কুর্দিরা আবারও প্রতারিত হবে by রবার্ট ফিস্ক
কর্নেল টমাস ভিয়েলকে এক অনাকাঙ্ক্ষিত কাজ
করতে হয়েছে। সিরিয়াকে জাতিভিত্তিক দল-উপদলে বিভক্ত করার যে প্রচেষ্টা
পশ্চিমারা হাতে নিয়েছে, তা ঘোষণা দেওয়ার দায় তাঁর ওপরই বর্তেছে। এই ব্যক্তি
ক্যানসাস বিশ্ববিদ্যালয় ও মার্কিন মিলিটারি একাডেমির স্নাতক। এই ঘোষণার
মর্ম তিনি বুঝুন আর না বুঝুন, তিনি বেশ খোলামেলাভাবে আরেকটি নতুন ও প্রধানত
কুর্দি বাহিনীর জন্মের কথা বলেছেন, যারা কাগজে-কলমে সিরিয়ার শত শত
বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করে আছে। ৩০ হাজার সেনা নিয়ে গঠিত শক্তিশালী
‘বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স’ ইউফ্রেটিস নদীর দক্ষিণ পারের তল্লাশিচৌকি পাহারা
দেবে।
উল্লিখিত কর্নেলের কথা উদ্ধৃত করে বলতে হয়, ‘এমনভাবে এই বাহিনী গঠন
করা হয়েছে যাতে এটি জনগণের সব অংশের প্রতিনিধিত্ব করে, লৈঙ্গিক ও
জাতিগত-উভয় দিক থেকেই।’ অর্থাৎ কুর্দি সেনারা কুর্দি জনগণের নিরাপত্তা
দেবে। অন্যদিকে তুরস্ক সীমান্তের পাশে আরব সেনারা অ-কুর্দি জনগণকে পাহারা
দেবে। কিন্তু এর মাধ্যমে গৃহযুদ্ধকে আরও উসকে দেওয়া হবে। যুক্তরাষ্ট্রের এই
সিদ্ধান্ত যে কতটা দ্ব্যর্থবোধক, সেটা বোঝা যায় সিরিয়ার সরকার ও তুরস্কের
মধ্যে তারা যে ক্ষণস্থায়ী ঐকমত্য গঠন করিয়েছিল, তা দিয়ে। সিরিয়ার সরকার
একদিকে দেশটির প্রতি ইঞ্চি ভূমি আইএস, আল-কায়েদা এবং বিভিন্ন পশ্চিমা ও
ইউরোপীয় বাহিনীর হাত থেকে উদ্ধার করতে মরিয়া ছিল, যেখানে তুরস্ক সেই একই
সময়ে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে উৎখাত করতে চাইছিল। তুর্কি
প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এই নতুন মার্কিন প্রক্সি ‘সন্ত্রাসী
বাহিনী’কে গলাটিপে শেষ করার অঙ্গীকার করেছেন। তুরস্ক মনে করে, এই নতুন
বাহিনী ‘সন্ত্রাসী’ কুর্দিশ ওয়ার্কার্স পার্টি বা পিকেকের নিয়ন্ত্রণাধীন।
আসাদ সরকার এই নতুন বাহিনীকে সিরিয়ার সার্বভৌমত্বের প্রতি ‘নির্লজ্জ
আগ্রাসন’ আখ্যা দিয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়া দেশভাগের ব্যাপারে সতর্ক করে
দিয়েছে। তবে তুরস্ক ও সিরিয়া উভয়ই ঠিক। আর রাশিয়ার তো ইউক্রেন ভাগ করার
অভিজ্ঞতা আছে।
সে কারণে তারা জানে, কীভাবে মার্কিনদের শঠতা ধরতে হয়। এর
সূত্রপাত যুদ্ধের শুরুর দিকে। ওই সময় স্থানীয় কুর্দিদের ‘পিপলস প্রোটেকশন
ইউনিট’কে (ওয়াইপিজি) দামেস্কের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ আইএস, আল-কায়েদা
(পরবর্তীকালে নুসরা) ও অন্যান্য জিহাদি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে
উৎসাহিত করেছে, যারা সিরিয়া রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। সিরিয়ার
সেনাবাহিনী এই ওয়াইপিজিকে আত্মরক্ষার জন্য শত শত অস্ত্র দিয়েছে। এমনকি
যুদ্ধের শুরুর দিকে আইএস ও আল-কায়েদা ‘সন্ত্রাসীদের’ প্রতিহত করার জন্য
কুর্দিদের প্রশংসাও করেছে। এই কেবল তিন বছরের কিছু সময় আগের কথা, তুরস্কের
কামিশলি সীমান্তে আমি এক সপ্তাহ সিরীয় বাহিনী ও তাদের কুর্দি ‘মিত্রদের’
সঙ্গে সময় কাটিয়েছি। কুর্দিরা বরাবরের মতো উত্তরাঞ্চলে ‘ফেডারেল’ মধ্যাঞ্চল
গঠনের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে জানায়, সিরিয়া সরকারের হাতে তারা যেভাবে
নির্যাতিত হয়েছে, সেটা তারা কখনো ভুলবে না। সিরিয়ার সেনাবাহিনী জোর দিয়ে
বলেছে, তারা কখনো কুর্দিদের জন্য ‘জায়গা ছেড়ে’ দেবে না। কিন্তু এরপরই
যুক্তরাষ্ট্র আইএসকে ধ্বংস করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। একে একে তারা ইরাকের
মসুল এবং সিরিয়ার ভেতরে আইএসের ঘাঁটি রাকায় হামলা চালাল। এরপর ওয়াশিংটন
প্রথমবারের মতো আসাদ ও আইএসবিরোধী জঙ্গি দল ‘সিরিয়ান ডিফেন্স ফোর্স’ গঠন
