তামাশার নির্বাচনে বামজোট অংশ নেবে না by কাজল ঘোষ
বাম
জোটের সমন্বয়কারী সাইফুল হক। বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির
সাধারণ সম্পাদক। আপাদমস্তক একজন রাজনৈতিক সচেতন মানুষ। ভাবেন দেশ নিয়ে।
দেশের মানুষকে নিয়ে। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি কীভাবে দেখছেন তিনি?
বলেন, ৫ই জানুয়ারির মতো আরেকটি নির্বাচন হজম করার পরিস্থিতি বা বাস্তবতা
দেশের মানুষের নেই। তিনি জোর দিয়ে বলেন, তামাশার নির্বাচনকে বৈধতা দিতে
বামজোট নির্বাচনে অংশ নেবে না। সাইফুল হক বলেন, একটি তদারকি সরকারই পারে
দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে।
প্রয়োজনে তদারকি সরকারের কেউ নির্বাচনে অংশ নেবেন না। পরবর্তীতে নির্বাচিত সরকারের কাছে তাদের জবাবদিহিতা থাকতে পারে।
বাম জোটের এ সমন্বয়ক বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন ও ক্রান্তিকাল সময় আমরা এখন অতিক্রম করছি। সাতচল্লিশ বছরেও আমরা নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা বদলের কোনো গ্রহণযোগ্য উপায় কার্যকর করতে পারিনি। সরকার পরিবর্তনের বিধিবদ্ধ কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। কীভাবে নির্বাচন হবে? ক্ষমতা হস্তান্তরে শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ার কোনো সমাধান হয়নি। সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য যে আইন থাকা দরকার তাও আমাদের এখানে হয়নি।
নির্বাচন কমিশন গঠন হচ্ছে এডহক ভিত্তিতে। কখনও প্রেসিডেন্ট সার্চ কমিটি গঠন করছেন, কখনও রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে নাম চেয়ে চূড়ান্ত করা হচ্ছে। শাসক শ্রেণির অভ্যন্তরীণ যে অবস্থান, আমাদের এখানে যে লুণ্ঠনকেন্দ্রিক, দলীয়কেন্দ্রিক, একচ্ছত্র শাসনকেন্দ্রিক প্রক্রিয়া চলমান নির্বাচন নিয়ে সংকট তারই বহিঃপ্রকাশ। এখানে রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে লুণ্ঠন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রুত বিত্তশালী হওয়ার একটি প্রতিযোগিতা অব্যাহত আছে। ফলে বিত্তশালী হওয়ার জন্য দুর্বৃত্তরা রাজনীতিকে তাদের প্রধান অবলম্বন করে নিয়েছে। আগে বড় ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক দলগুলোকে সমর্থন করতেন, চাঁদা দিতেন।
এখন ব্যবসায়ীদের বড় একটি অংশ নিজেরাই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাছাড়া গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ গড়ে না ওঠায় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিও গড়ে ওঠেনি। লক্ষ্য করার বিষয়, আওয়ামী লীগ একসময় মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য রাজনীতি করত। সেই আওয়ামী লীগেরও এখন মৌলিক চরিত্র বদলেছে। আওয়ামী লীগ কার্যত এখন লুণ্ঠনকেন্দ্রিক সুবিধাভোগীদের দল। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে সাম্যের স্বপ্ন মানুষ দেখেছিল তা থেকে রাষ্ট্র এখন অনেক দূরে। রাষ্ট্র এখন অনেক বেশি বর্বর, অনেক বেশি সহিংস, অনেক বেশি স্বৈরতান্ত্রিক। বৃটিশ-পাকিস্তানি আমলে রাষ্ট্রের যে বর্বর চেহারা দেখা যায়নি এখন আমরা তাই দেখছি।
বিচারবহির্ভূত হত্যা, সরকারি জিম্মায় মানুষকে যেভাবে হত্যা, গুম করা হচ্ছে এবং রিমান্ডের নামে যে নির্যাতন করা হচ্ছে এই চরিত্র সে আমলেও দেখা যায়নি। এখন এগুলো সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। মানুষ এখন চূড়ান্ত নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছে। রাষ্ট্রের সঙ্গে মানুষের বিচ্ছেদ তৈরি করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের আগে বিএনপিও একই ধারায় ছিল। তারা মনে করেছেন তাদের ভোটে যাওয়া দরকার তাকে একটা বৈধ রূপ দেয়ার জন্য। এটা মুক্তিযুদ্ধের উল্টোদিকে যাত্রা। আমরা এরকম রাষ্ট্র, এরকম আমলাতন্ত্র চাইনি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একটি লুণ্ঠনকেন্দ্রিক গোষ্ঠী। সে কারণে এখানে কেউ নির্বাচনে পরাজিত হতে চায় না। এটা করতে তারা যে ধরনের অপরাধ সংগঠিত করেন, আতঙ্কে থাকেন যে বিরোধী শিবিরে বসলে তাদের মামলা, হয়রানির স্বীকার হতে হবে। ফলে শাসক পক্ষ বিরোধী দলে গেলে নিজেরা টিকতে পারবে এমন কোনো সুযোগ রাখে না। বর্তমান শাসকদল আওয়ামী লীগকে বিরোধী দলে বসতে হতে পারে এমন কোনো চিন্তা তাদের কথাবার্তায় বা বডি ল্যাঙ্গুয়েজেও নেই। যদি সেটা থাকতো তাহলে বিরোধী দলে থাকলে সরকারের কাছ থেকে যে ধরনের আচরণ প্রত্যাশা তারা করে। এখন সরকারে বসে সে ধরনের আচরণ করত আওয়ামী লীগ।
- এবারের নির্বাচন নিয়ে কি ধরনের সংকট হতে পারে?
