সক্রিয় আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ বিদেশ থেকে by শুভ্র দেব
রাজধানীর
কাফরুল থানা এলাকার একজন চিকিৎসকের কাছে টেলিফোনে চাঁদা দাবি করা হয়। একজন
শীর্ষ সন্ত্রাসীর নামে তার কাছে এই চাঁদা দাবির পর ওই চিকিৎসক আইন শৃঙ্খলা
রক্ষাকারী বাহিনীকে জানিয়ে ছিলেন। সরকারি সংস্থা প্রাথমিক তদন্ত করে
নিশ্চিত হয় বিদেশি নম্বর থেকে ওই চিকিৎসকের কাছে চাঁদা দাবি করা হয়। আইন
শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ওই চিকিৎসকের নিরাপত্তা দিয়েছিল অভিযোগের পর।
কিন্তু এতে আশ্বস্ত হতে পারেননি ওই চিকিৎসক। তিনি পুলিশকে না জানিয়েই ওই
পক্ষকে মোটা অংকের চাঁদা দিয়ে দেন। শুধু এই চিকিৎসকই নন এমন অনেকের কাছে
চাঁদা দাবি করা হচ্ছে এক সময়ের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে। তাদের অনেকে
বিদেশে বা কারাগারে রয়েছেন।
তাদের কাউকে কাউকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছিল। পরে বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসীকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়। তাদের কেউ কেউ এখন কারাগারে। তবে বেশিরভাগ তালিকাভূক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী সীমান্ত পার হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। আর এখন কারাগার ও বিদেশে থেকে তারা নিয়ন্ত্রণ করছেন ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড। বিদেশে বসে তারা নির্দেশ দিচ্ছেন বিভিন্ন অপরাধের। তাদের নিজস্ব বাহিনী দিয়ে দেশে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন।
গোয়েন্দাসূত্র বলছে, পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনেকেই এখন একটি প্রতিবেশী দেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সুইডেন, দুবাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ডে অবস্থান করছেন। কেউ কেউ আছেন পাশ্ববর্তী দেশ ভারত বা পাকিস্তানে। তাদের মাথার ওপর একাধিক মামলা ঝুলছে। ইন্টারপোলের রেড অ্যালার্টও রয়েছে তাদের নামে। কিন্তু আইনি জটিলতা থাকায় তাদের সহজে ফেরানো যাচ্ছে না। ইন্টাপোলের রেড অ্যালার্টে নাম থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে রয়েছে, কালা জাহাঙ্গির ওরফে ফেরদৌস, সুব্রত বাইন, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, আমিনুর রসুল, হারিস আহমেদ, জাফর আহমেদ, আবদুল জব্বার, নবী হোসাইন, জিসান, শাহাদাত হোসাইন, মোল্লা মাসুদ। বছরের পর বছর ধরে তারা বিভিন্ন দেশে অবস্থান করে নিয়ন্ত্রণ করছেন দেশের আন্ডারওয়ার্ল্ড। তাদের নামে এখনও কোটি কোটি টাকার নিরব চাঁদাবাজি, খুনখারাবিসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হয়। আবার অনেকে সন্ত্রাসীর নাম ভাঙ্গিয়েও চাঁদাবাজি করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছে প্রায়ই অপরিচিত মোবাইল নম্বর থেকে ফোন আসে। ফোনের অপর পাশ থেকে ব্যবসায়ীর অবস্থান নিশ্চিত করে চাঁদা দাবি করা হয়। বিশেষ করে রমজান মাস শুরু হওয়ার পর থেকে সন্ত্রাসীদের হুমকি-ধমকি অনেকটা বেড়ে গেছে। চাহিদা মত চাঁদা না দিলে হত্যাসহ নানা রকম ভয়ভীতি দেখানো হয়। প্রাণের ভয়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে না জানিয়ে অনেকেই চাঁদা তুলে দেন সন্ত্রাসীদের হাতে।
