বানু আপা by ফরিদা বানু |
ডা. আয়শা আখতার মুনিম, আমাদের অতি প্রিয় বানু আপা একেবারে হঠাত্ই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আট বছর আগে ঠিক একইভাবে চলে গিয়েছেন তাঁর স্বামী অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আব্দুল মুনেম। আমি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
১৯৫৭ সালে বানু আপার সঙ্গে প্রথম পরিচয়। আমরা দুই বোন আইএসসি পাস করে উইমেন্স হলে (বর্তমান রোকেয়া হল) ঢুকেছি। কিছু দিন পরই বানু আপা রাজশাহী থেকে এসে ভর্তি হলেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে পার্ট ওয়ানে। আমরা গভীর শ্রদ্ধায় তাঁকে দূর থেকে দেখতাম। রাজশাহী কলেজে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সে তিনি ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছেন। সেই যুগে পড়াশোনায় ভালো ছাত্রছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবার কৌতূহল ও মনোযোগের কেন্দ্র হয়ে উঠত। তা ছাড়া লম্বা, সুশ্রী, উন্নত শির বানু আপা দূর থেকেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। সাদা শাড়ি, মাথায় একটু ঘোমটা, সুন্দর চেহারার বানু আপা পরবর্তীকালে খুব একটা বদলাননি। বিশ্ববিদ্যালয় ও হলজীবনের স্মৃতি আমাদের জীবনে—হয়তো বা বানু আপার জীবনেরও—এক সুমধুর মূল্যবান অধ্যায়। প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী কার্জন হলে সুপ্রশস্ত লম্বা বারান্দা, লেকচার থিয়েটার, প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাস আর শিক্ষকদের বক্তব্যের স্মৃতি কখনো ভোলার নয়। ক্লাসের পর হলে ফিরেও আমরা ক্লান্ত হতাম না। শীতকালে ব্যাডমিন্টন খেলা হতো। অন্য সময় মাঠে ঘাসের ওপর গোল হয়ে বসে আড্ডা চলত। এসব আড্ডায় প্রায়ই হতো বানু আপা ও রোজী আপার (অধ্যাপক রাজিয়া বেগম, সাবেক প্রিন্সিপাল, ইডেন কলেজ) গান। ১৯৯৬ সালে রোজী আপা আর ২০০৪ সালে সেলিনা আপা (অধ্যাপক সেলিনা বাহার জামান) ইহকাল ছেড়ে চলে গেছেন পরপারে। সেলিনা আপা যদিও হলে ছিলেন না, কিন্তু কার্জন হলের কমন রুমের মধ্যমণি ছিলেন তিনি। আজ বানু আপার কথা বলতে গিয়ে রোজী আপা ও সেলিনা আপাকে বড় বেশি মনে পড়ছে।
আমাদের সময় হলজীবন কেমন ছিল তা এই যুগের ছেলেমেয়েরা কল্পনাও কতে পারবে না। হলের ভিপি প্রতিভা মুত্সুদ্দি আমাদের জোর করে বাধ্য করতেন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে। কার্জন হলে উইমেন্স হলের বার্ষিক নাটক মঞ্চস্থ হলো—শরত্চন্দ্রের বিজয়া। কেউ কি মনে রেখেছেন ‘নরেন’ চরিত্রে বানু আপার অভিনয়ের কথা? আমার চোখে এখনো স্পষ্ট ভাসে, দীর্ঘ সুঠাম দেহ, প্রায় পুরুষ মানুষের সমান লম্বা, ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বানু আপাকে নরেনের চরিত্রে কী চমত্কার মানিয়েছিল! ফাইনাল ইয়ারে ওঠার পর বানু আপা হল ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছিলেন অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে। আমরা তাঁর একান্ত অনুগত সহকারী ছিলাম।
বানু আপা এমএসসি পাস করে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যাওয়ার পর অনেক দিন আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল না। তবে তাঁর খবর সব সময় রাখতে চেষ্টা করতাম। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে লন্ডনে গিয়ে ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে পিএইচডি করেন। পশ্চিম পাকিস্তানে ডিফেন্স সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে চাকরি করেন কিছুদিন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকায় ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে যোগদান করেন। ইতিমধ্যে তিনি একে একে চার সুযোগ্য কন্যার মা হয়েছেন এবং সংসারে নানা দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছেন।
