গল্প- অদরকারি by মোহাম্মদ কামরুজ্জামান
বাস্তব
জগতে যখন কিছু ঘটে, তখন তা ঘটতে যা যা লাগে তার সবকিছু নিয়েই সে ঘটে –
যেমন আসমান থেকে জমিনে বৃষ্টি পড়তে পানি লাগে, আসমান লাগে আর জমিন লাগে।
তিনটে জিনিসের উপস্থিতিতেই কেবল ‘গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা’ হয়। মুশকিল হচ্ছে,
যা লাগে না তা-ও থাকে, যেমন সুলতাদের ঘিনঘিনে কানাচে একটি আত্মজ্বালা
মানকচু গাছ – অঝোর বৃষ্টিধারায় ওর পাতা কেবল নুয়ে নুয়ে পড়ে।
বাসে বাসে গুঁতোগুঁতি লাগার সময় দুটো বাস, দুই বাসের দুই চালক, আর একটা রাস্তা হলেই হয়; গুঁতোগুঁতির কাজে সাহায্যের জন্য বড়জোর দুই বাসের দুই হেলপার লাগতে পারে, কিন্তু রাস্তার পাশে যে শিরীষ গাছটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাতাস টানছিল, ওটার নিশ্চয় দরকার ছিল না। কিন্তু সেদিন টাল সামলাতে না পেরে, পেছনের বাসটা গিয়ে ওটার সঙ্গেই দ্বিতীয় গোত্তাটা খেল, পেছনের দুই চাকা একবার শূন্যে তুলে দিয়ে মুখ ভচকে দাঁড়িয়ে পড়ল, যাওয়ার সময় সামনের বাসের হেলপারের কাঁধ থেকে বাঁ-হাত আর ধড় থেকে মাথা ছিঁড়ে নিয়ে গেল। ওই প্রকা- শিরীষ গাছের ডালপাতার ফাঁকে ফাঁকে যে অতগুলো কাকদুপুরে বিশ্রাম করছিল, সেটা বোঝা গেল, যখন বিকট দানবীয় শব্দ শুনে তারা কা-কা করতে করতে ডানা ঝাপটে ত্রস্তস্রস্ত বেরিয়ে এলো। অবশ্য তারপর মানবীয় চিৎকার শুরু হলে তারা একে একে আবার পাশের গাছে গিয়ে বসেছিল।
সামনের ডানপাশের বাসটা পশ্চাদ্দেশ দুলিয়ে যখন গোঁ-গোঁ করে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছিল, তখন বাঁপাশ থেকে ওই হতভাগা বাসটি মাথা গুঁজে ওটার পেছনে পেছনে আসছিল। দুই হেলপার পরস্পরের দিকে দুবার চোখ গোল করে তাকিয়েছিল। পেছনের চালক তার পান-খাওয়া ঠোঁটে রাঙা হাসি দেখিয়েছিল সামনের হেলপারকে, ও যখন পেছনের ওস্তাদের সঙ্গে তামাশা করার জন্য ঘাড় ঘুরিয়েছিল। ওস্তাদের রস বোধহয় একটু বেশিই বেরিয়ে গিয়েছিল – বাঁ-হাতের চেটোর উলটো পিঠ দিয়ে ঘষে ঠোঁট মুছে নিয়েছিল। সামনেরটার চালক যখন টের পেল পরকীয়া চলছে, তখন বাঁয়ে কাত হয়ে পেছনেরটাকে বেমক্কা চাপ দিলো। পেছনেরটা তাড়া খেয়ে সরে না গিয়ে ঝাড়া দিয়ে মাথা এগিয়ে দিলো। সে-মাথা গিয়ে সামনেরটার দরজা গলে ঢুকে পড়ল, তারপর খানিক কড়কড়-ক্যাঁচক্যাঁচ ঝনাৎ-ঝনাৎ আওয়াজ করে অবশেষে ঘোঁতঘোঁত করে বেরিয়ে এলো। আসার সময় হামানদিস্তার মতো ছেঁচে বের করে আনল হেলপারের শরীরের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ – মুখে করে নিয়ে বেগতিক ছুটল শিরীষ গাছটির দিকে। প্রকা- শিরীষ গাছের কা- সেঁধিয়ে গেল বাসের নাক বরাবর – গাছের বাকলের সঙ্গে বাসের মুখ ভাঁজ হয়ে লেপটে গেল। মুহূর্তে বাসের সামনের অর্ধেকটা বালকের শিশ্নের মতো কুঁচকে গেল।
থানা থেকে লোকজন এসে বাস কাটতে আরম্ভ করল। তখন দেড়টা বাজে। গনগনে রোদ। কাকের কা-কা। মাঝেমধ্যে খয়েরি-সাদা বিষ্ঠা ঝরে পড়ছে শিরীষ গাছগুলো থেকে। ক্রেনের কমলা রঙের বিশাল বাহুর ধীর ওঠানামা দেখা যাচ্ছে। বাসের সামনের দিক থেকে শুরু করল উদ্ধারকাজ। প্রথমে একটা একটা করে দুটো হাত বেরোল – একটা কাঁধ থেকে ছেঁড়া, আরেকটা কনুই থেকে। দুটোই বাঁহাত। ইন্সপেক্টর তপন ছোট্ট করে বললেন, ‘ড্রাইভার মরেছে।’ কেউ শুনতে পেল না। লোকজনের চেঁচামেচি, বাঁশির ফুঁকাফুঁকি, ওয়াকিটকির টুঁত-টুঁত, পুলিশভ্যানের হর্ন, দমকল গাড়ির সাইরেন – সবকিছুর সমবেত পরিবেশনার মাঝে ব্যক্তিবিশেষকে নিয়ে কারো কোনো আগ্রহ নেই। যে-লোকটা বলেছিল ড্রাইভার পালিয়েছে, তাকেও আর দেখা যাচ্ছে না, এতক্ষণে সমষ্টির মাঝে মিশে গেছে সে। হয়তো এত মানুষের কোলাহলে সে ভুলেও গেছে, কাকে সে ‘কালপ্রিট’ বলে গালি দিয়েছিল। ব্যক্তির অপরাধ সমষ্টির ঔৎসুক্যে মিশে গেছে – কিন্তু শোক মেশেনি; শোক মেশে না – শোক ব্যক্তির, সমষ্টির না। সেই ব্যক্তিরা এখনো অকুস্থলে এসে পৌঁছায়নি।
