মির্জা গালিবের যত বিপত্তি by জাভেদ হুসেন
বিচারক উঠে নিজের চেম্বারে রওনা হয়েছেন, মৃদুভাষী উকিল একটা কবিতার পঙ্ক্তির দ্বিতীয় লাইন পড়লেন:
‘কওন জিতা হ্যাঁয় তেরে জুলফ কে সর হোতে তক’
(কে বাঁচে তোমার কেশগুচ্ছ সাজিয়ে নেওয়া পর্যন্ত?)
কবিতা শুনে বিচারক থেমে গেলেন। উকিল সাহেবকে বললেন, প্রথম লাইনটাও পড়ুন। উকিল পড়লেন:
‘আহ কো চাহিয়ে ইক উম্র আসর হোতে তক’
(একটা দীর্ঘশ্বাসের ফল ফলতে একটা জীবন দরকার)
বিচারক চলে যাওয়ার আগে আদালতের কর্মচারীকে বললেন, এই মামলার তারিখ আগামী সপ্তাহে রাখবেন। বিচারকের নাম তিরথ সিং ঠাকুর। উকিল ছিলেন নাজমি ওয়াজিরি। মামলা চলছিল দিল্লি হাইকোর্টে। আর শেরটা মির্জা গালিবের।
মির্জা গালিব এই মামলায় খোদ উকিলের পরিত্রাতা হলেন। কিন্তু নিজের জীবনে ঝুটঝামেলা তাঁর পিছু ছাড়েনি। অর্থাভাব, পাওনাদারের অপমান আর আদালতে নালিশ, কয়েদবাস—কী ছিল না তাঁর জীবনে?
পেনশনের ঝামেলা
আইন, মামলা আর আদালতের সঙ্গে মির্জা গালিবকে মোটামুটি সারা জীবনই কাটাতে হয়েছে। তাঁর সৈনিক বাবা মির্জা আবদুল্লাহ বেগ মারা যান ১৮০৩ সালে। গালিবের বয়স তখন ৫। পরিবারের দায়িত্ব তুলে নেন চাচা মির্জা নসরুল্লাহ বেগ।
১৮০৬ সালে চাচাও মারা গেলেন দুর্ঘটনায়। পরিবারের পেনশন ঠিক হলো বছরে ১০ হাজার টাকা। সে টাকা দেওয়ার দায়িত্ব পড়ল ফিরোজপুর ঝিরকার জমিদারির ওপর। ইংরেজদের চাপিয়ে দেওয়া পেনশনের টাকা দিতে জমিদারদের খুব আগ্রহ থাকার কথাও নয়। পেনশনের টাকা নেমে এল বছরে তিন হাজার টাকায়। শেষে বিভিন্ন দাবিদারদের মধ্যে ভাগ হয়ে গালিবের ভাগে এল মাসে ৬২ টাকা ৫০ আনা।
গালিবের জীবনের অর্ধেক কেটেছে পেনশনের প্রাপ্য টাকা আদায় করতে দেনদরবার আর মামলা করে। প্রথমে প্রভাবশালী বন্ধুদের সহায়তা নিয়ে ব্যর্থ হয়ে মামলা করেছেন। সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে।
দেনদরবারে কলকাতায়
গালিবের বয়স যখন ১৪ বছর, ১৮১১ সালে পারিবারিক বন্ধুদের পরামর্শে দিল্লির ব্রিটিশ রেসিডেন্ট স্যার চার্লস মেটকাফের কাছে দরবার করলেন। সেখান থেকে জানলেন, গভর্নর জেনারেল ইন কাউন্সিল উইলিয়াম এমহার্স্ট ছাড়া এ সিদ্ধান্ত আর কেউ দিতে পারবেন না। এমহার্স্ট সাহেবের দপ্তর ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতায়।
গালিব যুবক বয়সে, ১৮২৬ সালে রওনা দিলেন কলকাতায়। পৌঁছালেন দেড় বছর পর। পথে বিভিন্ন জায়গায় থামলেন। বিভিন্ন দরবারে অতিথি হলেন। কাশি দেখে অভিভূত হয়ে লিখলেন ফারসি মসনভি, ‘চারাগে দ্যায়ের’, মানে মন্দিরের প্রদীপ। কলকাতায় গিয়ে পৌঁছালেন ১৮২৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। থাকলেন দেড় বছর।
