ঐকমত্য ছাড়া সংস্কার নয়

জাতীয় ঐকমত্য ছাড়া কোনো ধরনের সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকার চাপিয়ে দিতে পারবে না বলে মন্তব্য করেছেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি বলেন, এই সরকার যে সংস্কার করেছেন, সবই এলোমেলো মনে হয়েছে। সংস্কারের ১০টা কমিশন যে রিপোর্ট দেবে, তা এক-একজন এক এক রকমভাবে দেখে রিপোর্ট দেবে, তা এক হলে তবেই তো সংস্কার করবেন। সংবিধানের ওপরে যতগুলো প্রস্তাব আসবে সবগুলো সন্নিবেশ করে প্রবাসীসহ সকলের সহমতের পরে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কার করতে হবে।

গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত ‘জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে প্রবাসীদের ভূমিকা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেন। আইবি টিভি, নিউ ইয়র্ক সময় এবং কালার্স যৌথভাবে বৈঠকটির আয়োজন করে। বক্তারা জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে প্রবাস থেকে সমর্থন দেয়া দুবাইয়ের জেলে বন্দিদের মুক্ত করে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনতে অন্তর্বর্তী সরকারের নিকট আহ্বান জানান।
মান্না বলেন, বাংলাদেশ যতদিন আছে প্রতিদিনই এর সংস্কার করা দরকার। যেকোনো একটা বস্তুকে প্রতিদিন সংস্কার করবেন, প্রতিদিনই সেটা আরও উন্নত হবে। আমরা একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এই সংস্কার করার কথা ভাবছি। তাহলে বর্তমান সময়ের সংস্কার করার মেন্ডেট কতোদিন হতে পারে এটা ভাবা দরকার।

অন্তর্বর্তী সরকারকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ওরা বলছে সংস্কার সম্পন্ন করে তারপর নির্বাচন, তাহলে কি সবার জন্য অন্ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার পরে কি হবে? এটা তো হতে পারে না। আামাদের লড়াইটা হয়েছে গণতন্ত্রের জন্য, নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু হয় তার জন্য। আমরা একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাই, যে নির্বাচনের ফলাফলের ওপরে দাঁড়িয়ে আমরা এমন একটা বাংলাদেশ গড়তে পারবো, যারা প্রবাসীদের প্রতি সম্পূর্ণ সহযোগিতামূলক দেশ গঠন করতে পারি।

পুলিশ বাহিনী, গণপ্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকারের করণীয় সম্পর্কে মান্না বলেন, একটা পুলিশ বাহিনী ও গণপ্রশাসন লাগবে, যেটা এই ভোটকে সহযোগিতা করবে। নির্বাচন কমিশন লাগবে, যেটা এই ভোটে নিরপেক্ষভাবে তার দায়িত্ব পালন করবে। একেবারে ডাউন টু দ্য গ্রাউন্ড, যেখানে ভোট হয় সেই সেন্টার পর্যন্ত যারা যারা দায়িত্বে আছেন সবার সংস্কার লাগবে।
অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচনের ব্যাপারে পুনর্ব্যবস্থা করার আহ্বান জানিয়ে মান্না আরও বলেন, অনেকে দলগতভাবে আমার সঙ্গে একমত পোষণ নাও করতে পারেন, তবে প্রথম এই নির্বাচনের ব্যাপারে পুনর্ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা একটা খারাপ পরিস্থিতিতে আছি, এমন পরিস্থিতিতে যারা দেশকে পরিচালনা করছেন, তারা কতোদূর সামনে নিয়ে যেতে পারছেন- এটা একটা বিতর্কিত বিষয়। তিনি বলেন, এই ভোটের আগে সমস্ত বিষয়ে সংস্কার করা যাবে না। ভোটের পরে সংস্কারের দায়িত্ব থাকবে, নতুন বাংলাদেশ গড়বার দায়িত্ব থাকবে। এবং সেটা যদি সম্পন্ন করতে চান তাহলে আপনাকে ভোটের মাধ্যমে এমন কোনো সরকার গঠন করতে হবে যিনি এই সংস্কার করবেন এবং জনগণের কল্যাণের জন্য সমস্ত নিবেদন রাখবেন।

