লেবাননে সাদা ফসফরাস ব্যবহার করেছে ইসরাইল ভয়াবহ ক্ষতি, ধ্বংসলীলা চারদিকে

লেবাননে সাদা ফসফরাসে তৈরি বোমা হামলা চালিয়ে বাফার জোন বা নিজেদের মতো নিরাপদ অঞ্চল তৈরি করেছে ইসরাইল। ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে সাদা ফসফরাস ব্যবহার করে লেবাননে ১৯১ বার হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। এই হামলার ফলে ৯১৮ হেক্টর (২২৬৮ একর)-এর বেশি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তারা একটি বাফার জোন তৈরি করেছে। সেখানে ইসরাইলি সেনাবাহিনী নোটিশে জানিয়ে দিয়েছে ওই এলাকায় কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। এর মধ্য দিয়ে  লেবাননের জনগণকে বলা হচ্ছে তারা যেন বাফার জোন ব্যবহার করে তাদের বাড়িঘরে ফেরত না যায়। অনলাইন আল-জাজিরার এক রিপোর্টে বলা হয়, মার্চ মাসে  লেবাননে সাদা ফসফরাস ব্যবহার করে আবাসিক এলাকায় হামলা করে তা বসবাসের অযোগ্য করে তোলে ইসরাইল। ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরের তাপমাত্রায় সাদা ফসফরাস অক্সিজেনের সংস্পর্শে এসে জ্বলে ওঠে। অক্সিজেনের সঙ্গে মিশে ফসফরাস অক্সাইডের সাদা ধোঁয়া সৃষ্টি করে। যতক্ষণ অক্সিজেনের সরবরাহ থাকে ততক্ষণ সাদা ফসফরাস জ্বলতে থাকে। ঠিকমতো অক্সিডাইজ না হলে তা সবজি ক্ষেত, আবাসিক ভবন এবং মানুষের শরীর পর্যন্ত পুড়িয়ে দিতে সক্ষম। ইসরাইল দাবি করে- যুদ্ধক্ষেত্রে সাদাধোঁয়া তৈরি করার জন্য তারা সাদা ফসফরাস ব্যবহার করেছে। কিন্তু অধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো দাবি করেছে- লেবানন ও ফিলিস্তিন উভয় দেশের ঘনবসতি এলাকাগুলোতে সাদা ফসফরাস ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করেছে ইসরাইল। লুক্সেমবার্গভিত্তিক প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক হামজে আত্তার আল-জাজিরাকে বলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে সাদা ফসফরাসের ব্যবহার তিনটি ভিত্তির উপর নির্ভর করে। তা  হলো- সৈন্যদের অগ্রগতি অস্পষ্ট করার জন্য সাদা ধোঁয়া হিসেবে ব্যবহার করা, প্রশস্ত খোলা জায়গা থেকে সেনা এবং সামরিক সরঞ্জাম সরানো এবং রকেট উৎক্ষেপণের আগে বা পরে একটি দ্রুত প্রতিক্রিয়া পাওয়ার জন্য। ২০২৪ সালের জুনে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ কমপক্ষে ৫টি এমন ঘটনার প্রমাণ পেয়েছে, যেখানে ইসরাইলি সেনারা ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকায় যুদ্ধে বেআইনি উপকরণ ব্যবহার করেছে। বৈরুতে আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে ডিপার্টমেন্ট অব ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইন অ্যানই ইকোসিস্টেম ম্যানেজমেন্টের চেয়ারম্যান রামি জুরাইক বলেন, সীমান্ত অঞ্চল জুড়ে ভয়াবহ বোমা হামলা করেছে ইসরাইল। এর মধ্য দিয়ে ওইসব ভূমি থেকে জনগণকে একেবারে নির্মূল করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। যুদ্ধের প্রথম মাসগুলোতে তীব্রতার সঙ্গে দক্ষিণ লেবানন জুড়ে সাদা ফসফরাস ব্যবহারে মনোযোগ দিয়েছে ইসরাইল। এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন লেবাননের গবেষক ও গ্রিন সাউদার্নার্স নামের পরিবেশবাদী গ্রুপের আহমেদ বেদুইন। ২০২৩ সালে লেবাননে ১৯৯ বার সাদা ফসফরাস ব্যবহার করে আক্রমণ করা হয়। এর মধ্যে অক্টোবরে ৪৫ বার এবং নভেম্বরে ৪৪ বার ছিল যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথম দুই মাসে করা সবচেয়ে তীব্র আক্রমণ। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ইসরাইল পুনরায় হামলার মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং দুই মাসের ব্যবধানে প্রায় ৩১৫০ জনকে হত্যা করে। যুদ্ধে নজরদারি বিষয়ক নিরপেক্ষ সংগঠন এসিএলইডি’র মতে, ২০২৩ সালের ৮ই অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ২৭শে নভেম্বর পর্যন্ত ইসরাইল ৪,৮৪১টি সামরিক অভিযান চালিয়েছে।

এছাড়া লেবাননের নাবাতিয়েহ শহরে আরও ৮,২০৯টি আক্রমণ করেছে তারা। সম্প্রতি ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির কয়েক ঘণ্টা পর থেকে দক্ষিণ লেবাননের কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দারা নিজ নিজ আবাসস্থলে ফিরে যেতে শুরু করেন। কিন্তু যুদ্ধবিরতির একদিন পরই ইসরাইল তার মানচিত্রকে  রেড জোন এরিয়া বা লাল সীমাবদ্ধ অঞ্চল দিয়ে প্রকাশ করে। এমন সতর্কতা দিয়ে ইসরাইলি সেনাদের মুখপাত্র আভিচার আদ্রাই এক্সে একটি পোস্ট দিয়েছেন। তাতে বলা হয়েছে- পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত এই পথ ব্যবহার করে নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলো। যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ৬০ দিনের মধ্যে দক্ষিণ লেবানন থেকে ইসরাইলি সেনাবাহিনীকে সরে আসার নির্দেশ দেয়া হয়, যাতে লেবাননের সেনাবাহিনী দক্ষিণাঞ্চলে প্রত্যাবর্তন করতে পারে। কিন্তু যুদ্ধবিরতি চুক্তির পরও ইসরাইলি সেনাবাহিনী এখনও দক্ষিণ লেবাননে অবস্থান করছে। পাবলিক স্টুডিও নামে পরিচিত লেবাননের একটি নগর পরিকল্পনা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইসরাইলি সেনাদের আগ্রাসনের ফলে ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র প্রকাশ করেছে। এর বেশির ভাগেই ব্যবহার করা হয়েছে সাদা ফসফরাস। আহমেদ বেদুইন বলেন, ইসরাইল যে এলাকাকে বাফারজোন ঘোষণা করেছে এর ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপক। বেদুইন আরও বলেন, ইসরাইলের এই কর্মকাণ্ডের পরিণাম ভয়াবহ। অতি দ্রুত আমাদের এই এলাকা দূষণমুক্ত করা দরকার।  লেবাননের দক্ষিণ অঞ্চল এখনও ইসরাইলি সেনাবাহিনীর দখলে। থিঙ্কট্যাংক আটলান্টিক কাউন্সিলের লেবানন বিশেষজ্ঞ নিকোলাস বার্নাডফোল্ড বলেন, আমার মনে হয় বাফারজোনে হিজবুল্লাহর অবকাঠামো অনুসন্ধান করে ক্ষতির পরিমাণ বাড়াচ্ছে ইসরাইল এবং অযথা সময় নষ্ট করছে। তিনি আল-জাজিরাকে আরও বলেন, এটি কাকতালীয় ঘটনা নয় যে, ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে তাদের দখলদকৃত অঞ্চলের সঙ্গে এই অঞ্চলের যথেষ্ট মিল আছে। তিনি বিশ্বাস করেন না, ইসরাইলি সেনারা ৬০ দিনের বেশি ওই অঞ্চলে থাকবে। কারণ কোনো দীর্ঘমেয়াদি দখল হিজবুল্লাহ থেকে নতুন প্রতিরোধ তৈরি করবে। এখনো সাদা ফসফরাস ব্যবহার করে ইসরাইলের বাফারজোন তৈরির লক্ষ্য অর্জন হতে পারে। এটি ইতিমধ্যে শত শত হেক্টর জমি নষ্ট করেছে। তাছাড়া ১০ হাজার জলপাই গাছ মারা গেছে। এই শহরে অবস্থিত ভবনগুলোও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.