গালিব শিগগিরই ব্রিটিশ চিফ সেক্রেটারি এন্ড্রু স্টারলিং আর তাঁর সহযোগী সাইমন ফেজারের সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করে ফেললেন। বিষয় উত্থাপিত হলো গভর্নর জেনারেল ইন কাউন্সিলের দরবারে। তিনি জানালেন, এ বিষয়ে তাঁর কিছু করার নেই। দিল্লির রেসিডেন্ট সাহেব যদি মামলার দায়িত্ব দেন, তাহলে তিনি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিতে পারেন।
এর মধ্যে দিল্লির রেসিডেন্ট ম্যাটকাফ সাহেব বদলি হয়ে গেছেন। বদলিতে এসেছেন এডওয়ার্ড কোলব্রুক। এই সাহেবকে গালিব ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। গালিব দিল্লির বিখ্যাত উকিল পণ্ডিত হিরা নন্দকে দায়িত্ব দিলেন রেসিডেন্টের দরবারে বিষয় সুরাহা করার। ডাকযোগে কাগজপত্র পাঠালেন। মামলা চালানোর খরচ জোগাড় হলো কিছু দামি জিনিসপত্র বিক্রি করে। ওকালতনামা পাঠানো হলো। এর মধ্যে কোলব্রুক সাহেব বদলি হয়ে গেলেন। নতুন রেসিডেন্ট হলেন উইলিয়াম ফ্রেজার। আগের ওকালতনামা বাতিল হলো। সব চেষ্টা গেল জলে।
এ সময় গালিব কলকাতার সদর দিওয়ানি আদালতে আবেদন করলেন। এই আদালতও জানালেন যে মামলায় তাঁদের এখতিয়ার নেই। ব্যর্থ মনোরথ গালিব দিল্লিতে ফিরলেন ১৮২৯ সালের আগস্টে। তবে নতুন যুগের কলকাতা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। তিনি লিখেছিলেন:
‘কলকাতার কথা মনে করিয়ে দিলে হে বন্ধু
যেন আমার বুকে তির মারলে, হায় হায়।’
এদিকে দিল্লিতে রেসিডেন্টের দরবারেও মামলা খারিজ হয়ে গেল। গালিব আপিল করলেন লন্ডনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালকদের আদালতে। ফলাফল শূন্য।
ফ্রেজার হত্যা মামলা
লন্ডন থেকে আবেদন খারিজ হওয়ার পর গালিবের স্ত্রী উমরাও বেগমের চাচাতো ভাই বললেন যে তিনি দিল্লির রেসিডেন্ট ফ্রেজার সাহেবকে পেনশনের জন্য রাজি করাতে পারবেন। তবে এর জন্য খরচাপাতি লাগবে। গালিব আবার টাকা ধার নিয়ে দিলেন।
এর কিছুদিন পরেই এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটল। ১৮৩৫ সালের ২২ মার্চ ফ্রেজার সাহেব খুন হলেন। কিসনগড়ের রাজার বাড়িতে পার্টি শেষ করে ফিরছিলেন রাতে। পথে আততায়ী গুলি করে তাঁকে হত্যা করে। পুলিশ আততায়ীকে খুঁজে গ্রেপ্তার করে। নাম করিম উদ্দিন। জেরায় তিনি স্বীকার করেন যে হত্যার নির্দেশ পেয়েছেন নওয়াব শামসউদ্দিনের কাছ থেকে। উমরাও বেগমের যে ভাই গালিবের মামলা ফ্রেজার সাহেবের কাছে তদবির করছিলেন, শামসউদ্দিন তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই। শামসউদ্দিনদের জমিদারি থেকেই গালিবের পেনশনের টাকা আসত। তা নিয়ে শামসউদ্দিনের আপত্তি ছিল। বিবাদও ছিল সৎভাইয়ের সঙ্গে সম্পত্তি নিয়ে। বিবাদে ফ্রেজার শামসউদ্দিনের পক্ষে ছিলেন না।
