সুশাসন -সরকারি খাতের সংস্কার ও স্থানীয় সরকার by এ এম এম শওকত আলী
১৯৯৭ সালে একটি আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত এক সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের চাকরিসংক্রান্ত কাঠামোর বিষয়টি আলোচনা করা হয়েছিল। যদিও এ সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশের চাকরি কাঠামো, কিন্তু এর সঙ্গে সংগতভাবেই জড়িয়ে যায় স্থানীয় সরকারের কাঠামো। কারণ, বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরকারি চাকরিজীবীরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে একই ধারা দৃশ্যমান। এ নিয়ে বিতর্কও রয়েছে ব্যাপক। বাংলাদেশে এ বিতর্ক ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। এ বিতর্কে দুটি পরস্পরবিরোধী মতবাদের ধারা বিদ্যমান। এক. স্থানীয় সরকারকে স্বশাসিত করার লক্ষে শাসনব্যবস্থার আওতাভুক্ত সব ধরনের কাজ স্থানীয় সরকারকে অর্পণ করতে হবে এবং এ জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার। এ জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো কর্তৃত্বই কাম্য নয়। দুই. স্থানীয় সরকারকে উপযুক্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের লক্ষে সংসদের একটি আইনের মাধ্যমে ক্ষমতা দেওয়া আশু প্রয়োজন। তিন. কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে, কেন্দ্রীয় সরকারের মোট বাজেটের অন্তত শতকরা ৪০ ভাগ সরাসরি স্থানীয় সরকারকে দিতে হবে।
এ বিষয়ে ভিন্নমত হলো, সংসদই আইন দিয়ে নির্ধারণ করে দেবে স্থানীয় পর্যায়ের কী কী বিষয় এবং কতটুকু ক্ষমতা দেওয়া হবে। সব কাজ স্থানীয় সরকারকে দেওয়া সম্ভব বা সংগত নয়। স্থানীয় সরকার রাষ্ট্রেরই একটি অংশ। একে একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হিসেবে দেখার কোনো যুক্তি নেই। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে পরিচালিত কিছু কাজ দেশব্যাপী বিস্তৃত বিধায় এসব কাজকে খণ্ডিত করার কোনো যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। এসব কাজের প্রধান ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে বিদ্যুত্, খনিজ সম্পদ আহরণ ও ব্যবহার, বৃহত্ সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের অবকাঠামো, বিচার বিভাগ, অপরাধ দমন ও আইনের প্রয়োগসহ অন্যান্য নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা যা জনস্বার্থে অপরিহার্য। এ ছাড়া রয়েছে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন কাজ পরিচালনার কাঠামোগত দুর্বলতা, যার কারণে সব কাজই এদের দিয়ে সুচারুরূপে পরিচালনা করা সম্ভব নয়।
কেন্দ্রীয় বাজেটের নির্দিষ্ট একাংশ স্থানীয় সরকারকে দেওয়ার বিষয়ে অনেকেই বলেন, একাধিক কারণে এটা দেওয়া সম্ভব নয়। এক. ওই পর্যায়ে দুর্নীতি ও অপচয়। দুই. স্থানীয় সম্পদ আহরণে স্থানীয় সরকারের দুর্বলতা। এতে নির্বাচিত স্থানীয় সরকারকে দেওয়া হলে এ প্রতিষ্ঠানগুলো সব সময়ই সরকার মুখাপেক্ষী বা নির্ভরশীল হবে। এ জন্য বিশ্বের অনেক দেশেই স্থানীয় সম্পদ আহরণের জন্য স্থানীয় সরকারকে উত্সাহিত করার একটি পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। এ পদ্ধতি বাংলাদেশেও পাকিস্তান আমল থেকে চালু করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ইউনিয়ন পরিষদকে মোট স্থানীয় করের ন্যূনতম শতকরা ২৫ ভাগ আদায় করতে হবে। এ লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলে ওই সব ইউনিয়ন পরিষদ সরকারি কোনো অনুদান লাভের যোগ্য হবে না। কিন্তু মূলত রাজনৈতিক কারণে এটা প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি।