একটি হচ্ছে রাজনৈতিক সংকট। অন্যটি হচ্ছে শাসনতান্ত্রিক। প্রধানমন্ত্রীর হাতে সকল নির্বাহী ক্ষমতাকেন্দ্রিভূত। ফলে যখন যে দলই ক্ষমতায় থাকুক দেখা গেছে এককেন্দ্রিক একটি ক্ষমতা কাঠামো গড়ে উঠেছে স্বৈরতান্ত্রিকভাবে। কিছু ঐতিহাসিক ঘটনাও আমাদের রাজনৈতিক বিভাজনের পেছনে দায়ী। পঁচাত্তরের মর্মান্তিক হত্যার পরবর্তী পর্যায়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা রাজনীতির মধ্যে কিছু ঐতিহাসিক বিভাজন, বিরোধ ও বৈরিতার জন্ম দিয়েছে। মনস্তাত্বিক বিরোধ অব্যাহত আছে।
রাজনীতির ভিতরে কিছু ঘৃৃণা, কিছু বিদ্বেষ এবং প্রতিহিংসারও জন্ম দিয়েছে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যাগুলোর কোনো সুরাহা হয়নি। যেমন, আওয়ামী লীগ যখন জিয়াউর রহমান বা এ ধরনের ব্যক্তিদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করে তখন বিএনপির বাইরে সাধারণ মানুষের মধ্যেও একটি গভীর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার জন্ম হয়। আবার বিএনপি যখন জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে দাবি করে (তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে একজন ঘোষক) তখন সত্যের অপলাপ হয়ে থাকে।
অন্যদিকে পনেরই আগস্ট বেগম জিয়ার জন্মদিন হয়ে থাকলেও সেদিন ঘটা করে জন্মদিন করা একটা সাধারণ রীতিনীতি বা সৌজন্যের মধ্যেও পরে না। এ ছাড়া ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলার মতো ঘটনা আমাদের রাজনীতিতে চলমান সংকটের পাশাপাশি একটি গভীর মনস্তাত্বিক বিরোধের জন্ম দেয়। সংঘাত সংঘর্ষের জায়গাটিকে উস্কে দেয়। এসব প্রশ্নে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা কোনো দূরদর্শিতার পরিচয় দেননি। বিরোধ বৈরিতা আমাদের সমাজে এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছে একেবারে নিচু পর্যায়ে একধরনের গৃহযুদ্ধের যে আলামত তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এখন বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চল, প্রতিটি গ্রাম, প্রতিটি পাড়া, প্রতিটি রাস্তার লেন বিভক্ত। গত দশ বছরে বিএনপির ওপর যে পরিমাণ দমনপীড়ন চালানো হয়েছে বা এর আগে যখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল তখন আওয়ামী লীগ এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যে পরিমাণ দমনপীড়ন চলেছে এটা এক ধরনের প্রতিশোধাত্মক জায়গা থেকে করা হয়েছে। এই প্রতিহিংসা বিরোধ বৈরিতাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে একজনের বিনাশের ওপর আরেকজনের অস্তিত্ব নির্ভরশীল। সম্প্রতি ক্ষমতাসীন দলের এক নেতা বলেছেন, বাংলার মাটি থেকে যদি বিএনপিকে ধ্বংস করা না যায় তাহলে দেশ গড়া যাবে না। চিন্তা করুন আগামী ডিসেম্বরে নির্বাচন, সেখানে একটি বড় দলকে যারা প্রধান বিরোধীদল তাদের একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর সমর্থন রয়েছে। তাদের সহাবস্থানের কোনো প্রশ্ন নেই, তাকে গণতান্ত্রিক ধারায় আনার কোনো প্রস্তাবনা নেই। অথচ সরাসরি প্রস্তাবনা হচ্ছে এদের উচ্ছেদ করা, ধ্বংস করা। এটা ন্যূনতম কোনো গণতান্ত্রিক চিন্তা চেতনার কথা নয়।
এর মাধ্যমে সংঘাতকেই আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে; বিরোধকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে; একটা মল্লযুদ্ধকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। বিষয়টি এমন যে, শক্তি পরীক্ষায় আছি পারলে আমাকে ঠেকাও। বর্তমান পরিস্থিতিতে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যদি একটি যৌক্তিক পরিণতির দিকে আমরা না যেতে পারি তাহলে সমাধান আসবে না। যেমন- কীভাবে আমাদের ভোটাধিকার রক্ষা পাবে, কীভাবে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে, মানুষ কীভাবে তার ভোট নিরাপদে দিতে পারবে, নির্বাচন কীভাবে সকলের অংশগ্রহণমূলক হবে? আমরা এমন একটি দেশে বাস করি যেখানে মানুষ প্রয়োজনে দুবেলা ভাত না খেয়ে থাকতে রাজি আছে কিন্তু ভোটের অধিকার ছাড়তে রাজি নয়। ভোট দিতে না পারার যে যন্ত্রণা, রক্তক্ষরণ, অপমানবোধ এটা এখানকার মানুষ মানতে রাজি নয়। সুতরাং এগুলোর সমাধান না হলে লো ইনটেনসিটি সিভিল ওয়ারের যে লক্ষণ তা দেখা যাচ্ছে। ক্ষমতাকেন্দ্রিক শাসক শ্রেণির দলগুলো যেভাবে পরস্পরের মধ্যে প্রতিহিংসা আর এক দল আরেক দলকে ধ্বংস করার মরিয়া তাতে সংঘাত কমবে না আরো বাড়বে। এরকম পরিস্থিতিতে আমার দীর্ঘমেয়াদি সংকটে বলা যায় জ্ঞানত বা অজ্ঞানত একটি গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। এতে দেশে গভীর নৈরাজ্যের জন্ম হবে।
এ ধরনের সংকটময় মুহূর্তগুলো পৃথিবীর বহুদেশে কাজে লাগিয়েছেন বিপ্লবী শক্তি। শাসক শ্রেণি যখন ব্যর্থ হয়, তারা যখন দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত থাকে তখন মানুষের কাছে বিকল্প প্রস্তাবনা নিয়ে বৈষম্যহীন মানবিক সমাজের জন্য এরকম পরিস্থিতিকে বিপ্লবী বামপন্থিরা কাজে লাগিয়েছেন। বাংলাদেশে এ পরিস্থিতিকে বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে কাজে লাগাতে না পারলে জঙ্গিবাদী বা চরমপন্থার উত্থান ঘটবে। সমাজের অভ্যন্তরে চিন্তা-মতাদর্শের দিক থেকে এবং দক্ষিণপন্থি মতাদর্শের যে বাড়ন্ত লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি না হলে সমাজের অভ্যন্তরে দক্ষিণপন্থি মতাদর্শের শর্তগুলো আরো শক্তিশালী হবে। এটা দেশের শাসকশ্রেণির কোনো অংশের জন্য যেমন ভালো নয়, তেমনি গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার জন্য হবে আত্মঘাতী। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে আগামী নির্বাচনের আগে বিদ্যমান এই সমস্যাগুলো সুরাহা সম্ভব বলে মনে করি।
