দুদককে ব্যুরো বানানো চলবে না -দুর্নীতি দমন by মশিউল আলম
প্রথম আলোয় ২৫ অক্টোবর প্রকাশিত দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের সাক্ষাত্কারটির সুবাদে এ লেখা। কয়েক দিন আগে সাংবাদিকদের সামনে দুদক চেয়ারম্যান রূপকের ভাষায় মন্তব্য করেছিলেন, দুদক বর্তমানে একটি দন্তহীন প্রতিষ্ঠান; তবে এর যে থাবা আছে, তাতে নখও আছে। এখন নাকি এ নখগুলো কেটে নেওয়ার উদযোগ চলছে। প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাত্কারে দুদক চেয়ারম্যান অন্য অনেক কথার মধ্যে এ কথাগুলো আরও ব্যাখ্যা করে বলেছেন। বলা বাহুল্য, দুদকের নখগুলো কেটে নেওয়ার বা প্রতিষ্ঠানটির বিদ্যমান ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে একে দুর্বল করার এ উদযোগ চালাচ্ছে বর্তমান নির্বাচিত সরকার, যাদের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল দুদককে আরও শক্তিশালী করা। এখনো সরকারের নেতারা বিভিন্ন উপলক্ষে বক্তৃতার সময় তাঁদের সেই প্রতিশ্রুতির পুনরাবৃত্তি করছেন।
সাক্ষাত্কারটিতে দুদক চেয়ারম্যান স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, তিনি মনে করেন, দুর্নীতি দমনের লক্ষ্যে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার স্পষ্ট অঙ্গীকার রয়েছে, তাঁর আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। তাই দুদক আইন সংশোধনের লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের গঠিত পাঁচ সদস্যের কমিটি যেসব সুপারিশ করেছে, সেগুলোর মধ্যে যেগুলো বাস্তবায়ন করলে দুদকের ক্ষমতা হ্রাস পাবে, শেখ হাসিনা যত দিন প্রধানমন্ত্রী আছেন, তত দিন সেগুলো অনুমোদন পাবে না—এ রকম প্রত্যাশা প্রকাশ করেছেন দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান।
মনে প্রশ্ন জাগল, যে দেশে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার বিপরীতে বিরোধী দল ও নাগরিক সমাজ ছাড়া আর কেউ কিছু করার বা বলার সাহস রাখে না, সে দেশে সরকার দুদককে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে আইন সংশোধনের সুপারিশ করার জন্য যে কমিটি গঠন করেছে, সে কমিটির কাছে কি প্রধানমন্ত্রীর দুদককে শক্তিশালী করার বার্তাটি পৌঁছায়নি? কমিটি কেন এমন কিছু সুপারিশ করেছে, যেগুলো বাস্তবায়ন করলে একটি নখদন্তহীন প্রতিষ্ঠানে দুদকের রূপান্তর সম্পূর্ণ হবে? কমিটি কি এই বুঝেছে যে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকারের নীতিনির্ধারকেরা দুর্নীতি দমন কমিশনকে আবার দুর্নীতি দমন ব্যুরোতে পরিণত করতে চাচ্ছেন?