করে। অন্য সব গোষ্ঠীর মতো এরা জাতিগতভাবে ‘সিরীয়’ ছিল না। কারণ, এতে
কুর্দিরাই বেশি ছিল। আবার সিরিয়া রাষ্ট্রকে ‘রক্ষা’ করার ইচ্ছাও এদের ছিল
না। আর মার্কিনদের ‘বিমান’-সহায়তা ছাড়া তাদের ভিন্ন ‘শক্তি’ ছিল না।
কিছুদিনের মধ্যেই দলটির আদ্যক্ষরা ‘এসডিএফ’ প্রণীত হলো। আর গণমাধ্যমও দ্রুত
এর পাশে উদ্ধৃতি চিহ্ন দেওয়া বন্ধ করে দিল। এর মাধ্যমে তারা গোষ্ঠীটিকে
মেকি ‘আইনি ভিত্তি’ দিল। এরপর দ্রুতই এর নাম হলো ‘মার্কিন-সমর্থিত এসডিএফ’।
তারা সাহসের সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলে যুদ্ধ চালিয়ে শেষমেশ গত অক্টোবরে রাকা দখল
করল। কিন্তু সিরিয়ার সরকার রাকার মাত্র ১২ মাইল দূরে ছিল। তারা তত দিনে
ইউফ্রেটিস নদীতীরবর্তী একটি কাদার দেয়ালঘেরা গ্রামে সমন্বয় কেন্দ্র তৈরি
করে ফেলেছে, যেখানে সিরিয়ার সেনাবাহিনী, মার্কিন অস্ত্রে সজ্জিত কুর্দি
যোদ্ধা ও রুশ বিমানবাহিনীর কর্নেলরা নিয়মিত সমবেত হতেন। রাকা পুনর্দখলের
কয়েক দিন আগে আমার সঙ্গে তাদের সবার দেখা হয়েছে। সিরিয়ার সরকার তত দিনে
রাকার পশ্চিমে আসাদপন্থী স্থানীয় সরকার বসিয়েছে। অন্য কথায়, মার্কিন
অস্ত্রে সজ্জিত কুর্দিরা রাকার রাস্তা দখল করে রাখলেও সিরিয়া সেখানে তার
সার্বভৌমত্ব বজায় রাখবে। এই অঞ্চলে অবশ্য অন্য জাতিগোষ্ঠীরও বসবাস আছে।
সেখানে যেমন সুন্নি মুসলমান আছে, তেমনি আছে সিরকাসিয়ান খ্রিষ্টান,
আর্মেনিয়ান, তুর্কমেন ও এমনকি চেচেনরা। সে কারণেই উল্লিখিত কর্নেল অঙ্গীকার
করেছেন, ভবিষ্যতে এই অঞ্চলে জাতিভিত্তিক শাসন প্রতিষ্ঠা হবে।
ফলে
পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে, সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সের দিন ফুরিয়ে এসেছে।
তারা তো মার্কিনদের সহায়ক সেনা হিসেবে কাজ করেছে, তাই তাদের আরেকটি
দ্ব্যর্থবোধক নাম ধারণ করে আবার আবির্ভূত হতে হবে। এবারও গণমাধ্যমে উদ্ধৃতি
চিহ্ন ছাড়াই তাদের আদ্যক্ষরা প্রকাশ করবে। যারা তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তের
বেশ দূরে সিরিয়ার কিছু ভূমি দখলে রাখবে, যারা তুরস্কের ‘নিরাপত্তা’ নিশ্চিত
করতে পারবে না। এরা পুরোনো নাম এসডিএফের মতো শক্তির জন্য মার্কিন অস্ত্রের
ওপর নির্ভর করবে। প্রয়োজনবোধে মার্কিনরা তাদের বিমান-সহায়তাও দেবে। এটা
নিশ্চিত, কুর্দিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে। নতুন ‘শক্তি’ তত দিনই
টিকবে, যত দিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করবে, তাকে টিকিয়ে রাখার দরকার আছে। এরপর
তাদের তুরস্ক ও সিরিয়ার দয়ার ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে, যারা আবার উভয়ে তাকে
নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করে। এরদোয়ান ও আসাদ বহুদিন ধরে রাষ্ট্রের
শত্রুকে ‘সন্ত্রাসী’ মনে করেন। ব্যাপারটা হলো, সিরিয়া তার ভূখণ্ডে ছোটখাটো
কুর্দি রাষ্ট্র সহ্য করতে পারবে না। তুরস্ক দক্ষিণ সীমান্তে এরূপ রাষ্ট্র
সহ্য করতে পারবে না, তা সে নিজেকে যত ধর্মনিরপেক্ষ, উদার ও সমাজতন্ত্রী
দাবি করুক না কেন। এখন এই বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স যদি দাঁড়িয়ে যায় এবং এক
মার্কিনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী থেকে আরেক গোষ্ঠীর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে,
তাহলে এরদোয়ান, আসাদ ও পুতিনকে আবারও সমস্বার্থে আলোচনায় বসতে হবে। আর সেটা
হলো, সিরিয়ায় মার্কিন রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার অবসান ঘটানো।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া।
রবার্ট ফিস্ক: দ্য ইনডিপেনডেন্ট-এর মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া।
রবার্ট ফিস্ক: দ্য ইনডিপেনডেন্ট-এর মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি।
No comments