প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি -কয়েকটি বিষয়ে প্রশ্ন by এমাজউদ্দীন আহমদ
২০০৯ সালের জাতীয় শিক্ষানীতির খসড়া হাতে এসেছে। ৯০ পৃষ্ঠার খসড়ায় চোখ বুলিয়েছি। খুশি হয়েছি এই দেখে যে, এতে বেশ কয়েকটি প্রস্তাব রয়েছে, যা সময়োপযোগী। প্রাথমিক শিক্ষার প্রারম্ভে এক বছরের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা, আট বছর মেয়াদি বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সুষম অনুপাতের প্রস্তাব, বিভিন্ন ধরনের প্রাথমিক বিদ্যায়তনে বিদ্যমান বৈষম্য দূরীকরণের আগ্রহ, প্রাথমিক পর্যায়ে সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জন্য মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা, প্রাথমিক স্তরে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা ইতিবাচক। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতির ক্ষেত্রে ন্যূনতম যোগ্যতার প্রয়োজনীয়তা, উচ্চশিক্ষায় গবেষণাকে উত্সাহ দান, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার স্থাপন, জাতীয় শিক্ষানীতি মনিটরিং ও বাস্তবায়নের জন্য একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন এবং প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও বেসরকারি কলেজে শিক্ষকদের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি এবং প্রশিক্ষণের জন্য একটি স্বতন্ত্র শিক্ষক নির্বাচন ও উন্নয়ন কমিশন গঠনের প্রস্তাবও ইতিবাচক। অবশ্য এসব প্রস্তাবের অনেকগুলো অতীতের কমিটি/কমিশনের রিপোর্টে উপস্থাপিত হয়েছিল। তা যা-ই হোক, প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার ধারা নির্বিশেষে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবস্তু হিসেবে যে ছয়টি বিষয়—বাংলা, ইংরেজি, নৈতিক শিক্ষা, গণিত, বাংলাদেশ পরিচিতি, সামাজিক পরিবেশ ও প্রাকৃতিক পরিবেশ পরিচিতি এবং বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি—বাধ্যতামূলকভাবে পড়ার জন্য নির্দিষ্ট হয়েছে, তা ভালো। বিদ্যালয়ের পরিবেশ যেন আনন্দময় ও আকর্ষণীয় হয়, তার প্রস্তাবও ভালো। মাধ্যমিক পর্যায়ে তিনটি ধারায়—সাধারণ, মাদ্রাসা ও কারিগরি—এভাবে ছাত্রছাত্রীদের বিন্যাস ঘটানো হয়েছে, তাও ভালো। এসব ক্ষেত্রে কোনো প্রশ্নবোধক চিহ্ন নেই।
প্রশ্ন রয়েছে কয়েকটি বিষয়ে। তা উত্থাপনের আগে এই অঞ্চলে সাধারণ শিক্ষা ও মাদ্রাসাশিক্ষার বিভিন্ন প্রকরণের মধ্যে যে প্রকৃতিগত বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে, দীর্ঘকালীন পরিসরে সে সম্পর্কে কটি কথা বলা প্রয়োজন। দক্ষিণ এশিয়ায় যখন মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন থেকেই এই অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মক্তব-মাদ্রাসারূপে চিহ্নিত হয়। মক্তব শব্দের অর্থ শিক্ষাকেন্দ্র এবং মাদ্রাসার অর্থ শিক্ষানিকেতন। এসব প্রতিষ্ঠানে সবাই লেখাপড়া করত। বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এসব প্রতিষ্ঠানে সবকিছুই শেখানো হতো। কোরআন, হাদিস থেকে শুরু করে ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান ও সাহিত্যের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে পাঠদান করা হতো মাদ্রাসায়। শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা ও বদান্যতায় সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় অভিজ্ঞ শিক্ষকদের পরিচালনায় মাদ্রাসা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এই অঞ্চলের বহু জ্ঞানী-গুণী মাদ্রাসায় শিক্ষা লাভ করে রাজনীতি, ইতিহাস, সমাজসেবা ও সাহিত্য ক্ষেত্রে যশস্বী হয়েছেন। ১৭৬৫ সালে মীর্জা এহতেসামউদ্দিন (Mirza I’tesamuddin) ইংল্যান্ড সফর করে তাঁর অভিজ্ঞতার বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছিলেন শিগুর্ফ নামা-এ-বিলাত (Shigurf Nama-e-Vilayet) গ্রন্থে। ফারসি ভাষায় লিখিত এ গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেছেন কায়সার হক। প্রকাশিত হয়েছে ২০০২ সালে। এই বিবরণীতে তিনি বলেছেন, অক্সফোর্ড মাদ্রাসা দেখে আমার মনে হয়েছে, আমাদের দেশের মাদ্রাসার মতোই এটি। অন্য কথায়, এ দেশের মাদ্রাসার মান তখন উন্নত ছিল। উন্নত শিক্ষাকেন্দ্ররূপেই তা খ্যাতি অর্জন করে।