ওই কমিটি দুদক আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে কতগুলো সুপারিশ পেশ করেছে এবং সেগুলো কী কী, তা বিশদ জানি না। সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন সময় প্রকাশিত খবর থেকে যে দুটি বিষয় জানা গেল তার একটি হচ্ছে: সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনতে হলে দুদককে সরকারের পূর্বানুমতি নিতে হবে। সরকার অনুমতি না দিলে দুদকের ক্ষমতা থাকবে না কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে কিছু করার—না তদন্ত, না মামলা দায়ের। যত দূর জানি, এ রকম বিধান চালু ছিল দুর্নীতি দমন ব্যুরোর সময়, যখন ওই সংস্থাটি পরিচালিত হতো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে। অর্থাত্ প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি ছাড়া দুর্নীতি দমন ব্যুরো বস্তুত দুর্নীতি বিষয়ে কিছুই করার ক্ষমতা রাখত না। ফলে ব্যুরো ছিল কার্যত একটি অকার্যকর সংস্থা। কমিটির আরেকটি সুপারিশ এ রকম যে বর্তমান আইনের বলে দুদক তদন্তের স্বার্থে সরকারের গোপনীয় নথিপত্র দেখার যে ক্ষমতা রাখে, আইন সংশোধনের পর দুদকের সে ক্ষমতা আর থাকবে না। বলা হচ্ছে দুদককে আরও শক্তিশালী করা হবে, কিন্তু সুপারিশ করা হচ্ছে এমন, যাতে তার উল্টোটা ঘটে। দুদককে আরও ক্ষমতাশালী করতে হবে—এই যদি হয় সরকারের ইচ্ছা, তাহলে প্রথমেই খতিয়ে দেখা দরকার, বিদ্যমান দুদক আইনে কী কী দুর্বলতা বা সীমাবদ্ধতা আছে। সংশোধনী আনা উচিত সেই দুর্বলতা বা সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করার লক্ষ্যে, আরও ক্ষমতা প্রদানের জন্য। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, দুদকের বর্তমানে যেটুকু ক্ষমতা রয়েছে, সেগুলোও যেন আর না থাকে, সেই মর্মে আইন সংশোধনের সুপারিশ করা হচ্ছে।
দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার, ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার অপব্যবহার (দুদকের সংজ্ঞা অনুযায়ী মূলত এটাই দুর্নীতি) ক্রমাগত বেড়ে যাওয়া, দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের বছরের পর বছর চ্যাম্পিয়ন হওয়া ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে এ দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গড়ে ওঠে। নাগরিক সমাজের সোচ্চার ভূমিকা, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের ক্রমাগত চাপ, সংবাদমাধ্যমে দুর্নীতিবিরোধী ব্যাপক প্রচারণার প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দলগুলোও বক্তৃতায়-ভাষণে, নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অঙ্গীকার করতে বাধ্য হয়। এরই ধারাবাহিকতায় দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ গৃহীত হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে পরিচালিত ঠুঁটো জগন্নাথ দুর্নীতি দমন ব্যুরো ভেঙে দিয়ে গঠিত হয় স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মনে পড়ে, দুদকের প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সুলতান হোসেন খান নিয়োগ লাভের পর পর নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস প্রথম আলোয় এক বড়সড় নিবন্ধ লিখেছিলেন। ‘যদি হতে পারতেম দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান!’ শিরোনামের তাঁর সে নিবন্ধে থেকে কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করছি: ‘ইস, বাংলাদেশের সবচেয়ে সোজা কাজের দায়িত্বটা বিচারপতি সুলতান হোসেন খান পেয়ে গেলেন! কী ভাগ্যবান তিনি। মনে মনে এমনও ভাবলাম—আহা, এ কাজটা যদি আমি পেতাম, কী মজাটাই না হতো। এমন এক দায়িত্ব, যেখানে গাছে না চড়তেই কাঁদি কাঁদি ফল পাওয়া খুবই সোজা। এটা যে একেবারে সহজ কাজ, এ ব্যাপারে আশা করি দেশের সবাই আমার সঙ্গে একমত হবেন।’(প্রথম আলো, ৩০ মে ২০০৫)
