যানজট দূরীকরণ বনাম শিশুবান্ধব সময়সূচি -শিক্ষকের কথা by মো. সিদ্দিকুর রহমান
‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি/সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি’—এই তো হওয়া উচিত শিশুর প্রতিজ্ঞা। প্রতিদিন সকাল সকাল উঠে স্কুলে যাবে, বেলা গড়ানোর আগেই বাসায় ফিরে খাবার খেয়ে বিশ্রাম নেবে, বিকেলে খেলাধুলা করবে—শিশুর সুস্থ স্বাভাবিক বিকাশের জন্য এই তো চাই। শিশুরাও তাই চায়। কিন্তু আমরা চাই পরিবর্তন। শুভ, অশুভ যা-ই হোক না কেন, পরিবর্তন হতেই হবে। তা না হলে দিন যে বদল হচ্ছে, তা তো বোঝা যাবে না। আর তাই পরিবর্তনের জন্য শিশুদেরও বলি দিতে ছাড়ি না।
বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সূচি সকাল নয়টা ৩০ মিনিট থেকে বিকেল চারটা ১৫ মিনিট করা হয়েছে। তা সত্যিই চিন্তাসাপেক্ষ। বিগত সময়ে সর্বস্তরের প্রতিনিধি যেমন—শিক্ষক, ছাত্র, অভিভাবক, প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের থানা/উপজেলা, জেলা, উপ-পরিচালকসহ প্রায় সর্বস্তরের কর্মকর্তা, ম্যানেজিং কমিটির সদস্য, সাংবাদিক, পেশাজীবীদের সমন্বয়ে তত্কালীন সচিব তাহমিনা বেগমের সভাপতিত্বে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী (মোট চারটি) মহানগরের জন্য শিশুবান্ধব সময়সূচি ঘোষিত হয়েছিল। এ সময়ে শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিক নিয়মে পড়াশোনার পাশাপাশি তাদের দৈনন্দিন কাজ সারতে পারত। কিন্তু বর্তমান সময়সূচি অনুসারে একই সময়-কাল বিদ্যালয়ে অবস্থান করলেও বেলা যত গড়াতে থাকে, শিক্ষার্থীরা তত ক্লান্ত বোধ করে। দিনের দ্বিতীয় ভাগে (টিফিনের পর) তাদের পাঠে মনোযোগ ধরে রাখা সত্যিই কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। তাই এ সময়টাকে তাদের কাছে বড্ড বেশি দীর্ঘ মনে হয়। পরিশ্রান্ত হয়ে বাড়ি ফেরার পর তারা কোনো কাজেই আর উত্সাহ বোধ করে না। বাড়িতে পরের দিনের পাঠ-প্রস্তুতি নেওয়া তাদের পক্ষে আর সম্ভব হয় না।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ অভিভাবক বিদ্যালয়ে পৌঁছে দিয়ে যান। বেশির ভাগ অভিভাবকই কর্মজীবী। দেখা যায়, মা-বাবা অফিসে যাওয়ার পথে তাঁদের ছেলেমেয়েকে বিদ্যালয়ে পৌঁছে দিয়ে যান। বর্তমানে বিদ্যালয়ের সময় ও অফিস সময় একই হওয়ায় কোনো অবস্থাতেই তাঁদের সন্তানদের পৌঁছানো সম্ভব হয় না। এ কারণে অনেক শিশুর পক্ষে বিদ্যালয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। আগের সময়সূচি অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা দুপুরে ছুটির পর আহারাদি সেরে ঘুমের পর খেলাধুলা বা অন্যান্য বিনোদনের সুযোগ পেত। আর এখন ক্লান্ত শরীর চায় বিছানায় যেতে, কিন্তু ঘড়ির কাঁটা জানিয়ে দেয় কখন খেলার লগ্ন বয়ে যাবে। তারা না পারছে শরীরের ক্লান্তি অগ্রাহ্য করতে, না পারছে মনের ইচ্ছাকে অবদমিত করতে। তাদের মধ্যে কাজ করছে এক সীমাহীন অস্থিরতা। বর্তমানে টিফিনের সময়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যাহ্নভোজের জন্য বাড়িতে যেতে হচ্ছে। খাবারের পর যে ক্লান্তি আসে, তা অগ্রাহ্য করে শিক্ষার্থীদের একাংশের পক্ষে বিদ্যালয়ে আবার উপস্থিত হওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে উপস্থিতি ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে। ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ বাবা-মাকে শুধু পরিবারের কাজে নয়, আয় রোজগারমূলক কাজেও সাহায্য করে। দারিদ্র্যের কারণে সে তা করতে বাধ্য। বর্তমান সময়সূচি তাকে এই কাজ থেকে দূরে তো সরাতে পারবেই না, বরং এর অবশ্যম্ভাবী ফল হলো ঝরে পড়া। আর কেউ যদি মোটামুটি সামর্থ্যবান হয়, তবে সে বেসরকারি বিদ্যালয়ের দিকে ঝুঁকবে। কারণ, সেসব বিদ্যালয়ের সময়সূচি অপরিবর্তিত আছে।
বর্তমান অফিস সময়সূচি ও বিদ্যালয়ের সময়সূচি একই হওয়ায় ঢাকা শহরের যানজট পরিস্থিতির অবনতি নিশ্চিত হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী ও শিক্ষককে আসতে হয় দূর-দূরান্ত থেকে, যাদের এই যানজট মোকাবিলা করে তবেই পৌঁছাতে হবে। যানজট নিরসনে সরকারের এই অবাস্তব সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। শিক্ষার যেকোনো পদক্ষেপের সঙ্গে জড়িত কোমলমতি শিশুরা। তাই এর যেকোনো পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের আগে নিশ্চিত করতে হবে শিশুদের সর্বোত্তম স্বার্থরক্ষা। তাই শিশুদের দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে দেওয়ার স্বার্থেই আগের বিদ্যালয় সময়সূচি অবিলম্বে বহাল করা উচিত। শিশু শিক্ষার্থীদের শারীরিক, মানসিক সুস্থতাসহ আনন্দঘন শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করে যানজট নিরসনে আগের সকাল সাড়ে সাতটা থেকে বেলা দুইটা ১৫ মিনিট সময়সূচি বহাল হোক—এ প্রত্যাশা রইল।
মো. সিদ্দিকুর রহমান: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি।
বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সূচি সকাল নয়টা ৩০ মিনিট থেকে বিকেল চারটা ১৫ মিনিট করা হয়েছে। তা সত্যিই চিন্তাসাপেক্ষ। বিগত সময়ে সর্বস্তরের প্রতিনিধি যেমন—শিক্ষক, ছাত্র, অভিভাবক, প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের থানা/উপজেলা, জেলা, উপ-পরিচালকসহ প্রায় সর্বস্তরের কর্মকর্তা, ম্যানেজিং কমিটির সদস্য, সাংবাদিক, পেশাজীবীদের সমন্বয়ে তত্কালীন সচিব তাহমিনা বেগমের সভাপতিত্বে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী (মোট চারটি) মহানগরের জন্য শিশুবান্ধব সময়সূচি ঘোষিত হয়েছিল। এ সময়ে শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিক নিয়মে পড়াশোনার পাশাপাশি তাদের দৈনন্দিন কাজ সারতে পারত। কিন্তু বর্তমান সময়সূচি অনুসারে একই সময়-কাল বিদ্যালয়ে অবস্থান করলেও বেলা যত গড়াতে থাকে, শিক্ষার্থীরা তত ক্লান্ত বোধ করে। দিনের দ্বিতীয় ভাগে (টিফিনের পর) তাদের পাঠে মনোযোগ ধরে রাখা সত্যিই কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। তাই এ সময়টাকে তাদের কাছে বড্ড বেশি দীর্ঘ মনে হয়। পরিশ্রান্ত হয়ে বাড়ি ফেরার পর তারা কোনো কাজেই আর উত্সাহ বোধ করে না। বাড়িতে পরের দিনের পাঠ-প্রস্তুতি নেওয়া তাদের পক্ষে আর সম্ভব হয় না।