সকালে আতোয়ার সাহেব কাজে বেরিয়েছিলেন। দুটো বাসে গুঁতোগুঁতি ঘটার জন্য আতোয়ার সাহেবকে কি প্রয়োজন ছিল? – না, ছিল না। কিন্তু তিনি ছিলেন – পেছনের বাসটাতে ছিলেন – পুরো ঘটনার সাক্ষী। তার দরকার না থাকলেও মাঝেমধ্যে তিনি অনেক জায়গায়ই থাকেন। যেমন তার শ্যালিকার গায়ে হলুদে তাকে দাওয়াত দেওয়া হলো না, শুধু বিয়ের অনুষ্ঠানের দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল, অথচ গায়েহলুদের দিন সকালবেলায়ই তিনি পাঞ্জাবি-পাজামা পরে ড্রইংরুমে বসে হাঁক দিচ্ছিলেন, ‘কই, তোমার হলো? যেতে যেতে তো সবাই ওরা চলে যাবে। নতুন আত্মীয়রা আসবে, ওদের সঙ্গে একটু মোয়ামেলাদ না করলে কেমন হয়?’ ‘এই হলো’, বলে জোহরা রান্নাঘরে ঢুকল। সিংকে ছরছর করে পানি ছেড়ে মাজুনি দিয়ে পরিষ্কার করতে শুরু করে দিলো। আবার হাঁক দিলে, বালিশের কভারগুলো খুলে নতুন কভার লাগাতে বসল। কিন্তু শাড়ি পরছিল না, সাজগোজ করছিল না। আর আতোয়ার সাহেব কেবল ক্ষেপে যাচ্ছিলেন।
জোহরা কী করে বোঝায়, ওদের বাড়ির লোকজন আতোয়ারকে যেতে বলেনি, শুধু জোহরাকে যেতে বলেছে। জোহরা গটগট করে ড্রইংরুমে ঢুকল, হাতের মুঠোয় পর্দার কোনা ধরে দাঁড়াল, সোফায় পা-তুলে বসা আতোয়ার সাহেবকে সোজা জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কাপড় পরেছ কেন, তোমাকে তো যেতে বলেনি?’ আতোয়ার সাহেব বললেন, ‘এসব প্রোগ্রামে আবার বলা লাগে নাকি? হাজার হলেও শালির গায়েহলুদ, না গেলে ও খুব মাইন্ড করবে।’ ‘না, করবে না’, জোহরার কণ্ঠে শাসনের সুর, কিন্তু চোখে অভিমানের অশ্রু। ‘এটা পুরুষদের প্রোগ্রাম নয়, মহিলাদের’, জোহরা অন্যদিকে তাকিয়ে কথাটা বাতাসে ছেড়ে দিলো। আতোয়ার সাহেবের কানে পৌঁছালে তিনি সোফা থেকে পা নামিয়ে ঝাঁকুনি দিয়ে বসলেন, ‘কেন? ফরিদ যাচ্ছে না? ওর সাথে আমার এই একটু আগেই কথা হলো।’ জোহরা চুপ। জবাবে কী বলবে, সঙ্গে সঙ্গে ওর মনে এলো না – একটু দেরি হলো। ও কেবল বলতে যাচ্ছিল, ‘যাচ্ছে, ও সাবিনাকে দিয়ে চলে আসবে’, কিন্তু বলতে পারল না, ততক্ষণে আতোয়ার সাহেব একটার পর একটা পুরুষ মানুষের নাম আওড়াতে শুরু করে দিয়েছেন, ‘ছোটকাকা, বড় দুলাভাই, মিমের আব্বা, মাহতাবভাই, মিজান, মারুফ, মতিন … শাড়ি পরো, শাড়ি পরো। বাসন্তিটা পরো …।’ ‘তাহলে, তুমি যাও। আমি যাব না।’ জোহরা বলল।
‘তা কী করে হয়? তোমার ছোটবোন, আর তুমি যাবে না? ওরা কী ভাববে, বলো তো?’
জোহরা মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিল যে, শাকিলা ওর কাজিন, ছোটবোন নয়। কিন্তু কথাটা আটকে গেল। শাকিলা এ-বাসায় এতবার এসেছে, আর আতোয়ারকে নিয়ে ও ওদের বাসায় এতবার গিয়েছে যে, আপন-পরের পার্থক্য ওরা অনেক আগেই ভুলে গেছে। এত আগে ভুলেছে যে, এতদিন পরে তা মনে করিয়ে দিলেও মনে পড়বে না। আর মনে পড়লেও তাতে কোনো কাজ হবে বলে মনে হলো না। জোহরা যে উদ্দেশ্যে কথাটা বলতে চাচ্ছিল, সে উদ্দেশ্য সাধন হবে না – আতোয়ার সাহেব শাকিলার কপালে হলুদ লাগাবেনই।
মাসদুই আগে শাকিলাকে পাত্রপক্ষ যেদিন দেখতে এসেছিল, কাছের মানুষ হিসেবেই হোক আর কাজের মানুষ হিসেবেই হোক, আতোয়ার-জোহরারা সেখানে ছিলেন। জোহরা সারাদিন পাটায় মরিচ বেটেছে, টিকিয়ার মাংস ছেঁচেছে, খুঁটে খুঁটে রাজহাঁসের পশম তুলেছে, গরুর ভুঁড়ি সিদ্ধ করে পর্দা ছাড়িয়েছে, পাটায় পিষে ফলি মাছের কাঁটা বের করেছে। শাকিলার মা বারবার বলেছেন, ‘দোয়া কর, যেন ওই বাড়িতে বিয়ে না হয়, তাহলে মেয়ে দুইটাই পাঠাতে হবে।’
‘ক্যান চাচি?’ জোহরা পাটার ওপরে নোড়া ঘষতে ঘষতে বলেছিল।
‘তুই না গেলে শাকিলা একদিনও ও বাড়িতে টিকতে পারবে না, ওদের যে খাওয়ার মুখ।’ শাকিলার মা হেসে গড়িয়ে পড়ছিলেন। জোহরা দুই কাঁধ তুলে নোড়া দিয়ে পাটার ওপর জোরে জোরে দুই ঘষা দিয়ে দম নিল। হাসিতে যোগ দিতে গিয়েও থেমে গেল। শাকিলার মা জোহরার দিকে তাকিয়ে নেই, আনমনে পাত্রপক্ষের গাড়িবাড়ি শান-শওকত নিয়ে ব্যঙ্গ করতে শুরু করেছে। জোহরা আবার একমনে নোড়া ঘষতে লাগল।