সাইফুল হক বলেন, জনগণের বড় অংশ বিশ্বাস করে বর্তমান সরকারকে রেখে কোনো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাহলে সমাধান কোথায়? ছিয়ানব্বই সালে আওয়ামী লীগ যে কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করেছে সে তুলনায় এখন অবিশ্বাস অনাস্থা আরো বহুগুণ বেশি। ফলে তখন যে কারণে দলীয় সরকারের অধীনে আমরা নির্বাচনে অংশ নিইনি, এখন তা না করার যুক্তি অনেক অনেক বেশি। অনাস্থা, বিরোধ, বৈরিতা, সন্দেহ, অবিশ্বাস এখন আগের চেয়েও মারাত্মক পর্যায়ে। সে জায়গা থেকেই বলতে চাই এখানে সরকারকে সুষ্ঠু নির্বাচনে আয়োজনে রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে আলাপ আলোচনা করে, নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য তদারকি সরকার কায়েম করা জরুরি। সেই তদারকি সরকারে আওয়ামী লীগও থাকতে পারে পাশাপাশি প্রধান বিরোধীদলসহ সকল রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরাও থাকতে পারে। সকলে একমত হলে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের স্বার্থে সেই সরকারে যারা থাকবেন তারা প্রয়োজনে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে প্রত্যক্ষ নির্বাচনে অংশ নেবেন না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করেন? আমাদের দলীয় অবস্থান হচ্ছে, তদারকি সরকার গঠিত হলে তারা পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবেন। এ ধরনের নিয়ম থাকলে এই তিন মাসে তারা যা খুশি করতে পারবে না। তা ছাড়া বিনা ভোটের নির্বাচনে গঠিত বর্তমান সংসদের কোনো ম্যান্ডেট নেই। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পর কথা ছিল একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের। অথচ তা করা হয়নি। পাঁচ বছর কাটিয়ে দিলো সরকার। যদি সংসদ থাকে তাহলে এই সংসদের যারা আছেন তাদের সঙ্গেতো প্রতিদ্বন্দ্বী দল বা প্রার্থীদের কোনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হলো না। প্রশ্নহীন নির্বাচন চাইলে সরকারকে সংসদ বাতিলের ঘোষণা দিতে হবে। নির্বাচনে সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিতের জন্য লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির জন্য সরকারিদলকে ঘোষণা দিতে হবে।
বর্তমানে যে পরিস্থিতি তা অব্যাহত থাকলে আপনাদের জোট নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা?
বর্তমান পরিস্থিতি চলতে থাকলে নির্বাচনে অংশ নেয়া অসম্ভব। কারণ, নির্বাচনকালীন যে সরকারের কথা আলোচনায় আছে সে সরকার আর এ সরকারের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য হবে না। আগেই বলেছি, সকল নির্বাহী ক্ষমতা সরকার প্রধানের হাতে। সুতরাং নির্বাচনকালীন যে সরকার গঠিত হবে সংবিধান অনুযায়ী সেই সরকারের প্রধান অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর হাতেই সকল ক্ষমতা থাকবে। তিনি ক্ষমতা কতটুকু ব্যবহার করবেন সেটি ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু সকল ক্ষমতা তো ওনার হাতেই। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন তার দায়িত্ব ও মর্যাদা চূড়ান্তভাবে ভূলুণ্ঠিত করেছে। সরকার এবং নির্বাচন কমিশন মিলে যা করেছে এতে পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে মানুষের মধ্যে একটি গণঅনাস্থা সৃষ্টি হয়েছে। আরপিওর অগণতান্ত্রিক ধারাগুলো বাতিল করা, কীভাবে নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও নিরপেক্ষ করা যায়, কালো টাকার দৌরাত্ম্য কিভাবে বন্ধ করা যায় এ বিষয়ে সংলাপের সময় দেয়া প্রস্তাবনাগুলোর কোনো একটি বিষয়ও কমিশন আমলে নেয়নি। বরং সরকারি দলকে বাড়তি সুবিধা দিতে তারা ইভিএম চালুর চিন্তা করছে। যদিও মানুষের মনোভাব বুঝতে পেরে তারা কিছুটা পিছু হটেছে। নির্বাচন কমিশন প্রমাণ করেছে তারা মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। যে নির্বাচন কমিশন স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোর অধিকাংশই গ্রহণযোগ্য করতে পারেনি সেখানে এরকম একটি কমিশন দিয়ে একটি প্রশ্নহীন জাতীয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করা যাবে মানুষ এটা বিশ্বাস করে না।
সকল পরিস্থিতি বিবেচনায় বল সরকারের কোর্টে। রাজনৈতিক দলগুলোর অনেক দাবি। কিন্তু সরকারকেও তো সেই জায়গাটি তৈরি করতে হবে। মানুষকে বুঝতে হবে, তার নিজের ভোট সে নিরাপদে দিতে পারবে, তার ভোট কাউন্ট হবে। ভোট দেয়ার পর সে নিরাপদ থাকবে। রাজনৈতিক দল এবং প্রার্থীদের আশ্বস্ত করতে হবে যে, আমরা এবার একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাই, মানুষ যাকে সমর্থন করবে তারাই নির্বাচনে বিজয়ী হবে। সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অসম্ভব। শেষমুহূর্তে বামজোট আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা তা নির্ভর করছে সে সময়ের পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক সমীকরণের ওপর, রাজনৈতিক দল এবং জোটগুলোর যে অবস্থান সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে নির্বাচন বয়কটও করতে পারি আবার আন্দোলনের অংশ হিসাবে নির্বাচনে অংশও নিতে পারি। ফলে আমরা বর্তমানে নির্বাচন প্রস্তুতির পাশাপাশি রাজপথে আন্দোলনে আছি। তবে একটি কথা খোলাসা করে বলতে চাই, অংশগ্রহণমূলক না হলে তামাশার নির্বাচন বৈধতা দেয়ার জন্য বামজোট অংশ নেবে না।
- জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়েছে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে। তারা ইতিমধ্যেই সাত দফা দাবি আদায়ে মাঠে নেমেছেন। আপনারাও একটি জোট গঠন করেছেন? সামনের দিনে আপনারা তাদের সঙ্গে যোগ দেবেন কিনা?
- জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে স্বাগত জানাই। স্বাগত এজন্য যে, অনেক বিলম্বে হলেও তারাও একই কথা বলছেন। বর্তমান পরিস্থিতি অনুধাবন করে তারা অবস্থান গ্রহণ করেছেন। এগিয়ে এসেছেন। এটি যথেষ্ট ইতিবাচক। আমরা দেখতে চাই রাজপথে তারা ধারাবাহিক কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারকে এ দাবিগুলো মানাতে সরব হবেন। কারণ রাজপথের আন্দোলন ছাড়া সরকারকে এই দাবি মানানোর অন্য কোনো বিকল্প নেই।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যা বলছে আমরা এই কথাগুলো বলছি অনেক আগ থেকেই। তাদের দেয়া দফা ও লক্ষ্যসমূহের অধিকাংশই আমরা বছর খানেক আগ থেকে রাজপথে বলে এসেছি। তাদের ঘোষিত অনেকগুলো দাবি মেনে নিতে সরকারের প্রতি চাপ দিতে আমরা ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন করে যাচ্ছি। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, একটি অবাধ নির্বাচনের জন্য তারা যে দাবি উত্থাপন করেছেন তার জন্য মাঠে জোরালো আন্দোলন গড়ে ওঠলে মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার হবে, আস্থার জায়গা তৈরি হবে। মানুষের মধ্যে জাগরণ তৈরি করা, সে জাগরণ গণঅভ্যুত্থান হবে কিনা তা এখনই বলা সম্ভব নয়। তবে, একটি গণজাগরণ তৈরি করা সম্ভব। মানুষের গণজাগরণের মধ্য দিয়ে সরকারকে যদি পিছু হটানো না যায় তাহলে ভিন্ন কৌশলে হলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের মানুষকে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির মতো আরেকটি নির্বাচন প্রত্যক্ষ করতে হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, ৫ই জানুয়ারির মতো আরেকটি নির্বাচন হজম করার মতো শক্তি বাংলাদেশের মানুষের নেই। এই পরিস্থিতিতে সমাজের মধ্যে বিভাজন আরো প্রকট হবে, সহিংসতার জন্ম দেবে, আরো নানা ধরনের অপ্রত্যাশিত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্ম দেবে। আবার যদি তারা ২০১৪ সালের মতো একই কায়দায় ক্ষমতায় আসতে চায় তাহলে সে সরকারের তো কোনো ম্যান্ডেট থাকবে না। সুতরাং পরবর্তী পাঁচ বছর তারা একইভাবে চালিয়ে যেতে পারবেন সেটা প্রায় দুরাশার শামিল। সেসময় পুরো রাষ্ট্রের জন্যই একটি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হবে। যা সুস্থ বিবেকসম্পন্ন কোনো মানুষ চাইবে না।
-সমাধানটা কোথায়?
শেষ পর্যন্ত যারা আমরা সমমনা বা একই রকম দাবি নিয়ে মাঠে আছি তারা আন্দোলনের মাধ্যমে; আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বিষয়গুলোর যদি একটি যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে না পারি- বিশেষ করে কীভাবে মানুষের ভোটাধিকার রক্ষা পাবে ও নির্বাচন কীভাবে সুষ্ঠু ও অবাধ হবে; মানুষ কীভাবে তার ভোট নিরাপদে দিতে পারবে; নির্বাচন কীভাবে সকলের অংশগ্রহণমূলক হবে? আমাদের বৃহৎ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষগুলো তারা যেভাবে পরস্পর পরস্পরকে ধ্বংসের চিন্তা করছেন এবং কার্যক্রম পরিচালনা করছেন তাতে সংঘাত বাড়বে। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে সংকট যেভাবে ঘনীভূত হচ্ছে তাতে জ্ঞাত বা অজ্ঞাত দেশকে একটি গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এতে দেশের গভীর অনিশ্চয়তা তৈরি হবে এবং নৈরাজ্যে পরিস্থিতি জন্ম দেবে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে জঙ্গিবাদী বা মৌলবাদী গোষ্ঠীর জন্ম হবে এবং ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত বাড়তে থাকবে। অন্যদিকে সমাজের ভেতর থেকেই দক্ষিণপন্থার একটি উত্থানের সম্ভাবনা বাড়বে। এটা শাসক গোষ্ঠীর জন্য যেমন ভালো নয় তেমনি দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার জন্য আত্মঘাতী হবে।
সকল পরিস্থিতি বিবেচনায় মনে হয়, সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখানোর সুযোগ এখনও আছে। দেশের মানুষ বিশ্বাস করে না বর্তমান সরকারকে রেখে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। তাহলে সমাধানটা কোথায়? ’৯৬ সালে যে প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন করেছে এখন সে প্রেক্ষিত অনেক অনেক গুণ বেশি। এখনকার অনাস্থা-অবিশ্বাস আগের চেয়ে আরো অনেকগুণ বেশি। তখন যে কারণে দলীয় সরকারের অধীনে আমরা নির্বাচন করিনি বর্তমানেও তার যুক্তি অনেক অনেকগুণ বেশি। অনাস্থা বিরোধ সন্দেহ-অবিশ্বাস এখন আগের চেয়েও মারাত্মক পর্যায়ে।