এই মান এ অঞ্চলের মাদ্রাসা ধরে রাখতে পারেনি। এর একটা বড় কারণ হলো, ১৮৩৫ সালে লর্ড মেকলে (Macauley) কর্তৃক প্রবর্তিত শিক্ষানীতি। ফারসির পরিবর্তে ইংরেজি ও জ্ঞানবিজ্ঞানের অন্যান্য ধারা বর্জন করে সাধারণ শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি ছিল এই নীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। ভারত শাসনে এই অঞ্চলে উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে তাদের সহায়ক ও সমর্থক গোষ্ঠীতে রূপান্তর করাই ছিল এই শিক্ষানীতির মূল লক্ষ্য। মেকলের নিজের কথায়: “এই মুহূর্তে এমন এক শ্রেণী সৃষ্টির ক্ষেত্রে আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে যে শ্রেণী আমাদের এবং লাখ লাখ শাসিতের মধ্যে ব্যাখ্যাকারীর ভূমিকা পালন করবে। এ শ্রেণী এমন এক শ্রেণী হবে, যারা রক্তে ও বর্ণে হবে ভারতীয়, কিন্তু রুচি, অভিমত, নীতিবোধ ও বুদ্ধিবৃত্তিতে হবে ইংরেজি’ [‘We must at present do our best to form a class whom we govern, a class of persons, Indian in blood and colour but English in taste, in opinions, in morals and in intellect.’]। তখন থেকে এ দেশে আসে স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি প্রভৃতি শব্দ। ইংরেজির মাধ্যমে লেখাপড়া শিখে সরকারি চাকরি লাভ, ব্যবসা-বাণিজ্যে অগ্রগতি অর্জন ইত্যাদি লোভনীয় ক্ষেত্রে আকৃষ্ট হয় সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিরা। ইংরেজি মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার প্রসার ঘটতে থাকে দ্রুত। এ ক্ষেত্রে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে অসংখ্য মিশনারি গ্রুপের ইংরেজিতে পাঠদান সহায়তা করে ভীষণভাবে। ব্রিটিশ শাসকদের প্রবর্তিত এই শিক্ষানীতির প্রেক্ষাপটও উল্লেখযোগ্য। ভারত শাসনের জন্য প্রয়োজন ছিল ভারতীয়দের আচার-আচরণ, নীতি-নৈতিকতা, ইতিহাস-ঐতিহ্য, নিয়ম-পদ্ধতি সম্পর্কে সজ্ঞাত হওয়া। এই লক্ষ্যে সরকার কলকাতায় ১৭৮১ সালে প্রতিষ্ঠা করে হিন্দু কলেজ ও কলকাতা মাদ্রাসা। প্রসঙ্গত, এই দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো এ অঞ্চলে সর্বপ্রথম সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অন্যান্য ছাত্রের সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীরাও যেন এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা লাভ করতে পারে, সেই লক্ষ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এ দুটি প্রতিষ্ঠান। ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য তা-ই ছিল। হিন্দু কলেজ বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত পর্বে প্রেসিডেন্সি কলেজে রূপান্তর হয়, কিন্তু কলকাতা মাদ্রাসা অবহেলা, বঞ্চনা, উপেক্ষার কারণে স্থবির হয়ে থাকে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসারূপে। একদিকে মুসলমানদের দারিদ্র্য, অন্যদিকে কিছু নেতৃস্থানীয় মুসলিম নেতার ব্রিটিশ শাসনের প্রতি ঘৃণাজনিত সাধারণ শিক্ষার প্রতি অনীহা সরকারি মাদ্রাসা তথা দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত মাদ্রাসাগুলোকে রক্ষণশীল, সংকীর্ণ এবং যুগের অনুপযোগী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত করে ফেলে। অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষার ক্ষেত্রটি ক্রমে ক্রমে উর্বর হতে থাকে। স্কুল থেকে কলেজ, কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এবং এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আধুনিকতার