সন্ধ্যায় পাত্রপক্ষ শাকিলাকে দেখতে এলে আতোয়ার সাহেবের সারামুখে অনুনয়-বিনয় গলে গলে পড়ছিল – কাকে কী বলে, কাকে কোথায় বসতে দেয়, কার কী লাগে, কে কখন টয়লেটে যায়। পাত্রপক্ষ আর কথা কী বলবে, বলার আগেই তিনি সব উত্তর দিয়ে দিচ্ছিলেন। মেয়ে যে হীরের টুকরো সে-কথা বিশ^াস করাতে যতরকম প্রমাণ হাজির করতে হয়, তার সব তিনি গড়গড় করে হাজির করছিলেন। পাত্রের বাবা তো দূরের কথা, শাকিলার বাবাও দুকথা বলার সুযোগ পাচ্ছিলেন না। একপর্যায়ে পাত্রের মামা চোয়াল শক্ত করে জিজ্ঞাসা করে বসল, ‘তিনি কে?’ আতোয়ার সাহেব নিজেই সে-প্রশ্নের উত্তর দিতে আরম্ভ করলে শাকিলার ছোটকাকা বিষয়টা সামলালেন। তাতেই সর্বনাশ ঘটল। ছোটকাকা যা বলেছিলেন তাতে কোনোভাবেই বোঝা গেল না আতোয়ার সাহেব শাকিলার কত আপনজন, শাকিলা সম্পর্কে খুঁটিনাটি কথা কেবল তিনিই বলতে পারেন, ঘনিষ্ঠতার সূত্রে শাকিলা সম্পর্কে তিনি এমন কিছু জানেন, যা তার পরিবারের কেউ জানে না; তিনি জানেন, শাকিলা একা একা বৃষ্টি দেখতে পছন্দ করে। বলতে বলতে আতোয়ার সাহেবের স্নেহবিগলিত মুখটি প্রিয়জনের সুখসম্ভাবনায় যতই প্রস্ফুটিত হতে থাকল পাত্রপক্ষের সবার চোখ ততই সরু হতে থাকল। মাঝখানে ছোটকাকা আতোয়ার সাহেবকে ডেকে আড়ালে নিয়ে না গেলে সেদিন হয়তো ওদের চোখ একেবারেই বুজে যেত। পাশের ঘর থেকে শুধু শোনা যাচ্ছিল আতোয়ার সাহেব ছোটকাকার চাপা কণ্ঠস্বর ছাপিয়ে চেঁচাচ্ছেন, ‘… আমি তো সেই কথাই বলছি … আমি তো সেই কথাই বলছি …।’
সেদিন পাত্রপক্ষের চোখ যতটুকু বুজেছিল, সেটুকু খুলতেই ছোটকাকার দুমাস লেগে গিয়েছিল। দুমাস পর, বিয়ের তারিখ দিলে, ছোটকাকা গায়ে হলুদের জন্য দুদিন আগের তারিখটা নিয়ে নিলেন। দাওয়াত দেওয়ার সময় শাকিলার মা জোহরাকে বলেছিলেন, ‘তুই আসিস। … দ্যাখ, পাত্রপক্ষ থেকে কয়েকজন হলুদ দিতে আসবে …।’
মানুষের যে-কোনো খুঁটিনাটি বিষয়ের প্রতিই আতোয়ার সাহেবের অতি আগ্রহ; কারোর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে দুপক্ষের আগ্রহ তিনি একাই দেখিয়ে দেন, দেখানোর জন্য অন্যপক্ষের আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। বাইরে সবার ব্যাপারে যার সীমাহীন আগ্রহ সেই আতোয়ার সাহেব ঘরে জোহরার গুরুতর ব্যাপারগুলোতে কোনো আগ্রহই দেখান না। আজ সকালে বেরোনোর আগে চায়ের কাপ হাতে দিয়ে জোহরা যখন বলল, ‘তুমি কী ভাবছ, আইভিএফ করাবে না?’ আতোয়ার সাহেব কিছু বললেন না। প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে চাইলেন। জোহরা বলল, ‘অনেকেই তো এভাবে বাচ্চা নিচ্ছে।’ আতোয়ার সাহেব জানেন, জোহরার আর বাচ্চা হবে না – ডাক্তার অনেক আগেই পরিষ্কার বলে দিয়েছেন। আর জোহরা জানে আইভিএফ করালেই ওর বাচ্চা হবে – একবারে না হলে দুবারে হবে, কিন্তু হবে। জোহরা জানে, ওর হাজব্যান্ড রাজি হচ্ছে না বলেই ওদের বাচ্চা হচ্ছে না; আর আতোয়ার সাহেব জানেন, জোহরার ওভারি ড্যামেজড, যে-কথা তিনি ওকে কোনোদিনই বলবেন না, ওর মুখ ছোট হয়ে যাবে, ও আর ঝগড়া করতে পারবে না। ও যেন ঝগড়া করতে পারে, তাই ওকে আতোয়ার সাহেব বলেছেন, তিনি আইভিএফ পছন্দ করেন না, ওনার শুচিবায়ু আছে, সন্তানের প্রতি অশুচিবোধ নিয়ে উনি স্বাভাবিক থাকতে পারবেন না – এসব। এ নিয়ে জোহরা রোজ ঝগড়া করে, হাজব্যান্ডকে বোঝায়, আইভিএফে তার শরীরের উপাদানই কীভাবে প্রসেস করা হয়, আর তাতে তারই পুরোপুরি সম্পৃক্ততা, অন্য কারো নয়। আতোয়ার সাহেব বোঝেন, কথাগুলো জোহরার, কিন্তু শব্দগুলো জোহরার নয় – ওর কোনো বান্ধবী ওকে বুঝিয়েছে। জোহরা কঠিন শব্দ মনে রাখতে পারে না। জোর করে মনে রাখলে বলার সময় ধরা পড়ে যায় – উচ্চারণে ভুল হয় – ও ‘ফেলোপিয়ান টিউবকে’ ‘পোলাপান টিউব’ বলছিল।
জোহরা ঝগড়া করুক। যে মেয়ে ঝগড়া করে না, সে মেয়ে হতে পারে, স্ত্রী নয়। আতোয়ার সাহেবের ভালো লাগে, জোহরা যখন ঝগড়া করে, ঝগড়া করতে করতে ও যখন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, সত্যিমিথ্যে ভুলে যায়, অসম্ভব মিথ্যে কথা বলতে থাকে, কঠিন কঠিন মিথ্যে কথা বলতে থাকে। আর প্রতিটা মিথ্যে কথা ঢাকার জন্য আবার মিথ্যে কথা বলে। তারপর আবার। তারপর আবার। যতই এগোতে থাকে, মিথ্যে কথা তরল থেকে তরলতর হতে থাকে; শেষে হয় হাসি, না হয় কান্না, না হয় হাসিকান্না হয়ে সব একবারে বেরিয়ে যায়।
আতোয়ার সাহেব বিশ^াস করেন, স্ত্রীর মিথ্যে কথাগুলোই সত্যিকার কথা, আর নীরবতা মিথ্যে। সংসার করতে হয় সত্যিকারের কথা নিয়ে, সত্যি কথা নিয়ে সংসার করা যায় না। জোহরা সত্যিকারের কথা বলুক। সত্যিকারভাবে বেঁচে থাকুক।
