বিধ্বস্ত বীমা খাতে গ্রাহকদের হাহাকার by এমএম মাসুদ

রংপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ঢাকায় এসেছেন আবদুল হাকিম। উদ্দেশ্য একটি নামকরা বীমা কোম্পানির হেড অফিসে গিয়ে বীমার টাকা উদ্ধার করা। তার সহ এলাকার আরও কয়েকজনের অর্ধডজন পলিসির মেয়াদ শেষ হয়েছে। কিন্তু টাকা তুলতে পারছেন না। এ টাকার পেছনে ঘুরছেন প্রায় দুই বছর ধরে। হাকিম জানান, পলিসির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর  যখন তারা টাকা তুলে নিতে চান, তখন স্থানীয় বীমা কোম্পানির অফিস থেকে চাপ দেয়া হয় টাকাটা একই কোম্পানিতে ডিপিএস করে রাখতে। কিন্তু আমরা ডিপিএস করতে রাজি হইনি। আমরা টাকা তুলতে চেয়েছি। হেড অফিসে জানালে তখন বলা হয় যে, টাকা ফেরত দেবে। কিন্তু টাকা পাওয়া যাচ্ছে না। কখনো বলে আগামী মাসে আসেন, কখনো বলে চেক হয় নাই। কখনো বলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নাই। একেকবার একেক কথা। শুধু হয়রানি।

শুধু আবদুল হাকিম নয়, তার মতো অনেকেই বীমা করতে আগ্রহী হন না। ঢাকার একজন বেসরকারি চাকরিজীবী জাইমা ইসলাম জানান, তার কাছে মাঝে মধ্যে এজেন্ট বা প্রতিনিধিরা আসেন বীমা করাতে। কিন্তু তার এতে আস্থা নেই। তার মতে, দেশের বীমা সিস্টেমটাই একটা ফটকা মনে হয়। টাকা কাকে দিচ্ছি। আসলেই এ টাকা ফেরত পাবো কি-না এটি আমি জানি না। তাই ব্যাংকে ডিপিএস করি কিন্তু বীমা করিনি।

আরেকজন স্কুল শিক্ষক কাকন বেগম বলেন, তার স্বামী কয়েক বছর আগে বীমা করেছিলেন। কিন্তু পরে জমা দেয়া টাকাটাই আর ফেরত পাননি। ফলে মৃত্যু, দুর্ঘটনা, অঙ্গহানিসহ এ ধরনের ঘটনায় বীমা না করায় আর্থিক সুবিধার বাইরেই থাকছেন অধিকাংশ মানুষ। এ ছাড়া স্বাস্থ্যবীমার প্রসার না ঘটায় চিকিৎসাখাতেও মানুষের ব্যক্তিগত ব্যয় বাড়ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বীমা খাতে প্রকৃত এজেন্ট তৈরি না হওয়া এবং কিছু ক্ষেত্রে গ্রাহকরা এজেন্টদের দ্বারা প্রতারণার শিকার হওয়ায় বীমা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা বিরাজ করছে। ফলে এ শিল্পের বিকাশে বাধা হিসেবে কাজ করছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে ১৯৭৩ সাল থেকে বীমা কার্যক্রম শুরু হলেও এখন বিভিন্ন ধরনের বীমার আওতায় আছে দুই কোটিরও কম মানুষ এবং বিশ্লেষকরা বলছেন বীমা কোম্পানিগুলোর প্রতি মানুষের চরম অনাস্থার কারণে এ বিষয়ে মানুষের আগ্রহ কম।

সাধারণ মানুষ কী ভাবে: মানুষ মনে করে, আমরা ইন্স্যুরেন্সের প্রিমিয়াম অব্যাহতভাবে দিয়েছি। কিন্তু যখনই আমার প্রয়োজনটা দেখা দিচ্ছে অর্থাৎ কোনো দুর্ঘটনা ঘটছে, তখন আমরা কোম্পানির কাছে যাচ্ছি। কিন্তু টাকা পাচ্ছি না। এখান থেকে ওখানে ঘুরাচ্ছে। তাহলে যে ঝুঁকি মেটানোর জন্য ইন্স্যুরেন্স করলাম, আমার তো সে উদ্দেশ্য পূরণ হলো না। বীমা কোম্পানির এজেন্ট বা প্রতিনিধিদের কাছ থেকে সন্তোষজনক সেবা পাচ্ছি না। ফলে মানুষের কাছে নেতিবাচক বার্তা যাচ্ছে।

বাংলাদেশে বীমা খাতে ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে আস্থা পাচ্ছে না সাধারণ গ্রাহক। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের বাজার। এ খাত থেকে টাকা পয়সা তছরুপ করে নিয়ে পালিয়েছেন অনেকে। দীর্ঘদিন ঘুরেও বীমার টাকা তুলতে পারেননি তারা। ফলে বীমা পলিসি নেয়ার ক্ষেত্রেও অনীহা কাজ করছে। এ খাতের প্রতি আস্থা বাড়াতে স্বচ্ছতা ও সুশাসন জরুরি বলে মত দেন ভুক্তভোগী ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