আরও সমস্যা ছিল। শামসউদ্দিন বিয়ে করেছিলেন ওয়াজির খানম নামের এক নারীকে। ওয়াজির ছিলেন একজন তাওয়ায়েফ। ফ্রেজারের তাঁর সঙ্গে আগে থেকে সখ্য ছিল। সব মিলিয়ে শামসউদ্দিন গ্রেপ্তার হলেন। রায়ে তাঁর হলো ফাঁসি। ফ্রেজার ছিলেন ভারতীয় সংস্কৃতি নিয়ে আগ্রহী লোক, গালিবের বন্ধুস্থানীয়। আর নওয়াব শামসউদ্দিন তাঁর বিরোধী। আবার পরিবারের আত্মীয়। হত্যা মামলায় গালিব জড়িয়ে পড়লেন। দিল্লির ম্যাজিস্ট্রেট মামলায় তাঁর জবানবন্দি নিয়েছিলেন।
শামসউদ্দিনের ফাঁসিতে দিল্লিতে প্রবল আলোড়ন শুরু হলো। অধিকাংশ মানুষের বিশ্বাস, তিনি নির্দোষ। ইংরেজদের ষড়যন্ত্রের শিকার। ফাঁসির পর তিনি শহীদের মর্যাদা পেয়ে গেলেন প্রায়। আর গালিব পুলিশকে জবানবন্দি দিয়ে দিল্লিবাসীর কাছে তকমা পেয়ে গেলেন বিশ্বাসঘাতকের। এটা অবশ্য অন্যায্য ছিল। প্রথমত, জবানবন্দি তাঁকে দিতেই হতো। আর দ্বিতীয়ত, পুরো ঘটনায় তাঁর ক্ষতিই হয়েছিল। একদিকে ফ্রেজারের মতো প্রভাবশালী বন্ধুস্থানীয় লোক হারালেন। অপর দিকে ঝিরকার নবাবদের জমিদারি বাজেয়াপ্ত হলো। তিনি চিরকালের মতো পেনশন বাড়ানোর সুযোগ হারালেন।
বাকি জীবন গালিবের আর্থিক দৈন্যে কেটেছে। নিজের অবস্থা যেমন হোক না কেন, বাড়িতে সব মিলিয়ে পোষ্য ছিল ২০ জন। কেমন করে সংসার চালাতেন, কোত্থেকে আসত টাকা? বন্ধু সুরুরকে লেখা ১৮৬২ সালের এক চিঠিতে এর কিছু বয়ান পাওয়া যায়, ‘বেশ কিছুদিন পর দিল্লির বাদশাহ আমাকে মাসে ৫০ টাকায় নিয়োগ দিলেন। যুবরাজ বরাদ্দ করলেন বছরে ৪০০ টাকা। এর দুই বছর পরে যুবরাজ মারা গেলেন। আমার কাসিদা পড়ে আওধের বাদশাহ ওয়াজিদ আলী শাহ বছরে ৫০০ টাকা বরাদ্দ করলেন। তিনিও দুই বছরের বেশি টিকে থাকতে পারলেন না। মানে, বেঁচে তিনি এখনো আছেন, কিন্তু তাঁর রাজত্ব নেই। দিল্লির রাজত্বের প্রাণ একটু বেশি শক্ত ছিল। আমাকে সাত বছর খাবার জোগানোর ব্যবস্থা করে তারপর ধ্বংস হলো।’
চৌসরের দায়, জুয়ার দায়
মোগল আমলে সামান্য টাকা বাজি রেখে চৌসর খেলা খুব একটা দোষের কিছু ছিল না। কিন্তু ইংরেজদের নতুন শাসনে তা হলো দণ্ডনীয় অপরাধ। গালিব পাশা ফেলে চৌসর খেলতেন নিজ ঘরে। কাছের কিছু বন্ধুর সঙ্গে। আগের কোতোয়াল ছিলেন গালিবের বন্ধু। ফলে কখনো সমস্যা হয়নি। সেই কোতোয়াল বদলি হলেন। নতুন কোতোয়াল এলেন ফয়জুল হাসান খান। তিনি মোগল ক্ষয়িষ্ণু অভিজাতদের মান-সম্মানের ধার ধারতেন না।
