ধর্মঘটের নেপথ্যে কারা by শাহেদ শফিক
পরিবহন ধর্মঘটে মহাখালী বাস টার্মিনালের চিত্র |
সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ এর কয়েকটি ধারা সংশোধনসহ আট দফা দাবিতে দেশজুড়ে
শ্রমিকদের ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘট চলছে। এই ধর্মঘটে জনদুর্ভোগের পাশাপাশি নানা
অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে। সরকারের শেষ মুহূর্তে এমন ধর্মঘট পর্যবেক্ষণে রাখা
হয়েছে। সরকারের কেউ কেউ বিশৃঙ্খলাসহ সহিংসতা ঘটালে কঠোর হাতে দমনের ইঙ্গিতও
দিয়েছেন। তবে এর নেপথ্যে সরকার ও সরকারবিরোধীদের শ্রমিক নেতারা রয়েছে বলে
অভিযোগ রয়েছে। যদিও ধর্মঘট আহ্বানকারী সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক
ফেড়ারেশন বলছে, তাদের এই দাবি ন্যায়সংগত। তারা কোনও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি
সৃষ্টি করতে চান না। সরকারবিরোধী কোনও শক্তিরও হাত নেই এতে।
তবে সরকারপন্থী বেশ কয়েকটি সংগঠনের অভিযোগ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক
ফেড়ারেশনের অধিকাংশ নেতাই বিএনপি আর জামায়াতের। এদের সঙ্গে সরকারের একজন
মন্ত্রীসহ কিছু স্বার্থন্বেষী লোকও জড়িত। তারা দেশকে অচল করতে এবং সরকারের
উন্নয়ন কাজকে বাধা দিতে সরকারের শেষ মুহূর্তে সংসদ নির্বাচনের আগে এমন
কর্মবিরতি আহ্বান করে সরকার ও জনগণকে জিম্মি করে ফায়দা লুটতে চায়। যদিও এই
সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সরকারের নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। তিনি এর
কার্যকরী সভাপতি।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হানিফ
খোকনের অভিযোগ, ‘অতীতে শ্রম আইন পরিপন্থী ধর্মঘট ডেকে যারা সরকারকে জিম্মি
করতে চেয়েছিল, সেই একই চক্র আজকে পরিবহন খাতে কর্মবিরতি ডেকেছে। এই
চক্রটিতে কারা আছে, কাদের নির্দেশে কর্মবিরতি চলছে তা সবাই জানে। পরিবহন
শ্রমিকদের এই সংগঠনের বেশিরভাগ নেতাই বিএনপিপন্থী। তাই সংগঠনটি সরকারকে অচল
করতে এমন কাজ করছে। এই সংগঠন শ্রম আইন, নীতি কিছুই মানে না। তাছাড়া
আন্দোলনের নামে সাধারণ যাত্রী ও প্রাইভেটকার চালকদের মুখে পোড়া মবিল মেখে
দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এটা ফেডারেশনের নেতাদের ইন্ধনেই ঘটেছে। তারা একজন
ক্ষমতাধর মন্ত্রীর ওপর ভর দিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চায়।
জানা গেছে, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি
শাজাহান খান, তিনি সরকারের নৌপরিবহন মন্ত্রী। সহসভাপতি-১ আব্দুর রহিম বক্স
দুদু, তিনি জাতীয়বাদী শ্রমিক দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম-সম্পাদক এবং খুলনা
মহানগর শ্রমিক দলের সেক্রেটারি। সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বাংলাদেশ
সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা। যুগ্ম-সম্পাদক অ্যাডভোকেট
শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার
ব্যক্তিগত সহকারী। ফেড়ারেশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করম আলী দোহার থাকা
বিএনপির সভাপতি ছিলেন। কার্যকরী কমিটির সদস্য- ইসমাইল হোসেন ফলিক জামায়াত
সমর্থিত বলে জানা গেছে। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির খান বিএনপির
কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-শ্রম বিষয়ক সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক মুখলেসুর রহমান
এক সময় ফ্রিডম পার্টির সদস্য ছিলেন। ফেড়ারেশনের সহ-সভাপতি আব্দুল ওদুদ নয়ন
সিপিডির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, সহ-সভাপতি আব্বাস উদ্দিন সাভার থাকার
বিএনপির সভাপতি বলে জানা গেছে।
তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফেড়ারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বাংলা
ট্রিবিউনকে বলেন, আমি ও শাজাহান খান দীর্ঘ ৪০-৪৪ বছর ধরে এই শ্রমিক সংগঠনের
সঙ্গে জড়িত। অনেকেই অভিযোগ করতেই পারে। শাজাহান খানকেও বিএনপি বানিয়ে দিতে
পারে। কেউ বলতো তো করার কিছু নেই। আমরা শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব করছি।
শ্রমিকের ন্যায়সঙ্গত দাবির পক্ষে আছি এবং থাকবো। আমাদের কর্মবিরতি
শ্রমিকদের অধিকার বাস্তবায়নের জন্য। যে বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে আমাদের ৮ দফার
মধ্যে উল্লেখ রয়েছে।
তবে এই আন্দোলনের সঙ্গে ফেড়ারেশনের কার্যকরী সভাপতি ও সরকারের নৌপরিবহন
মন্ত্রী শাজাহান খান সম্পৃক্ত আছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,
তিনি কার্যকরী সভাপতি হিসেবে সংগঠনের সিদ্ধান্তগুলো জানেন। কিন্তু
সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তার একার বিরোধিতায় তো আর হবে না। এখানে সংগঠনের
অধিকাংশের মতামতের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিনি আমাদের সঙ্গে
আছেন এবং সরকারেরও প্রতিনিধিত্ব করছেন।
সরকারপন্থী বিভিন্ন সংগঠন ফেডারেশনের অধিকাংশ নেতাকে বিএনপি ও
জামায়াতপন্থী বলছে। এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, যারা এই অভিযোগ
করছেন তারা বিএনপি জামায়াতের তাণ্ডবের সময় কোথায় ছিলেন? আমরা তো রাস্তায়
ছিলাম। এখন বিষয়টা হচ্ছে সংগঠন একটা খুলে একটা সংবাদ সম্মেলন করে অনেক
অভিযোগ করা যায়। কিন্তু রাস্তায় তাদেরকে দেখা যায় না। এরাই রিকশা এবং
ভ্যানগাড়ির লাইসেন্স বিক্রি করে চলে।
এদিকে রবিবার সকালে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ
সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক মো. ইনসুর আলী অভিযোগ
করে বলেন, আগামী নির্বাচন উপলক্ষে যখন দেশে উৎসবমুখর নির্বাচনি প্রচারণা
চলছে ঠিক তখনই বিএনপি জামাতের মদদপুষ্ট সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন
কর্মবিরতির নামে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনি পরিবেশ
অশান্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। গতকাল (২৭ অক্টোবর) জাতীয় প্রেসক্লাবে
পরিবহন শ্রমিক সমাবেশের নামে যারা বক্তব্য রেখেছেন তারা অধিকাংশই
বিএনপি-জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব করছেন। ওই মিটিংয়ে ফেডারেশনের সভাপতি জনাব
ওয়াজ উদ্দিন খানের উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও তিনি উপস্থিত হননি।
তিনি আরও অভিযোগ করেন, দীর্ঘদিন যাবত এই তথাকথিত নেতারা পরিবহন
শ্রমিকদের ব্যবহার করে নিজেদের আখের গুছিয়েছেন। পরিবহন শ্রমিকদের ভাগ্য
পরিবর্তনের জন্য কখনও কোনও কর্মসূচি গ্রহণ করে নাই। যার ফলে কিছুদিন আগে
বাংলাদেশ পণ্য পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ ফেডারেশনের তথাকথিত নেতাদের
পরিত্যাগ করে নিজেরাই আন্দোলন সূচনা করেছিল এবং সরকার তাদের সঙ্গে আলোচনা
করে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী ধারা-উপধারা শিথিল করার
আশ্বাস দেন। যেখানে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের তথাকথিত নেতারা
সংযুক্ত ছিল না। যার ফলে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য আজ থেকে ৪৮ ঘণ্টা
কর্মবিরতির নামে ধর্মঘট ডেকে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার পাঁয়তারা
করছে।
এর আগেই প্রায় একই দাবিতে গত ৮ অক্টোবর ঢাকা বিভাগের জেলাগুলোতে
পণ্যপরিবহন ধর্মঘট আহ্বান করে বাংলাদেশ পণ্য পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য
পরিষদ। কিন্তু তখন ওই ধর্মঘটে ফেডারেশনের নেতাদের সমর্থন ছিল না।
No comments