দুই মাস আগে কাফরুলের হাইটেক মাল্টিকেয়ায় হাসপাতালের এক চিকিৎসকের মুঠো ফোনে কল দিয়ে বিদেশ থেকে চাঁদা দাবি করে শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহিন শিকদার। চাঁদা না দিলে তাকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকিও দেয়া হয়। পরে ওই চিকিৎসক হুমকির বিষয়টি উল্লেখ করে কাফরুল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। পুলিশ তার অভিযোগ আমলে নিয়ে নিরাপত্তা জোরদার ও নজরদারি বাড়ায়।
কিন্তু ওই চিকিৎসককে ক্রমাগত হুমকি দিতে থাকে ওই সন্ত্রাসী। পরে ওই চিকিৎসক প্রাণের ভয়ে দাবিকৃত চাঁদা তুলে দেন ওই শীর্ষ সন্ত্রাসীর লোকজনের হাতে। কাফরুল থানার তৎকালীন পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আসলাম উদ্দিন গতকাল মানবজমিনকে বলেন, একজন চিকিৎসক হুমকি পেয়ে থানায় জিডি করেছিলেন। আমরা তার জন্য ব্যাপক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিলাম। যে মোবাইল নম্বর থেকে ওই সন্ত্রাসী ফোন দিয়েছিল সেই নম্বর যাচাই-বাচাই করে আমরা নিশ্চিত হয়েছি ফোনটা দেশের বাইরে থেকে করা হয়েছে। দেশের ভেতরে থাকলে তাকে আমরা শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতাম। তিনি বলেন, সম্প্রতি কাফরুল থানায় দুটি মার্ডার মামলার রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তারকৃত আসামীরা আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে এসব মার্ডারের সঙ্গে শাহীন শিকদারের সম্পৃক্ততা রয়েছে। কিন্তু সে দেশের বাইরে থাকায় তাকে কিছু করা যাচ্ছে না। কাফরুল থানার বর্তমান পরিদর্শক (তদন্ত) ফারুকুল আলম বলেন, আমি এপ্রিলের শেষ দিকে এ থানায় এসেছি। এখানে আসার পরই শাহিন শিকদারের নাম শুনেছি। কয়েকটি মার্ডারের সঙ্গে সে জড়িত আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কাফরুল, পল্লবী এলাকায় পলাতক শাহিন শিকদারের নামে নানা অপকর্ম হচ্ছে। ব্যবসায়ী, বাড়ির মালিক, ডেভেলপার কোম্পানির কাছে চাঁদা দাবি করছে তার লোকজন। গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলছেন শুধু্ হাইটেক হাসপাতালের ওই চিকিৎসক নয়। ভয়ভীতি দেখিয়ে আরও অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে শাহিন শিকদারের লোকজন। তবে ভয়ে কেউ মুখ খোলেনি।
চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারে যাদের নাম আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে আছে তাদের মধ্যে রয়েছে মিরপুরে শাহাদাত ও লিটু, খিলগাঁওয়ে জিসান, কাওরান বাজারে আশিক, কল্যাণপুরে বিকাশ-প্রকাশ, বাড্ডার মেহেদী হাসান, রবিন-ডালিম, নাহিদ, আশিক, যাত্রাবাড়িতে ইটালি নাসির, জুরাইনের কচি, মগবাজারের রনি, শাহআলী এলাকায় গাজী সুমন, আদাবরের নবী, মোহাম্মদপুরের কালা মনির, পল্লবীর মোক্তার বাহিনী ও কাফরুলের শাহিন শিকদার।
এসব শীর্ষ সন্ত্রাসী তাদের ছত্রছায়ায় নিজস্ব বাহিনী তৈরি করেছে। এলাকা ভিত্তিক পলাতক বড় বড় সন্ত্রাসীদের নামে অপরাধ করছে। এদের মধ্যে বাড্ডা এলাকায় রয়েছে সজিব, আলমগীর, আরিফ, মান্নান, ডালিম, রবিন, রমজান, দুলাল, মানিক, শিপলু, রায়হান, রুবেল, রিয়াদ খিলগাঁওয়ে খালেদ ও মানিক, রামপুরায় পলাশ, মুরাদ, গুলশান-বনানী এলাকায় টিপু, যাত্রাবাড়ি-সায়েদাবাদ এলাকায় জাহাঙ্গির, সায়েম আলীম মহাখালী এলাকায় অপু, মিলন মুকুল সাততলা বস্তিতে মনিরম লম্বু সেলিম, হাজারীবাগে বুলু, লিংকন,তপু, জনি, রফিক, বিল্লু, মুন্না, কলাবাগান এলাকায় নাজিম, ইমন, মোহাম্মদপুরে মোশারফ, লম্বা মোশারফ, চিকা জসিম, আহম্মদ, সাজ্জাদ, মোহন, পাভেল, লোটন, তানভীর, রবিন, আদিত্য, মীম, খলিল, হাজী আক্কাস ও শাহ আলীতে বল্টু রাসেল।
শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতায় বাড্ডা ও পাশ্ববর্তী এলাকায় রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ছাড়াও আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা নিয়ে বিরোধ, অটো রিকশা চলাচলের রুটে চাঁদাবাজি, খাল ভরাট, বালু মহাল দখল, মাছের ঘের দখল, ডিশ ব্যবসা ও ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রতিনিয়ত অস্থির হয়ে থাকে। এসব দ্বন্দ্বে গত কয়েক বছরে আওয়ামী লীগ নেতা ফরহাদসহ বেশ কয়েকজনকে হত্যা করা হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, দেশের বাইরে বসে ভাড়াটে কিলার দিয়ে পলাতক সন্ত্রাসীরা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছেন। আলাদা আলাদা এসব সন্ত্রাসী গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করছে মালয়েশিয়ায় পলাতক রবিন ও ডালিম, যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী মেহেদি ও সাখায়াত হোসেন চঞ্চল, সুইডেনে থাকা নাহিদ এবং ভারতে অবস্থান করা আশিক।
তাদের নির্দেশে ওই এলাকায় সকল অপরাধ সংঘটিত হয়। ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো ও ম্যাসেঞ্জারে চাঁদাবাজি ও খুনের নির্দেশ দিচ্ছে তারা। গত বছর স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ফরহাদ হোসেন, আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলমের ভাই কামরুজ্জামান দুখু এবং ডিশ ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক ওরফে ডিশ বাবু হত্যাকান্ডে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো জড়িত বলে স্থানীয়রা বলে আসছেন। এছাড়া আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীদের হুমকি পেয়ে থানায় জিডি করে রেখেছেন অনেকে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কারাগারে থাকা রামপুুরা এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী কাইল্ল্যা পলাশ তার বাহিনী দিয়ে আধিপত্য বিস্তার করছেন। তার সঙ্গে রয়েছে তার ভাগিনা তুষার ও আরেক সন্ত্রাসী শাহজাদা।
গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, মিরপুর এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাত হোসেন অনেক আগেই ভারতে চলে যায়। সেখান থেকে সে ভারতীয় পাসপোর্ট করে বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বর্তমানে মধ্যেপ্রাচ্যর দেশ দুবাইতে অবস্থান করছে।
দুবাইয়ে তার অবস্থান থাকলেও মিরপুর এলাকায় এখনও সে আধিপত্য বিস্তার করে যাচ্ছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মো. মাহবুব আলম মানবজমিনকে বলেন, আন্ডারওয়ার্ল্ডের অবস্থা এখন আর আগের মত নেই। তবে বিদেশে পলাতক কিছু শীর্ষ সন্ত্রাসী এখনও নীরবে নানা রকম অপরাধ করছে। কিছুদিন আগেও কাফরুল এলাকায় বড় ধরনের চাঁদাবাজি করেছে পলাতক সন্ত্রাসী শাহিন শিকদার। যদিও ভুক্তভোগী ওই ব্যক্তি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানোর পরও ওই সন্ত্রাসীর লোকজনের কাছে চাঁদা তুলে দিয়েছেন। মোহাম্মদপুর এলাকায়ও বড় অংকের টাকা ছিনতাইয়ের একটি ঘটনা ঘটেছে। তিনি বলেন, শীর্ষ এসব সন্ত্রাসীদের ধরার জন্য পুলিশ চেষ্টা করছে।