জুয়া খেলার অভিযোগে গালিবের বাড়িতে পুলিশের অভিযান হয়েছিল। জরিমানা গুনতে হয়েছিল ১০০ টাকা। তাহলে এরপরও কেন তিনি ঘরে বসে টাকা বাজি রেখে পাশা খেলছিলেন? কারণ বোধ হয় এই যে তিনি ইংরেজ প্রশাসনে বেশ কিছু প্রভাবশালী বন্ধু পেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, তেমন কিছু হলে তাঁরা রক্ষা করবেন। কিন্তু গালিবের ভুল ভাঙল। তিনি বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার হলেন। বিচার আর শাস্তিও হলো। ২০০ টাকা নগদ অর্থদণ্ড আর ছয় মাস সশ্রম জেল। ৫০ টাকা বাড়তি দিলে বিনাশ্রম কয়েদ।
পুরো ছয় মাস গালিবকে জেল খাটতে হয়নি। তিন মাস পর মুক্তি পেয়েছিলেন। কী কারণে এই রেয়াত, তা আজ আর জানা যায় না। তবে এ ঘটনায় গালিবের মন ভেঙে গিয়েছিল। অস্তমিত বংশগৌরব, তবু মনে গর্ব ছিল, বড় কবি তিনি। কিন্তু এই কয়েদ খাটার ঘটনায় কাছের মানুষদের ওপর আস্থাও যে কবির টলে গিয়েছিল, জেলে কাটানো সময় নিয়ে লেখা একটা ফারসি কবিতায় তা বোঝা যায়:
‘পুরোনো বন্ধুরা, বৃথা করো না কষ্ট
আমাকে দেখতে আসার
নেড়ো না কড়া আমার দরজার, কে খুলবে আর এই দ্বার
বন্দী তস্কর আমার বন্ধু এখন, তারাই আমার কদরদান
তাদের কোলাহল থামিয়ে বলি,
“বাইরে নেই বিশ্বস্ততা বলে কিছু”’
দেনার দায়
এদিকে বাজারে দেনা বেড়ে অবস্থা করুণ। কলকাতায় গিয়ে পেনশনের টাকা ফিরে পাবেন বলে আশা ছিল। সে আশার গুড়ে বালি পড়েছে। পাওনাদারেরা সব জেনে গেছেন সে কথা। তাঁরা টাকার জন্য অস্থির। বাড়ির সামনে এসে ভিড় করে থাকেন। হইহল্লা করেন। বিপদের এই ঘনঘটা দেখে গালিব নাকি বলেছিলেন, ‘খোদার পাঠানো সব বিপদ দুনিয়ায় নেমেই জিজ্ঞাসা করে, গালিবের বাড়িটা কোথায়?’
তবে স্বভাবসিদ্ধ রসিকতা তিনি ভোলেননি। দেনাদারদের হাতে নাজেহাল হয়ে এক বন্ধুকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘মানুষ অন্যের কষ্ট দেখলে আনন্দ পায়। আমিও এক কায়দা শিখে নিয়েছি। নিজেকে আরেকজন ভেবে নিয়ে নিজের বিপদে নিজেই মজা পাই।’
মৃত্যুর আগপর্যন্ত এই দেনার টাকা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন গালিব। বিভিন্ন জায়গায় অর্থসহায়তা চেয়ে চিঠি লিখেও কোনো সাড়া পাননি। আর চিন্তা ছিল স্ত্রী উমরাওকে নিয়েও। তাঁর মৃত্যুর পর নিকটজন বলতে এমন কেউ ছিল না যে এই নারীর সহায় হবে।
নিজের দেনা শোধ করতে না পারলেও মির্জা গালিব আমাদের ঋণী করে গেলেন। এখনো অনেক অজ্ঞাত উর্দু কবি নিজেদের কবিতা গালিবের বলে প্রচার করেন। তবে সেসব জাল কবিতা কোনোমতেই গালিবের নয়, পড়লেই বোঝা যায়।
হায় রে, মৃত্যুর পরও কবিতা লেখা থামল না গালিবের!
No comments