আলোয় জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন ধারার চর্চা হতে শুরু করে। লর্ড মেকলের সেই লক্ষ্য অর্জিত হয় বটে, সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমে ক্রমে জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা এবং গবেষণার কেন্দ্রে রূপায়িত হয়েছে। মাদ্রাসাগুলো কিন্তু সেই স্থবিরতা আজও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এই প্রেক্ষাপট মনে রাখলে বর্তমান শিক্ষা কমিশন আরও একটু সংবেদনশীল হয়ে মাদ্রাসাশিক্ষা সম্পর্কে ভাবতে পারত। ভাবেনি তারা। ভাবেনি বলেই মাদ্রাসাশিক্ষার বিভিন্ন প্রকরণের মধ্যে সমন্বয় সাধনের প্রস্তাবটি অস্পষ্ট ও হেলাফেলার। ইবতেদায়ি পর্যায়ে নির্দিষ্ট শ্রেণীর শিক্ষাক্রম অনুযায়ী নির্ধারিত বিষয়গুলোর পাঠদান বাধ্যতামূলক হলেও মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রস্তাবিত কারিকুলামের আওতায় আনার কোনো প্রস্তাব নেই এই শিক্ষানীতিতে। যদিও দেশের বহুসংখ্যক ছেলেমেয়ে, বিশেষ করে অতি দরিদ্র, দুস্থ ও অসহায় পরিবারের ছেলেমেয়েরা এসব প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে অথবা করতে বাধ্য হয়। কওমি মাদ্রাসা সম্পর্কেও নেই কোনো প্রস্তাব, যদিও দেশে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা প্রচুর। বর্তমান শিক্ষানীতি এদিক থেকে অনেকটা অসম্পূর্ণ। মাধ্যমিক পর্যায়ে অর্থাত্ নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরা বয়সের পরিপ্রেক্ষিতে কোমল প্রাণ, সহজপ্রবণ (impressionable)। এই বয়সের ছেলেমেয়েদের জন্য ধর্ম ও নীতিশাস্ত্র ঐচ্ছিক না হয়ে আবশ্যিক হওয়া বাঞ্ছনীয়। এই দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের আমল থেকে অর্থাত্ ১৯৭২ সাল থেকে এ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে ধর্ম মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিচালিত কর্মসূচিতে সব ধর্মের শিশুদের ধর্মীয় জ্ঞান, অক্ষরজ্ঞানসহ আধুনিক শিক্ষা ও নৈতিকতা শেখানোর যে প্রস্তাব উপস্থাপিত হয়েছে, মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা এবং চার্চে উপস্থিত করিয়ে তা যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে বিভিন্ন ধর্ম-জাতিসত্তা ও সম্প্রদায়ের মোজায়েকে গড়া এই জনপদে এর ফল উল্টো হতে পারে। বড় হয়ে যারা নিজেদের ভিন্নতা এবং স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে সচেতন হতো, শিশুকাল থেকেই তাদের মধ্যে সেই চেতনা জন্ম লাভ করতে পারে। জাতীয় পর্যায়ে ধর্মকেন্দ্রিক বিভেদ আরও দৃঢ় হতে পারে। এই প্রস্তাব প্রত্যাহারযোগ্য।
বাংলাদেশের সংবিধানে উল্লিখিত হয়েছে, ‘রাষ্ট্র (১) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য... কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন’ (অনুচ্ছেদ ১৭(১)। এই কমিশনও সংবিধানের দোহাই দিয়ে শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে লিখেছে, ‘এই শিক্ষা নীতি সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশে সেক্যুলার, গণমুখী, সুলভ, সুষম, সার্বজনীন, সুপরিকল্পিত এবং মানসম্পন্ন শিক্ষাদানে সক্ষম শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ভিত্তি ও রণকৌশল হিসেবে কাজ করবে।’ সংবিধানের নির্দেশ ছাড়াও এরশাদবিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে গড়ে ওঠা সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য যে ১০ দফা দাবিনামা রচনা করেছিল, তার একটি দফায় উল্লিখিত হয়েছিল, ‘সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও শোষণ মুক্তির লক্ষ্যকে সামনে রেখে অবিলম্বে একটি সার্বজনীন, বিজ্ঞানভিত্তিক, বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।’ এই নীতি একমুখী শিক্ষানীতিরূপেই সমধিক পরিচিত। এ ক্ষেত্রে কমিশনের ব্যর্থতা প্রকট। এক, সংবিধানে লিখিত ‘গণমুখী’ শব্দের পূর্বে ‘সেক্যুলার’ শব্দটি ব্যবহার করে কমিশন তাদের শিক্ষানীতিকে অকারণে বিতর্কিত করেছে। বিতর্কিত করেছে বলছি এ জন্য যে, একদিকে শিক্ষাব্যবস্থাকে সেক্যুলার করার কথা বলা হয়েছে, অন্যদিকে প্রাক-প্রাথমিক পর্বে শিশুদের মসজিদ, মন্দির ও প্যাগোডায় নেওয়ার প্রস্তাবও রয়েছে। রয়েছে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা ক্যাটাগরিতে ইসলামধর্ম, হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম ও খ্রিষ্টধর্ম শিক্ষার ব্যবস্থাও। আমার মনে হয়েছে, এই প্রেক্ষাপটে সেক্যুলার শব্দটি প্রোভোকেটিভ (Provocative)। দুই, মাদ্রাসাশিক্ষার নিম্নস্তরের শিক্ষার সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার সমন্বয় সাধনের প্রস্তাব থাকলেও দেশের ক্যাডেট কলেজ, কিন্ডারগার্টেন, রেসিডেনশিয়াল মডেল স্কুল, প্রি-ক্যাডেট, টিউটোরিয়াল হোম এবং বিদেশের শিকড়যুক্ত ‘ও’ লেভেল ও ‘এ’ লেভেলকে অব্যাহত রেখেছে। একমুখী শিক্ষার কনসেপ্টকে এভাবে কমিশন পরিত্যাগ করেছে। তিন, রিপোর্টে ‘জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারা বিকশিত করে প্রজন্মপরম্পরায় সঞ্চালনের ব্যবস্থা করার’ কথা বলা হলেও ‘ও’ লেভেল ও ‘এ’ লেভেল পরিবর্তনের কোনো ইঙ্গিতের অনুপস্থিতি পীড়াদায়ক। চার, মাধ্যমিক স্তরে চূড়ান্ত পাবলিক পরীক্ষা দ্বাদশ শ্রেণী শেষে হলে এ দেশের যেসব ছেলেমেয়ে বিদেশে লেখাপড়া করবে; তারা যে অশেষ দুর্গতির মধ্যে পড়বে, তাও এই কমিশনের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। মাধ্যমিক স্তরে দশম শ্রেণীর শেষে একটি পাবলিক পরীক্ষা যে জরুরি, তা অনুধাবন করা প্রয়োজন ছিল। পাঁচ, আগেই বলা হয়েছে, মাধ্যমিক স্তরের কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের জন্য ধর্ম ও নীতির পাঠদান বাধ্যতামূলক হওয়া প্রয়োজন; ঐচ্ছিক কোনো বিষয় হতে পারে না। সর্বস্থানে মৌলবাদের ভূত না দেখে উন্নত জীবনের সূত্রগুলো সামনে রাখা দরকার।
যেকোনো জনপদে শিক্ষানীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হওয়া উচিত সেই জনপদের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। যে বাংলাদেশে এখনো মোট জনসমষ্টির প্রায় অর্ধেক নিরক্ষরতার অন্ধকারে নিমজ্জিত এবং যে দেশে মোট জনসমষ্টির প্রায় ৪৪-৪৫ ভাগ জনসমষ্টি এখনো দারিদ্র্য সীমারেখার নিচে বসবাস করে, যাদের অর্ধেকই মানবেতর জীবন-যাপনে বাধ্য হচ্ছে, সে দেশে, কমিশনের কথায় ‘সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে শহর ও গ্রাম পর্যায়ে ভ্রাম্যমাণ চিত্রকলা ও কারুশিল্পের প্রদর্শনী, সংগীত, নাটক ও নৃত্যানুষ্ঠানের ব্যবস্থা’ যে কত বড় প্রহসন, তা তাদের কে বলবে? গ্রামাঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর খবর তাঁরা রাখেন কি? কটা বিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় ঘর-দরজা রয়েছে? রয়েছে কি প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক? আছে কি কিছু বইপত্র রাখার ব্যবস্থা? কটা বিদ্যালয়ে রয়েছে ছোট ছোট ছেলেমেয়ের খেলার মাঠ? খেলাধুলা শেখানোর শিক্ষক? ললিতকলা, সংগীত, নাটক বা চারুকলা, কারুশিল্পের পক্ষে আমি। কিন্তু আমি দেশের সর্বজনীন সাক্ষরতাকে সবার আগে স্থান দিয়ে থাকি। সাক্ষরতার মাটির প্রদীপটি জ্বলে উঠলেই শুধু ললিতকলা চারদিক আলোকিত করতে পারে। সবার আগে স্থান দিয়ে থাকি আমি দারিদ্র্য বিমোচনকে। যার পেটে ভাত নেই তার কাছে অর্থহীন স্বাধীনতা, অধিকার, কর্তব্যবোধ, রুচিশীলতা। এই প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলে শেষ করতে চাই। দেশে গার্লস গাইড, বয়স্কাউট, এমনকি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনসিসি চালু আছে। চলছেও হোঁচট খেতে খেতে। এর পরও সেই অতীতের, বর্তমানে অপ্রচলিত ব্রতচারী ব্যবস্থাকে টেনে আনার মানসিকতাকে কী বলবেন? অতীত স্মৃতির প্রতি তীব্র আকর্ষণ? না অন্য কিছু?