ন্যাশনাল কাউন্সিল ব্যুরো বাংলাদেশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মহিউল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনেকেই এখন বিভিন্ন দেশে পলাতক। ইন্টারপোলের রেডঅ্যালার্টে তাদের নাম প্রকাশ করা হয়েছে। অনেকের অবস্থানও আমরা শনাক্ত করেছি। আমরা সংশ্লিষ্ট দেশের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। এসব ক্রিমিনালরা দেশের বাইরেও যেকোন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে পারে। কিন্তু কিছু জটিলতার কারণে তাদের এখনই ফেরানো যাচ্ছে না। তবে আলোচনা চলছে, নিয়মনীতি মেনেই তাদের দেশে ফেরানো হবে।
তাদের কাউকে কাউকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছিল। পরে বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসীকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়। তাদের কেউ কেউ এখন কারাগারে। তবে বেশিরভাগ তালিকাভূক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী সীমান্ত পার হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। আর এখন কারাগার ও বিদেশে থেকে তারা নিয়ন্ত্রণ করছেন ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড। বিদেশে বসে তারা নির্দেশ দিচ্ছেন বিভিন্ন অপরাধের। তাদের নিজস্ব বাহিনী দিয়ে দেশে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন।
গোয়েন্দাসূত্র বলছে, পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনেকেই এখন একটি প্রতিবেশী দেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সুইডেন, দুবাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ডে অবস্থান করছেন। কেউ কেউ আছেন পাশ্ববর্তী দেশ ভারত বা পাকিস্তানে। তাদের মাথার ওপর একাধিক মামলা ঝুলছে। ইন্টারপোলের রেড অ্যালার্টও রয়েছে তাদের নামে। কিন্তু আইনি জটিলতা থাকায় তাদের সহজে ফেরানো যাচ্ছে না। ইন্টাপোলের রেড অ্যালার্টে নাম থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে রয়েছে, কালা জাহাঙ্গির ওরফে ফেরদৌস, সুব্রত বাইন, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, আমিনুর রসুল, হারিস আহমেদ, জাফর আহমেদ, আবদুল জব্বার, নবী হোসাইন, জিসান, শাহাদাত হোসাইন, মোল্লা মাসুদ। বছরের পর বছর ধরে তারা বিভিন্ন দেশে অবস্থান করে নিয়ন্ত্রণ করছেন দেশের আন্ডারওয়ার্ল্ড। তাদের নামে এখনও কোটি কোটি টাকার নিরব চাঁদাবাজি, খুনখারাবিসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হয়। আবার অনেকে সন্ত্রাসীর নাম ভাঙ্গিয়েও চাঁদাবাজি করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছে প্রায়ই অপরিচিত মোবাইল নম্বর থেকে ফোন আসে। ফোনের অপর পাশ থেকে ব্যবসায়ীর অবস্থান নিশ্চিত করে চাঁদা দাবি করা হয়। বিশেষ করে রমজান মাস শুরু হওয়ার পর থেকে সন্ত্রাসীদের হুমকি-ধমকি অনেকটা বেড়ে গেছে। চাহিদা মত চাঁদা না দিলে হত্যাসহ নানা রকম ভয়ভীতি দেখানো হয়। প্রাণের ভয়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে না জানিয়ে অনেকেই চাঁদা তুলে দেন সন্ত্রাসীদের হাতে।
দুই মাস আগে কাফরুলের হাইটেক মাল্টিকেয়ায় হাসপাতালের এক চিকিৎসকের মুঠো ফোনে কল দিয়ে বিদেশ থেকে চাঁদা দাবি করে শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহিন শিকদার। চাঁদা না দিলে তাকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকিও দেয়া হয়। পরে ওই চিকিৎসক হুমকির বিষয়টি উল্লেখ করে কাফরুল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। পুলিশ তার অভিযোগ আমলে নিয়ে নিরাপত্তা জোরদার ও নজরদারি বাড়ায়।