যেদিন জোহরা বলেছিল, বিয়ের আগে জাফর নামে একটা ছেলের সঙ্গে ওর প্রেম হয়েছিল, ছেলেটা ওকে পাগলের মতো ভালোবাসত, ওর সঙ্গে বিয়ে হলে ও সুখী হতো, ছেলেটা জাপান থেকে বার-অ্যাট-ল করেছিল, আতোয়ার সাহেব শুনে বুঝেছিলেন, এটা স্রেফ মিথ্যে কথা। জোহরাদের এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় জাপানে থাকে। সেই থেকে জাপানের নামটা ওর মাথায় ঢুকেছে। ওর বড়বোনের জন্য এক প্রস্তাব এসেছিল। ছেলেটা বার-অ্যাট-ল করা। সেই থেকে বার-অ্যাট-ল ওর মাথায় ঢুকে আছে। আর জাফর হচ্ছে – জাফর ইকবাল – নায়ক। বিয়ের আগে ও যখন টিভিতে সিনেমা দেখত, তখন জাফর ইকবাল ছিল ওর প্রিয় নায়ক, তার হঠাৎ মৃত্যুতে ও খুব শক্ড হয়েছিল। ওর হৃদয় অনেক গভীর। সেখানে যা ঢোকে, হারিয়ে যায়। ওর হৃদয়ের গহিনে ঠাঁই-নেওয়া এই তিনটি শব্দবিন্দুর মাঝে রেখা টেনে একটা ত্রিভুজ এঁকেছে ও – একটা প্রেমের গল্প ফেঁদেছে। ওর কল্পনাশক্তি খুবই নিম্নমানের। ও একটা নিম্নমানের মানুষ। নিম্নমানের মিথ্যুক। একজন নিম্নমানের মিথ্যুককে নিয়ে সমস্যা হচ্ছে, এদের অবিরাম স্নেহ করে যাওয়া ছাড়া কোনো গতি নেই। প্রকৃতি এদের আশ্চর্য এক বল দিয়ে সৃষ্টি করেছে। একবার সেই বল কাউকে টানতে থাকলে, সে বলকে উপেক্ষা করতে পারে না সে, এক অপার্থিব মায়া তাকে পেয়ে বসে; যতই দিন যেতে থাকে, এক প্রশান্ত আনন্দ এসে ভর করে তার সর্বাঙ্গ জুড়ে। যে কেউ এ বলে ধরা পড়ে না। আতোয়ার সাহেবের মতো কিছু মানুষ, মানুষের ব্যাপারে যাদের অসীম আগ্রহ, কেবল তারাই এদের সন্ধান পায়।
অতএব, দুর্ঘটনার সাক্ষ্য আতোয়ার সাহেবেরই দেওয়ার কথা। দুই চালক আর দুই হেলপার – এই চারটি মানুষের মনোজগতে আর বহির্জগতে কী ঘটছিল, তা যদি কেউ অনুপুঙ্খ দেখে থাকেন, তিনি হচ্ছেন আতোয়ার সাহেব। তিনিই পরম নিরপেক্ষভাবে তাদের নিজ নিজ ভূমিকাও মূল্যায়ন করতে পারবেন। তিনি গাড়ির পেছনের দিকে বসে ছিলেন। আগ্রহ নিয়ে সবকিছু দেখছিলেন। ফাঁকে ফাঁকে কথাও বলছিলেন। কিন্তু প্রচ- ঝাঁকুনিতে তার মাথা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। হালকা-পাতলা মানুষ, জীবনে অনেক ঝাঁকুনি খেয়ে এসেছেন, কিন্তু অত বড় ঝাঁকুনি বোধহয় কখনো খাননি। এক ধাক্কায় উড়ে গিয়ে বাসের ছাদের সঙ্গে মাথা ঠেকালেন, কপালের দুপাশ বেয়ে গলগল করে বেরোতে লাগল রক্ত। সেই রক্ত গালে মেখেই ইন্সপেক্টর তপনের কাছে ঘটনার কিছু না বলেই তিনি মর্গে চলে গেলেন, পোস্টমর্টেমের জন্য অপেক্ষা করছেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। এগারোজন মারা গেছে। আটজন তো তার সামনেই ছেঁচে গেল – তাদের সাতজন তার বাসেই ছিল, সামনের দিকে বসে ছিল। বাসে ওঠার সময় তাদের দু-একজনের সঙ্গে তার কথাও হয়েছিল। তাদের নাম কী, গ্রামের বাড়ি কোথায়, কী করেন, অমুককে চেনেন কি না, ছেলেমেয়ে কোন ক্লাসে পড়ে – এসবই জিজ্ঞাসা করেছিলেন। প্রথমবার কথা হলো বলে এর চেয়ে বেশি কিছু জানতে চাননি।
জোহরা অপেক্ষা করছে। মাঝেমধ্যে একটু-আধটু করতে হয়। তবে আজ একটু বেশিই করতে হচ্ছে। হবে না কেন? দুই বাস মিলে মারা গেছে এগারোজন, আরো পাঁচ-ছয়জন মরবে বলে বসে আছে, বাকিরা যারা বেঁচে আছে, তাদের অনেকেই হাত-পা-চোখ-মুখ মুচলেকা দিয়ে এসেছে। এত লোকের ঝামেলা নিয়ে ডাক্তার-পুলিশের গলদঘর্ম অবস্থা। কাকে ফেলে কাকে আগে দেখবে – ব্লাড কালেকশন, সার্জিক্যাল মেডিসিন জোগাড় করা, আত্মীয়স্বজনকে খবর দেওয়া। আতোয়ার সাহেবের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
গনগনে রোদ। শিরীষ গাছটির নিচে দাঁড়িয়ে ইন্সপেক্টর তপন বুকের বোতাম লাগিয়ে নিচ্ছিলেন। অকুস্থলে এসপি সাহেব এসেছেন। খটাস খটাস করে চারপাশ থেকে স্যালুট পড়ছে।
দুপুরের খাবার খেতে জোহরার বড্ড বেশি দেরি হয়ে যাচ্ছে। জোহরা মনে মনে ভাবছে, ‘এতই যখন দেরি হবে, একটিবার ফোন দিয়ে জানিয়ে দিলেও তো পারত – দেবে না। আমার জন্য ওর কোনো গরজ নেই, যত গরজ শুধু হাটবাজারের লোকদের জন্য। … ও যখন দেবে না, আমিও দেব না …।’ জোহরা মনে মনে আরো ভেবে রাখল, আজ এলে ও একটা মিথ্যে কথা বলে ওকে শায়েস্তা করবে, ‘আমি খেয়েছি, তুমি খেয়ে নাও।’ তখন ও বুঝবে একা একা খাওয়ার কী যন্ত্রণা।
ডাক্তার এসে দেখে গেছে; অপেক্ষমাণ সবাইকে একবার করে পর্যবেক্ষণ করে গেছে। আতোয়ার সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভেবে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল সে।