বানু আপা অতি শান্ত, স্নিগ্ধ স্বভাবের মানুষ ছিলেন। তাঁকে কখনো রাগ করে মাথা গরম করতে দেখিনি। বেশ অন্তর্মুখী, প্রচারবিমুখ মানুষ ছিলেন। নিজেকে কখনো জাহির করতেন না। আমার অনেক সময় মনে হয়েছে, তিনি তাঁর ন্যায্য দাবিও নিজের মুখে অন্যের কাছে তুলে ধরতে পারতেন না। দূর থেকে তাঁকে খুব গম্ভীর, রিজার্ভ মনে হলেও যারা তাঁর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছে, তারা তাঁর চরিত্রে মাধুর্যের পরিচয় পেয়েছে। কখনো তাঁকে অন্য মানুষের নিন্দা করতে শুনিনি। সাধারণ আনন্দ-উত্সবে সব সময় তাঁকে আমাদের মধ্যে না পেলেও, ১৪ ডিসেম্বর আমার ভাই শহীদ গিয়াসউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুবার্ষিকীতে তিনি প্রতিবছর উপস্থিত থাকতেন। এবার থেকে তাঁর অনুপস্থিতি আমাদের ভীষণ কষ্ট দেবে।
গত কয়েক বছর নানা উপলক্ষে আমাদের প্রায়ই দেখা হয়েছে। ২০০০-০৩ সালে আমরা একসঙ্গে ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েসনের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যরূপে কাজ করেছি। প্রতিটি মিটিংয়ে উপস্থিত থেকে তিনি বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন। গত বছর আমরা একসঙ্গে সাভারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হাউজিং সোসাইটির বার্ষিক সভায় গিয়েছি। তাঁর সান্নিধ্যে সময়টা কী সুন্দর কেটেছে! তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা হওয়ার স্মৃতি আমাকে ভীষণ কষ্ট দেয়। এক মাসও হয়নি, আমরা দুজন সন্ধ্যার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে গিয়ে হাউজিং সোসাইটির জমির নমিনেশন ফর্ম পূরণ করে এলাম। ফেরার পথে আমার বাসায় চা খেতে খেতে কত যে গল্প করলেন! অনেক দিন তাঁর এত গল্প শুনিনি। নিজের প্রয়াত স্বামী, মেয়ে, নাতি-নাতনিদের কথা, শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদ সবার গল্প করলেন। যাওয়ার সময় বললেন, ‘তোমার সঙ্গে গল্প করে খুব ভালো লাগছে।’ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে একাকিত্ববোধে আক্রান্ত হব আমরা সবাই। তরুণ বয়সের মধুর স্মৃতি তর্পণ করে সময় কাটবে হয়তো। রোজী আপা, সেলিনা আপা চলে গেছেন একে একে। একইভাবে কাউকে কোনো কষ্ট না দিয়ে বানু আপাও চলে গেলেন সৃষ্টিকর্তার অমোঘ নিয়মে। আমিও শেষ দিনের অপেক্ষায় আছি। মনে মনে ভাবি, জীবনে চলার পথে এমন কিছু মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি, যাঁদের সংস্পর্শে নিজের জীবন সার্থক হলো। তাঁদের প্রতি নিবেদন করি আমার একান্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
১৯৫৭ সালে বানু আপার সঙ্গে প্রথম পরিচয়। আমরা দুই বোন আইএসসি পাস করে উইমেন্স হলে (বর্তমান রোকেয়া হল) ঢুকেছি। কিছু দিন পরই বানু আপা রাজশাহী থেকে এসে ভর্তি হলেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে পার্ট ওয়ানে। আমরা গভীর শ্রদ্ধায় তাঁকে দূর থেকে দেখতাম। রাজশাহী কলেজে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সে তিনি ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছেন। সেই যুগে পড়াশোনায় ভালো ছাত্রছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবার কৌতূহল ও মনোযোগের কেন্দ্র হয়ে উঠত। তা ছাড়া লম্বা, সুশ্রী, উন্নত শির বানু আপা দূর থেকেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। সাদা শাড়ি, মাথায় একটু ঘোমটা, সুন্দর চেহারার বানু আপা পরবর্তীকালে খুব একটা বদলাননি। বিশ্ববিদ্যালয় ও হলজীবনের স্মৃতি আমাদের জীবনে—হয়তো বা বানু আপার জীবনেরও—এক সুমধুর মূল্যবান অধ্যায়। প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী কার্জন হলে সুপ্রশস্ত লম্বা বারান্দা, লেকচার থিয়েটার, প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাস আর শিক্ষকদের বক্তব্যের স্মৃতি কখনো ভোলার নয়। ক্লাসের পর হলে ফিরেও আমরা ক্লান্ত হতাম না। শীতকালে ব্যাডমিন্টন খেলা হতো। অন্য সময় মাঠে ঘাসের ওপর গোল হয়ে বসে আড্ডা চলত। এসব আড্ডায় প্রায়ই হতো বানু আপা ও রোজী আপার (অধ্যাপক রাজিয়া বেগম, সাবেক প্রিন্সিপাল, ইডেন কলেজ) গান। ১৯৯৬ সালে রোজী আপা আর ২০০৪ সালে সেলিনা আপা (অধ্যাপক সেলিনা বাহার জামান) ইহকাল ছেড়ে চলে গেছেন পরপারে। সেলিনা আপা যদিও হলে ছিলেন না, কিন্তু কার্জন হলের কমন রুমের মধ্যমণি ছিলেন তিনি। আজ বানু আপার কথা বলতে গিয়ে রোজী আপা ও সেলিনা আপাকে বড় বেশি মনে পড়ছে।
