স্বাধীন সংবাদপত্রকেই দুর্নীতিবাজেরা ভয় পায় by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে এ রকম জঘন্য বিজ্ঞাপন এর আগে প্রকাশিত হয়েছিল কি না আমার জানা নেই। প্রবীণ সাংবাদিক ও পাঠকেরা এর সাক্ষ্য দিতে পারবেন। একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান রাজধানীর চার-পাঁচটি বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় বড় আকারের বিজ্ঞাপন দিয়ে আরেকটি জনপ্রিয় ও বহুল প্রচারিত (সম্ভবত প্রচারসংখ্যায় শীর্ষে) দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলো বর্জন করার আহ্বান জানিয়েছে। এ ধরনের বিজ্ঞাপন প্রকাশ সাংবাদিকতা ও প্রকাশনার নীতিমালা সমর্থন করে না বলেই জানি। তবু ১৩ অক্টোবর থেকে এ নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত (২৬ অক্টোবর) এই বিজ্ঞাপন অন্তত কয়েকবার করে বিভিন্ন পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছে। এ বিজ্ঞাপন প্রকাশ বাবদ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানটির যত টাকা ব্যয় হয়েছে, তা দিয়ে অনেক ছোট দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিকদের এক মাসের বেতন দেওয়া যেত। কালো টাকা থাকলে কত অপচয় যে সম্ভব, তা এই বিজ্ঞাপন আরেকবার প্রমাণ করেছে।
২৬ অক্টোবরের খবর হলো: প্রথম আলোর পক্ষে একটি আইনি প্রতিষ্ঠান ওই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে বিজ্ঞাপনগুলো প্রত্যাহার ও সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রকাশ্যে প্রথম আলোর প্রকাশক ও সম্পাদকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করার উকিল নোটিশ দিয়েছে। আমরা এর আইনি পরিসমাপ্তি কী হয়, তা জানার অপেক্ষায় থাকলাম।
প্রথম আলো একটি বহুল প্রচারিত জনপ্রিয় পত্রিকা। সম্প্রতি পত্রিকা প্রকাশনায় এটি একটি সফল বেসরকারি উদ্যোগ। বেসরকারি খাতে এত বড় ব্যবসাসফল প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি আর দেখা যায়নি, বিশেষ করে মিডিয়া সেক্টরে। প্রথম আলো তার নিজস্ব একটা সম্পাদকীয় নীতি অনুসরণ করে থাকে। সেটা সবার মনঃপূত হবে, এমন আশা করা উচিত নয়। যাদের মনঃপূত হয় না, তারা প্রথম আলো পড়ে না। অন্য পত্রিকা পড়ে। ঢাকার আরও কয়েকটি দৈনিক পত্রিকার ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠী রয়েছে। এমনকি নিয়মিত ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ করে যাচ্ছে, এমন একটি সস্তা দৈনিকের পাঠকও কম নয়। কাজেই প্রথম আলোর সম্পাদকীয় নীতি কারও পছন্দ না হলে পত্রিকাটি না পড়াই হচ্ছে সহজ বিকল্প।
একটি সংবাদপত্র তার স্বাধীন সম্পাদকীয় নীতি অনুসরণ করে প্রকাশিত হচ্ছে। এখন পাঠকের মর্জি, পত্রিকাটি সে পড়তেও পারে, নাও পারে। পত্রিকাটি যদি নিম্নমানের সাংবাদিকতা করে, গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে, বিনিয়োগের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তাহলে দেশের সচেতন নানা গোষ্ঠী ও ফোরাম ইতিমধ্যে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিত। সে রকম কোনো উদ্যোগ এ পর্যন্ত দেখা যায়নি। আমাদের পাঠকসমাজও এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি সচেতেন। উল্লিখিত অভিযোগগুলো যদি সত্য হতো, তাহলে পাঠকেরা বহু আগেই এ পত্রিকা পড়া ছেড়ে দিত। পাঠকেরা কোনো পত্রিকার কাছে জিম্মি নয়। যেমন দর্শকেরা কোনো টিভি চ্যানেলের কাছে জিম্মি নয় (শুধু গ্রামের দর্শকেরা ‘বিটিভির’ কাছে জিম্মি)। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানটি বহু অভিযোগ করেছে, অথচ প্রথম আলোর প্রচারসংখ্যা তাতে কমেনি। এতে কি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানটি পাঠকের বিচার-বুদ্ধি সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করছে? দেশের সংবাদপত্র পাঠকেরা এতই নির্বোধ? তারা প্রথম আলোর ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত ও বাংলাদেশবিরোধী ভূমিকা বুঝতেই পারছে না? পাঠককে এতটা বোকা, অশিক্ষিত বা নির্বোধ ভাবা ঠিক নয়। ব্যবাসয়ী প্রতিষ্ঠানটি প্রথম আলো সম্পর্কে যত অভিযোগ করেছে, তার যদি ২৫ শতাংশও সত্য হতো, তাহলেও আমার ধারণা প্রথম আলোর সার্কুলেশনে বিরাট ধস নামত। প্রথম আলো আজকের প্রচারসংখ্যা কিছুতেই ধরে রাখতে পারত না।
বিজ্ঞাপনটিতে অভিযোগ করা হয়েছে: ‘প্রথম আলো দেশের রাজনৈতিক নেতারা, প্রথা প্রতিষ্ঠান, বিচার বিভাগ, সিভিল প্রশাসন, দেশের সশস্ত্র বাহিনী, মোটকথা রাষ্ট্রের সব ইনস্টিটিউশনের ওপর আঘাত করে চলেছে।’ এ অভিযোগ খুবই মারাত্মক। প্রথম আলো সামান্য একটি দৈনিক পত্রিকা। এক কলমের খোঁচায় সরকার এর ডিক্লারেশন বাতিল করে দিতে পারে। এতগুলো প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রথম আলো আঘাত করে চলেছে, অথচ তারা সবাই নিশ্চুপ? ম্যাজিকটা কী? আর সোচ্চার হয়েছে শুধু এমন একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, যাদের নামে দুর্নীতির নানা মামলা ও অভিযোগ রয়েছে। একটি নিষ্কলুষ প্রতিষ্ঠান এসব অভিযোগ করলে তবু অভিযোগকে কিছুটা গুরুত্ব দেওয়া যেত।
ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনটি পরোক্ষভাবে সরকারকেও হেয় করেছে, সরকারের ক্ষমতা সম্পর্কে চ্যালেঞ্জ করেছে। এটা সরকারের দেখা উচিত। একটি দৈনিক পত্রিকা একসঙ্গে এত রকম ষড়যন্ত্র করে চলেছে, অথচ সরকারের কোনো বিভাগের তা দৃষ্টিগোচর হয়নি, এটা অবিশ্বাস্য। যা সরকারের এত বিভাগের দৃষ্টিগোচর হয়নি, তা একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিতেই শুধু ধরা পড়েছে, যে প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত।
বিজ্ঞাপনটিতে বলা হয়েছে: ‘প্রথম আলো পত্রিকায় প্রচুর সাবজুডিস ও অসত্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।’ যাদের সম্পর্কে অসত্য ও সাবজুডিস রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, তারা আদালত বা প্রেস কাউন্সিলে মামলা করছে না কেন? প্রেস কাউন্সিল যদিও একটি অকার্যকর সরকারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু আদালতের দরজা তো খোলাই ছিল। কোনো সংক্ষুব্ধ প্রতিষ্ঠান আদালতের আশ্রয় নিল না কেন?