মুহাম্মদ ইউনূসের এ কথাগুলো পরিহাসের মতো মনে হতে পারে। বাস্তবে তো দেখা যাচ্ছে দুর্নীতি দমন করা, দুর্নীতিবাজদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো এ দেশে সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটি—দণ্ড দিয়ে সেই দণ্ড পূর্ণ মেয়াদে ভোগ করানো তো প্রায় অসম্ভব। কিন্তু যে অনৈতিক বাস্তবতাকে আমরা মেনে নিয়েছি, তা যদি এমন সর্বগ্রাসী না হতো, যদি নির্বাহী ক্ষমতাই সর্বময় না হতো, যদি দুর্নীতি দমন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারত, তাহলে দুর্নীতি দমন করা এতটা কঠিন হতো না। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের শেষের দিকে দুর্নীতি দমন কমিশন গঠিত হয়েছে ‘স্বাধীন’ প্রতিষ্ঠান হিসেবে। কিন্তু বাস্তবে ব্যুরো থেকে কমিশনের কোনো পার্থক্যই দৃশ্যমান হয়নি। দুর্নীতি বন্ধ হওয়া দূরে থাক, বরং আরও বেড়েছে। জোট সরকারের বাকি মেয়াদে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার কী লাগামহীন হয়ে উঠেছিল, তা দেশবাসী দেখেছে। বিচারপতি সুলতান হোসেন খান তত্কালীন সরকারের অনুগ্রহভাজন ছিলেন বলে নির্বাহী ক্ষমতা দুদকের আইনি (কাগুজে) স্বাধীনতাকে অর্থহীন করে দিতে পেরেছিল।
দুদকের স্বাধীনতার কিছু স্বাক্ষর দেখা গিয়েছিল জরুরি অবস্থাকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে: দুদক, সরকার ও বিচার বিভাগের মধ্যে দুর্নীতিবিরোধী অঙ্গীকারের ব্যাপারে অভিন্ন নৈতিক অবস্থানের কারণেই মূলত দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চলতে পেরেছিল; প্রক্রিয়াগত ভুলত্রুটি হলেও অনেক মামলা হয়েছিল অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে। এক হাজার ১০০-এর বেশি মামলা করেছিল দুদক। বসেছিল বিশেষ আদালত, অনেককে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল, অনেকে পালিয়ে ছিলেন। অন্তত ৮০ জন ব্যক্তি দণ্ড পেয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রীসহ অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ছিলেন। তখন দুদকের ওপর নির্বাহী বিভাগের চাপের প্রসঙ্গ শোনা যায়নি। সে কারণে দুদকের স্বাধীনতার চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক ছিল সরকারের সমন্বয় ও সহযোগিতার বিষয়গুলো। কিন্তু আমাদের দেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে, নির্বাচিত দলীয় সরকারের সময়ে নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গ ও সাংবিধানিক/স্বতন্ত্র/স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পর্ক যতটা না সমন্বয়-সহযোগিতামূলক, তার চেয়ে বেশি কর্তৃত্বমূলক হয়। নির্বাহী বিভাগের মধ্যে কর্তৃত্বের প্রবণতা কাজ করে।
বর্তমান নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব গ্রহণের অল্প সময়ের মধ্যে দুদক চেয়ারম্যানের পদ থেকে হাসান মশহুদ চৌধুরীর ইস্তফা প্রথম এই সংশয় বয়ে এনেছিল যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুদক যতটা স্বাধীনভাবে কর্ম সম্পাদন করতে পেরেছে, নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের সময়ে তেমনটি আর সম্ভব হবে কি না। হবে না আঁচ করতে পেরেই সম্ভবত তিনি অব্যাহতি নিয়েছেন। হাসান মশহুদ চৌধুরী অবশ্য তাঁর পদত্যাগের কারণ হিসেবে সে রকম কিছু বলেননি; ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে বিদায় নিয়েছেন। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন গোলাম রহমান, যিনি একজন সজ্জন বলে পরিচিত এবং যাঁর কথাবার্তায় মনে হচ্ছে দুর্নীতি দমনের ব্যাপারে তাঁর আন্তরিক অঙ্গীকারে কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু দুদক আইন সংশোধনের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে এই স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের সামনে সত্যিই এক বিপদ এসে হাজির হয়েছে। এই বিপদ এসেছে নির্বাহী ক্ষমতার পক্ষ থেকে। কেবল দুর্নীতি দমনের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদিচ্ছার ওপর ভরসা রেখেই এ বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া কঠিন হবে। দুদককে দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মতো নির্বাহী ক্ষমতার অধীনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে গোটা আমলাতন্ত্র এবং যাদের হাতে ক্ষমতা আছে, যারা সে ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহার করতে চায় জবাবদিহির ঊর্ধ্বে থেকে, তারা সবাই। প্রধানমন্ত্রীকেও তারা প্রভাবিত করার চেষ্টা করবে। সরকারি দলের দুর্নীতিবাজদের চাপও কম নয়। দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহারের জন্য প্রতিদিন দুদকের কাছে তালিকা পাঠানো হচ্ছে; ইতিমধ্যে মধ্যে ১০০-এর বেশি মামলা রাজনৈতিক আখ্যা দিয়ে প্রত্যাহারের আবেদন জমা হয়েছে এবং তালিকা আসা অব্যাহত আছে। শুধু বিচারাধীন মামলা নয়, নিম্ন আদালতে সাজা হয়েছে, এমন মামলাও প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, প্রধানমন্ত্রী কি অবগত নন, কী অভিযোগে, কাদের বিরুদ্ধে এসব মামলা? সবই কি মিথ্যা, ভিত্তিহীন অভিযোগের মামলা? তা যদি হয়ও, আদালতেই সেটা প্রমাণিত হোক। মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশের মধ্যে কি আইনের প্রতি শ্রদ্ধার প্রকাশ ঘটে? আর, যাদের মামলা প্রত্যাহরের জন্য বলা হচ্ছে, তাঁরা কি কেবলই ক্ষমতাবলয় ও তার চারপাশের ঘনিষ্ঠ লোকজন নন? কাদের বিরুদ্ধে কী অভিযোগে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের জন্য দুদককে বলা হচ্ছে, তার একটা তালিকা যদি দুদকের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়, তাহলে জনগণ তা দেখে ধারণা করতে পারবে, এই সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অঙ্গীকারের স্বরূপ কেমন।
দুদক দুর্নীতি দমন করবে কী, নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব ও বিদ্যমান ক্ষমতাগুলো (দাঁত-নখ) রক্ষা করার জন্যই তাকে এখন প্রাণপণ চেষ্টা চালাতে হবে। এই চেষ্টায় দুদকের সঙ্গে নাগরিক সমাজেরও শামিল হওয়া কর্তব্য। সে জন্য দুদক আইন সংশোধনের লক্ষ্যে সরকারের গঠিত কমিটির সুপারিশগুলো দুদকের ওয়েবসাইটসহ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করা হোক; এগুলো সম্পর্কে জনগণের মতামত চাওয়া হোক, খোলা ফোরামে, সভা-সেমিনার-গোলটেবিল বৈঠকে, বেতার-টিভিতে আলোচনা-পর্যালোচনা হোক। দুদককে আরও শক্তিশালী করার জন্য বিদ্যমান আইনের যদি সংশোধন, সংযোজন-বিয়োজনের প্রয়োজন হয়, তবে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে সেভাবে সংশোধনীর উদ্যোগ নিতে হবে। দুদককে দুর্বল করতে পারে, এমন কোনো সুপারিশ কোনোভাবেই বাস্তবায়ন করা চলবে না।
মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
সাক্ষাত্কারটিতে দুদক চেয়ারম্যান স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, তিনি মনে করেন, দুর্নীতি দমনের লক্ষ্যে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার স্পষ্ট অঙ্গীকার রয়েছে, তাঁর আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। তাই দুদক আইন সংশোধনের লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের গঠিত পাঁচ সদস্যের কমিটি যেসব সুপারিশ করেছে, সেগুলোর মধ্যে যেগুলো বাস্তবায়ন করলে দুদকের ক্ষমতা হ্রাস পাবে, শেখ হাসিনা যত দিন প্রধানমন্ত্রী আছেন, তত দিন সেগুলো অনুমোদন পাবে না—এ রকম প্রত্যাশা প্রকাশ করেছেন দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান।
মনে প্রশ্ন জাগল, যে দেশে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার বিপরীতে বিরোধী দল ও নাগরিক সমাজ ছাড়া আর কেউ কিছু করার বা বলার সাহস রাখে না, সে দেশে সরকার দুদককে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে আইন সংশোধনের সুপারিশ করার জন্য যে কমিটি গঠন করেছে, সে কমিটির কাছে কি প্রধানমন্ত্রীর দুদককে শক্তিশালী করার বার্তাটি পৌঁছায়নি? কমিটি কেন এমন কিছু সুপারিশ করেছে, যেগুলো বাস্তবায়ন করলে একটি নখদন্তহীন প্রতিষ্ঠানে দুদকের রূপান্তর সম্পূর্ণ হবে? কমিটি কি এই বুঝেছে যে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকারের নীতিনির্ধারকেরা দুর্নীতি দমন কমিশনকে আবার দুর্নীতি দমন ব্যুরোতে পরিণত করতে চাচ্ছেন?