এ পরিস্থিতিতে সরকারকে বলতে চাই, সদিচ্ছা দেখাতে। আমরা ইতিমধ্যেই প্রস্তাব করেছি নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দলগুলোকে নিয়ে নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনা একটি তদারকি সরকার গঠন করা। সেই সরকারে আওয়ামী লীগসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ দলগুলোর প্রতিনিধি থাকতে পারে। যারা সরকারে অংশ নেবে তারা হতে পারে নির্বাচনে অংশ নেবে না। আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে এই তদারকি সরকার খেয়াল খুশিমতো যা খুশি না করতে পারেন সেজন্য পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হবে।
প্রয়োজনে তদারকি সরকারের কেউ নির্বাচনে অংশ নেবেন না। পরবর্তীতে নির্বাচিত সরকারের কাছে তাদের জবাবদিহিতা থাকতে পারে।
বাম জোটের এ সমন্বয়ক বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন ও ক্রান্তিকাল সময় আমরা এখন অতিক্রম করছি। সাতচল্লিশ বছরেও আমরা নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা বদলের কোনো গ্রহণযোগ্য উপায় কার্যকর করতে পারিনি। সরকার পরিবর্তনের বিধিবদ্ধ কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। কীভাবে নির্বাচন হবে? ক্ষমতা হস্তান্তরে শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ার কোনো সমাধান হয়নি। সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য যে আইন থাকা দরকার তাও আমাদের এখানে হয়নি।
নির্বাচন কমিশন গঠন হচ্ছে এডহক ভিত্তিতে। কখনও প্রেসিডেন্ট সার্চ কমিটি গঠন করছেন, কখনও রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে নাম চেয়ে চূড়ান্ত করা হচ্ছে। শাসক শ্রেণির অভ্যন্তরীণ যে অবস্থান, আমাদের এখানে যে লুণ্ঠনকেন্দ্রিক, দলীয়কেন্দ্রিক, একচ্ছত্র শাসনকেন্দ্রিক প্রক্রিয়া চলমান নির্বাচন নিয়ে সংকট তারই বহিঃপ্রকাশ। এখানে রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে লুণ্ঠন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রুত বিত্তশালী হওয়ার একটি প্রতিযোগিতা অব্যাহত আছে। ফলে বিত্তশালী হওয়ার জন্য দুর্বৃত্তরা রাজনীতিকে তাদের প্রধান অবলম্বন করে নিয়েছে। আগে বড় ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক দলগুলোকে সমর্থন করতেন, চাঁদা দিতেন।
এখন ব্যবসায়ীদের বড় একটি অংশ নিজেরাই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাছাড়া গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ গড়ে না ওঠায় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিও গড়ে ওঠেনি। লক্ষ্য করার বিষয়, আওয়ামী লীগ একসময় মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য রাজনীতি করত। সেই আওয়ামী লীগেরও এখন মৌলিক চরিত্র বদলেছে। আওয়ামী লীগ কার্যত এখন লুণ্ঠনকেন্দ্রিক সুবিধাভোগীদের দল। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে সাম্যের স্বপ্ন মানুষ দেখেছিল তা থেকে রাষ্ট্র এখন অনেক দূরে। রাষ্ট্র এখন অনেক বেশি বর্বর, অনেক বেশি সহিংস, অনেক বেশি স্বৈরতান্ত্রিক। বৃটিশ-পাকিস্তানি আমলে রাষ্ট্রের যে বর্বর চেহারা দেখা যায়নি এখন আমরা তাই দেখছি।
বিচারবহির্ভূত হত্যা, সরকারি জিম্মায় মানুষকে যেভাবে হত্যা, গুম করা হচ্ছে এবং রিমান্ডের নামে যে নির্যাতন করা হচ্ছে এই চরিত্র সে আমলেও দেখা যায়নি। এখন এগুলো সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। মানুষ এখন চূড়ান্ত নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছে। রাষ্ট্রের সঙ্গে মানুষের বিচ্ছেদ তৈরি করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের আগে বিএনপিও একই ধারায় ছিল। তারা মনে করেছেন তাদের ভোটে যাওয়া দরকার তাকে একটা বৈধ রূপ দেয়ার জন্য। এটা মুক্তিযুদ্ধের উল্টোদিকে যাত্রা। আমরা এরকম রাষ্ট্র, এরকম আমলাতন্ত্র চাইনি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একটি লুণ্ঠনকেন্দ্রিক গোষ্ঠী। সে কারণে এখানে কেউ নির্বাচনে পরাজিত হতে চায় না। এটা করতে তারা যে ধরনের অপরাধ সংগঠিত করেন, আতঙ্কে থাকেন যে বিরোধী শিবিরে বসলে তাদের মামলা, হয়রানির স্বীকার হতে হবে। ফলে শাসক পক্ষ বিরোধী দলে গেলে নিজেরা টিকতে পারবে এমন কোনো সুযোগ রাখে না। বর্তমান শাসকদল আওয়ামী লীগকে বিরোধী দলে বসতে হতে পারে এমন কোনো চিন্তা তাদের কথাবার্তায় বা বডি ল্যাঙ্গুয়েজেও নেই। যদি সেটা থাকতো তাহলে বিরোধী দলে থাকলে সরকারের কাছ থেকে যে ধরনের আচরণ প্রত্যাশা তারা করে। এখন সরকারে বসে সে ধরনের আচরণ করত আওয়ামী লীগ।
- এবারের নির্বাচন নিয়ে কি ধরনের সংকট হতে পারে?
