ড্রাইভিং সিটে বসেও বিএনপি’র উদ্বেগের নেপথ্যে কী? by সাজেদুল হক ও কিরণ শেখ

ফুটবল অথবা ক্রিকেট। ছন্দময় ব্রাজিল কিংবা আক্রমণাত্মক অস্ট্রেলিয়া। প্রতিপক্ষকে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়া। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমনটা কখনোই বিএনপি’র বৈশিষ্ট্য ছিল না। যদিও প্রতিপক্ষকে নির্মূলের চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে দলটির বিরুদ্ধে। কিন্তু শুরু থেকেই বিএনপি মনোযোগী ছিল টেবিল পলিটিক্সে। প্রয়াত জিয়াউর রহমানকে ঘিরে ছিলেন একদল মেধাবী মানুষ। খালেদা জিয়া বিএনপিকে রাজপথে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করান। এরশাদের পতনের পর ভোটে জয়ী হয়ে চমক তৈরি করেন। এরপর কখনো মসনদে, কখনো বিরোধী দলে আসন ছিল বিএনপি’র। তবে ওয়ান ইলেভেন সবকিছু একেবারে তছনছ করে দেয়। এরপর টানা ১৮ বছর ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। তবে আরেকটি বিখ্যাত তারিখ বিএনপিকে প্রত্যাশিত কিন্তু নাটকীয়ভাবে ড্রাইভিং সিটে নিয়ে এসেছে।

৫ই আগস্ট হাসিনার পলায়নের পর বিএনপি তার দুঃসময় অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে। রাজপথ থেকে প্রশাসন সর্বত্র দলটির কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। তারপরও বিএনপি’র বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের কথায় একধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশিত হচ্ছে। অন্তত বক্তৃতা-বিবৃতিতে তারা দ্রুত নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ তৈরি করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের একধরনের রোডম্যাপ দিলেও বিএনপি তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। দলটির পক্ষ থেকে স্পষ্ট রোডম্যাপের দাবি জানানো হয়েছে। এমনকি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভোটের অধিকারের দাবিতে রাজপথে নামার কথাও বলছেন। বিএনপিতে কেন এ ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। দলটির ভেতরে-বাইরে কথা বলে একটা ধারণা পাওয়া যায়।

বেশির ভাগ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মনে করেন, এখন দেশে নির্বাচন হলে বিএনপি জয়লাভ করবে। স্বাভাবিকভাবেই এ কারণে বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চাচ্ছে। এটি রাজনীতির সবচেয়ে সহজ হিসাব।
বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ মনে করেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর ক্রমশ চাপ বাড়বে। ভারত বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও তারা এসব বিষয়ে বুঝানোর চেষ্টা করছে। পণ্য সরবরাহসহ নানা ইস্যুতে পতিত সরকারের সহযোগীরা অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপাকে ফেলার চেষ্টা করবে। এতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। অন্য কোনো শক্তি যার সুযোগ নিতে পারে।

এমন একটি ধারণাও বিএনপি’র কারও মধ্যে রয়েছে যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি অংশ যতটা সম্ভব নির্বাচন বিলম্ব করতে চায়। তারা দ্রুত নির্বাচন দিতে চায় না। এক্ষেত্রে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হলে তাদের জন্য সুবিধাজনক সময়ে নির্বাচন হতে পারে এমন আলোচনাও রয়েছে। বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রকাশ্যেই অভিযোগ করেছেন, ‘রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা একটি রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।’ তবে একাধিক গোয়েন্দা সূত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

১৮ বছর ধরে বিএনপি ক্ষমতার বাইরে। দলটির নেতাকর্মীরা গুম, খুন, মামলা, কারাভোগসহ নানা ধরনের নির্যাতন সহ্য করেছেন। ঘরছাড়া ছিলেন হাজার হাজার নেতাকর্র্মী। পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই তারা এলাকায় ফিরেছেন। অনেকে তাদের দখল হওয়া জমি, সম্পদ উদ্ধার করেছেন। আবার অনেকে জড়িয়েছেন দখল ও চাঁদাবাজিতে। এ রিপোর্টারের কাছেও দখলের এমন কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। অনেক জায়গাতেই হাতবদল হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এসব অভিযোগ নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে বিএনপি’র বিরুদ্ধেও জনগণ ক্ষুব্ধ হতে পারে এমন আশঙ্কা রয়েছে।

বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অবশ্য এবার শুরু থেকেই শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। অভিযুক্তদের একটি বড় অংশের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তারেক রহমান দলের নেতাকর্মীদের বারবার সতর্ক করছেন।     

কী বলছেন বিএনপি নেতারা?
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন মানবজমিনকে বলেন, এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বুঝতে হবে, কেন ছাত্রদের গণআন্দোলন হয়েছে? বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য এই আন্দোলন হয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এবিষয়টি সরকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য আমরা  নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানাচ্ছি। আর আমরা উদ্বিগ্ন না। আমরা চিন্তা-ভাবনা করছি, জনগণ নির্বাচনমুখী হলে যে ছোটখাটো সমস্যা তৈরি হচ্ছে তা তারা নিজেরাই মোকাবিলা করবে। যেটা এই সরকারের জন্য প্রয়োজন।

বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু মানবজমিনকে বলেন, বিএনপি ১৭ বছর ধরে আন্দোলন, সংগ্রাম করছে। জুলুম নির্যাতন সহ্য করছে। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে ১ লাখ ৬০ হাজার মামলা হয়েছে। ৬২ লাখ নেতাকর্মী আসামি হয়েছেন। আমরা এই আন্দোলন কেন করেছি? এ আন্দোলন আমরা করেছি জনগণের ভোটের অধিকারের জন্য। জনগণ তো এখনো সে অধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। গণতান্ত্রিক সরকার মানে হচ্ছে জনগণের নির্বাচিত সরকার। জনগণের নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠার জন্যই দ্রুত নির্বাচন প্রয়োজন। দ্রুত নির্বাচন মানে এই নয় যে, আমরা দুই মাসের মধ্যেই নির্বাচন চাচ্ছি। প্রধান উপদেষ্টা একটা টাইমলাইন বলেছেন। আগামী বছর ডিসেম্বর অথবা পরের বছর শুরুর দিকে। এখন আলোচনা করে একটি ডেট দিলেই হয়। বর্তমান সরকারের প্রতি বিএনপি’র সমর্থন রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোনো দেশের সত্যিকারের উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি কেবল নির্বাচিত সরকারের দ্বারাই সম্ভব। জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে গঠিত কোনো দলকে হুমকি বলে মনে করেন না বলে জানান তিনি। বলেন, দল করার অধিকার সবারই রয়েছে। জনগণ যাদের ভোট দেয় তারাই সরকার গঠন করবে।
বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, আমরা ১৬ বছর ধরে ভালো নির্বাচনের কথা বলছি। হাসিনার আমলে তামাশা, ভোট চুরি ও ডাকাতির নির্বাচন হয়েছে। আর এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচন বন্ধ করতে চায়। তাদের গায়ে জ্বালা করছে। তারা বলছেন, ‘৫৩ বছরে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কী করেছেন! আমরা জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার তাদের কাছে ফিরিয়ে দিতে নির্বাচন চাচ্ছি। আমরা আতঙ্কিত হচ্ছি একারণে যে, নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্রে উত্তোরণের পথ নাই।’ বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দেয়া উচিত। কেননা, অনির্বাচিত সরকার বহু সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। তিনি ঢাকা এবং অন্যান্য শহরে ক্রমবর্ধমান সংঘর্ষ এবং বিক্ষোভের দিকে ইঙ্গিত করেন। যেসব বিক্ষোভের মধ্যে অটোরিকশা চালকদের আন্দোলনও ছিল।

বিএনপি’র জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু গণমাধ্যমকে বলছেন, সুনির্দিষ্ট  রোডম্যাপ না দিয়ে নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য আসছে বলেই জনমনে বিভ্রান্তি কিংবা অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, মানুষ কখন ভোট দিয়ে তাদের পছন্দনীয় সরকার গঠন করতে পারবে সেটা স্পষ্ট করা দরকার দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে। সরকার অন্য যাই বলুক, এই ভোটের সময়টা না পাওয়াতেই জনমনে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বিএনপি  সেটিই তুলে ধরছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলছেন, নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা  মোটামুটি একটি সময়ের কথা বললেও সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণায় যে সরকারের প্রবল অনীহা- তা কিন্তু দৃশ্যমান। বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা একদিকে একটি সময় বলেছেন, আবার অন্যদিকে বলেছেন তার নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এসব বিষয় চূড়ান্ত করবে। আবার উপদেষ্টারা  কেউ কেউ বলছেন সংস্কারের পর নির্বাচন। ফলে নির্বাচনের তারিখ বলার ক্ষেত্রে একটি অনিশ্চয়তা  তো জনমনে আছে। সে কারণেই বিএনপি’র মধ্যেও শঙ্কা তৈরি হয়েছে এবং এ পরিস্থিতিতে  সেটাই স্বাভাবিক।

শেষ কথা: একধরনের বৈপরীত্য নিয়ে এগুচ্ছে বিএনপি’র রাজনীতি। একদিকে ক্ষমতার একেবারে কাছাকাছি অবস্থান। অন্যদিকে অনিশ্চয়তা। রাজনীতিতে যদিও এটা কোনো অভিনব দৃশ্যপট নয়। ঢাকার একজন বিশ্লেষক বলেন, ‘হাজার হাজার বছর ধরেই এটা চলে আসছে। মসনদে বসা কোনো সহজ খেলা নয়।’ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রনেতাদের সঙ্গে একধরনের দ্বান্দ্বিক অবস্থান তৈরি হয়েছে বিএনপি’র। এটাকেও সব বিশ্লেষক নেতিবাচক মনে করেন না। তারা স্মরণ করেন, বন্ধুত্ব ক্ষণকালের। দ্বন্দ্ব চিরদিনের। তবে শত্রুতা না এলেই হলো।  

mzamin

No comments

Powered by Blogger.