বিজ্ঞাপনটিতে এমন আরও কিছু অভিযোগ করা হয়েছে, যেগুলো ফৌজদারি বিষয়। এগুলো আইনের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, দেশে বর্তমানে আইনের শাসন অনেকটা রয়েছে। যদিও সরকারদলীয় রাজনীতিবিদদের প্রতি আইনের প্রয়োগ কিছুটা নমনীয়। প্রথম আলো সরকারদলীয় পত্রিকা নয়। কাজেই এ ক্ষেত্রে আইন তার পূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিজ্ঞাপনটিতে উল্লিখিত অনেক অভিযোগ নিয়ে বিজ্ঞাপনদাতা বিজ্ঞাপনের বদলে আইনের শরণাপন্ন হতে পারত।
আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রথম আলোর সব কাজ বা সব নীতি সমর্থন করি না। তাতে পত্রিকাটির কিছু আসে-যায় না। প্রথম আলোর সম্পাদকীয় নীতি যদি আমার একেবারেই পছন্দ না হয়, তাহলে আমি পত্রিকাটি পড়া ছেড়ে দিতে পারি। এর বেশি কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কোনো সংবাদপত্র বা সাংবাদিক কারও বিরুদ্ধে অসত্য প্রতিবেদন লিখে পার পেয়ে যাবে, তা আমি মেনে নিতে পারি না। হলুদ সাংবাদিকতা দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার ক্ষতি করছে। হলুদ সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেওয়ার জন্য প্রেস কাউন্সিলকে ঢেলে সাজাতে হবে। বর্তমান প্রেস কাউন্সিল দিয়ে তা সম্ভব হবে না।
সংবাদপত্র বা সাংবাদিকেরা ধোয়া তুলসীর পাতা নয়। তাদের নানা অপকর্ম থাকতে পারে। কিন্তু তা আইনিভাবে বিচার করতে হবে। পত্রিকার প্রথম পাতায় বিজ্ঞাপন দিয়ে পত্রিকা ও সম্পাদকের বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ প্রকাশ কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। তেমনি প্রত্যেকটি সংবাদপত্রেরও সাংবাদিকতার নীতিমালা অনুসরণ করা উচিত। নীতিমালা অনুসরণ করলে হলুদ সাংবাদিকতার সুযোগ কমে আসবে।
হলুদ সাংবাদিকতার মতোই দেশের আরেকটি বড় উপদ্রব হলো দুর্নীতি। বাংলাদেশের রাজনীতি ও ব্যবসার একটা বড় অংশ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। ১/১১-এর সরকার সেই দুর্নীতির শিকড় ধরে টান দিলেও পরিকল্পনা ও কৌশল ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় দুর্নীতির সেই অভিযান সফল হয়নি। সাজাপ্রাপ্ত ও অভিযুক্ত দুর্নীতিবাজেরা আইনের ফাঁক দিয়ে একে একে বেরিয়ে আসছে। বর্তমান সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার বটে, কিন্তু সরকারের কাজে সেই দৃঢ়তার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে না। দুদকও এখন নতুন বিধিমালার প্যাঁচে পড়ে দুর্বল। ফলে সমাজের দুর্নীতিবাজেরা এখন আবার মাথা তুলছে। কালো টাকা দিয়ে কিনে নিচ্ছে অনেক কিছু। এর মধ্যে মিডিয়াও বাদ যাচ্ছে না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার দৃঢ় অবস্থান (কথায় ও কাজে) না নিলে আমরা আবার ১/১১-এর পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে পারি, সে আশঙ্কা অনেকের। সরকার যদি দুর্নীতির সঙ্গে সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করে, তাহলে এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না। দেশে যদি দুর্নীতিবাজেরা প্রশ্রয় পায়, আইন যদি তাদের স্পর্শ করতে না পারে, তাহলে স্বাধীন সংবাদপত্র বিকশিত হতে পারবে না। একমাত্র স্বাধীন ও দক্ষ সংবাদপত্রকেই দুর্নীতিবাজেরা ভয় পায়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের শক্ত অবস্থানের ওপর দেশের অনেক কিছুই নির্ভর করছে। স্বাধীন সংবাদপত্রের বিকাশও এর অন্তর্ভুক্ত।
২৬ অক্টোবর ২০০৯
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।
২৬ অক্টোবরের খবর হলো: প্রথম আলোর পক্ষে একটি আইনি প্রতিষ্ঠান ওই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে বিজ্ঞাপনগুলো প্রত্যাহার ও সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রকাশ্যে প্রথম আলোর প্রকাশক ও সম্পাদকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করার উকিল নোটিশ দিয়েছে। আমরা এর আইনি পরিসমাপ্তি কী হয়, তা জানার অপেক্ষায় থাকলাম।