বিশ্লেষকদের মন্তব্য: আইডিআরএ’র সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী বলেন, এটা ঠিক যে, দেশের সার্বিক অর্থনীতি যে গতিতে এগোচ্ছে, বীমা খাত সেভাবে এগোতে পারছে না। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আমাদের দেশের মানুষ বীমাবান্ধব নয়। সরকারি বাধ্যবাধকতা অর্থাৎ আইনগত বাধ্যবাধকতা না থাকলে কেউ বীমা করে না। এ ছাড়া, অনেক প্রতিষ্ঠান বীমা দাবি পরিশোধ না করায় মানুষের মধ্যে এক ধরনের আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে।

দাবি নিষ্পত্তির হার:
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দাবি নিষ্পত্তির হার ছিল ৬৫.১৯ শতাংশ। এক বছর আগে যা ছিল ৬১.১৬ শতাংশ। বাংলাদেশে ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে বীমা খাতে দাবি নিষ্পত্তির হার ৪ শতাংশের বেশি বেড়েছে। আইডিআরএ’র তথ্যে দেখা গেছে, লাইফ ও নন-লাইফ উভয় বীমার ক্ষেত্রেই নিষ্পত্তির হার বেড়েছে। লাইফ ইন্স্যুরেন্স খাতে ২০২৩ সালে ৭২ শতাংশ দাবি নিষ্পত্তি হয়েছে, আগের বছর যা ছিল ৬৭ শতাংশ। এ ছাড়া নন-লাইফ বীমার ক্ষেত্রে আগের বছরের ৩৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৩ সালে হয়েছে ৪১ শতাংশ।

আইডিআরএ’র ২০ সালের প্রতিবেদন বলছে, বীমা কোম্পানিগুলোতে এখনো অনেক বীমা দাবি মেয়াদ শেষে নিষ্পত্তি হচ্ছে না, অর্থাৎ গ্রাহক টাকা বুঝে পাচ্ছেন না। জীবন বীমার ক্ষেত্রে দাবি নিষ্পত্তির হার ৬৭ শতাংশ। আর সাধারণ বীমার ক্ষেত্রে ৩৫ শতাংশ।

৯০ ভাগ মানুষ বীমার বাইরে:
আইডিআরএ’র তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে সব মিলিয়ে ৮২টি বীমা প্রতিষ্ঠান সেবা দিচ্ছে। এর মধ্যে লাইফ ৩৬টি আর নন-লাইফ ৪৬টি। বর্তমানে ১৭ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে বীমার আওতায় আছে মাত্র ১ কোটি ৭১ লাখ মানুষ, যা শতাংশের হিসাবে ১০ শতাংশ। অর্থাৎ দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ এখনো বীমা সেবার বাইরে রয়ে গেছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০২২ সালে মোট বীমার পরিমাণ ছিল এক কোটি ১৪ লাখ ২ হাজার ৮৬৯টি, যা ২০২৩ সালে কিছুটা কমে হয়েছে ৯৮ লাখ ৪৮ হাজার ৫৯৯টি। এ সময়ে লাইফে কমলেও নন-লাইফে বীমার পরিমাণ বেড়েছে।

গবেষাণা সংস্থাগুলোর তথ্য:
সিপিডি’র এক তথ্যে বলা হয়, বীমা খাত থেকে টাকা পয়সা নিয়ে অনেকে পালিয়ে যাচ্ছেন। দীর্ঘদিন ঘুরেও বীমার টাকা তোলা যাচ্ছে না। অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে বর্তমানে তীব্র আস্থা সংকটে পড়েছে খাতটি। এ খাতের প্রতি আস্থা বাড়াতে স্বচ্ছতা ও সুশাসন জরুরি।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে বীমা খাতের বিস্তার না হওয়ার পেছনে মূল কারণ হিসেবে উঠে এসেছে আস্থাহীনতার কথা। আর এই আস্থাহীনতার মূল কারণ পাওনা দাবি নিষ্পত্তিতে জটিলতা।
সূত্রমতে, দেশের বীমা খাত শুরু থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বীমা অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এরপর বীমা খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ২০১১ সালে অধিদপ্তর বিলুপ্ত করে প্রতিষ্ঠা করা হয় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। সেই হিসাবে আইডিআর-এর বয়সও ১৩ বছর। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়েও বীমা খাত যেন সেই এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। এখনো জিডিপি’র তুলনায় বীমা খাতের অবদান মাত্র আধা শতাংশ।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.