আমাদের সময় হলজীবন কেমন ছিল তা এই যুগের ছেলেমেয়েরা কল্পনাও কতে পারবে না। হলের ভিপি প্রতিভা মুত্সুদ্দি আমাদের জোর করে বাধ্য করতেন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে। কার্জন হলে উইমেন্স হলের বার্ষিক নাটক মঞ্চস্থ হলো—শরত্চন্দ্রের বিজয়া। কেউ কি মনে রেখেছেন ‘নরেন’ চরিত্রে বানু আপার অভিনয়ের কথা? আমার চোখে এখনো স্পষ্ট ভাসে, দীর্ঘ সুঠাম দেহ, প্রায় পুরুষ মানুষের সমান লম্বা, ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বানু আপাকে নরেনের চরিত্রে কী চমত্কার মানিয়েছিল! ফাইনাল ইয়ারে ওঠার পর বানু আপা হল ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছিলেন অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে। আমরা তাঁর একান্ত অনুগত সহকারী ছিলাম।
বানু আপা এমএসসি পাস করে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যাওয়ার পর অনেক দিন আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল না। তবে তাঁর খবর সব সময় রাখতে চেষ্টা করতাম। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে লন্ডনে গিয়ে ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে পিএইচডি করেন। পশ্চিম পাকিস্তানে ডিফেন্স সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে চাকরি করেন কিছুদিন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকায় ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে যোগদান করেন। ইতিমধ্যে তিনি একে একে চার সুযোগ্য কন্যার মা হয়েছেন এবং সংসারে নানা দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছেন।
বানু আপা অতি শান্ত, স্নিগ্ধ স্বভাবের মানুষ ছিলেন। তাঁকে কখনো রাগ করে মাথা গরম করতে দেখিনি। বেশ অন্তর্মুখী, প্রচারবিমুখ মানুষ ছিলেন। নিজেকে কখনো জাহির করতেন না। আমার অনেক সময় মনে হয়েছে, তিনি তাঁর ন্যায্য দাবিও নিজের মুখে অন্যের কাছে তুলে ধরতে পারতেন না। দূর থেকে তাঁকে খুব গম্ভীর, রিজার্ভ মনে হলেও যারা তাঁর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছে, তারা তাঁর চরিত্রে মাধুর্যের পরিচয় পেয়েছে। কখনো তাঁকে অন্য মানুষের নিন্দা করতে শুনিনি। সাধারণ আনন্দ-উত্সবে সব সময় তাঁকে আমাদের মধ্যে না পেলেও, ১৪ ডিসেম্বর আমার ভাই শহীদ গিয়াসউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুবার্ষিকীতে তিনি প্রতিবছর উপস্থিত থাকতেন। এবার থেকে তাঁর অনুপস্থিতি আমাদের ভীষণ কষ্ট দেবে।
গত কয়েক বছর নানা উপলক্ষে আমাদের প্রায়ই দেখা হয়েছে। ২০০০-০৩ সালে আমরা একসঙ্গে ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েসনের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যরূপে কাজ করেছি। প্রতিটি মিটিংয়ে উপস্থিত থেকে তিনি বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন। গত বছর আমরা একসঙ্গে সাভারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হাউজিং সোসাইটির বার্ষিক সভায় গিয়েছি। তাঁর সান্নিধ্যে সময়টা কী সুন্দর কেটেছে! তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা হওয়ার স্মৃতি আমাকে ভীষণ কষ্ট দেয়। এক মাসও হয়নি, আমরা দুজন সন্ধ্যার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে গিয়ে হাউজিং সোসাইটির জমির নমিনেশন ফর্ম পূরণ করে এলাম। ফেরার পথে আমার বাসায় চা খেতে খেতে কত যে গল্প করলেন! অনেক দিন তাঁর এত গল্প শুনিনি। নিজের প্রয়াত স্বামী, মেয়ে, নাতি-নাতনিদের কথা, শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদ সবার গল্প করলেন। যাওয়ার সময় বললেন, ‘তোমার সঙ্গে গল্প করে খুব ভালো লাগছে।’ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে একাকিত্ববোধে আক্রান্ত হব আমরা সবাই। তরুণ বয়সের মধুর স্মৃতি তর্পণ করে সময় কাটবে হয়তো। রোজী আপা, সেলিনা আপা চলে গেছেন একে একে। একইভাবে কাউকে কোনো কষ্ট না দিয়ে বানু আপাও চলে গেলেন সৃষ্টিকর্তার অমোঘ নিয়মে। আমিও শেষ দিনের অপেক্ষায় আছি। মনে মনে ভাবি, জীবনে চলার পথে এমন কিছু মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি, যাঁদের সংস্পর্শে নিজের জীবন সার্থক হলো। তাঁদের প্রতি নিবেদন করি আমার একান্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
No comments