প্রথম আলো একটি বহুল প্রচারিত জনপ্রিয় পত্রিকা। সম্প্রতি পত্রিকা প্রকাশনায় এটি একটি সফল বেসরকারি উদ্যোগ। বেসরকারি খাতে এত বড় ব্যবসাসফল প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি আর দেখা যায়নি, বিশেষ করে মিডিয়া সেক্টরে। প্রথম আলো তার নিজস্ব একটা সম্পাদকীয় নীতি অনুসরণ করে থাকে। সেটা সবার মনঃপূত হবে, এমন আশা করা উচিত নয়। যাদের মনঃপূত হয় না, তারা প্রথম আলো পড়ে না। অন্য পত্রিকা পড়ে। ঢাকার আরও কয়েকটি দৈনিক পত্রিকার ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠী রয়েছে। এমনকি নিয়মিত ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ করে যাচ্ছে, এমন একটি সস্তা দৈনিকের পাঠকও কম নয়। কাজেই প্রথম আলোর সম্পাদকীয় নীতি কারও পছন্দ না হলে পত্রিকাটি না পড়াই হচ্ছে সহজ বিকল্প।
একটি সংবাদপত্র তার স্বাধীন সম্পাদকীয় নীতি অনুসরণ করে প্রকাশিত হচ্ছে। এখন পাঠকের মর্জি, পত্রিকাটি সে পড়তেও পারে, নাও পারে। পত্রিকাটি যদি নিম্নমানের সাংবাদিকতা করে, গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে, বিনিয়োগের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তাহলে দেশের সচেতন নানা গোষ্ঠী ও ফোরাম ইতিমধ্যে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিত। সে রকম কোনো উদ্যোগ এ পর্যন্ত দেখা যায়নি। আমাদের পাঠকসমাজও এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি সচেতেন। উল্লিখিত অভিযোগগুলো যদি সত্য হতো, তাহলে পাঠকেরা বহু আগেই এ পত্রিকা পড়া ছেড়ে দিত। পাঠকেরা কোনো পত্রিকার কাছে জিম্মি নয়। যেমন দর্শকেরা কোনো টিভি চ্যানেলের কাছে জিম্মি নয় (শুধু গ্রামের দর্শকেরা ‘বিটিভির’ কাছে জিম্মি)। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানটি বহু অভিযোগ করেছে, অথচ প্রথম আলোর প্রচারসংখ্যা তাতে কমেনি। এতে কি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানটি পাঠকের বিচার-বুদ্ধি সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করছে? দেশের সংবাদপত্র পাঠকেরা এতই নির্বোধ? তারা প্রথম আলোর ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত ও বাংলাদেশবিরোধী ভূমিকা বুঝতেই পারছে না? পাঠককে এতটা বোকা, অশিক্ষিত বা নির্বোধ ভাবা ঠিক নয়। ব্যবাসয়ী প্রতিষ্ঠানটি প্রথম আলো সম্পর্কে যত অভিযোগ করেছে, তার যদি ২৫ শতাংশও সত্য হতো, তাহলেও আমার ধারণা প্রথম আলোর সার্কুলেশনে বিরাট ধস নামত। প্রথম আলো আজকের প্রচারসংখ্যা কিছুতেই ধরে রাখতে পারত না।
বিজ্ঞাপনটিতে অভিযোগ করা হয়েছে: ‘প্রথম আলো দেশের রাজনৈতিক নেতারা, প্রথা প্রতিষ্ঠান, বিচার বিভাগ, সিভিল প্রশাসন, দেশের সশস্ত্র বাহিনী, মোটকথা রাষ্ট্রের সব ইনস্টিটিউশনের ওপর আঘাত করে চলেছে।’ এ অভিযোগ খুবই মারাত্মক। প্রথম আলো সামান্য একটি দৈনিক পত্রিকা। এক কলমের খোঁচায় সরকার এর ডিক্লারেশন বাতিল করে দিতে পারে। এতগুলো প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রথম আলো আঘাত করে চলেছে, অথচ তারা সবাই নিশ্চুপ? ম্যাজিকটা কী? আর সোচ্চার হয়েছে শুধু এমন একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, যাদের নামে দুর্নীতির নানা মামলা ও অভিযোগ রয়েছে। একটি নিষ্কলুষ প্রতিষ্ঠান এসব অভিযোগ করলে তবু অভিযোগকে কিছুটা গুরুত্ব দেওয়া যেত।
ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনটি পরোক্ষভাবে সরকারকেও হেয় করেছে, সরকারের ক্ষমতা সম্পর্কে চ্যালেঞ্জ করেছে। এটা সরকারের দেখা উচিত। একটি দৈনিক পত্রিকা একসঙ্গে এত রকম ষড়যন্ত্র করে চলেছে, অথচ সরকারের কোনো বিভাগের তা দৃষ্টিগোচর হয়নি, এটা অবিশ্বাস্য। যা সরকারের এত বিভাগের দৃষ্টিগোচর হয়নি, তা একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিতেই শুধু ধরা পড়েছে, যে প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত।
বিজ্ঞাপনটিতে বলা হয়েছে: ‘প্রথম আলো পত্রিকায় প্রচুর সাবজুডিস ও অসত্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।’ যাদের সম্পর্কে অসত্য ও সাবজুডিস রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, তারা আদালত বা প্রেস কাউন্সিলে মামলা করছে না কেন? প্রেস কাউন্সিল যদিও একটি অকার্যকর সরকারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু আদালতের দরজা তো খোলাই ছিল। কোনো সংক্ষুব্ধ প্রতিষ্ঠান আদালতের আশ্রয় নিল না কেন?
বিজ্ঞাপনটিতে এমন আরও কিছু অভিযোগ করা হয়েছে, যেগুলো ফৌজদারি বিষয়। এগুলো আইনের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, দেশে বর্তমানে আইনের শাসন অনেকটা রয়েছে। যদিও সরকারদলীয় রাজনীতিবিদদের প্রতি আইনের প্রয়োগ কিছুটা নমনীয়। প্রথম আলো সরকারদলীয় পত্রিকা নয়। কাজেই এ ক্ষেত্রে আইন তার পূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিজ্ঞাপনটিতে উল্লিখিত অনেক অভিযোগ নিয়ে বিজ্ঞাপনদাতা বিজ্ঞাপনের বদলে আইনের শরণাপন্ন হতে পারত।
আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রথম আলোর সব কাজ বা সব নীতি সমর্থন করি না। তাতে পত্রিকাটির কিছু আসে-যায় না। প্রথম আলোর সম্পাদকীয় নীতি যদি আমার একেবারেই পছন্দ না হয়, তাহলে আমি পত্রিকাটি পড়া ছেড়ে দিতে পারি। এর বেশি কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কোনো সংবাদপত্র বা সাংবাদিক কারও বিরুদ্ধে অসত্য প্রতিবেদন লিখে পার পেয়ে যাবে, তা আমি মেনে নিতে পারি না। হলুদ সাংবাদিকতা দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার ক্ষতি করছে। হলুদ সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেওয়ার জন্য প্রেস কাউন্সিলকে ঢেলে সাজাতে হবে। বর্তমান প্রেস কাউন্সিল দিয়ে তা সম্ভব হবে না।
সংবাদপত্র বা সাংবাদিকেরা ধোয়া তুলসীর পাতা নয়। তাদের নানা অপকর্ম থাকতে পারে। কিন্তু তা আইনিভাবে বিচার করতে হবে। পত্রিকার প্রথম পাতায় বিজ্ঞাপন দিয়ে পত্রিকা ও সম্পাদকের বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ প্রকাশ কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। তেমনি প্রত্যেকটি সংবাদপত্রেরও সাংবাদিকতার নীতিমালা অনুসরণ করা উচিত। নীতিমালা অনুসরণ করলে হলুদ সাংবাদিকতার সুযোগ কমে আসবে।
হলুদ সাংবাদিকতার মতোই দেশের আরেকটি বড় উপদ্রব হলো দুর্নীতি। বাংলাদেশের রাজনীতি ও ব্যবসার একটা বড় অংশ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। ১/১১-এর সরকার সেই দুর্নীতির শিকড় ধরে টান দিলেও পরিকল্পনা ও কৌশল ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় দুর্নীতির সেই অভিযান সফল হয়নি। সাজাপ্রাপ্ত ও অভিযুক্ত দুর্নীতিবাজেরা আইনের ফাঁক দিয়ে একে একে বেরিয়ে আসছে। বর্তমান সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার বটে, কিন্তু সরকারের কাজে সেই দৃঢ়তার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে না। দুদকও এখন নতুন বিধিমালার প্যাঁচে পড়ে দুর্বল। ফলে সমাজের দুর্নীতিবাজেরা এখন আবার মাথা তুলছে। কালো টাকা দিয়ে কিনে নিচ্ছে অনেক কিছু। এর মধ্যে মিডিয়াও বাদ যাচ্ছে না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার দৃঢ় অবস্থান (কথায় ও কাজে) না নিলে আমরা আবার ১/১১-এর পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে পারি, সে আশঙ্কা অনেকের। সরকার যদি দুর্নীতির সঙ্গে সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করে, তাহলে এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না। দেশে যদি দুর্নীতিবাজেরা প্রশ্রয় পায়, আইন যদি তাদের স্পর্শ করতে না পারে, তাহলে স্বাধীন সংবাদপত্র বিকশিত হতে পারবে না। একমাত্র স্বাধীন ও দক্ষ সংবাদপত্রকেই দুর্নীতিবাজেরা ভয় পায়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের শক্ত অবস্থানের ওপর দেশের অনেক কিছুই নির্ভর করছে। স্বাধীন সংবাদপত্রের বিকাশও এর অন্তর্ভুক্ত।
২৬ অক্টোবর ২০০৯
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।
No comments