আতোয়ার সাহেবের আরো দেরি হবে। আরো খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে – তার শুধু মাথা ফেটেছে বলে তার পোস্টমর্টেমটা সবার পরে হবে।
বাসে বাসে গুঁতোগুঁতি লাগার সময় দুটো বাস, দুই বাসের দুই চালক, আর একটা রাস্তা হলেই হয়; গুঁতোগুঁতির কাজে সাহায্যের জন্য বড়জোর দুই বাসের দুই হেলপার লাগতে পারে, কিন্তু রাস্তার পাশে যে শিরীষ গাছটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাতাস টানছিল, ওটার নিশ্চয় দরকার ছিল না। কিন্তু সেদিন টাল সামলাতে না পেরে, পেছনের বাসটা গিয়ে ওটার সঙ্গেই দ্বিতীয় গোত্তাটা খেল, পেছনের দুই চাকা একবার শূন্যে তুলে দিয়ে মুখ ভচকে দাঁড়িয়ে পড়ল, যাওয়ার সময় সামনের বাসের হেলপারের কাঁধ থেকে বাঁ-হাত আর ধড় থেকে মাথা ছিঁড়ে নিয়ে গেল। ওই প্রকা- শিরীষ গাছের ডালপাতার ফাঁকে ফাঁকে যে অতগুলো কাকদুপুরে বিশ্রাম করছিল, সেটা বোঝা গেল, যখন বিকট দানবীয় শব্দ শুনে তারা কা-কা করতে করতে ডানা ঝাপটে ত্রস্তস্রস্ত বেরিয়ে এলো। অবশ্য তারপর মানবীয় চিৎকার শুরু হলে তারা একে একে আবার পাশের গাছে গিয়ে বসেছিল।
সামনের ডানপাশের বাসটা পশ্চাদ্দেশ দুলিয়ে যখন গোঁ-গোঁ করে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছিল, তখন বাঁপাশ থেকে ওই হতভাগা বাসটি মাথা গুঁজে ওটার পেছনে পেছনে আসছিল। দুই হেলপার পরস্পরের দিকে দুবার চোখ গোল করে তাকিয়েছিল। পেছনের চালক তার পান-খাওয়া ঠোঁটে রাঙা হাসি দেখিয়েছিল সামনের হেলপারকে, ও যখন পেছনের ওস্তাদের সঙ্গে তামাশা করার জন্য ঘাড় ঘুরিয়েছিল। ওস্তাদের রস বোধহয় একটু বেশিই বেরিয়ে গিয়েছিল – বাঁ-হাতের চেটোর উলটো পিঠ দিয়ে ঘষে ঠোঁট মুছে নিয়েছিল। সামনেরটার চালক যখন টের পেল পরকীয়া চলছে, তখন বাঁয়ে কাত হয়ে পেছনেরটাকে বেমক্কা চাপ দিলো। পেছনেরটা তাড়া খেয়ে সরে না গিয়ে ঝাড়া দিয়ে মাথা এগিয়ে দিলো। সে-মাথা গিয়ে সামনেরটার দরজা গলে ঢুকে পড়ল, তারপর খানিক কড়কড়-ক্যাঁচক্যাঁচ ঝনাৎ-ঝনাৎ আওয়াজ করে অবশেষে ঘোঁতঘোঁত করে বেরিয়ে এলো। আসার সময় হামানদিস্তার মতো ছেঁচে বের করে আনল হেলপারের শরীরের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ – মুখে করে নিয়ে বেগতিক ছুটল শিরীষ গাছটির দিকে। প্রকা- শিরীষ গাছের কা- সেঁধিয়ে গেল বাসের নাক বরাবর – গাছের বাকলের সঙ্গে বাসের মুখ ভাঁজ হয়ে লেপটে গেল। মুহূর্তে বাসের সামনের অর্ধেকটা বালকের শিশ্নের মতো কুঁচকে গেল।
থানা থেকে লোকজন এসে বাস কাটতে আরম্ভ করল। তখন দেড়টা বাজে। গনগনে রোদ। কাকের কা-কা। মাঝেমধ্যে খয়েরি-সাদা বিষ্ঠা ঝরে পড়ছে শিরীষ গাছগুলো থেকে। ক্রেনের কমলা রঙের বিশাল বাহুর ধীর ওঠানামা দেখা যাচ্ছে। বাসের সামনের দিক থেকে শুরু করল উদ্ধারকাজ। প্রথমে একটা একটা করে দুটো হাত বেরোল – একটা কাঁধ থেকে ছেঁড়া, আরেকটা কনুই থেকে। দুটোই বাঁহাত। ইন্সপেক্টর তপন ছোট্ট করে বললেন, ‘ড্রাইভার মরেছে।’ কেউ শুনতে পেল না। লোকজনের চেঁচামেচি, বাঁশির ফুঁকাফুঁকি, ওয়াকিটকির টুঁত-টুঁত, পুলিশভ্যানের হর্ন, দমকল গাড়ির সাইরেন – সবকিছুর সমবেত পরিবেশনার মাঝে ব্যক্তিবিশেষকে নিয়ে কারো কোনো আগ্রহ নেই। যে-লোকটা বলেছিল ড্রাইভার পালিয়েছে, তাকেও আর দেখা যাচ্ছে না, এতক্ষণে সমষ্টির মাঝে মিশে গেছে সে। হয়তো এত মানুষের কোলাহলে সে ভুলেও গেছে, কাকে সে ‘কালপ্রিট’ বলে গালি দিয়েছিল। ব্যক্তির অপরাধ সমষ্টির ঔৎসুক্যে মিশে গেছে – কিন্তু শোক মেশেনি; শোক মেশে না – শোক ব্যক্তির, সমষ্টির না। সেই ব্যক্তিরা এখনো অকুস্থলে এসে পৌঁছায়নি।
সকালে আতোয়ার সাহেব কাজে বেরিয়েছিলেন। দুটো বাসে গুঁতোগুঁতি ঘটার জন্য আতোয়ার সাহেবকে কি প্রয়োজন ছিল? – না, ছিল না। কিন্তু তিনি ছিলেন – পেছনের বাসটাতে ছিলেন – পুরো ঘটনার সাক্ষী। তার দরকার না থাকলেও মাঝেমধ্যে তিনি অনেক জায়গায়ই থাকেন। যেমন তার শ্যালিকার গায়ে হলুদে তাকে দাওয়াত দেওয়া হলো না, শুধু বিয়ের অনুষ্ঠানের দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল, অথচ গায়েহলুদের দিন সকালবেলায়ই তিনি পাঞ্জাবি-পাজামা পরে ড্রইংরুমে বসে হাঁক দিচ্ছিলেন, ‘কই, তোমার হলো? যেতে যেতে তো সবাই ওরা চলে যাবে। নতুন আত্মীয়রা আসবে, ওদের সঙ্গে একটু মোয়ামেলাদ না করলে কেমন হয়?’ ‘এই হলো’, বলে জোহরা রান্নাঘরে ঢুকল। সিংকে ছরছর করে পানি ছেড়ে মাজুনি দিয়ে পরিষ্কার করতে শুরু করে দিলো। আবার হাঁক দিলে, বালিশের কভারগুলো খুলে নতুন কভার লাগাতে বসল। কিন্তু শাড়ি পরছিল না, সাজগোজ করছিল না। আর আতোয়ার সাহেব কেবল ক্ষেপে যাচ্ছিলেন।