একই পদ্ধতি ইএনডিপি কয়েক বছর আগে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করে। এ অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী সময়ে ২০০৬-০৭ সালে বিশ্বব্যাংক দেশব্যাপী পর্যায়ক্রমে এ প্রথা চালু করে। সরকারি ও দাতা সংস্থার অনুদানপ্রাপ্তি এদের জন্য একটি নির্দিষ্ট ছকে মূল্যায়ন করার পরই নির্ধারিত অনুদান দেওয়ার প্রথা চালু হয়। এ প্রকল্পের মোট বিনিয়োগ ছিল এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের আওতায় নির্দিষ্ট ছকে ছিল কার্যাবলি প্রণয়নে স্বচ্ছতাসহ কর আদায় ও উন্নয়ন কার্যাবলি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে জনসম্পৃক্ততা। এ প্রকল্পের আওতায় ২০০৭ সালে অনুদান সরাসরি দেওয়ার বিষয় সম্পর্কেও তত্কালীন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন। এ প্রকল্পের মূল্যায়নের পরই পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া সংগত হবে।
কেন্দ্রীয় সরকারের সব কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে ১৯৮৪-৮৫ সালে উপজেলা প্রথা চালু করার পর একটি ভারসাম্যমূলক নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর প্রবর্তন করা হয়েছিল। সে কাঠামো প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু হোঁচট খেলেও পরবর্তী সমেয় অনেকটা সঠিকভাবে কাজ করে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পঞ্চায়েত প্রথা অনেক গবেষকের মতে সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত নয়। এ প্রথার আইনি ও নির্বাহী নিয়ন্ত্রণ রাজ্য সরকারের; কেন্দ্রীয় সরকারের নয়। একেক রাজ্যের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাপর মধ্যে পার্থক্যও বিদ্যমান। কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থায় সরকারি চাকরিজীবীদের অনেক ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিত কিছুটা ভিন্নতর। কারণ বাংলাদেশ একটি একক রাষ্ট্র, যাতে কোনো রাজ্য নেই। অনেকটা যুক্তরাজ্যের অনুরূপ। ওই রাষ্ট্রের স্থানীয় সরকারব্যবস্থার যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। তবে এতে কোনো সরকারি কর্মকর্তা যুক্ত নন। বলা হয়ে থাকে, যুক্তরাজ্যেও স্থানীয় সরকার কাঠামোর যথেষ্ট ক্ষমতা। তবে নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য ওই রাষ্ট্রে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা বিদ্যমান। ১৯৯৭ সালে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে গবেষকেরা এ কথাই বলেছেন।
যুক্তরাজ্যের স্থানীয় সরকারব্যবস্থার ক্ষমতার কাঠামো ও পরিধি ওই দেশের সংসদ আইন দ্বারা নির্ধারণ করে, যা বাংলাদেশের অনুরূপ। এ আইন ‘আইনবহির্ভূত (টষঃত্ধ ারত্বং)’ নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। ওই দেশের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, যে ক্ষমতা আইনের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারকে দেওয়া হয়, সে ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকার সংসদের মাধ্যমে রহিতও করে। পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য দেশের প্রথায় এ বিষয়টি স্বীকৃত নয় যে স্থানীয় সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতার ঊর্ধ্বে অবস্থান করবে। ওই সব দেশে এ বিষয়টি স্বীকৃত যে স্থানীয় সরকারের সম্পদ সীমিত এবং প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা ও দক্ষতাও সীমিত। এ কারণে সব কাজই তারা করতে সক্ষম নয়। তবে নিজস্ব ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার নিজেরাই সিদ্ধান্ত গ্রহণে ক্ষমতাবান। জার্মানির কেন্দ্রীয় সরকার প্রকৃত পক্ষে স্থানীয় সরকারকে কিছু কাজ সম্পাদনের বিষয়টি আইনের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করে থাকে।