তিনি আরও বলেন, এই আন্দোলনে যারা মারা গেছেন সরকার তাদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে পারেনি। যারা আহত হয়েছেন তারা শেষ পর্যন্ত চিকিৎসার টাকার দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন। সরকারের নিকট দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, এদেরকে যথাযথ সম্মান দেয়া হোক। বাংলাদেশে আসার পরে তাদের জীবন যেন সচ্ছলভাবে চলতে পারে সেই ব্যবস্থা করা হোক। সিন্ডিকেট ভেঙে এত টাকা দিয়ে অনেক নির্যাতনের শিকার হয়ে যারা যেতে চান, তাদের জায়গায় নিজের জীবন যেন সুন্দর করতে পারেন সেটা ব্যবস্থা করার চেষ্টা করতে হবে।

আলোচনায় অংশ নিয়ে সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজা বলেন, বিদেশে বন্দি ৩৫৭ জনের বিষয়টি অবিলম্বে সরকারের নজরে আনতে হবে, নজরে যদি থেকে থাকে তাহলে সেটি সরকারকে মনিটর করতে হবে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, প্রবাসীদের মুক্তির ব্যাপারে কেন এত দেরি হচ্ছে? অথবা আদৌ কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কিনা? অন্যদিকে সরকারি অর্থ পাচারকারীদের তথ্য আলোচনায় আনার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, প্রবাসীরা দেশে অর্থ পাঠায়। আরেকটি গ্রুপ বিদেশে অর্থ নিয়ে যায়। এখানে এক নম্বরে যার নামটা আসা দরকার, সেটি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের নাম। জয় ওয়াশিংটনে কিছু করে না, কখনই কিছু করতো না।
তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের রাজপুত্ররা যেমন জীবনযাপন করে, সজীব ওয়াজেদ জয় তেমন জীবনযাপন করে। তার কোনো পেশা নাই, তথাকথিত কম্পিউটার বিজ্ঞানী। হিসাব করে দেখেন কতো টাকা তিনি বাংলাদেশ থেকে নিয়ে গেছেন। এক স্যাটেলাইটের জন্য ৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে, যেখানে ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকার উপরে খরচ হয় নাই। এমন আরও কতো আছে! তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার কোনো পেশা নাই। লন্ডনে তিনি বিশাল বাড়িতে থাকেন। তারা কীভাবে টাকা দেশের বাইরে নিয়ে গেছে? এটা আমরা এত বছর আলোচনা করতে পারিনি। আলোচনাগুলো সামনে আনা দরকার।

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের নিকট আহ্বান জানিয়ে গোলাম মোর্তোজা বলেন, সৌদি আরব, দুবাই অথবা মালয়েশিয়া হোক- ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা খরচ করে যাওয়ার একটা লুটপাট-জালিয়াতির যে ধারাটা তৈরি হয়েছে, এই ধারাটা বন্ধ করে দিতে হবে। এবং যখন-যারা ক্ষমতায় ছিলেন তারাই এই ধারার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

বৈঠকে আরও বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি’র সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, সাংবাদিক সোহরাব হাসান, সাংবাদিক মাসুদ কামাল, সাংবাদিক আশরাফ কায়সার, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. সায়ন্ত সাখাওয়াত, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর প্রমুখ।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ে প্রবাসীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এখন পতিত সরকারের দোসররা ভারতের সহযোগিতায় সে লড়াইয়ের সফলতা নস্যাৎ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ডনাল্ড ট্রাম্পের ছবি নিয়ে কর্মীদের ছবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছে।

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সোহরাব হোসেন বলেন, প্রবাসীদের ভোটাধিকারের ব্যবস্থা করার ওপরে গুরুত্ব দিতে হবে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, কোনো নেতা যদি ঢাকায় থেকে কোনো জেলার প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন, তাহলে অন্য কোনো দেশে থেকে কেন দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন না। এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, প্রবাসীদের প্রতি মানবিক দৃষ্টি দিলে দেশ আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে।

সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেন, জুলাই-আগস্টে প্রবাসীদের ভূমিকা অনেক বেশি ছিল। হাসিনা সরকারের সময় রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করে দিয়ে তারা খুব ভালো কাজ করেছে। কনক, সারোয়ার, ইলিয়াস, পিনাকীরা মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিল। এটাই সফলতা।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.