একটি হচ্ছে রাজনৈতিক সংকট। অন্যটি হচ্ছে শাসনতান্ত্রিক। প্রধানমন্ত্রীর হাতে সকল নির্বাহী ক্ষমতাকেন্দ্রিভূত। ফলে যখন যে দলই ক্ষমতায় থাকুক দেখা গেছে এককেন্দ্রিক একটি ক্ষমতা কাঠামো গড়ে উঠেছে স্বৈরতান্ত্রিকভাবে। কিছু ঐতিহাসিক ঘটনাও আমাদের রাজনৈতিক বিভাজনের পেছনে দায়ী। পঁচাত্তরের মর্মান্তিক হত্যার পরবর্তী পর্যায়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা রাজনীতির মধ্যে কিছু ঐতিহাসিক বিভাজন, বিরোধ ও বৈরিতার জন্ম দিয়েছে। মনস্তাত্বিক বিরোধ অব্যাহত আছে।
রাজনীতির ভিতরে কিছু ঘৃৃণা, কিছু বিদ্বেষ এবং প্রতিহিংসারও জন্ম দিয়েছে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যাগুলোর কোনো সুরাহা হয়নি। যেমন, আওয়ামী লীগ যখন জিয়াউর রহমান বা এ ধরনের ব্যক্তিদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করে তখন বিএনপির বাইরে সাধারণ মানুষের মধ্যেও একটি গভীর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার জন্ম হয়। আবার বিএনপি যখন জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে দাবি করে (তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে একজন ঘোষক) তখন সত্যের অপলাপ হয়ে থাকে।
অন্যদিকে পনেরই আগস্ট বেগম জিয়ার জন্মদিন হয়ে থাকলেও সেদিন ঘটা করে জন্মদিন করা একটা সাধারণ রীতিনীতি বা সৌজন্যের মধ্যেও পরে না। এ ছাড়া ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলার মতো ঘটনা আমাদের রাজনীতিতে চলমান সংকটের পাশাপাশি একটি গভীর মনস্তাত্বিক বিরোধের জন্ম দেয়। সংঘাত সংঘর্ষের জায়গাটিকে উস্কে দেয়। এসব প্রশ্নে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা কোনো দূরদর্শিতার পরিচয় দেননি। বিরোধ বৈরিতা আমাদের সমাজে এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছে একেবারে নিচু পর্যায়ে একধরনের গৃহযুদ্ধের যে আলামত তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এখন বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চল, প্রতিটি গ্রাম, প্রতিটি পাড়া, প্রতিটি রাস্তার লেন বিভক্ত। গত দশ বছরে বিএনপির ওপর যে পরিমাণ দমনপীড়ন চালানো হয়েছে বা এর আগে যখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল তখন আওয়ামী লীগ এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যে পরিমাণ দমনপীড়ন চলেছে এটা এক ধরনের প্রতিশোধাত্মক জায়গা থেকে করা হয়েছে। এই প্রতিহিংসা বিরোধ বৈরিতাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে একজনের বিনাশের ওপর আরেকজনের অস্তিত্ব নির্ভরশীল। সম্প্রতি ক্ষমতাসীন দলের এক নেতা বলেছেন, বাংলার মাটি থেকে যদি বিএনপিকে ধ্বংস করা না যায় তাহলে দেশ গড়া যাবে না। চিন্তা করুন আগামী ডিসেম্বরে নির্বাচন, সেখানে একটি বড় দলকে যারা প্রধান বিরোধীদল তাদের একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর সমর্থন রয়েছে। তাদের সহাবস্থানের কোনো প্রশ্ন নেই, তাকে গণতান্ত্রিক ধারায় আনার কোনো প্রস্তাবনা নেই। অথচ সরাসরি প্রস্তাবনা হচ্ছে এদের উচ্ছেদ করা, ধ্বংস করা। এটা ন্যূনতম কোনো গণতান্ত্রিক চিন্তা চেতনার কথা নয়।
এর মাধ্যমে সংঘাতকেই আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে; বিরোধকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে; একটা মল্লযুদ্ধকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। বিষয়টি এমন যে, শক্তি পরীক্ষায় আছি পারলে আমাকে ঠেকাও। বর্তমান পরিস্থিতিতে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যদি একটি যৌক্তিক পরিণতির দিকে আমরা না যেতে পারি তাহলে সমাধান আসবে না। যেমন- কীভাবে আমাদের ভোটাধিকার রক্ষা পাবে, কীভাবে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে, মানুষ কীভাবে তার ভোট নিরাপদে দিতে পারবে, নির্বাচন কীভাবে সকলের অংশগ্রহণমূলক হবে? আমরা এমন একটি দেশে বাস করি যেখানে মানুষ প্রয়োজনে দুবেলা ভাত না খেয়ে থাকতে রাজি আছে কিন্তু ভোটের অধিকার ছাড়তে রাজি নয়। ভোট দিতে না পারার যে যন্ত্রণা, রক্তক্ষরণ, অপমানবোধ এটা এখানকার মানুষ মানতে রাজি নয়। সুতরাং এগুলোর সমাধান না হলে লো ইনটেনসিটি সিভিল ওয়ারের যে লক্ষণ তা দেখা যাচ্ছে। ক্ষমতাকেন্দ্রিক শাসক শ্রেণির দলগুলো যেভাবে পরস্পরের মধ্যে প্রতিহিংসা আর এক দল আরেক দলকে ধ্বংস করার মরিয়া তাতে সংঘাত কমবে না আরো বাড়বে। এরকম পরিস্থিতিতে আমার দীর্ঘমেয়াদি সংকটে বলা যায় জ্ঞানত বা অজ্ঞানত একটি গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। এতে দেশে গভীর নৈরাজ্যের জন্ম হবে।
এ ধরনের সংকটময় মুহূর্তগুলো পৃথিবীর বহুদেশে কাজে লাগিয়েছেন বিপ্লবী শক্তি। শাসক শ্রেণি যখন ব্যর্থ হয়, তারা যখন দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত থাকে তখন মানুষের কাছে বিকল্প প্রস্তাবনা নিয়ে বৈষম্যহীন মানবিক সমাজের জন্য এরকম পরিস্থিতিকে বিপ্লবী বামপন্থিরা কাজে লাগিয়েছেন। বাংলাদেশে এ পরিস্থিতিকে বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে কাজে লাগাতে না পারলে জঙ্গিবাদী বা চরমপন্থার উত্থান ঘটবে। সমাজের অভ্যন্তরে চিন্তা-মতাদর্শের দিক থেকে এবং দক্ষিণপন্থি মতাদর্শের যে বাড়ন্ত লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি না হলে সমাজের অভ্যন্তরে দক্ষিণপন্থি মতাদর্শের শর্তগুলো আরো শক্তিশালী হবে। এটা দেশের শাসকশ্রেণির কোনো অংশের জন্য যেমন ভালো নয়, তেমনি গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার জন্য হবে আত্মঘাতী। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে আগামী নির্বাচনের আগে বিদ্যমান এই সমস্যাগুলো সুরাহা সম্ভব বলে মনে করি।
সাইফুল হক বলেন, জনগণের বড় অংশ বিশ্বাস করে বর্তমান সরকারকে রেখে কোনো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাহলে সমাধান কোথায়? ছিয়ানব্বই সালে আওয়ামী লীগ যে কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করেছে সে তুলনায় এখন অবিশ্বাস অনাস্থা আরো বহুগুণ বেশি। ফলে তখন যে কারণে দলীয় সরকারের অধীনে আমরা নির্বাচনে অংশ নিইনি, এখন তা না করার যুক্তি অনেক অনেক বেশি। অনাস্থা, বিরোধ, বৈরিতা, সন্দেহ, অবিশ্বাস এখন আগের চেয়েও মারাত্মক পর্যায়ে। সে জায়গা থেকেই বলতে চাই এখানে সরকারকে সুষ্ঠু নির্বাচনে আয়োজনে রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে আলাপ আলোচনা করে, নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য তদারকি সরকার কায়েম করা জরুরি। সেই তদারকি সরকারে আওয়ামী লীগও থাকতে পারে পাশাপাশি প্রধান বিরোধীদলসহ সকল রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরাও থাকতে পারে। সকলে একমত হলে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের স্বার্থে সেই সরকারে যারা থাকবেন তারা প্রয়োজনে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে প্রত্যক্ষ নির্বাচনে অংশ নেবেন না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করেন? আমাদের দলীয় অবস্থান হচ্ছে, তদারকি সরকার গঠিত হলে তারা পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবেন। এ ধরনের নিয়ম থাকলে এই তিন মাসে তারা যা খুশি করতে পারবে না। তা ছাড়া বিনা ভোটের নির্বাচনে গঠিত বর্তমান সংসদের কোনো ম্যান্ডেট নেই। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পর কথা ছিল একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের। অথচ তা করা হয়নি। পাঁচ বছর কাটিয়ে দিলো সরকার। যদি সংসদ থাকে তাহলে এই সংসদের যারা আছেন তাদের সঙ্গেতো প্রতিদ্বন্দ্বী দল বা প্রার্থীদের কোনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হলো না। প্রশ্নহীন নির্বাচন চাইলে সরকারকে সংসদ বাতিলের ঘোষণা দিতে হবে। নির্বাচনে সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিতের জন্য লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির জন্য সরকারিদলকে ঘোষণা দিতে হবে।
বর্তমানে যে পরিস্থিতি তা অব্যাহত থাকলে আপনাদের জোট নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা?
বর্তমান পরিস্থিতি চলতে থাকলে নির্বাচনে অংশ নেয়া অসম্ভব। কারণ, নির্বাচনকালীন যে সরকারের কথা আলোচনায় আছে সে সরকার আর এ সরকারের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য হবে না। আগেই বলেছি, সকল নির্বাহী ক্ষমতা সরকার প্রধানের হাতে। সুতরাং নির্বাচনকালীন যে সরকার গঠিত হবে সংবিধান অনুযায়ী সেই সরকারের প্রধান অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর হাতেই সকল ক্ষমতা থাকবে। তিনি ক্ষমতা কতটুকু ব্যবহার করবেন সেটি ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু সকল ক্ষমতা তো ওনার হাতেই। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন তার দায়িত্ব ও মর্যাদা চূড়ান্তভাবে ভূলুণ্ঠিত করেছে। সরকার এবং নির্বাচন কমিশন মিলে যা করেছে এতে পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে মানুষের মধ্যে একটি গণঅনাস্থা সৃষ্টি হয়েছে। আরপিওর অগণতান্ত্রিক ধারাগুলো বাতিল করা, কীভাবে নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও নিরপেক্ষ করা যায়, কালো টাকার দৌরাত্ম্য কিভাবে বন্ধ করা যায় এ বিষয়ে সংলাপের সময় দেয়া প্রস্তাবনাগুলোর কোনো একটি বিষয়ও কমিশন আমলে নেয়নি। বরং সরকারি দলকে বাড়তি সুবিধা দিতে তারা ইভিএম চালুর চিন্তা করছে। যদিও মানুষের মনোভাব বুঝতে পেরে তারা কিছুটা পিছু হটেছে। নির্বাচন কমিশন প্রমাণ করেছে তারা মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। যে নির্বাচন কমিশন স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোর অধিকাংশই গ্রহণযোগ্য করতে পারেনি সেখানে এরকম একটি কমিশন দিয়ে একটি প্রশ্নহীন জাতীয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করা যাবে মানুষ এটা বিশ্বাস করে না।
সকল পরিস্থিতি বিবেচনায় বল সরকারের কোর্টে। রাজনৈতিক দলগুলোর অনেক দাবি। কিন্তু সরকারকেও তো সেই জায়গাটি তৈরি করতে হবে। মানুষকে বুঝতে হবে, তার নিজের ভোট সে নিরাপদে দিতে পারবে, তার ভোট কাউন্ট হবে। ভোট দেয়ার পর সে নিরাপদ থাকবে। রাজনৈতিক দল এবং প্রার্থীদের আশ্বস্ত করতে হবে যে, আমরা এবার একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাই, মানুষ যাকে সমর্থন করবে তারাই নির্বাচনে বিজয়ী হবে। সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অসম্ভব। শেষমুহূর্তে বামজোট আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা তা নির্ভর করছে সে সময়ের পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক সমীকরণের ওপর, রাজনৈতিক দল এবং জোটগুলোর যে অবস্থান সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে নির্বাচন বয়কটও করতে পারি আবার আন্দোলনের অংশ হিসাবে নির্বাচনে অংশও নিতে পারি। ফলে আমরা বর্তমানে নির্বাচন প্রস্তুতির পাশাপাশি রাজপথে আন্দোলনে আছি। তবে একটি কথা খোলাসা করে বলতে চাই, অংশগ্রহণমূলক না হলে তামাশার নির্বাচন বৈধতা দেয়ার জন্য বামজোট অংশ নেবে না।
- জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়েছে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে। তারা ইতিমধ্যেই সাত দফা দাবি আদায়ে মাঠে নেমেছেন। আপনারাও একটি জোট গঠন করেছেন? সামনের দিনে আপনারা তাদের সঙ্গে যোগ দেবেন কিনা?
- জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে স্বাগত জানাই। স্বাগত এজন্য যে, অনেক বিলম্বে হলেও তারাও একই কথা বলছেন। বর্তমান পরিস্থিতি অনুধাবন করে তারা অবস্থান গ্রহণ করেছেন। এগিয়ে এসেছেন। এটি যথেষ্ট ইতিবাচক। আমরা দেখতে চাই রাজপথে তারা ধারাবাহিক কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারকে এ দাবিগুলো মানাতে সরব হবেন। কারণ রাজপথের আন্দোলন ছাড়া সরকারকে এই দাবি মানানোর অন্য কোনো বিকল্প নেই।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যা বলছে আমরা এই কথাগুলো বলছি অনেক আগ থেকেই। তাদের দেয়া দফা ও লক্ষ্যসমূহের অধিকাংশই আমরা বছর খানেক আগ থেকে রাজপথে বলে এসেছি। তাদের ঘোষিত অনেকগুলো দাবি মেনে নিতে সরকারের প্রতি চাপ দিতে আমরা ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন করে যাচ্ছি। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, একটি অবাধ নির্বাচনের জন্য তারা যে দাবি উত্থাপন করেছেন তার জন্য মাঠে জোরালো আন্দোলন গড়ে ওঠলে মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার হবে, আস্থার জায়গা তৈরি হবে। মানুষের মধ্যে জাগরণ তৈরি করা, সে জাগরণ গণঅভ্যুত্থান হবে কিনা তা এখনই বলা সম্ভব নয়। তবে, একটি গণজাগরণ তৈরি করা সম্ভব। মানুষের গণজাগরণের মধ্য দিয়ে সরকারকে যদি পিছু হটানো না যায় তাহলে ভিন্ন কৌশলে হলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের মানুষকে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির মতো আরেকটি নির্বাচন প্রত্যক্ষ করতে হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, ৫ই জানুয়ারির মতো আরেকটি নির্বাচন হজম করার মতো শক্তি বাংলাদেশের মানুষের নেই। এই পরিস্থিতিতে সমাজের মধ্যে বিভাজন আরো প্রকট হবে, সহিংসতার জন্ম দেবে, আরো নানা ধরনের অপ্রত্যাশিত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্ম দেবে। আবার যদি তারা ২০১৪ সালের মতো একই কায়দায় ক্ষমতায় আসতে চায় তাহলে সে সরকারের তো কোনো ম্যান্ডেট থাকবে না। সুতরাং পরবর্তী পাঁচ বছর তারা একইভাবে চালিয়ে যেতে পারবেন সেটা প্রায় দুরাশার শামিল। সেসময় পুরো রাষ্ট্রের জন্যই একটি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হবে। যা সুস্থ বিবেকসম্পন্ন কোনো মানুষ চাইবে না।
-সমাধানটা কোথায়?
শেষ পর্যন্ত যারা আমরা সমমনা বা একই রকম দাবি নিয়ে মাঠে আছি তারা আন্দোলনের মাধ্যমে; আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বিষয়গুলোর যদি একটি যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে না পারি- বিশেষ করে কীভাবে মানুষের ভোটাধিকার রক্ষা পাবে ও নির্বাচন কীভাবে সুষ্ঠু ও অবাধ হবে; মানুষ কীভাবে তার ভোট নিরাপদে দিতে পারবে; নির্বাচন কীভাবে সকলের অংশগ্রহণমূলক হবে? আমাদের বৃহৎ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষগুলো তারা যেভাবে পরস্পর পরস্পরকে ধ্বংসের চিন্তা করছেন এবং কার্যক্রম পরিচালনা করছেন তাতে সংঘাত বাড়বে। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে সংকট যেভাবে ঘনীভূত হচ্ছে তাতে জ্ঞাত বা অজ্ঞাত দেশকে একটি গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এতে দেশের গভীর অনিশ্চয়তা তৈরি হবে এবং নৈরাজ্যে পরিস্থিতি জন্ম দেবে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে জঙ্গিবাদী বা মৌলবাদী গোষ্ঠীর জন্ম হবে এবং ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত বাড়তে থাকবে। অন্যদিকে সমাজের ভেতর থেকেই দক্ষিণপন্থার একটি উত্থানের সম্ভাবনা বাড়বে। এটা শাসক গোষ্ঠীর জন্য যেমন ভালো নয় তেমনি দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার জন্য আত্মঘাতী হবে।
সকল পরিস্থিতি বিবেচনায় মনে হয়, সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখানোর সুযোগ এখনও আছে। দেশের মানুষ বিশ্বাস করে না বর্তমান সরকারকে রেখে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। তাহলে সমাধানটা কোথায়? ’৯৬ সালে যে প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন করেছে এখন সে প্রেক্ষিত অনেক অনেক গুণ বেশি। এখনকার অনাস্থা-অবিশ্বাস আগের চেয়ে আরো অনেকগুণ বেশি। তখন যে কারণে দলীয় সরকারের অধীনে আমরা নির্বাচন করিনি বর্তমানেও তার যুক্তি অনেক অনেকগুণ বেশি। অনাস্থা বিরোধ সন্দেহ-অবিশ্বাস এখন আগের চেয়েও মারাত্মক পর্যায়ে।
এ পরিস্থিতিতে সরকারকে বলতে চাই, সদিচ্ছা দেখাতে। আমরা ইতিমধ্যেই প্রস্তাব করেছি নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দলগুলোকে নিয়ে নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনা একটি তদারকি সরকার গঠন করা। সেই সরকারে আওয়ামী লীগসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ দলগুলোর প্রতিনিধি থাকতে পারে। যারা সরকারে অংশ নেবে তারা হতে পারে নির্বাচনে অংশ নেবে না। আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে এই তদারকি সরকার খেয়াল খুশিমতো যা খুশি না করতে পারেন সেজন্য পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হবে।
No comments