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ অভিভাবক বিদ্যালয়ে পৌঁছে দিয়ে যান। বেশির ভাগ অভিভাবকই কর্মজীবী। দেখা যায়, মা-বাবা অফিসে যাওয়ার পথে তাঁদের ছেলেমেয়েকে বিদ্যালয়ে পৌঁছে দিয়ে যান। বর্তমানে বিদ্যালয়ের সময় ও অফিস সময় একই হওয়ায় কোনো অবস্থাতেই তাঁদের সন্তানদের পৌঁছানো সম্ভব হয় না। এ কারণে অনেক শিশুর পক্ষে বিদ্যালয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। আগের সময়সূচি অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা দুপুরে ছুটির পর আহারাদি সেরে ঘুমের পর খেলাধুলা বা অন্যান্য বিনোদনের সুযোগ পেত। আর এখন ক্লান্ত শরীর চায় বিছানায় যেতে, কিন্তু ঘড়ির কাঁটা জানিয়ে দেয় কখন খেলার লগ্ন বয়ে যাবে। তারা না পারছে শরীরের ক্লান্তি অগ্রাহ্য করতে, না পারছে মনের ইচ্ছাকে অবদমিত করতে। তাদের মধ্যে কাজ করছে এক সীমাহীন অস্থিরতা। বর্তমানে টিফিনের সময়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যাহ্নভোজের জন্য বাড়িতে যেতে হচ্ছে। খাবারের পর যে ক্লান্তি আসে, তা অগ্রাহ্য করে শিক্ষার্থীদের একাংশের পক্ষে বিদ্যালয়ে আবার উপস্থিত হওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে উপস্থিতি ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে। ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ বাবা-মাকে শুধু পরিবারের কাজে নয়, আয় রোজগারমূলক কাজেও সাহায্য করে। দারিদ্র্যের কারণে সে তা করতে বাধ্য। বর্তমান সময়সূচি তাকে এই কাজ থেকে দূরে তো সরাতে পারবেই না, বরং এর অবশ্যম্ভাবী ফল হলো ঝরে পড়া। আর কেউ যদি মোটামুটি সামর্থ্যবান হয়, তবে সে বেসরকারি বিদ্যালয়ের দিকে ঝুঁকবে। কারণ, সেসব বিদ্যালয়ের সময়সূচি অপরিবর্তিত আছে।
বর্তমান অফিস সময়সূচি ও বিদ্যালয়ের সময়সূচি একই হওয়ায় ঢাকা শহরের যানজট পরিস্থিতির অবনতি নিশ্চিত হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী ও শিক্ষককে আসতে হয় দূর-দূরান্ত থেকে, যাদের এই যানজট মোকাবিলা করে তবেই পৌঁছাতে হবে। যানজট নিরসনে সরকারের এই অবাস্তব সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। শিক্ষার যেকোনো পদক্ষেপের সঙ্গে জড়িত কোমলমতি শিশুরা। তাই এর যেকোনো পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের আগে নিশ্চিত করতে হবে শিশুদের সর্বোত্তম স্বার্থরক্ষা। তাই শিশুদের দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে দেওয়ার স্বার্থেই আগের বিদ্যালয় সময়সূচি অবিলম্বে বহাল করা উচিত। শিশু শিক্ষার্থীদের শারীরিক, মানসিক সুস্থতাসহ আনন্দঘন শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করে যানজট নিরসনে আগের সকাল সাড়ে সাতটা থেকে বেলা দুইটা ১৫ মিনিট সময়সূচি বহাল হোক—এ প্রত্যাশা রইল।
মো. সিদ্দিকুর রহমান: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি।
No comments