত বলছি, ১০০ বছর আগে সেটা প্রমিত ছিল না, ১০০ বছর পরেও থাকবে না। প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, ‘ভাষা মানুষের মুখ হতে কলমের মুখে আসে, কলমের মুখ হতে মানুষের মুখে নয়। উল্টোটা করতে গেলে মুখে শুধু কালি পড়ে।’ (প্রমথ চৌধুরী, কথার কথা, প্রবন্ধসংগ্রহ)। আমি লেখার সময় বাংলা একাডেমীর প্রমিত বানান অভিধান মেনে চলি, কিন্তু বাংলাদেশের বহু গুরুত্বপূর্ণ লেখক আছেন, যাঁরা ওই বানানরীতি মানেন না। তাঁদের কি আমরা বলতে পারব, আপনারা আইন লঙ্ঘন করছেন? বানানের ক্ষেত্রেই যদি আমরা বাংলা একাডেমীর প্রমিত বানান অভিধান সবাইকে মানতে বাধ্য করতে না পারি, তাহলে উচ্চারণের ক্ষেত্রে কীভাবে পারব? প্রমিত বাংলা নষ্ট হয়ে যাবে, এই ভয়ে কি আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের চরমপত্র পাঠ নিষিদ্ধ করে দেব? অথচ ওইটাই ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান! আমরা কি বেতারে কি টেলিভিশনে ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালি-লালন-হাসন প্রচার করব না! আমরা কি সাতই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ‘দাবায়া রাখতে পারবা না’ বাক্যটাকে সম্পাদিত করে ‘দাবিয়ে রাখতে পারবে না’ করতে বলব? অসম্ভব। আমরা কি টেলিভিশন নাটক নির্মাণের সময় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝির সংলাপ বা দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকের সংলাপ বদলে প্রমিত মান বাংলা করে দেব? আবার আমাদের সংবিধান লেখা সাধু ভাষায়, আমরা কি তাহলে সাধু ভাষাকে প্রমিত ভাষা ধরে নিয়ে বেতার-টেলিভিশনে সাধু ভাষা বাধ্যতামূলক করব? রবীন্দ্রনাথের একটা গল্প ‘ল্যাবরেটরি’ থেকে তিনটা বাক্য উদ্ধৃত করি, খেয়াল করে দেখুন তিনি কত ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেছেন, ‘নন্দনকিশোর ছিলেন লন্ডন য়ুনিভার্সিটি থেকে পাস করা এঞ্জিনিয়ার। যাকে সাধুভাষায় বলে দেদীপ্যমান ছাত্র, অর্থাত্ ব্রিলিয়ান্ট, তিনি ছিলেন তাই।...এসব দেনা-পাওনা নাকি কোম্পানি নামক একটা অ্যাব্স্ট্রাক্ট সত্তার সঙ্গে জড়িত...।’ এখন রবিবাবুর এই গল্পকে জগাখিচুড়ি ভাষা বলে আমরা বাতিলের খাতায় পাঠাতে পারব কি?
তাই বলি, প্রথমেই একটা সীমারেখা টানতে হবে। তা হলো, সৃজনশীল এলাকা আর আনুষ্ঠানিক এলাকা। শিল্পী-সাহিত্যিক-নাট্যকারেরা স্বাধীনভাবে লিখবেন। একটা বেতার বা টেলিভিশন বা সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় নীতি বলে দেবে, এটা তারা প্রকাশ বা প্রচার করতে পারবে কি না। যেমন হাসান আজিজুল হক একটা অপূর্ব উপন্যাস লিখেছেন আগুনপাখি নামে। এটা প্রথম আলোর বর্ষসেরা বইয়ের পুরস্কার পেয়েছে এই বাংলাদেশে, পশ্চিমবঙ্গে পেয়েছে আনন্দ পুরস্কার। বইটা লেখা হয়েছে রাঢ় অঞ্চলের কথ্য ভাষায়। ‘আমার মায়ের য্যাকন মিত্যু হলো আমার বয়েস ত্যাকন আট-ল’ বছর হবে। ভাইটোর বয়েস দেড়-দু বছর। এই দুই ভাই-বুনকে অকূলে ভাসিয়ে মা আমার চোখ বুজল। ত্যাকনকার দিনে কে যি কিসে মরত ধরবার বাগ ছিল না।’ পুরো বইটার বর্ণনা এই ভাষায়। এটাকে তো আপনি প্রমিত নয় বলে নিষিদ্ধ করে দিতে পারেন না।
আমরা কি টেলিভিশনে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, নূরলদীনের সারাজীবন বা হাতহদাই প্রচারে বাধা দেব? নাটকের সংলাপ হবে চরিত্রানুগ, সেটা দীনবন্ধু মিত্রও লিখেছেন, মধুসূদন দত্তও লিখেছেন, সেটা নিয়ে কোনো বিতর্ক কখনো ছিল না, আশা করি এখনো নাই। আবার সৃষ্টিশীল লেখক তাঁর বর্ণনার ভাষাও নিজের মতো করে তৈরি করে নিতে পারেন, আঞ্চলিক ভাষায় লিখতে পারেন—আইন করে সেটাকে ঠেকানোর কথা কেউ কল্পনাও করে না।
কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে যখন আমরা বেতারে বা টেলিভিশনে কথা বলব, শ্রেণীকক্ষে বা আলোচনা সভায় বক্তৃতা করব, আমরা তখন প্রমিত কথ্য ভাষা ব্যবহারের চেষ্টা করব ১০০ ভাগ। সেখানে যখন অন্যথা দেখি, আমরা আমাদের উদ্বেগের কথা নিশ্চয়ই জানাব। আমাদের কোনো পরামর্শ থাকলে সেটা দেবও। আমরা চাইব, আমাদের সংবাদপাঠকেরা প্রমিত বাংলায় খবর পরিবেশন করবেন। আমরা চাইব আমাদের আলোচনা অনুষ্ঠানগুলোর আলোচকেরা মান বাংলায় আলোচনা করবেন। কিন্তু সেটাও পাহারা দিয়ে রাখা মুশকিল। আমরা কি আমাদের জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পিকার আবদুল হামিদের সংসদে বলা উক্তিগুলো প্রচার করব না? নিশ্চয়ই করব। অসাধারণ দক্ষতায় তিনি সংসদ পরিচালনা করেন এবং তাঁর মুখের কথা শুনতে আমাদের ভালো লাগে।
বলতে চাচ্ছি, এটা অসম্ভব যে কোন বেতারে, কোন টেলিভিশনে, কোন সংবাদপত্রে দূষণীয় ভাষা পরিবেশিত হচ্ছে, সরকারের পক্ষে তা পাহারা দিয়ে রাখা, তা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা। এ ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমকেই যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। যে যত জনপ্রিয় হবে, তাকে তত বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। এমনকি শিল্পীরও দায়িত্ব আছে। দায়বদ্ধতা আছে। শিল্পী নিশ্চয়ই এ বিষয়ে সচেতন হবেন।
প্রমিত বাংলা আমাদের শিখতে হবে। আমরা শুদ্ধ বাংলা বলতে ও লিখতে পারার কষ্টটা স্বীকার করব না, এটা খুব কাজের কথা নয়। আমাদের স্কুলগুলোকে, আমাদের নাগরিকদেরকে এ ব্যাপারে দায়িত্ব পালন করতে হবে। পাশাপাশি এটাও বলি, আঞ্চলিক ভাষা বাংলা ভাষার শত্রু নয়, আঞ্চলিক ভাষা বাংলার প্রধান সম্পদ। এটাকে যেন আমরা অবহেলা না করি, আঞ্চলিক ভাষায় যাঁরা কথা বলেন, তাঁদের যেন আমরা হেয় না করি। আমাদের যেন আবার লিখতে না হয়, ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়।’ একুশের চেতনা মানে বহুস্বরের চেতনা, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের চেতনা আমাদের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর ভাষাগুলোকেও গুরুত্ব ও মর্যাদা দেওয়ার চেতনা। সংস্কৃতি মানে কেবল কেন্দ্রের বা মধ্যবিত্তের স্বর নয়, শাসক শ্রেণীর স্বর নয়; প্রান্তেরও স্বর, শত ফুল ফুটতে দেবার সাধনা, গরিব মানুষ, কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের কণ্ঠস্বরও যেন আমাদের শিল্প-সাহিত্য-গণমাধ্যমে স্থান পায়। আমরা যেন কথায় কথায় হাতে-পায়ে শেকল পরানোর ভুল চেষ্টা না করি।
বাংলা ভাষার প্রধান শত্রু কে? আমাদের আঞ্চলিক ভাষাগুলো মোটেও নয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ যে বিভিন্ন উপভাষায় কথা বলেন, সেসবের বদলে রাষ্ট্র একটা কেন্দ্র-নির্দেশিত ভাষা প্রবর্তন করবে, এই চিন্তার মতো স্বৈরাচারী ও একুশের চেতনাবিরোধী আর কিছুই হতে পারে না। বাংলা ভাষার প্রধান শত্রু বিশ্বায়নের চাপে মুক্তবাজারের খোলা দরজা-জানালা দিয়ে ঢুকে পড়া পণ্যবাদী সংস্কৃতির আগ্রাসন। সরকারের এসব ক্ষেত্রে করার আছে অনেক কিছু। একবার এই দেশে আইন করা হয়েছিল, অফিস-আদালত, দোকানের নামফলক বাংলায় লিখতে হবে। সাইনবোর্ডে বাংলা থাকতে হবে, এই আইনটা যদি থেকে থাকে, তাহলে সেটাকে পুরোপুরি কার্যকর করা হোক, যদি না থাকে, তাহলে এই আইন আবার চালু করতে হবে। বাংলা ভাষার আরেকটা বড় শত্রু অবশ্যই হিন্দি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো আর বাংলাদেশের চ্যানেল দেখে না। তথ্য মন্ত্রণালয় যদি সত্যি সত্যি বাংলা ভাষার জন্য একটা কিছু করতে চায়, তাহলে তার প্রথম কাজ হওয়া উচিত এই দেশে হিন্দি চ্যানেলের ওপরে বিধিনিষেধ আরোপ করা। এটা ভীষণ অজনপ্রিয় একটা পদক্ষেপ হবে, কারণ আমরা এই হিন্দি ধারাবাহিকগুলোতে মাদকের মতো নেশাসক্ত হয়ে পড়েছি। শিশুদের একটা হিন্দি চ্যানেলে হিন্দি কার্টুন দেখানো হয়, ওর দ্বারা শিশুরা বাংলা বলা ভুলে যাচ্ছে। এটা অবিলম্বে বন্ধ করে দেওয়া উচিত। আমাদের ভোগ্যপণ্যগুলোর মোড়কে বাংলা লেখা থাকা বাধ্যতামূলক করা যায়। আমাদের বিজ্ঞাপনচিত্রে ইংরেজির ব্যবহার সহজেই বন্ধ করে দেওয়া যায়। এসব পদক্ষেপ যদি তথ্য মন্ত্রণালয় গ্রহণ করে, বাংলা ভাষার ভীষণ উপকার হবে। অফিস-আদালতে বাংলা ব্যবহারের সাংবিধানিক অঙ্গীকার পালনে আন্তরিক হতে হবে সরকারকেই। প্রথম আলো ২০১০ একুশে সংখ্যায় মিশা হোসেন একটা চমত্কার প্রবন্ধ লিখেছেন, আজকে দেশের মানুষ ইংরেজি জানা ও ইংরেজি না জানা এ দুই শ্রেণীতে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। একুশের চেতনা হলো বৈষম্যহীনতা, রাষ্ট্রকে এই বৈষম্য বিলোপে কাজ করতে হবে। আমাদের ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়গুলোয় ভারতের ইতিহাস পড়ানো হয়, ব্রিটেনের ইতিহাস পড়ানো হয়, তাদের বাংলার ইতিহাস পড়াতে হবে। সেসব না করে রাষ্ট্র যদি বহু মানুষের কণ্ঠস্বরকে সংস্কৃতিতে আসতে বাধা দেয়, তা হবে পণ্ডশ্রম, তা আমাদের মনে করিয়ে দেয় শহীদ কাদরীর কবিতা, ‘রাষ্ট্র মানেই লেফ্ট রাইট লেফ্ট রাইট।’ একুশের চেতনা এ রকম লেফট রাইট মার্কা রাষ্ট্র নয়, একটা বৈষম্যহীন উদার অসাম্প্রদায়িক সুখী আলোকিত মুক্ত রাষ্ট্র—যে রাষ্ট্রে বর্ণমালা যাবে প্রতিটা ভূমিহীনেরও ঘরে, ভূমিহীনের কণ্ঠস্বরও ধ্বনিত হবে জাতীয় গণমাধ্যমে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক, সাংবাদিক।
No comments