এর পরও যেটুকু রয়েছে তাকে মার্জিত করা প্রয়োজন। দলীয় স্লোগানগুলো মুছে ফেলে, দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষানীতির বিভিন্ন সুপারিশ বিশ্লেষণ করে জাতীয় নীতির আদল দেওয়া প্রয়োজন। বহুবার নীতি প্রণীত হতে দেখেছি। বাস্তবায়ন ক্ষেত্রটি কিন্তু বন্ধ্যাত্বে আক্রান্ত। শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য, বিশেষ করে দীর্ঘকালীন পরিসরে এর স্থায়িত্বের জন্য প্রয়োজন জাতীয় পর্যায়ে এ সম্পর্কে মতৈক্য। জোর করে শুরু করলে তা কোনো দিন শেষ হয় না। গন্তব্যে তা না-ও পৌঁছাতে পারে। বিজয়স্তম্ভ তা কোনো দিন স্পর্শ না-ও করতে পারে। এ সত্য অনুধাবন করতে হবে সরকারকে। গ্রামাঞ্চলে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে এবং প্রায় সবাই তা মেনেও চলে—আগে ঘর সাজাও, তারপর নববধূকে বরণ করো। অসুন্দরও তখন সুন্দর হয়ে উঠতে পারে।
এমাজউদ্দীন আহমদ: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রশ্ন রয়েছে কয়েকটি বিষয়ে। তা উত্থাপনের আগে এই অঞ্চলে সাধারণ শিক্ষা ও মাদ্রাসাশিক্ষার বিভিন্ন প্রকরণের মধ্যে যে প্রকৃতিগত বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে, দীর্ঘকালীন পরিসরে সে সম্পর্কে কটি কথা বলা প্রয়োজন। দক্ষিণ এশিয়ায় যখন মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন থেকেই এই অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মক্তব-মাদ্রাসারূপে চিহ্নিত হয়। মক্তব শব্দের অর্থ শিক্ষাকেন্দ্র এবং মাদ্রাসার অর্থ শিক্ষানিকেতন। এসব প্রতিষ্ঠানে সবাই লেখাপড়া করত। বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এসব প্রতিষ্ঠানে সবকিছুই শেখানো হতো। কোরআন, হাদিস থেকে শুরু করে ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান ও সাহিত্যের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে পাঠদান করা হতো মাদ্রাসায়। শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা ও বদান্যতায় সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় অভিজ্ঞ শিক্ষকদের পরিচালনায় মাদ্রাসা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এই অঞ্চলের বহু জ্ঞানী-গুণী মাদ্রাসায় শিক্ষা লাভ করে রাজনীতি, ইতিহাস, সমাজসেবা ও সাহিত্য ক্ষেত্রে যশস্বী হয়েছেন। ১৭৬৫ সালে মীর্জা এহতেসামউদ্দিন (Mirza I’tesamuddin) ইংল্যান্ড সফর করে তাঁর অভিজ্ঞতার বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছিলেন শিগুর্ফ নামা-এ-বিলাত (Shigurf Nama-e-Vilayet) গ্রন্থে। ফারসি ভাষায় লিখিত এ গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেছেন কায়সার হক। প্রকাশিত হয়েছে ২০০২ সালে। এই বিবরণীতে তিনি বলেছেন, অক্সফোর্ড মাদ্রাসা দেখে আমার মনে হয়েছে, আমাদের দেশের মাদ্রাসার মতোই এটি। অন্য কথায়, এ দেশের মাদ্রাসার মান তখন উন্নত ছিল। উন্নত শিক্ষাকেন্দ্ররূপেই তা খ্যাতি অর্জন করে।
এই মান এ অঞ্চলের মাদ্রাসা ধরে রাখতে পারেনি। এর একটা বড় কারণ হলো, ১৮৩৫ সালে লর্ড মেকলে (Macauley) কর্তৃক প্রবর্তিত শিক্ষানীতি। ফারসির পরিবর্তে ইংরেজি ও জ্ঞানবিজ্ঞানের অন্যান্য ধারা বর্জন করে সাধারণ শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি ছিল এই নীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। ভারত শাসনে এই অঞ্চলে উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে তাদের সহায়ক ও সমর্থক গোষ্ঠীতে রূপান্তর করাই ছিল এই শিক্ষানীতির মূল লক্ষ্য। মেকলের নিজের কথায়: “এই মুহূর্তে এমন এক শ্রেণী সৃষ্টির ক্ষেত্রে আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে যে শ্রেণী আমাদের এবং লাখ লাখ শাসিতের মধ্যে ব্যাখ্যাকারীর ভূমিকা পালন করবে। এ শ্রেণী এমন এক শ্রেণী হবে, যারা রক্তে ও বর্ণে হবে ভারতীয়, কিন্তু রুচি, অভিমত, নীতিবোধ ও বুদ্ধিবৃত্তিতে হবে ইংরেজি’ [‘We must at present do our best to form a class whom we govern, a class of persons, Indian in blood and colour but English in taste, in opinions, in morals and in intellect.’]। তখন থেকে এ দেশে আসে স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি প্রভৃতি শব্দ। ইংরেজির মাধ্যমে লেখাপড়া শিখে সরকারি চাকরি লাভ, ব্যবসা-বাণিজ্যে অগ্রগতি অর্জন ইত্যাদি লোভনীয় ক্ষেত্রে আকৃষ্ট হয় সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিরা। ইংরেজি মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার প্রসার ঘটতে থাকে দ্রুত। এ ক্ষেত্রে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে অসংখ্য মিশনারি গ্রুপের ইংরেজিতে পাঠদান সহায়তা করে ভীষণভাবে। ব্রিটিশ শাসকদের প্রবর্তিত এই শিক্ষানীতির প্রেক্ষাপটও উল্লেখযোগ্য। ভারত শাসনের জন্য প্রয়োজন ছিল ভারতীয়দের আচার-আচরণ, নীতি-নৈতিকতা, ইতিহাস-ঐতিহ্য, নিয়ম-পদ্ধতি সম্পর্কে সজ্ঞাত হওয়া। এই লক্ষ্যে সরকার কলকাতায় ১৭৮১ সালে প্রতিষ্ঠা করে হিন্দু কলেজ ও কলকাতা মাদ্রাসা। প্রসঙ্গত, এই দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো এ অঞ্চলে সর্বপ্রথম সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অন্যান্য ছাত্রের সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীরাও যেন এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা লাভ করতে পারে, সেই লক্ষ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এ দুটি প্রতিষ্ঠান। ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য তা-ই ছিল। হিন্দু কলেজ বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত পর্বে প্রেসিডেন্সি কলেজে রূপান্তর হয়, কিন্তু কলকাতা মাদ্রাসা অবহেলা, বঞ্চনা, উপেক্ষার কারণে স্থবির হয়ে থাকে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসারূপে। একদিকে মুসলমানদের দারিদ্র্য, অন্যদিকে কিছু নেতৃস্থানীয় মুসলিম নেতার ব্রিটিশ শাসনের প্রতি ঘৃণাজনিত সাধারণ শিক্ষার প্রতি অনীহা সরকারি মাদ্রাসা তথা দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত মাদ্রাসাগুলোকে রক্ষণশীল, সংকীর্ণ এবং যুগের অনুপযোগী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত করে ফেলে। অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষার ক্ষেত্রটি ক্রমে ক্রমে উর্বর হতে থাকে। স্কুল থেকে কলেজ, কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এবং এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আধুনিকতার আলোয় জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন ধারার চর্চা হতে শুরু করে। লর্ড মেকলের সেই লক্ষ্য অর্জিত হয় বটে, সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমে ক্রমে জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা এবং গবেষণার কেন্দ্রে রূপায়িত হয়েছে। মাদ্রাসাগুলো কিন্তু সেই স্থবিরতা আজও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এই প্রেক্ষাপট মনে রাখলে বর্তমান শিক্ষা কমিশন আরও একটু সংবেদনশীল হয়ে মাদ্রাসাশিক্ষা সম্পর্কে ভাবতে পারত। ভাবেনি তারা। ভাবেনি বলেই মাদ্রাসাশিক্ষার বিভিন্ন প্রকরণের মধ্যে সমন্বয় সাধনের প্রস্তাবটি অস্পষ্ট ও হেলাফেলার। ইবতেদায়ি পর্যায়ে নির্দিষ্ট শ্রেণীর শিক্ষাক্রম অনুযায়ী নির্ধারিত বিষয়গুলোর পাঠদান বাধ্যতামূলক হলেও মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রস্তাবিত কারিকুলামের আওতায় আনার কোনো প্রস্তাব নেই এই শিক্ষানীতিতে। যদিও দেশের বহুসংখ্যক ছেলেমেয়ে, বিশেষ করে অতি দরিদ্র, দুস্থ ও অসহায় পরিবারের ছেলেমেয়েরা এসব প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে অথবা করতে বাধ্য হয়। কওমি মাদ্রাসা সম্পর্কেও নেই কোনো প্রস্তাব, যদিও দেশে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা প্রচুর। বর্তমান শিক্ষানীতি এদিক থেকে অনেকটা অসম্পূর্ণ। মাধ্যমিক পর্যায়ে অর্থাত্ নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরা বয়সের পরিপ্রেক্ষিতে কোমল প্রাণ, সহজপ্রবণ (impressionable)। এই বয়সের ছেলেমেয়েদের জন্য ধর্ম ও নীতিশাস্ত্র ঐচ্ছিক না হয়ে আবশ্যিক হওয়া বাঞ্ছনীয়। এই দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের আমল থেকে অর্থাত্ ১৯৭২ সাল থেকে এ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে ধর্ম মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিচালিত কর্মসূচিতে সব ধর্মের শিশুদের ধর্মীয় জ্ঞান, অক্ষরজ্ঞানসহ আধুনিক শিক্ষা ও নৈতিকতা শেখানোর যে প্রস্তাব উপস্থাপিত হয়েছে, মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা এবং চার্চে উপস্থিত করিয়ে তা যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে বিভিন্ন ধর্ম-জাতিসত্তা ও সম্প্রদায়ের মোজায়েকে গড়া এই জনপদে এর ফল উল্টো হতে পারে। বড় হয়ে যারা নিজেদের ভিন্নতা এবং স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে সচেতন হতো, শিশুকাল থেকেই তাদের মধ্যে সেই চেতনা জন্ম লাভ করতে পারে। জাতীয় পর্যায়ে ধর্মকেন্দ্রিক বিভেদ আরও দৃঢ় হতে পারে। এই প্রস্তাব প্রত্যাহারযোগ্য।
বাংলাদেশের সংবিধানে উল্লিখিত হয়েছে, ‘রাষ্ট্র (১) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য... কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন’ (অনুচ্ছেদ ১৭(১)। এই কমিশনও সংবিধানের দোহাই দিয়ে শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে লিখেছে, ‘এই শিক্ষা নীতি সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশে সেক্যুলার, গণমুখী, সুলভ, সুষম, সার্বজনীন, সুপরিকল্পিত এবং মানসম্পন্ন শিক্ষাদানে সক্ষম শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ভিত্তি ও রণকৌশল হিসেবে কাজ করবে।’ সংবিধানের নির্দেশ ছাড়াও এরশাদবিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে গড়ে ওঠা সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য যে ১০ দফা দাবিনামা রচনা করেছিল, তার একটি দফায় উল্লিখিত হয়েছিল, ‘সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও শোষণ মুক্তির লক্ষ্যকে সামনে রেখে অবিলম্বে একটি সার্বজনীন, বিজ্ঞানভিত্তিক, বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।’ এই নীতি একমুখী শিক্ষানীতিরূপেই সমধিক পরিচিত। এ ক্ষেত্রে কমিশনের ব্যর্থতা প্রকট। এক, সংবিধানে লিখিত ‘গণমুখী’ শব্দের পূর্বে ‘সেক্যুলার’ শব্দটি ব্যবহার করে কমিশন তাদের শিক্ষানীতিকে অকারণে বিতর্কিত করেছে। বিতর্কিত করেছে বলছি এ জন্য যে, একদিকে শিক্ষাব্যবস্থাকে সেক্যুলার করার কথা বলা হয়েছে, অন্যদিকে প্রাক-প্রাথমিক পর্বে শিশুদের মসজিদ, মন্দির ও প্যাগোডায় নেওয়ার প্রস্তাবও রয়েছে। রয়েছে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা ক্যাটাগরিতে ইসলামধর্ম, হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম ও খ্রিষ্টধর্ম শিক্ষার ব্যবস্থাও। আমার মনে হয়েছে, এই প্রেক্ষাপটে সেক্যুলার শব্দটি প্রোভোকেটিভ (Provocative)। দুই, মাদ্রাসাশিক্ষার নিম্নস্তরের শিক্ষার সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার সমন্বয় সাধনের প্রস্তাব থাকলেও দেশের ক্যাডেট কলেজ, কিন্ডারগার্টেন, রেসিডেনশিয়াল মডেল স্কুল, প্রি-ক্যাডেট, টিউটোরিয়াল হোম এবং বিদেশের শিকড়যুক্ত ‘ও’ লেভেল ও ‘এ’ লেভেলকে অব্যাহত রেখেছে। একমুখী শিক্ষার কনসেপ্টকে এভাবে কমিশন পরিত্যাগ করেছে। তিন, রিপোর্টে ‘জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারা বিকশিত করে প্রজন্মপরম্পরায় সঞ্চালনের ব্যবস্থা করার’ কথা বলা হলেও ‘ও’ লেভেল ও ‘এ’ লেভেল পরিবর্তনের কোনো ইঙ্গিতের অনুপস্থিতি পীড়াদায়ক। চার, মাধ্যমিক স্তরে চূড়ান্ত পাবলিক পরীক্ষা দ্বাদশ শ্রেণী শেষে হলে এ দেশের যেসব ছেলেমেয়ে বিদেশে লেখাপড়া করবে; তারা যে অশেষ দুর্গতির মধ্যে পড়বে, তাও এই কমিশনের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। মাধ্যমিক স্তরে দশম শ্রেণীর শেষে একটি পাবলিক পরীক্ষা যে জরুরি, তা অনুধাবন করা প্রয়োজন ছিল। পাঁচ, আগেই বলা হয়েছে, মাধ্যমিক স্তরের কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের জন্য ধর্ম ও নীতির পাঠদান বাধ্যতামূলক হওয়া প্রয়োজন; ঐচ্ছিক কোনো বিষয় হতে পারে না। সর্বস্থানে মৌলবাদের ভূত না দেখে উন্নত জীবনের সূত্রগুলো সামনে রাখা দরকার।
যেকোনো জনপদে শিক্ষানীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হওয়া উচিত সেই জনপদের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। যে বাংলাদেশে এখনো মোট জনসমষ্টির প্রায় অর্ধেক নিরক্ষরতার অন্ধকারে নিমজ্জিত এবং যে দেশে মোট জনসমষ্টির প্রায় ৪৪-৪৫ ভাগ জনসমষ্টি এখনো দারিদ্র্য সীমারেখার নিচে বসবাস করে, যাদের অর্ধেকই মানবেতর জীবন-যাপনে বাধ্য হচ্ছে, সে দেশে, কমিশনের কথায় ‘সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে শহর ও গ্রাম পর্যায়ে ভ্রাম্যমাণ চিত্রকলা ও কারুশিল্পের প্রদর্শনী, সংগীত, নাটক ও নৃত্যানুষ্ঠানের ব্যবস্থা’ যে কত বড় প্রহসন, তা তাদের কে বলবে? গ্রামাঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর খবর তাঁরা রাখেন কি? কটা বিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় ঘর-দরজা রয়েছে? রয়েছে কি প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক? আছে কি কিছু বইপত্র রাখার ব্যবস্থা? কটা বিদ্যালয়ে রয়েছে ছোট ছোট ছেলেমেয়ের খেলার মাঠ? খেলাধুলা শেখানোর শিক্ষক? ললিতকলা, সংগীত, নাটক বা চারুকলা, কারুশিল্পের পক্ষে আমি। কিন্তু আমি দেশের সর্বজনীন সাক্ষরতাকে সবার আগে স্থান দিয়ে থাকি। সাক্ষরতার মাটির প্রদীপটি জ্বলে উঠলেই শুধু ললিতকলা চারদিক আলোকিত করতে পারে। সবার আগে স্থান দিয়ে থাকি আমি দারিদ্র্য বিমোচনকে। যার পেটে ভাত নেই তার কাছে অর্থহীন স্বাধীনতা, অধিকার, কর্তব্যবোধ, রুচিশীলতা। এই প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলে শেষ করতে চাই। দেশে গার্লস গাইড, বয়স্কাউট, এমনকি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনসিসি চালু আছে। চলছেও হোঁচট খেতে খেতে। এর পরও সেই অতীতের, বর্তমানে অপ্রচলিত ব্রতচারী ব্যবস্থাকে টেনে আনার মানসিকতাকে কী বলবেন? অতীত স্মৃতির প্রতি তীব্র আকর্ষণ? না অন্য কিছু?
এর পরও যেটুকু রয়েছে তাকে মার্জিত করা প্রয়োজন। দলীয় স্লোগানগুলো মুছে ফেলে, দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষানীতির বিভিন্ন সুপারিশ বিশ্লেষণ করে জাতীয় নীতির আদল দেওয়া প্রয়োজন। বহুবার নীতি প্রণীত হতে দেখেছি। বাস্তবায়ন ক্ষেত্রটি কিন্তু বন্ধ্যাত্বে আক্রান্ত। শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য, বিশেষ করে দীর্ঘকালীন পরিসরে এর স্থায়িত্বের জন্য প্রয়োজন জাতীয় পর্যায়ে এ সম্পর্কে মতৈক্য। জোর করে শুরু করলে তা কোনো দিন শেষ হয় না। গন্তব্যে তা না-ও পৌঁছাতে পারে। বিজয়স্তম্ভ তা কোনো দিন স্পর্শ না-ও করতে পারে। এ সত্য অনুধাবন করতে হবে সরকারকে। গ্রামাঞ্চলে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে এবং প্রায় সবাই তা মেনেও চলে—আগে ঘর সাজাও, তারপর নববধূকে বরণ করো। অসুন্দরও তখন সুন্দর হয়ে উঠতে পারে।
এমাজউদ্দীন আহমদ: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments