প্রতিমা বিসর্জনে শেষ হচ্ছে দুর্গাপূজা: ঢাকেশ্বরী মন্দির পরিদর্শন প্রধান উপদেষ্টার

হিন্দু শাস্ত্রমতে, এবার দেবীদুর্গা মর্ত্যে এসেছিলেন পালকিতে চড়ে। আর ঘোড়ায় চড়ে কৈলাশে ফিরবেন। তিথি স্বল্পতার কারণে এবারের দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা তিনদিনেই শেষ হয়েছে। একইদিনে অষ্টমী ও নবমীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল বিধিমতে, মন্ত্রপাঠ করে দেবীকে ঢাকঢোল, শঙ্খ বাজিয়ে গানের তালে তালে বিদায় জানানো হয়েছে। দেশের অনেক জায়গায় গতকালই প্রতিমা বিসর্জন  করা হয়েছে। তবে বেশির ভাগ স্থানে আজ সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ভারাক্রান্ত মনে সিদুঁর খেলার মধ্যদিয়ে প্রতিমা বিসর্জন করবে। গতকাল থেকেই মন্দিরে মন্দিরে বিদায়ী সুর বাজছিল।

বেলতলায় ষষ্ঠী পূজার মধ্যদিয়ে শুরু হয় পাঁচ দিনব্যাপী শারদীয় দুর্গোৎসব। মণ্ডপে মণ্ডপে সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ও দশমী পূজার মধ্যদিয়ে শেষ হলো আনুষ্ঠানিকতা। সনাতনী ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন পালকি বা দোলায় দেবীর আগমন বা গমন হলে এর ফল হয় মড়ক। খাদ্যশস্যে পোকা-মাকড়ের আক্রমণ হবে ও রোগব্যাধি বাড়বে। এ ছাড়া দেবী স্বর্গে গমন করেন ঘোটকে বা ঘোড়ায়। শাস্ত্রমতে দেবীর গমন বা আগমন ঘোটকে হলে ফলাফল হয় ছত্রভঙ্গ। এটা সামাজিক ও রাজনৈতিক এলোমেলো অবস্থাকে ইঙ্গিত করে। পঞ্জিকা মতে, এবার মহানবমী পূজার পরই দশমী বিহিত পূজা হয়। গতকাল সকালে  শুরু হয় বিজয়া দশমীর পূজা। মণ্ডপগুলোতে আড়ম্বর অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে শুরু হয় পূজা-অর্চনা। শারদীয় দুর্গোৎসবের মহানবমী তিথিতে বিহিত পূজা এবং দর্পণ বিসর্জনের মাধ্যমে মণ্ডপে মণ্ডপে দেবীদুর্গার আরাধনা করেছেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা।

গতকাল রাজধানীর পূজামণ্ডপগুলোতে দেখা যায়, প্রতিটি মণ্ডপেই দুর্গাপূজার শেষ সময়ের প্রস্তুতি শেষ করা হচ্ছে। মন্ত্রপাঠে আনন্দময়ীকে অঞ্জলি দিচ্ছেন ভক্তরা। এবার তিথির কারণে মহানবমী পূজার পরই দশমীর বিহিত পূজা এবং বিসর্জন অনুষ্ঠিত হয়েছে। শ্রী শ্রী বরদেশ্বরী কালীমাতা মন্দিরের আহ্বায়ক বাবু পবন দাস বলেন, এবার একদিনেই নবমী-দশমী পালিত হয়েছে। রোববার প্রতিমা বিসর্জন হবে। এ বছর কিছুটা ভীতি থাকলেও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। জমকালোভাবেই পালিত হয়েছে দুর্গোৎসব। পরিতোষ নামের এক ভক্ত বলেন, এবার পূজা ঘিরে আমাদের মধ্যে শঙ্কা ছিল। তবে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই পূজা হয়েছে।
শাস্ত্রমতে, নবমীতেই দেবীদুর্গা রুদ্ররূপ ধারণ করে বধ করেছিলেন মহিষাসুরকে। নবমীর সকাল তাই অশুভ শক্তি থেকে মুক্তির সকাল। ১০৮টি বেলপাতা, আম কাঠ, ঘি দিয়ে যজ্ঞের মাধ্যমে দেবীদুর্গার কাছে দেয়া হয় আহুতি। ৮টা ২৬ মিনিটে শুরু হয় দশমী পূজা। দর্পণ বিসর্জনের মধ্যদিয়ে ভক্তদের কাঁদিয়ে একদিন আগেই দেবী দুর্গার প্রস্থান। সপ্তমী থেকে নবমী, চার সন্তান নিয়ে অন্নপূর্ণা এবার পৃথিবীতে থাকলেন কেবল তিনদিন। দেবীর বিদায়ে নবমীর আনন্দের সঙ্গে যুক্ত হলো বিষাদের সুর। শেষবেলায় তাই দেবীর কাছে সুখ-শান্তি এবং সমৃদ্ধির প্রার্থনা করেন ভক্তরা।

সারা দেশে মন্দির ছাড়াও বিভিন্ন মাঠে হয়েছে দুর্গাপূজা। পূজামণ্ডপ ঘিরে ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা। সরজমিন দেখা যায়, বৌদ্ধ মন্দির সংলগ্ন সালাম ডেইরি বালুর মাঠেও মণ্ডপ সাজানো হয়। নিরাপত্তায় ছিলেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। সনাতন ধম্বাবলম্বীর মানুষ তাদের ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী পূজা-অর্চনা করেছেন। সনাতন ছাত্র ও সমাজকল্যাণ সংঘের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৌরভ দাস বলেন, এবার কিছুটা ভীতি ছিল আমাদের মনে। যদিও এখানে কোনো অপ্রীতিকর কিছু হয়নি। পুরান ঢাকার একটি মণ্ডপের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় কিছুটা ভয় কাজ করেছে। তবে সুন্দরভাবে আমরা আমাদের পূজার আনুষ্ঠানিতা সম্পন্ন করতে পেরেছি।

ঢাকেশ্বরী মন্দির পরিদর্শন প্রধান উপদেষ্টার

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আমরা এমন সমাজ চাই না যেখানে সেনাবাহিনী, পুলিশ দিয়ে উৎসব পালন করতে হবে। এ সরকার এমন বাংলাদেশে গঠন করতে চায় যেখানে সব সমপ্রদায় এবং নাগরিকের সমান অধিকার থাকবে। শনিবার রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে তিনি এসব কথা বলেন। এর আগে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির পরিদর্শন করেন এবং সেখানে হিন্দু সমপ্রদায়ের সদস্যদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।

তিনি বলেন, আমরা বাধ্য হয়ে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব-এর সাহায্য নিয়ে দুর্গাপূজা করেছি। তাদের সহায়তার জন্য ধন্যবাদ জানাই। আমরা এমন একটি রাষ্ট্র গঠন করতে পারি খুব শিগগিরই, যেখানে তারাও ছুটি উপভোগ করবে, আমরাও ছুটি উপভোগ করবো। তাদের (আইনশৃঙ্খলা বাহিনী) ছুটি বিসর্জন দিয়ে আমাদের আনন্দ করতে হবে না। এ ‘অপরাধবোধ’ থেকে আমরা মুক্ত হয়ে যাবো। দেশের নাগরিক হিসেবে উৎসব পালন করবো।

এ রকম রাষ্ট্র আমরা গঠন করবো। আমরা সেই স্বপ্নের রাষ্ট্র গঠন করতে পারি, যেটা দিয়ে দেশের মানুষ দুনিয়ার সামনে গর্ব করতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় মন্দিরে পৌঁছলে তাকে পূজা উৎসব পরিষদের পক্ষ থেকে সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেয়া হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি জয়ন্ত কুমার দেব, সাধারণ সম্পাদক তাপস চন্দ্র পাল, বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর ও সাধারণ সম্পাদক সন্তোষ শর্মা। ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেনও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

শুভেচ্ছা বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই যে আমরা আপনাদের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে আপনাদের পূজা উৎসবের সুযোগ করে দিলাম। এটা যেন ভবিষ্যতে আর কখনো করতে না হয়, সে জন্য আমরা একযোগে কাজ করবো। আমরা এমন এক বাংলাদেশ তৈরি করতে চাই, যে বাংলাদেশে যারা এই দেশের নাগরিক তাদের ‘সকলেরই সমান অধিকার’, এটা যেন আমরা নিশ্চিত করি।

শুধু কিতাবে লিখে দিলে হবে না- মন্তব্য করে তিনি বলেন, এরপর কাটাকাটি মারামারি এগুলো করলাম, অধিকার কেড়ে নিয়ে বাহবা পেলাম, এ রকম বাংলাদেশ আমরা চাই না। এ রকম সমাজ চায় না বলেই ছাত্র-জনতা তাদের জীবন দিয়েছে। নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টি করার স্বপ্ন নিয়ে এ যাত্রা শুরু করেছি। আমরা এ স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে চাই। এটা শুধু কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই না।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারের বিষয়ে তিনি বলেন, নতুন বাংলাদেশে আমাদের কী কী নতুন দরকার, তা বের করে আনতে হবে, সেটি প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আমরা কতোগুলো কমিশন বানিয়ে দিয়েছি। তারা তো দেশ পাল্টিয়ে ফেলতে পারবে না। তাদের সেই সাধ্য তো নেই। কমিশন করেছি এই জন্য যে, তারা আমাদের স্বপ্নগুলোকে একত্র করবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের কারণে মহাস্বপ্নে আমরা চলে এসেছি, এ স্বপ্নের একটা রূপরেখা থাকবে। আমরা বলছি সংবিধান সংশোধন করবো, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন প্রথা সংশোধন করবো, অনেক কিছু।

সংস্কার কমিশন তিন মাসের মধ্যে প্রতিটি বিষয়ে রূপরেখা দেবে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যেগুলো আপনারা চান সেগুলো বাস্তবায়ন করার নামই হলো সংস্কার। দেশকে ‘পাল্টে ফেলার’ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, এটা যেন আমাদের হাতছাড়া না হয়ে যায়। কারণ, একবার হাতছাড়া হয়ে গেলে এটা আর কোনো দিন ফিরে আসবে না।

অপূর্ব এক সুযোগ ছাত্র-জনতা আমাদের হাতে দিয়েছে। আমাদের হাতে আলাদিনের প্রদীপ দিয়ে দিয়েছে, আমরা যা চাই, তাই করতে পারি। স্বপ্নগুলোকে একত্র করেন। ছোটখাটো বিষয়ের মধ্যে থাইকেন না। বড় বিষয়ের দিকে আসেন। কাঠামো তৈরি করে দিলে, তারপরে কে কী পেলো বা পেলো না, সে হিসাবই নেই, পাবো বলেই তো সবকিছু করছি।

অতীতে অত্যাচারিত হওয়ার অভিযোগ এনে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এমন একটা সমাজ থেকে আমরা বেরিয়ে আসছি, যেখানে সমস্ত অধিকার ছিল ছোট্ট একটি গোষ্ঠীর কাছে, বাকি মানুষের কোনো অধিকার ছিল না। আমরা সব অধিকার বঞ্চিত ছিলাম।

এই অভ্যুত্থান হঠাৎ করে সেটা পাল্টে ফেললো। যারা মানুষের সমস্ত অধিকার কেড়ে নিয়েছিল তাদের থেকে দেশকে মুক্ত করেছিল ছাত্র-জনতা। এখন এ অধিকার আমাদের সবার কাছে আসতে হবে।

রাষ্ট্র যদি কারও অধিকার নিশ্চিত করতে পারে তা হলে সেই রাষ্ট্রের কী দরকার- এই প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে প্রত্যেকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। যে অধিকার কেড়ে নেবে, তাকে যেন সঙ্গে সঙ্গে শাস্তি দেয়া হয়। এটিই স্বপ্ন।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.