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারের ক্ষমতার পরিধির বর্তমান বিতর্কের মূল উত্স এ সরকারের ওপর স্থানীয় সাংসদদের নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামো। এ ধরনের নিয়ন্ত্রণ বিশ্বের কোনো দেশেই নেই। এমনকি ভারতেও এ ধরনের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশে কেন হলো, তা বলা নিষ্প্রয়োজন। সবাই নির্বাহী ক্ষমতালিপ্সু। সরকারি দলের নেতারা যদিও এ প্রথাকে সমর্থন করেন এই যুক্তি দিয়ে যে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার জন্যই এটা করা হয়েছে। প্রকৃত অর্থে এতে ক্ষমতার ভারসাম্যই ধ্বংস করা হয়েছে। মাঠপর্যায়ে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব তীব্র আকার ধারণ করেছে। এতে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন জনকল্যাণমুখী কার্যাবলি সম্পাদনে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে। ভোগান্তি হচ্ছে জনগণের, গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর।
ইতিমধ্যে সাংসদদের কর্তৃত্ব রহিত করার জন্য হাইকোর্টে রিট দাখিল করা হয়েছে। বিজ্ঞ আদালত সরকারকে কারণ দর্শানোর নির্দেশ এই মর্মে দিয়েছেন, কেন এ কর্তৃত্ব বিলুপ্ত করা হবে না। এ ধরনের ঘটনা যে ঘটবে, তার কিছু আভাস উপজেলা-সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ আইন সংসদের অনুমোদনপ্রাপ্তির পরই দৃশ্যমান ছিল। ওই সময়ে কিছু সংক্ষুব্ধ উপজেলা চেয়ারম্যান এ ধরনের হুমকি দিয়েছিলেন। যা ঘটার তা-ই ঘটেছে। হাইকোর্টের রায় চূড়ান্ত হওয়ার পর বোঝা যাবে, প্রকৃত অবস্থা কী? অনুমান করা যায়, রায় সরকারের বিরুদ্ধে গেলে সরকার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দ্বারস্থ হবে। হওয়াই স্বাভাবিক। তখন আসবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়।
এ বিষয়ে উল্লেখ করা প্রয়োজন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে উপজেলা-সংক্রান্ত অধ্যাদেশে সাংসদদের কোনো কর্তৃত্বই দেওয়া হয়নি। নির্বাচিত সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে সৃষ্ট হয়েছে অনেক জটিলতা। এ জটিলতার কারণে আইনের দ্বারা সৃষ্ট শক্তিশালী স্থানীয় সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রচেষ্টা অনেকটা বিফল হবে। এ বিষয়ে আরও জটিলতা বিদ্যমান। এক. ইউনিয়ন পরিষদের ওপর উপজেলা পরিষদের কর্তৃত্ব। দুই. উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে পূর্ববর্তী অধ্যাদেশের প্রথা পরিহার করে পরিষদের অংশ হিসেবে বর্তমান আইনে বিধান সন্নিবেশ করা হয়েছে।
এ এম এম শওকত আলী: তত্ত্বাবাধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।
এ বিষয়ে ভিন্নমত হলো, সংসদই আইন দিয়ে নির্ধারণ করে দেবে স্থানীয় পর্যায়ের কী কী বিষয় এবং কতটুকু ক্ষমতা দেওয়া হবে। সব কাজ স্থানীয় সরকারকে দেওয়া সম্ভব বা সংগত নয়। স্থানীয় সরকার রাষ্ট্রেরই একটি অংশ। একে একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হিসেবে দেখার কোনো যুক্তি নেই। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে পরিচালিত কিছু কাজ দেশব্যাপী বিস্তৃত বিধায় এসব কাজকে খণ্ডিত করার কোনো যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। এসব কাজের প্রধান ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে বিদ্যুত্, খনিজ সম্পদ আহরণ ও ব্যবহার, বৃহত্ সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের অবকাঠামো, বিচার বিভাগ, অপরাধ দমন ও আইনের প্রয়োগসহ অন্যান্য নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা যা জনস্বার্থে অপরিহার্য। এ ছাড়া রয়েছে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন কাজ পরিচালনার কাঠামোগত দুর্বলতা, যার কারণে সব কাজই এদের দিয়ে সুচারুরূপে পরিচালনা করা সম্ভব নয়।
কেন্দ্রীয় বাজেটের নির্দিষ্ট একাংশ স্থানীয় সরকারকে দেওয়ার বিষয়ে অনেকেই বলেন, একাধিক কারণে এটা দেওয়া সম্ভব নয়। এক. ওই পর্যায়ে দুর্নীতি ও অপচয়। দুই. স্থানীয় সম্পদ আহরণে স্থানীয় সরকারের দুর্বলতা। এতে নির্বাচিত স্থানীয় সরকারকে দেওয়া হলে এ প্রতিষ্ঠানগুলো সব সময়ই সরকার মুখাপেক্ষী বা নির্ভরশীল হবে। এ জন্য বিশ্বের অনেক দেশেই স্থানীয় সম্পদ আহরণের জন্য স্থানীয় সরকারকে উত্সাহিত করার একটি পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। এ পদ্ধতি বাংলাদেশেও পাকিস্তান আমল থেকে চালু করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ইউনিয়ন পরিষদকে মোট স্থানীয় করের ন্যূনতম শতকরা ২৫ ভাগ আদায় করতে হবে। এ লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলে ওই সব ইউনিয়ন পরিষদ সরকারি কোনো অনুদান লাভের যোগ্য হবে না। কিন্তু মূলত রাজনৈতিক কারণে এটা প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি।
একই পদ্ধতি ইএনডিপি কয়েক বছর আগে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করে। এ অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী সময়ে ২০০৬-০৭ সালে বিশ্বব্যাংক দেশব্যাপী পর্যায়ক্রমে এ প্রথা চালু করে। সরকারি ও দাতা সংস্থার অনুদানপ্রাপ্তি এদের জন্য একটি নির্দিষ্ট ছকে মূল্যায়ন করার পরই নির্ধারিত অনুদান দেওয়ার প্রথা চালু হয়। এ প্রকল্পের মোট বিনিয়োগ ছিল এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের আওতায় নির্দিষ্ট ছকে ছিল কার্যাবলি প্রণয়নে স্বচ্ছতাসহ কর আদায় ও উন্নয়ন কার্যাবলি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে জনসম্পৃক্ততা। এ প্রকল্পের আওতায় ২০০৭ সালে অনুদান সরাসরি দেওয়ার বিষয় সম্পর্কেও তত্কালীন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন। এ প্রকল্পের মূল্যায়নের পরই পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া সংগত হবে।
কেন্দ্রীয় সরকারের সব কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে ১৯৮৪-৮৫ সালে উপজেলা প্রথা চালু করার পর একটি ভারসাম্যমূলক নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর প্রবর্তন করা হয়েছিল। সে কাঠামো প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু হোঁচট খেলেও পরবর্তী সমেয় অনেকটা সঠিকভাবে কাজ করে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পঞ্চায়েত প্রথা অনেক গবেষকের মতে সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত নয়। এ প্রথার আইনি ও নির্বাহী নিয়ন্ত্রণ রাজ্য সরকারের; কেন্দ্রীয় সরকারের নয়। একেক রাজ্যের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাপর মধ্যে পার্থক্যও বিদ্যমান। কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থায় সরকারি চাকরিজীবীদের অনেক ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিত কিছুটা ভিন্নতর। কারণ বাংলাদেশ একটি একক রাষ্ট্র, যাতে কোনো রাজ্য নেই। অনেকটা যুক্তরাজ্যের অনুরূপ। ওই রাষ্ট্রের স্থানীয় সরকারব্যবস্থার যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। তবে এতে কোনো সরকারি কর্মকর্তা যুক্ত নন। বলা হয়ে থাকে, যুক্তরাজ্যেও স্থানীয় সরকার কাঠামোর যথেষ্ট ক্ষমতা। তবে নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য ওই রাষ্ট্রে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা বিদ্যমান। ১৯৯৭ সালে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে গবেষকেরা এ কথাই বলেছেন।
যুক্তরাজ্যের স্থানীয় সরকারব্যবস্থার ক্ষমতার কাঠামো ও পরিধি ওই দেশের সংসদ আইন দ্বারা নির্ধারণ করে, যা বাংলাদেশের অনুরূপ। এ আইন ‘আইনবহির্ভূত (টষঃত্ধ ারত্বং)’ নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। ওই দেশের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, যে ক্ষমতা আইনের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারকে দেওয়া হয়, সে ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকার সংসদের মাধ্যমে রহিতও করে। পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য দেশের প্রথায় এ বিষয়টি স্বীকৃত নয় যে স্থানীয় সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতার ঊর্ধ্বে অবস্থান করবে। ওই সব দেশে এ বিষয়টি স্বীকৃত যে স্থানীয় সরকারের সম্পদ সীমিত এবং প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা ও দক্ষতাও সীমিত। এ কারণে সব কাজই তারা করতে সক্ষম নয়। তবে নিজস্ব ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার নিজেরাই সিদ্ধান্ত গ্রহণে ক্ষমতাবান। জার্মানির কেন্দ্রীয় সরকার প্রকৃত পক্ষে স্থানীয় সরকারকে কিছু কাজ সম্পাদনের বিষয়টি আইনের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করে থাকে।
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারের ক্ষমতার পরিধির বর্তমান বিতর্কের মূল উত্স এ সরকারের ওপর স্থানীয় সাংসদদের নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামো। এ ধরনের নিয়ন্ত্রণ বিশ্বের কোনো দেশেই নেই। এমনকি ভারতেও এ ধরনের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশে কেন হলো, তা বলা নিষ্প্রয়োজন। সবাই নির্বাহী ক্ষমতালিপ্সু। সরকারি দলের নেতারা যদিও এ প্রথাকে সমর্থন করেন এই যুক্তি দিয়ে যে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার জন্যই এটা করা হয়েছে। প্রকৃত অর্থে এতে ক্ষমতার ভারসাম্যই ধ্বংস করা হয়েছে। মাঠপর্যায়ে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব তীব্র আকার ধারণ করেছে। এতে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন জনকল্যাণমুখী কার্যাবলি সম্পাদনে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে। ভোগান্তি হচ্ছে জনগণের, গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর।
ইতিমধ্যে সাংসদদের কর্তৃত্ব রহিত করার জন্য হাইকোর্টে রিট দাখিল করা হয়েছে। বিজ্ঞ আদালত সরকারকে কারণ দর্শানোর নির্দেশ এই মর্মে দিয়েছেন, কেন এ কর্তৃত্ব বিলুপ্ত করা হবে না। এ ধরনের ঘটনা যে ঘটবে, তার কিছু আভাস উপজেলা-সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ আইন সংসদের অনুমোদনপ্রাপ্তির পরই দৃশ্যমান ছিল। ওই সময়ে কিছু সংক্ষুব্ধ উপজেলা চেয়ারম্যান এ ধরনের হুমকি দিয়েছিলেন। যা ঘটার তা-ই ঘটেছে। হাইকোর্টের রায় চূড়ান্ত হওয়ার পর বোঝা যাবে, প্রকৃত অবস্থা কী? অনুমান করা যায়, রায় সরকারের বিরুদ্ধে গেলে সরকার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দ্বারস্থ হবে। হওয়াই স্বাভাবিক। তখন আসবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়।
এ বিষয়ে উল্লেখ করা প্রয়োজন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে উপজেলা-সংক্রান্ত অধ্যাদেশে সাংসদদের কোনো কর্তৃত্বই দেওয়া হয়নি। নির্বাচিত সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে সৃষ্ট হয়েছে অনেক জটিলতা। এ জটিলতার কারণে আইনের দ্বারা সৃষ্ট শক্তিশালী স্থানীয় সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রচেষ্টা অনেকটা বিফল হবে। এ বিষয়ে আরও জটিলতা বিদ্যমান। এক. ইউনিয়ন পরিষদের ওপর উপজেলা পরিষদের কর্তৃত্ব। দুই. উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে পূর্ববর্তী অধ্যাদেশের প্রথা পরিহার করে পরিষদের অংশ হিসেবে বর্তমান আইনে বিধান সন্নিবেশ করা হয়েছে।
এ এম এম শওকত আলী: তত্ত্বাবাধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।
No comments