ওই কমিটি দুদক আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে কতগুলো সুপারিশ পেশ করেছে এবং সেগুলো কী কী, তা বিশদ জানি না। সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন সময় প্রকাশিত খবর থেকে যে দুটি বিষয় জানা গেল তার একটি হচ্ছে: সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনতে হলে দুদককে সরকারের পূর্বানুমতি নিতে হবে। সরকার অনুমতি না দিলে দুদকের ক্ষমতা থাকবে না কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে কিছু করার—না তদন্ত, না মামলা দায়ের। যত দূর জানি, এ রকম বিধান চালু ছিল দুর্নীতি দমন ব্যুরোর সময়, যখন ওই সংস্থাটি পরিচালিত হতো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে। অর্থাত্ প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি ছাড়া দুর্নীতি দমন ব্যুরো বস্তুত দুর্নীতি বিষয়ে কিছুই করার ক্ষমতা রাখত না। ফলে ব্যুরো ছিল কার্যত একটি অকার্যকর সংস্থা। কমিটির আরেকটি সুপারিশ এ রকম যে বর্তমান আইনের বলে দুদক তদন্তের স্বার্থে সরকারের গোপনীয় নথিপত্র দেখার যে ক্ষমতা রাখে, আইন সংশোধনের পর দুদকের সে ক্ষমতা আর থাকবে না। বলা হচ্ছে দুদককে আরও শক্তিশালী করা হবে, কিন্তু সুপারিশ করা হচ্ছে এমন, যাতে তার উল্টোটা ঘটে। দুদককে আরও ক্ষমতাশালী করতে হবে—এই যদি হয় সরকারের ইচ্ছা, তাহলে প্রথমেই খতিয়ে দেখা দরকার, বিদ্যমান দুদক আইনে কী কী দুর্বলতা বা সীমাবদ্ধতা আছে। সংশোধনী আনা উচিত সেই দুর্বলতা বা সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করার লক্ষ্যে, আরও ক্ষমতা প্রদানের জন্য। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, দুদকের বর্তমানে যেটুকু ক্ষমতা রয়েছে, সেগুলোও যেন আর না থাকে, সেই মর্মে আইন সংশোধনের সুপারিশ করা হচ্ছে।
দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার, ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার অপব্যবহার (দুদকের সংজ্ঞা অনুযায়ী মূলত এটাই দুর্নীতি) ক্রমাগত বেড়ে যাওয়া, দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের বছরের পর বছর চ্যাম্পিয়ন হওয়া ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে এ দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গড়ে ওঠে। নাগরিক সমাজের সোচ্চার ভূমিকা, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের ক্রমাগত চাপ, সংবাদমাধ্যমে দুর্নীতিবিরোধী ব্যাপক প্রচারণার প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দলগুলোও বক্তৃতায়-ভাষণে, নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অঙ্গীকার করতে বাধ্য হয়। এরই ধারাবাহিকতায় দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ গৃহীত হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে পরিচালিত ঠুঁটো জগন্নাথ দুর্নীতি দমন ব্যুরো ভেঙে দিয়ে গঠিত হয় স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মনে পড়ে, দুদকের প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সুলতান হোসেন খান নিয়োগ লাভের পর পর নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস প্রথম আলোয় এক বড়সড় নিবন্ধ লিখেছিলেন। ‘যদি হতে পারতেম দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান!’ শিরোনামের তাঁর সে নিবন্ধে থেকে কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করছি: ‘ইস, বাংলাদেশের সবচেয়ে সোজা কাজের দায়িত্বটা বিচারপতি সুলতান হোসেন খান পেয়ে গেলেন! কী ভাগ্যবান তিনি। মনে মনে এমনও ভাবলাম—আহা, এ কাজটা যদি আমি পেতাম, কী মজাটাই না হতো। এমন এক দায়িত্ব, যেখানে গাছে না চড়তেই কাঁদি কাঁদি ফল পাওয়া খুবই সোজা। এটা যে একেবারে সহজ কাজ, এ ব্যাপারে আশা করি দেশের সবাই আমার সঙ্গে একমত হবেন।’(প্রথম আলো, ৩০ মে ২০০৫)