কিন্তু ওই চিকিৎসককে ক্রমাগত হুমকি দিতে থাকে ওই সন্ত্রাসী। পরে ওই চিকিৎসক প্রাণের ভয়ে দাবিকৃত চাঁদা তুলে দেন ওই শীর্ষ সন্ত্রাসীর লোকজনের হাতে। কাফরুল থানার তৎকালীন পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আসলাম উদ্দিন গতকাল মানবজমিনকে বলেন, একজন চিকিৎসক হুমকি পেয়ে থানায় জিডি করেছিলেন। আমরা তার জন্য ব্যাপক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিলাম। যে মোবাইল নম্বর থেকে ওই সন্ত্রাসী ফোন দিয়েছিল সেই নম্বর যাচাই-বাচাই করে আমরা নিশ্চিত হয়েছি ফোনটা দেশের বাইরে থেকে করা হয়েছে। দেশের ভেতরে থাকলে তাকে আমরা শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতাম। তিনি বলেন, সম্প্রতি কাফরুল থানায় দুটি মার্ডার মামলার রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তারকৃত আসামীরা আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে এসব মার্ডারের সঙ্গে শাহীন শিকদারের সম্পৃক্ততা রয়েছে। কিন্তু সে দেশের বাইরে থাকায় তাকে কিছু করা যাচ্ছে না। কাফরুল থানার বর্তমান পরিদর্শক (তদন্ত) ফারুকুল আলম বলেন, আমি এপ্রিলের শেষ দিকে এ থানায় এসেছি। এখানে আসার পরই শাহিন শিকদারের নাম শুনেছি। কয়েকটি মার্ডারের সঙ্গে সে জড়িত আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কাফরুল, পল্লবী এলাকায় পলাতক শাহিন শিকদারের নামে নানা অপকর্ম হচ্ছে। ব্যবসায়ী, বাড়ির মালিক, ডেভেলপার কোম্পানির কাছে চাঁদা দাবি করছে তার লোকজন। গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলছেন শুধু্ হাইটেক হাসপাতালের ওই চিকিৎসক নয়। ভয়ভীতি দেখিয়ে আরও অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে শাহিন শিকদারের লোকজন। তবে ভয়ে কেউ মুখ খোলেনি।
চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারে যাদের নাম আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে আছে তাদের মধ্যে রয়েছে মিরপুরে শাহাদাত ও লিটু, খিলগাঁওয়ে জিসান, কাওরান বাজারে আশিক, কল্যাণপুরে বিকাশ-প্রকাশ, বাড্ডার মেহেদী হাসান, রবিন-ডালিম, নাহিদ, আশিক, যাত্রাবাড়িতে ইটালি নাসির, জুরাইনের কচি, মগবাজারের রনি, শাহআলী এলাকায় গাজী সুমন, আদাবরের নবী, মোহাম্মদপুরের কালা মনির, পল্লবীর মোক্তার বাহিনী ও কাফরুলের শাহিন শিকদার।
এসব শীর্ষ সন্ত্রাসী তাদের ছত্রছায়ায় নিজস্ব বাহিনী তৈরি করেছে। এলাকা ভিত্তিক পলাতক বড় বড় সন্ত্রাসীদের নামে অপরাধ করছে। এদের মধ্যে বাড্ডা এলাকায় রয়েছে সজিব, আলমগীর, আরিফ, মান্নান, ডালিম, রবিন, রমজান, দুলাল, মানিক, শিপলু, রায়হান, রুবেল, রিয়াদ খিলগাঁওয়ে খালেদ ও মানিক, রামপুরায় পলাশ, মুরাদ, গুলশান-বনানী এলাকায় টিপু, যাত্রাবাড়ি-সায়েদাবাদ এলাকায় জাহাঙ্গির, সায়েম আলীম মহাখালী এলাকায় অপু, মিলন মুকুল সাততলা বস্তিতে মনিরম লম্বু সেলিম, হাজারীবাগে বুলু, লিংকন,তপু, জনি, রফিক, বিল্লু, মুন্না, কলাবাগান এলাকায় নাজিম, ইমন, মোহাম্মদপুরে মোশারফ, লম্বা মোশারফ, চিকা জসিম, আহম্মদ, সাজ্জাদ, মোহন, পাভেল, লোটন, তানভীর, রবিন, আদিত্য, মীম, খলিল, হাজী আক্কাস ও শাহ আলীতে বল্টু রাসেল।
শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতায় বাড্ডা ও পাশ্ববর্তী এলাকায় রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ছাড়াও আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা নিয়ে বিরোধ, অটো রিকশা চলাচলের রুটে চাঁদাবাজি, খাল ভরাট, বালু মহাল দখল, মাছের ঘের দখল, ডিশ ব্যবসা ও ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রতিনিয়ত অস্থির হয়ে থাকে। এসব দ্বন্দ্বে গত কয়েক বছরে আওয়ামী লীগ নেতা ফরহাদসহ বেশ কয়েকজনকে হত্যা করা হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, দেশের বাইরে বসে ভাড়াটে কিলার দিয়ে পলাতক সন্ত্রাসীরা এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছেন। আলাদা আলাদা এসব সন্ত্রাসী গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করছে মালয়েশিয়ায় পলাতক রবিন ও ডালিম, যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী মেহেদি ও সাখায়াত হোসেন চঞ্চল, সুইডেনে থাকা নাহিদ এবং ভারতে অবস্থান করা আশিক।
তাদের নির্দেশে ওই এলাকায় সকল অপরাধ সংঘটিত হয়। ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো ও ম্যাসেঞ্জারে চাঁদাবাজি ও খুনের নির্দেশ দিচ্ছে তারা। গত বছর স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ফরহাদ হোসেন, আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলমের ভাই কামরুজ্জামান দুখু এবং ডিশ ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক ওরফে ডিশ বাবু হত্যাকান্ডে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো জড়িত বলে স্থানীয়রা বলে আসছেন। এছাড়া আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীদের হুমকি পেয়ে থানায় জিডি করে রেখেছেন অনেকে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কারাগারে থাকা রামপুুরা এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী কাইল্ল্যা পলাশ তার বাহিনী দিয়ে আধিপত্য বিস্তার করছেন। তার সঙ্গে রয়েছে তার ভাগিনা তুষার ও আরেক সন্ত্রাসী শাহজাদা।
গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, মিরপুর এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাত হোসেন অনেক আগেই ভারতে চলে যায়। সেখান থেকে সে ভারতীয় পাসপোর্ট করে বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বর্তমানে মধ্যেপ্রাচ্যর দেশ দুবাইতে অবস্থান করছে।
দুবাইয়ে তার অবস্থান থাকলেও মিরপুর এলাকায় এখনও সে আধিপত্য বিস্তার করে যাচ্ছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মো. মাহবুব আলম মানবজমিনকে বলেন, আন্ডারওয়ার্ল্ডের অবস্থা এখন আর আগের মত নেই। তবে বিদেশে পলাতক কিছু শীর্ষ সন্ত্রাসী এখনও নীরবে নানা রকম অপরাধ করছে। কিছুদিন আগেও কাফরুল এলাকায় বড় ধরনের চাঁদাবাজি করেছে পলাতক সন্ত্রাসী শাহিন শিকদার। যদিও ভুক্তভোগী ওই ব্যক্তি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানোর পরও ওই সন্ত্রাসীর লোকজনের কাছে চাঁদা তুলে দিয়েছেন। মোহাম্মদপুর এলাকায়ও বড় অংকের টাকা ছিনতাইয়ের একটি ঘটনা ঘটেছে। তিনি বলেন, শীর্ষ এসব সন্ত্রাসীদের ধরার জন্য পুলিশ চেষ্টা করছে।
ন্যাশনাল কাউন্সিল ব্যুরো বাংলাদেশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মহিউল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনেকেই এখন বিভিন্ন দেশে পলাতক। ইন্টারপোলের রেডঅ্যালার্টে তাদের নাম প্রকাশ করা হয়েছে। অনেকের অবস্থানও আমরা শনাক্ত করেছি। আমরা সংশ্লিষ্ট দেশের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। এসব ক্রিমিনালরা দেশের বাইরেও যেকোন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে পারে। কিন্তু কিছু জটিলতার কারণে তাদের এখনই ফেরানো যাচ্ছে না। তবে আলোচনা চলছে, নিয়মনীতি মেনেই তাদের দেশে ফেরানো হবে।
No comments