জোহরা কী করে বোঝায়, ওদের বাড়ির লোকজন আতোয়ারকে যেতে বলেনি, শুধু জোহরাকে যেতে বলেছে। জোহরা গটগট করে ড্রইংরুমে ঢুকল, হাতের মুঠোয় পর্দার কোনা ধরে দাঁড়াল, সোফায় পা-তুলে বসা আতোয়ার সাহেবকে সোজা জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কাপড় পরেছ কেন, তোমাকে তো যেতে বলেনি?’ আতোয়ার সাহেব বললেন, ‘এসব প্রোগ্রামে আবার বলা লাগে নাকি? হাজার হলেও শালির গায়েহলুদ, না গেলে ও খুব মাইন্ড করবে।’ ‘না, করবে না’, জোহরার কণ্ঠে শাসনের সুর, কিন্তু চোখে অভিমানের অশ্রু। ‘এটা পুরুষদের প্রোগ্রাম নয়, মহিলাদের’, জোহরা অন্যদিকে তাকিয়ে কথাটা বাতাসে ছেড়ে দিলো। আতোয়ার সাহেবের কানে পৌঁছালে তিনি সোফা থেকে পা নামিয়ে ঝাঁকুনি দিয়ে বসলেন, ‘কেন? ফরিদ যাচ্ছে না? ওর সাথে আমার এই একটু আগেই কথা হলো।’ জোহরা চুপ। জবাবে কী বলবে, সঙ্গে সঙ্গে ওর মনে এলো না – একটু দেরি হলো। ও কেবল বলতে যাচ্ছিল, ‘যাচ্ছে, ও সাবিনাকে দিয়ে চলে আসবে’, কিন্তু বলতে পারল না, ততক্ষণে আতোয়ার সাহেব একটার পর একটা পুরুষ মানুষের নাম আওড়াতে শুরু করে দিয়েছেন, ‘ছোটকাকা, বড় দুলাভাই, মিমের আব্বা, মাহতাবভাই, মিজান, মারুফ, মতিন … শাড়ি পরো, শাড়ি পরো। বাসন্তিটা পরো …।’ ‘তাহলে, তুমি যাও। আমি যাব না।’ জোহরা বলল।
‘তা কী করে হয়? তোমার ছোটবোন, আর তুমি যাবে না? ওরা কী ভাববে, বলো তো?’
জোহরা মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিল যে, শাকিলা ওর কাজিন, ছোটবোন নয়। কিন্তু কথাটা আটকে গেল। শাকিলা এ-বাসায় এতবার এসেছে, আর আতোয়ারকে নিয়ে ও ওদের বাসায় এতবার গিয়েছে যে, আপন-পরের পার্থক্য ওরা অনেক আগেই ভুলে গেছে। এত আগে ভুলেছে যে, এতদিন পরে তা মনে করিয়ে দিলেও মনে পড়বে না। আর মনে পড়লেও তাতে কোনো কাজ হবে বলে মনে হলো না। জোহরা যে উদ্দেশ্যে কথাটা বলতে চাচ্ছিল, সে উদ্দেশ্য সাধন হবে না – আতোয়ার সাহেব শাকিলার কপালে হলুদ লাগাবেনই।
মাসদুই আগে শাকিলাকে পাত্রপক্ষ যেদিন দেখতে এসেছিল, কাছের মানুষ হিসেবেই হোক আর কাজের মানুষ হিসেবেই হোক, আতোয়ার-জোহরারা সেখানে ছিলেন। জোহরা সারাদিন পাটায় মরিচ বেটেছে, টিকিয়ার মাংস ছেঁচেছে, খুঁটে খুঁটে রাজহাঁসের পশম তুলেছে, গরুর ভুঁড়ি সিদ্ধ করে পর্দা ছাড়িয়েছে, পাটায় পিষে ফলি মাছের কাঁটা বের করেছে। শাকিলার মা বারবার বলেছেন, ‘দোয়া কর, যেন ওই বাড়িতে বিয়ে না হয়, তাহলে মেয়ে দুইটাই পাঠাতে হবে।’
‘ক্যান চাচি?’ জোহরা পাটার ওপরে নোড়া ঘষতে ঘষতে বলেছিল।
‘তুই না গেলে শাকিলা একদিনও ও বাড়িতে টিকতে পারবে না, ওদের যে খাওয়ার মুখ।’ শাকিলার মা হেসে গড়িয়ে পড়ছিলেন। জোহরা দুই কাঁধ তুলে নোড়া দিয়ে পাটার ওপর জোরে জোরে দুই ঘষা দিয়ে দম নিল। হাসিতে যোগ দিতে গিয়েও থেমে গেল। শাকিলার মা জোহরার দিকে তাকিয়ে নেই, আনমনে পাত্রপক্ষের গাড়িবাড়ি শান-শওকত নিয়ে ব্যঙ্গ করতে শুরু করেছে। জোহরা আবার একমনে নোড়া ঘষতে লাগল।
সন্ধ্যায় পাত্রপক্ষ শাকিলাকে দেখতে এলে আতোয়ার সাহেবের সারামুখে অনুনয়-বিনয় গলে গলে পড়ছিল – কাকে কী বলে, কাকে কোথায় বসতে দেয়, কার কী লাগে, কে কখন টয়লেটে যায়। পাত্রপক্ষ আর কথা কী বলবে, বলার আগেই তিনি সব উত্তর দিয়ে দিচ্ছিলেন। মেয়ে যে হীরের টুকরো সে-কথা বিশ^াস করাতে যতরকম প্রমাণ হাজির করতে হয়, তার সব তিনি গড়গড় করে হাজির করছিলেন। পাত্রের বাবা তো দূরের কথা, শাকিলার বাবাও দুকথা বলার সুযোগ পাচ্ছিলেন না। একপর্যায়ে পাত্রের মামা চোয়াল শক্ত করে জিজ্ঞাসা করে বসল, ‘তিনি কে?’ আতোয়ার সাহেব নিজেই সে-প্রশ্নের উত্তর দিতে আরম্ভ করলে শাকিলার ছোটকাকা বিষয়টা সামলালেন। তাতেই সর্বনাশ ঘটল। ছোটকাকা যা বলেছিলেন তাতে কোনোভাবেই বোঝা গেল না আতোয়ার সাহেব শাকিলার কত আপনজন, শাকিলা সম্পর্কে খুঁটিনাটি কথা কেবল তিনিই বলতে পারেন, ঘনিষ্ঠতার সূত্রে শাকিলা সম্পর্কে তিনি এমন কিছু জানেন, যা তার পরিবারের কেউ জানে না; তিনি জানেন, শাকিলা একা একা বৃষ্টি দেখতে পছন্দ করে। বলতে বলতে আতোয়ার সাহেবের স্নেহবিগলিত মুখটি প্রিয়জনের সুখসম্ভাবনায় যতই প্রস্ফুটিত হতে থাকল পাত্রপক্ষের সবার চোখ ততই সরু হতে থাকল। মাঝখানে ছোটকাকা আতোয়ার সাহেবকে ডেকে আড়ালে নিয়ে না গেলে সেদিন হয়তো ওদের চোখ একেবারেই বুজে যেত। পাশের ঘর থেকে শুধু শোনা যাচ্ছিল আতোয়ার সাহেব ছোটকাকার চাপা কণ্ঠস্বর ছাপিয়ে চেঁচাচ্ছেন, ‘… আমি তো সেই কথাই বলছি … আমি তো সেই কথাই বলছি …।’
সেদিন পাত্রপক্ষের চোখ যতটুকু বুজেছিল, সেটুকু খুলতেই ছোটকাকার দুমাস লেগে গিয়েছিল। দুমাস পর, বিয়ের তারিখ দিলে, ছোটকাকা গায়ে হলুদের জন্য দুদিন আগের তারিখটা নিয়ে নিলেন। দাওয়াত দেওয়ার সময় শাকিলার মা জোহরাকে বলেছিলেন, ‘তুই আসিস। … দ্যাখ, পাত্রপক্ষ থেকে কয়েকজন হলুদ দিতে আসবে …।’
মানুষের যে-কোনো খুঁটিনাটি বিষয়ের প্রতিই আতোয়ার সাহেবের অতি আগ্রহ; কারোর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে দুপক্ষের আগ্রহ তিনি একাই দেখিয়ে দেন, দেখানোর জন্য অন্যপক্ষের আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। বাইরে সবার ব্যাপারে যার সীমাহীন আগ্রহ সেই আতোয়ার সাহেব ঘরে জোহরার গুরুতর ব্যাপারগুলোতে কোনো আগ্রহই দেখান না। আজ সকালে বেরোনোর আগে চায়ের কাপ হাতে দিয়ে জোহরা যখন বলল, ‘তুমি কী ভাবছ, আইভিএফ করাবে না?’ আতোয়ার সাহেব কিছু বললেন না। প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে চাইলেন। জোহরা বলল, ‘অনেকেই তো এভাবে বাচ্চা নিচ্ছে।’ আতোয়ার সাহেব জানেন, জোহরার আর বাচ্চা হবে না – ডাক্তার অনেক আগেই পরিষ্কার বলে দিয়েছেন। আর জোহরা জানে আইভিএফ করালেই ওর বাচ্চা হবে – একবারে না হলে দুবারে হবে, কিন্তু হবে। জোহরা জানে, ওর হাজব্যান্ড রাজি হচ্ছে না বলেই ওদের বাচ্চা হচ্ছে না; আর আতোয়ার সাহেব জানেন, জোহরার ওভারি ড্যামেজড, যে-কথা তিনি ওকে কোনোদিনই বলবেন না, ওর মুখ ছোট হয়ে যাবে, ও আর ঝগড়া করতে পারবে না। ও যেন ঝগড়া করতে পারে, তাই ওকে আতোয়ার সাহেব বলেছেন, তিনি আইভিএফ পছন্দ করেন না, ওনার শুচিবায়ু আছে, সন্তানের প্রতি অশুচিবোধ নিয়ে উনি স্বাভাবিক থাকতে পারবেন না – এসব। এ নিয়ে জোহরা রোজ ঝগড়া করে, হাজব্যান্ডকে বোঝায়, আইভিএফে তার শরীরের উপাদানই কীভাবে প্রসেস করা হয়, আর তাতে তারই পুরোপুরি সম্পৃক্ততা, অন্য কারো নয়। আতোয়ার সাহেব বোঝেন, কথাগুলো জোহরার, কিন্তু শব্দগুলো জোহরার নয় – ওর কোনো বান্ধবী ওকে বুঝিয়েছে। জোহরা কঠিন শব্দ মনে রাখতে পারে না। জোর করে মনে রাখলে বলার সময় ধরা পড়ে যায় – উচ্চারণে ভুল হয় – ও ‘ফেলোপিয়ান টিউবকে’ ‘পোলাপান টিউব’ বলছিল।
জোহরা ঝগড়া করুক। যে মেয়ে ঝগড়া করে না, সে মেয়ে হতে পারে, স্ত্রী নয়। আতোয়ার সাহেবের ভালো লাগে, জোহরা যখন ঝগড়া করে, ঝগড়া করতে করতে ও যখন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, সত্যিমিথ্যে ভুলে যায়, অসম্ভব মিথ্যে কথা বলতে থাকে, কঠিন কঠিন মিথ্যে কথা বলতে থাকে। আর প্রতিটা মিথ্যে কথা ঢাকার জন্য আবার মিথ্যে কথা বলে। তারপর আবার। তারপর আবার। যতই এগোতে থাকে, মিথ্যে কথা তরল থেকে তরলতর হতে থাকে; শেষে হয় হাসি, না হয় কান্না, না হয় হাসিকান্না হয়ে সব একবারে বেরিয়ে যায়।
আতোয়ার সাহেব বিশ^াস করেন, স্ত্রীর মিথ্যে কথাগুলোই সত্যিকার কথা, আর নীরবতা মিথ্যে। সংসার করতে হয় সত্যিকারের কথা নিয়ে, সত্যি কথা নিয়ে সংসার করা যায় না। জোহরা সত্যিকারের কথা বলুক। সত্যিকারভাবে বেঁচে থাকুক।