মুহাম্মদ ইউনূসের এ কথাগুলো পরিহাসের মতো মনে হতে পারে। বাস্তবে তো দেখা যাচ্ছে দুর্নীতি দমন করা, দুর্নীতিবাজদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো এ দেশে সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটি—দণ্ড দিয়ে সেই দণ্ড পূর্ণ মেয়াদে ভোগ করানো তো প্রায় অসম্ভব। কিন্তু যে অনৈতিক বাস্তবতাকে আমরা মেনে নিয়েছি, তা যদি এমন সর্বগ্রাসী না হতো, যদি নির্বাহী ক্ষমতাই সর্বময় না হতো, যদি দুর্নীতি দমন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারত, তাহলে দুর্নীতি দমন করা এতটা কঠিন হতো না। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের শেষের দিকে দুর্নীতি দমন কমিশন গঠিত হয়েছে ‘স্বাধীন’ প্রতিষ্ঠান হিসেবে। কিন্তু বাস্তবে ব্যুরো থেকে কমিশনের কোনো পার্থক্যই দৃশ্যমান হয়নি। দুর্নীতি বন্ধ হওয়া দূরে থাক, বরং আরও বেড়েছে। জোট সরকারের বাকি মেয়াদে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার কী লাগামহীন হয়ে উঠেছিল, তা দেশবাসী দেখেছে। বিচারপতি সুলতান হোসেন খান তত্কালীন সরকারের অনুগ্রহভাজন ছিলেন বলে নির্বাহী ক্ষমতা দুদকের আইনি (কাগুজে) স্বাধীনতাকে অর্থহীন করে দিতে পেরেছিল।
দুদকের স্বাধীনতার কিছু স্বাক্ষর দেখা গিয়েছিল জরুরি অবস্থাকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে: দুদক, সরকার ও বিচার বিভাগের মধ্যে দুর্নীতিবিরোধী অঙ্গীকারের ব্যাপারে অভিন্ন নৈতিক অবস্থানের কারণেই মূলত দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চলতে পেরেছিল; প্রক্রিয়াগত ভুলত্রুটি হলেও অনেক মামলা হয়েছিল অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে। এক হাজার ১০০-এর বেশি মামলা করেছিল দুদক। বসেছিল বিশেষ আদালত, অনেককে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল, অনেকে পালিয়ে ছিলেন। অন্তত ৮০ জন ব্যক্তি দণ্ড পেয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রীসহ অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ছিলেন। তখন দুদকের ওপর নির্বাহী বিভাগের চাপের প্রসঙ্গ শোনা যায়নি। সে কারণে দুদকের স্বাধীনতার চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক ছিল সরকারের সমন্বয় ও সহযোগিতার বিষয়গুলো। কিন্তু আমাদের দেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে, নির্বাচিত দলীয় সরকারের সময়ে নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গ ও সাংবিধানিক/স্বতন্ত্র/স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পর্ক যতটা না সমন্বয়-সহযোগিতামূলক, তার চেয়ে বেশি কর্তৃত্বমূলক হয়। নির্বাহী বিভাগের মধ্যে কর্তৃত্বের প্রবণতা কাজ করে।