যেদিন জোহরা বলেছিল, বিয়ের আগে জাফর নামে একটা ছেলের সঙ্গে ওর প্রেম হয়েছিল, ছেলেটা ওকে পাগলের মতো ভালোবাসত, ওর সঙ্গে বিয়ে হলে ও সুখী হতো, ছেলেটা জাপান থেকে বার-অ্যাট-ল করেছিল, আতোয়ার সাহেব শুনে বুঝেছিলেন, এটা স্রেফ মিথ্যে কথা। জোহরাদের এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় জাপানে থাকে। সেই থেকে জাপানের নামটা ওর মাথায় ঢুকেছে। ওর বড়বোনের জন্য এক প্রস্তাব এসেছিল। ছেলেটা বার-অ্যাট-ল করা। সেই থেকে বার-অ্যাট-ল ওর মাথায় ঢুকে আছে। আর জাফর হচ্ছে – জাফর ইকবাল – নায়ক। বিয়ের আগে ও যখন টিভিতে সিনেমা দেখত, তখন জাফর ইকবাল ছিল ওর প্রিয় নায়ক, তার হঠাৎ মৃত্যুতে ও খুব শক্ড হয়েছিল। ওর হৃদয় অনেক গভীর। সেখানে যা ঢোকে, হারিয়ে যায়। ওর হৃদয়ের গহিনে ঠাঁই-নেওয়া এই তিনটি শব্দবিন্দুর মাঝে রেখা টেনে একটা ত্রিভুজ এঁকেছে ও – একটা প্রেমের গল্প ফেঁদেছে। ওর কল্পনাশক্তি খুবই নিম্নমানের। ও একটা নিম্নমানের মানুষ। নিম্নমানের মিথ্যুক। একজন নিম্নমানের মিথ্যুককে নিয়ে সমস্যা হচ্ছে, এদের অবিরাম স্নেহ করে যাওয়া ছাড়া কোনো গতি নেই। প্রকৃতি এদের আশ্চর্য এক বল দিয়ে সৃষ্টি করেছে। একবার সেই বল কাউকে টানতে থাকলে, সে বলকে উপেক্ষা করতে পারে না সে, এক অপার্থিব মায়া তাকে পেয়ে বসে; যতই দিন যেতে থাকে, এক প্রশান্ত আনন্দ এসে ভর করে তার সর্বাঙ্গ জুড়ে। যে কেউ এ বলে ধরা পড়ে না। আতোয়ার সাহেবের মতো কিছু মানুষ, মানুষের ব্যাপারে যাদের অসীম আগ্রহ, কেবল তারাই এদের সন্ধান পায়।
অতএব, দুর্ঘটনার সাক্ষ্য আতোয়ার সাহেবেরই দেওয়ার কথা। দুই চালক আর দুই হেলপার – এই চারটি মানুষের মনোজগতে আর বহির্জগতে কী ঘটছিল, তা যদি কেউ অনুপুঙ্খ দেখে থাকেন, তিনি হচ্ছেন আতোয়ার সাহেব। তিনিই পরম নিরপেক্ষভাবে তাদের নিজ নিজ ভূমিকাও মূল্যায়ন করতে পারবেন। তিনি গাড়ির পেছনের দিকে বসে ছিলেন। আগ্রহ নিয়ে সবকিছু দেখছিলেন। ফাঁকে ফাঁকে কথাও বলছিলেন। কিন্তু প্রচ- ঝাঁকুনিতে তার মাথা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। হালকা-পাতলা মানুষ, জীবনে অনেক ঝাঁকুনি খেয়ে এসেছেন, কিন্তু অত বড় ঝাঁকুনি বোধহয় কখনো খাননি। এক ধাক্কায় উড়ে গিয়ে বাসের ছাদের সঙ্গে মাথা ঠেকালেন, কপালের দুপাশ বেয়ে গলগল করে বেরোতে লাগল রক্ত। সেই রক্ত গালে মেখেই ইন্সপেক্টর তপনের কাছে ঘটনার কিছু না বলেই তিনি মর্গে চলে গেলেন, পোস্টমর্টেমের জন্য অপেক্ষা করছেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। এগারোজন মারা গেছে। আটজন তো তার সামনেই ছেঁচে গেল – তাদের সাতজন তার বাসেই ছিল, সামনের দিকে বসে ছিল। বাসে ওঠার সময় তাদের দু-একজনের সঙ্গে তার কথাও হয়েছিল। তাদের নাম কী, গ্রামের বাড়ি কোথায়, কী করেন, অমুককে চেনেন কি না, ছেলেমেয়ে কোন ক্লাসে পড়ে – এসবই জিজ্ঞাসা করেছিলেন। প্রথমবার কথা হলো বলে এর চেয়ে বেশি কিছু জানতে চাননি।
জোহরা অপেক্ষা করছে। মাঝেমধ্যে একটু-আধটু করতে হয়। তবে আজ একটু বেশিই করতে হচ্ছে। হবে না কেন? দুই বাস মিলে মারা গেছে এগারোজন, আরো পাঁচ-ছয়জন মরবে বলে বসে আছে, বাকিরা যারা বেঁচে আছে, তাদের অনেকেই হাত-পা-চোখ-মুখ মুচলেকা দিয়ে এসেছে। এত লোকের ঝামেলা নিয়ে ডাক্তার-পুলিশের গলদঘর্ম অবস্থা। কাকে ফেলে কাকে আগে দেখবে – ব্লাড কালেকশন, সার্জিক্যাল মেডিসিন জোগাড় করা, আত্মীয়স্বজনকে খবর দেওয়া। আতোয়ার সাহেবের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
গনগনে রোদ। শিরীষ গাছটির নিচে দাঁড়িয়ে ইন্সপেক্টর তপন বুকের বোতাম লাগিয়ে নিচ্ছিলেন। অকুস্থলে এসপি সাহেব এসেছেন। খটাস খটাস করে চারপাশ থেকে স্যালুট পড়ছে।
দুপুরের খাবার খেতে জোহরার বড্ড বেশি দেরি হয়ে যাচ্ছে। জোহরা মনে মনে ভাবছে, ‘এতই যখন দেরি হবে, একটিবার ফোন দিয়ে জানিয়ে দিলেও তো পারত – দেবে না। আমার জন্য ওর কোনো গরজ নেই, যত গরজ শুধু হাটবাজারের লোকদের জন্য। … ও যখন দেবে না, আমিও দেব না …।’ জোহরা মনে মনে আরো ভেবে রাখল, আজ এলে ও একটা মিথ্যে কথা বলে ওকে শায়েস্তা করবে, ‘আমি খেয়েছি, তুমি খেয়ে নাও।’ তখন ও বুঝবে একা একা খাওয়ার কী যন্ত্রণা।
ডাক্তার এসে দেখে গেছে; অপেক্ষমাণ সবাইকে একবার করে পর্যবেক্ষণ করে গেছে। আতোয়ার সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভেবে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল সে।
আতোয়ার সাহেবের আরো দেরি হবে। আরো খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে – তার শুধু মাথা ফেটেছে বলে তার পোস্টমর্টেমটা সবার পরে হবে।
No comments