বর্তমান নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব গ্রহণের অল্প সময়ের মধ্যে দুদক চেয়ারম্যানের পদ থেকে হাসান মশহুদ চৌধুরীর ইস্তফা প্রথম এই সংশয় বয়ে এনেছিল যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুদক যতটা স্বাধীনভাবে কর্ম সম্পাদন করতে পেরেছে, নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের সময়ে তেমনটি আর সম্ভব হবে কি না। হবে না আঁচ করতে পেরেই সম্ভবত তিনি অব্যাহতি নিয়েছেন। হাসান মশহুদ চৌধুরী অবশ্য তাঁর পদত্যাগের কারণ হিসেবে সে রকম কিছু বলেননি; ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে বিদায় নিয়েছেন। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন গোলাম রহমান, যিনি একজন সজ্জন বলে পরিচিত এবং যাঁর কথাবার্তায় মনে হচ্ছে দুর্নীতি দমনের ব্যাপারে তাঁর আন্তরিক অঙ্গীকারে কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু দুদক আইন সংশোধনের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে এই স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের সামনে সত্যিই এক বিপদ এসে হাজির হয়েছে। এই বিপদ এসেছে নির্বাহী ক্ষমতার পক্ষ থেকে। কেবল দুর্নীতি দমনের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদিচ্ছার ওপর ভরসা রেখেই এ বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া কঠিন হবে। দুদককে দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মতো নির্বাহী ক্ষমতার অধীনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে গোটা আমলাতন্ত্র এবং যাদের হাতে ক্ষমতা আছে, যারা সে ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহার করতে চায় জবাবদিহির ঊর্ধ্বে থেকে, তারা সবাই। প্রধানমন্ত্রীকেও তারা প্রভাবিত করার চেষ্টা করবে। সরকারি দলের দুর্নীতিবাজদের চাপও কম নয়। দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহারের জন্য প্রতিদিন দুদকের কাছে তালিকা পাঠানো হচ্ছে; ইতিমধ্যে মধ্যে ১০০-এর বেশি মামলা রাজনৈতিক আখ্যা দিয়ে প্রত্যাহারের আবেদন জমা হয়েছে এবং তালিকা আসা অব্যাহত আছে। শুধু বিচারাধীন মামলা নয়, নিম্ন আদালতে সাজা হয়েছে, এমন মামলাও প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, প্রধানমন্ত্রী কি অবগত নন, কী অভিযোগে, কাদের বিরুদ্ধে এসব মামলা? সবই কি মিথ্যা, ভিত্তিহীন অভিযোগের মামলা? তা যদি হয়ও, আদালতেই সেটা প্রমাণিত হোক। মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশের মধ্যে কি আইনের প্রতি শ্রদ্ধার প্রকাশ ঘটে? আর, যাদের মামলা প্রত্যাহরের জন্য বলা হচ্ছে, তাঁরা কি কেবলই ক্ষমতাবলয় ও তার চারপাশের ঘনিষ্ঠ লোকজন নন? কাদের বিরুদ্ধে কী অভিযোগে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের জন্য দুদককে বলা হচ্ছে, তার একটা তালিকা যদি দুদকের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়, তাহলে জনগণ তা দেখে ধারণা করতে পারবে, এই সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অঙ্গীকারের স্বরূপ কেমন।
দুদক দুর্নীতি দমন করবে কী, নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব ও বিদ্যমান ক্ষমতাগুলো (দাঁত-নখ) রক্ষা করার জন্যই তাকে এখন প্রাণপণ চেষ্টা চালাতে হবে। এই চেষ্টায় দুদকের সঙ্গে নাগরিক সমাজেরও শামিল হওয়া কর্তব্য। সে জন্য দুদক আইন সংশোধনের লক্ষ্যে সরকারের গঠিত কমিটির সুপারিশগুলো দুদকের ওয়েবসাইটসহ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করা হোক; এগুলো সম্পর্কে জনগণের মতামত চাওয়া হোক, খোলা ফোরামে, সভা-সেমিনার-গোলটেবিল বৈঠকে, বেতার-টিভিতে আলোচনা-পর্যালোচনা হোক। দুদককে আরও শক্তিশালী করার জন্য বিদ্যমান আইনের যদি সংশোধন, সংযোজন-বিয়োজনের প্রয়োজন হয়, তবে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে সেভাবে সংশোধনীর উদ্যোগ নিতে হবে। দুদককে দুর্বল করতে পারে, এমন কোনো সুপারিশ কোনোভাবেই বাস্তবায়ন করা চলবে না।
মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments